Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কার্লোস ঘোন: জাপানের বুকে মিশন ইম্পসিবল চালিয়েছেন যিনি

২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরের কোনো এক সময় এশিয়াভিত্তিক এক সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরের কাছে একটি ফোন আসে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফোন করা হয়েছিল তা শোনার পর তিনি প্রথমে বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। ফোনের অপর প্রান্তে যিনি ছিলেন তিনি সেই সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তার মতোই সেই লোকও প্রতিকূল পরিবেশে ভিআইপি ব্যক্তি এবং দামি পণ্যবাহী কার্গোর নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন।

ফোনের অপর প্রান্তের সেই লোক তাকে জাপান থেকে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে গোপনে বের করে আনার সময় নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ভাড়া করতে চান। এর জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ দেওয়া হবে। তবে এই অপারেশনে তিনি এমন কিছু লোক চান যারা দেখতে হবেন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাধারণ নাগরিকদের মতো। এবং তাদের সেনাবাহিনী অথবা পুলিশে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

এশিয়ার সেই কন্ট্রাক্টর বিষয়টি নিয়ে আরো কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তিনি আরো জানতে চান। যাকে নিরাপত্তা দিতে হবে সেই লোকটি কে? তার উপর কী ধরনের হুমকি রয়েছে? তার সাথে কী নগদ অর্থ, সোনা কিংবা অন্য কোনো দামি বস্তু থাকবে? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে সেসবের কোনো জবাব মেলেনি। তিনিও কোনো কথা দেননি। তবে তার যদি এই কাজের জন্য উপযুক্ত কোনো লোকের কথা মনে পড়ে তাহলে তিনি ফোনের অপর প্রান্তের সেই লোককে জানাবেন বলে ফোন রেখে দেন। এরপর বিষয়টি ঝুলে ছিল। এশিয়ার সেই কন্ট্রাক্টর বিষয়টি নিয়ে আর কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। যতদিন না তিনি এবং বাকি পৃথিবী কার্লোস ঘোনের জাপান পালানোর খবরটি শুনতে পান।

কার্লোস ঘোন © JOEL SAGET/AFP via Getty Images

 

সর্বশেষ ইংরেজি নববর্ষের মাত্র কয়েকদিন আগে এক দুঃসাহসিক অভিযানের মাধ্যমে জাপান থেকে পালান নিশান মোটরসের সাবেক চেয়ারম্যান এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেনল্টের চেয়ারম্যান ও সিইও কার্লোস ঘোন। জাপানে তার বিরুদ্ধে তখন আর্থিক অনিয়মের মামলা চলমান। এবং তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তা প্রমাণিত হলে ১০ বছরের বেশি জেল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

প্রায় ১০০ দিনের বেশি টোকিওতে জেল খাটার পর তিনি জামিন পান। কিন্তু তার বাসার বাইরে ২৪ ঘণ্টা ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হতো। তিনি কখন বাসা থেকে বের হচ্ছেন, কখন প্রবেশ করছেন সবকিছু জাপানের পুলিশ চোখে চোখে রাখতো। এখানেই শেষ নয়। তিনি বাসা থেকে বের হলেই আন্ডারকভার এজেন্টরা তাকে অনুসরণ করত, যাতে তিনি কোনো অবস্থাতেই পালাতে না পারেন। কিন্তু এমন কঠোর নজরদারির মধ্যেও জাপানকে হতভম্ব করে দিয়ে তিনি লেবাননে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তার পালানোর পেছনের যে গল্প রয়েছে তা যেকোনো সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে। আমরা শুনব সেই গল্প। তার আগে কে এই কার্লোস ঘোন এবং জাপানে তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল সে সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।

যেভাবে মি. ফিক্স-ইট হয়ে ওঠেন কার্লোস ঘোন

১৯৫৪ সালের ৯ মার্চ ব্রাজিলের পোর্তো ভেলোতে জন্মগ্রহণ করেন কার্লোস ঘোন। তার বাবা হোর্হে ঘোন হীরার ব্যবসা করতেন। পাশাপাশি এয়ারলাইন্স ইন্ডাস্ট্রির সাথেও জড়িত ছিলেন। ১৯৬০ সালে হোর্হের বিরুদ্ধে লেবাননের সাওফারে একজন যাজককে খুনের অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তিনি লেবানন থেকে পালিয়ে ব্রাজিল চলে যান। ঘোনের বাবার বিরুদ্ধে যে বছর খুনের অভিযোগ ওঠে সেই বছর তিনি তার মা ও বোনের সাথে বৈরুত চলে যান। সেখানে তার নানী ও আরো দুই বোন থাকতেন।

ঘোনের বেড়ে ওঠা বৈরুতেই। সেখানে তিনি তার স্কুল জীবন শেষ করেন। এরপর চলে যান ফ্রান্সের প্যারিসে। সেখানকার স্তানিসলাস কলেজ এবং লিঁসে সেন্ট-লুইস থেকে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ইকোল পলিটেকনিকে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। এবং ১৯৭৮ সালে তিনি ইকোল দেস মিনেস ডি প্যারিস থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ইউরোপের সর্ববৃহৎ টায়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিচেলিনে যোগ দেন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সাথে কার্লোস ঘোন; Image Source: AFP

 

১৯৮৫ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে মিচেলিনের দক্ষিণ আমেরিকার শাখার চীফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) পদে বহাল হন ঘোন। সেখানে সফলতা অর্জন করার পর ১৯৮৯ সালে তাকে মিচেলিনের উত্তর আমেরিকা শাখার প্রেসিডেন্ট এবং সিওও’র দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক বছর পরই তিনি সেখানকার সিইও হিসেবে পদোন্নতি পান। মিচেলিনে প্রায় ১৮ বছর চাকরি করার পর ১৯৯৬ সালে ফরাসি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেনল্টের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ঘোন যখন রেনল্টে যোগ দেন তখন কোম্পানিটি ভলভোর সাথে একত্রীকরণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তিনি যোগ দেওয়ার পর তাকে কোম্পানির উৎপাদন, ক্রয়, গবেষণা ও উন্নয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই তিনি কোম্পানির ব্যয় হ্রাস করে গাড়ির মডেল এবং মানের দিকে নজর দেন। এক বছরের মাথায় তার মাধ্যমে ভালো অবস্থানে চলে যায় রেনল্ট

১৯৯৯ সালে জাপানি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিশানের ৪৩.৪ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় রেনল্ট। তাকে চীফ অপারেটিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে জাপান পাঠানো হয়। সেখানে এসেই তিনি নিশানের পাঁচটি কারখানা বন্ধ করে দেন। এছাড়া গড়ে ৭ জনের মধ্যে ১ জন করে কর্মী ছাঁটাই করেন। এতে কোম্পানিটির প্রায় ২১ হাজার কর্মী চাকরি হারায়। এছাড়া কোম্পানির কর্মক্ষমতা প্রায় ১৪ শতাংশ হ্রাস করা হয়। এজন্য তখন তিনি ‘লে কস্ট কিলার’ নামে পরিচিতি পান।

নিশানের একটি নতুন মডেলের গাড়ির উদ্বোধন করছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান কার্লোস ঘোন © Yoshikazu Tsuno / AFP – Getty Images

 

২০০১ সালে ঘোন নিশানের এবং ২০০৫ সালে রেনল্টের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পান। ১৯৯৯ সালে তিনি যখন নিশানের দায়িত্ব নেন তখন কোম্পানিটির প্রায় ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ছিল। তারা প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পথে ছিল। কিন্তু ঘোনের অসাধারণ দক্ষতায় মাত্র ৬ বছরের মধ্যে হোন্ডাকে হটিয়ে জাপানের দ্বিতীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের স্থান দখল করে নেয় নিশান। তখন থেকে অটো ইন্ডাস্ট্রিতে কার্লোস ঘোনের ডাকনাম হয়ে যায় ‘মি. ফিক্স-ইট’।

২০১৬ সালে জাপানের আরেক অটোমোবাইল কোম্পানি মিতসুবিশির ৩৪ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয় নিশান। তখন নিশানের সিইও পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মিতসুবিশির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ঘোন। পাশাপাশি তিনি নিশানের প্রেসিডেন্ট পদেও ছিলেন। ২০১৭ সালে এই তিন কোম্পানি সারা বিশ্বে মোট ১০.৬ মিলিয়ন গাড়ি বিক্রি করে, যার মাধ্যমে বিশ্বের নিজেকে অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন ঘোন।

ঘোনের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

ঘোনের বিরুদ্ধে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে তিনি নিশানের কাছে থেকে ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যে পরিমাণ বেতন নিয়েছেন তার মাত্র অর্ধেক কাগজপত্রে দেখিয়েছেন। তিনি এই ৮ বছরে প্রায় ৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বেতন নিলেও জাপান সরকারের কাছে দাখিল করা কাগজপত্রে দেখিয়েছেন ৪৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এই অনিয়মের সাথে তিনি এবং তার ডান হাত হিসেবে পরিচিত গ্রেগ কেলি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। কেলি এখনো জাপানের জেলে বন্দী রয়েছেন। এবং তার বিচার চলছে।

ঘোনের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে তিনি তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীক ক্ষতি নিশানের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তা করতে ব্যর্থ হন। তখন তার এক সৌদির ব্যবসায়ীক সহযোগীর কাছে কৌশলে নিশানের সিইও রিজার্ভ ফান্ড থেকে ১৪.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন এই অর্থ তিনি নিশানের কাজেই তাকে দিয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরো ৫ মিলিয়ন ওমানের এক ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সরানোর অভিযোগ উঠেছে।

কার্লোস ঘোনকে যখন আটক করা হয়; Image Source: Picture-Alliance/AP Photo/Kyodo

 

তার বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ হচ্ছে তিনি নিশানের ফান্ড থেকে প্রচুর অর্থ নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন। নিজের বোনকে উপদেষ্টার চেয়ারে বসিয়ে ২০০৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ডলার করে বেতন দিয়েছেন। আরো বিভিন্ন অভিযোগের পর ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর তাকে আটক করে জাপানের পুলিশ। আটক হওয়ার পর তাকে নিশান এবং মিতসুবিশির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে যেসব অভিযোগে তার বিচার চলছিল সেখান থেকে তার নির্দোষ প্রমাণ সম্ভাবনা ছিল একেবারেই ক্ষীণ। যে কারণে তিনি জাপান ছাড়ার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করে বাস্তব জীবনে ‘মিশন ইম্পসিবল’ পরিচালনা করেন। আবার একে বাস্তবের ‘এক্সট্র্যাকশন’ বললেও ভুল হবে না।

যেভাবে জাপান থেকে পালিয়ে আসেন কার্লোস ঘোন

জামিনে বের হওয়ার পর ঘোন অধিকাংশ সময়ই কাটাতেন তার আইনজীবীর অফিসে, যেটি সেন্ট্রাল টোকিওতে ইমপেরিয়াল প্যালেসের কাছে অবস্থিত। তাকে যখন জামিন দেওয়া হয় তখন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে তিনি কোথাও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে বিচারকের অনুমতি সাপেক্ষে তিনি একটি বদ্ধ ঘরে একটি খালি টেবিল, হোয়াইট বোর্ড এবং ল্যাপটপ পাবেন বলে জানানো হয়। সেখান থেকে তিনি তার স্ত্রী ক্যারোল ঘোনের সাথে কথা টেলিফোনে কথা বলতে পারবেন। তবে স্ত্রীর সাথে ঘোনের দেখা করার অনুমতি ছিল না।

জাপানে যেভাবে প্রায় গৃহবন্দী জীবন কাটিয়েছেন কার্লোস ঘোন © WOSHIBAI/ BLOOMBERG BUSINESSWEEK

 

স্ত্রীর সাথে দেখা করতে না পেরে ঘোন আরো ভেঙে পড়েন। এর মধ্যে জানতে পারেন তার পরবর্তী শুনানি ২০২১ সাল পর্যন্ত পেছানো হতে পারে। এবং পুরো বিচারকাজ শেষ করতে ৫ বছরের বেশি সময় লাগবে। বিচার কাজ শেষ হওয়ার আগে তার জাপান ছাড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এদিকে তিনি বিচারে জিততে পারবেন এমন আত্মবিশ্বাসও ছিল না। তখন তিনি জাপান থেকে পালানোর পরিকল্পনা করেন।

ঘোন একদিকে অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক। আরেকদিকে তিনি ব্রাজিল, লেবানন এবং ফ্রান্সের নাগরিক। তবে লেবাননে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি থাকার কারণে তিনি জাপান ছেড়ে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লেবাননে তিনি খুবই জনপ্রিয়। দেশটিতে তার ছবি দিয়ে একটি ডাকটিকিটও বের করা হয়েছিল।

জাপান থেকে পালানোর জন্য ইউএস আর্মির স্পেশাল ফোর্সের এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করেন ঘোন। তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি এশিয়ার সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টরকে ফোন করেছিলেন। তার নাম মাইকেল টেলর, যিনি পরবর্তীতে ঘোনকে জাপান থেকে বের করার জন্য ১২-১৫ জনের একটি দলকে নিয়োগ করেন। আর সবকিছুর নেতৃত্ব দেন তিনি নিজেই। যারা এই কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের অনেকে জানতেনই না তারা কাকে পালাতে সাহায্য করছেন।

টেলরের জন্ম নিউ ইয়র্কে। হাই স্কুলের পাঠ চুকিয়েই তিনি ইউএস আর্মিতে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি স্পেশাল ফোর্স গ্রিন বেরেটস এর জন্য নির্বাচিত হন। লেবাননে গৃহযুদ্ধ চলাকালে টেলর সেখানে নিয়োজিত ছিলেন। এবং সেখানে থাকাকালীন তার সাথে ভবিষ্যত স্ত্রী লামিয়ার সাথে পরিচয় হয়। ঘোনের মতো লামিয়াও লেবাননের সংখ্যালঘু ম্যারোনাইট খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর সদস্য।

ইস্তাম্বুলের বিমানবন্দরের সিসি ক্যামেরায় তোলা ছবিতে মাইকেল টেলর (সামনে) এবং জর্জ জায়েক (পেছনে); Image Source: DHA via AP

 

চাকরি ছাড়ার পর টেলর তার দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি কর্পোরেশন (এআইএসসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন। যে প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সম্পদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করতো। এছাড়া তিনি অপহৃত ব্যক্তিদের উদ্ধারসহ মাদক দমন এবং বিস্ফোরক উদ্ধার করে এমন কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথেও কাজ করেন। আর এসব কাজ করতে গিয়ে তার বিখ্যাত সিআইএ এজেন্ট ডুয়াইন ক্লারিজের সাথে পরিচয় হয়, যিনি অবসরের পর নিজেও একটি প্রাইভেট এসপিওনাজ নেটওয়ার্কের দেখাশোনা করতেন।

টেলর গ্রে এরিয়াতে কাজ করতে পছন্দ করতেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি ম্যাসাচুসেটসে অবৈধভাবে টেলিফোনে আড়িপাতার জন্য অভিযুক্ত হন। নিজের দোষ স্বীকার করে নেওয়ায় তিনি ছাড়া পান। এরপর তার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে একটি ‘অফ দ্য বুক’ এসপিওনাজ নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগও ওঠে, যা ইউএস আর্মির স্পষ্ট আইনলঙ্ঘন। সবশেষ ২০১২ সালে এক সেনা কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের একটি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই সাথে একটি মামলার তদন্ত শুরুতেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য এক এফবিআই এজেন্টের সাথে কৌশলে ষড়যন্ত্র করেন। যে কারণে তাকে দুই বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়। এবং তার কোম্পানি এআইএসসি বন্ধ হয়ে যায়।

ঘোনের সাথে টেলরের কীভাবে যোগাযোগ হয়েছিল সেই বিষয়টি ঠিক জানা যায়নি। তবে লেবাননে তাদের মধ্যে জানা-শোনা থাকা একেবারে অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এই কাজটি টেলরের জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। কারণ জাপানের অন্যতম শীর্ষ কোম্পানির প্রধান হিসেবে প্রায় ২০ বছর ধরে কাজ করছেন ঘোন। টোকিওতে তাকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই তাকে সেখান থেকে গোপনে বের করে আনা মারাত্মক কঠিন এবং ঝুঁকির কাজ।

ঘোন না ছিলেন সন্ত্রাসীদের কাছে কোনো জিম্মি হওয়া ব্যক্তি অথবা না ছিলেন অপহৃত হওয়া কোনো শিশু। বরং তিনি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি যার বিচার কাজ চলমান। সেটাও আবার যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র জাপানে। তাই টেলর এবং তার ভাড়া করা যেসব লোক বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কারণ যদি তাদের পরিচয় কখনো ফাঁস হয় তাহলে তাদের ভবিষ্যতে ভ্রমণ এবং কর্মক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে। এমনকি দীর্ঘদিনের জেল পর্যন্ত হতে পারে। জাপানে চুক্তিতে নিরাপত্তা দিয়েছেন এমন একজন কন্ট্রাক্টরের ভাষ্যমতে, তিনি কখনোই এত বিপজ্জনক কাজ হাতে নিতেন না। আর নিলেও এজন্য তিনি ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিংবা তার চেয়ে বেশি অর্থ দাবি করতেন।

তবে টেলর শুধু অর্থের জন্য ঘোনকে সাহায্য করেননি। তিনি মূলত ঘোনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কারণ তিনি নিজেও একবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। টেলরের বিচার চলাকালীন তাকে বিচারক জামিন না দিয়ে ম্যাসাচুসেটস থেকে অনেক দূরে উতাহ জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়। তার কাছে মনে হয়েছে ঘোন অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন। এ কারণে তিনি তাকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও সাহায্য করতে রাজি হন।

জাপানে যে বাড়িতে থাকতেন কার্লোস ঘোন © Tim Kelly

 

ঘোনকে জাপান থেকে বের করার কাজে টেলরকে সাহায্য করেন জর্জ জায়েক নামে তার এক লেবাননের বন্ধু, যিনি পেশাগতভাবে একজন রত্ন বিশারদ। লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় তিনি খ্রিস্টান মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দেন। সেই যুদ্ধে তিনি তার এক পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পান। বৈরুতের ডাক্তাররা জায়েকের পা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু টেলর তার জন্য বোস্টনে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এতে তার পা কাটতে না হলেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। এই উপকারের জন্য তিনি টেলরের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। পরবর্তীতে জায়েক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। এবং নব্বইয়ে দশকে টেলরের কোম্পানির হয়ে ইরাকে কাজ করেন।

ঘোনের অভিযানের চূড়ান্ত পর্বের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে বড়দিনের ঠিক আগের দিন। আল নিতাক আল আখধার নামে এক কোম্পানির কাগজপত্র দিয়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার দিয়ে তুরস্কের অ্যাভিয়েশন কোম্পানি এমএনজি জেটের কাছে থেকে চার্টার বিমান হিসেবে বোম্বারডিয়ার গ্লোবাল এক্সপ্রেস জেট ভাড়া করেন। এই বিমানের রেঞ্জ ১১ হাজার কিলোমিটার।

তবে টেলরের পক্ষে কাজটি কঠিন হয়ে যেত যদি এমএনজি জেটের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিনিধি টেলরের দেওয়া ঠিকানায় যোগাযোগ করতেন। কারণ চার্টার্ড বিমান ভাড়া করার জন্য কাগজপত্রে দুবাইয়ের আল নিতাক আল আখধার নামে যে কোম্পানির ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, সেই কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এদিকে অন্য ক্লায়েন্টের মাধ্যমে একই সময় শর্ট রেঞ্জের আরো একটি বোম্বারডিয়ার বিমান ভাড়া করা হয়। যার গন্তব্য ছিল ইস্তাম্বুল থেকে বৈরুত।

২৯ ডিসেম্বর ২০১৯। দিনটি ছিল রবিবার। সেদিন সকালে ভাড়া করা চার্টার্ড বিমানে টেলর ও জায়েক জাপানের কানসাই বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তারা সাথে করে বেশ কয়েকটি বড় বড় কালো বাক্স নিয়ে আসেন যেগুলো দেখতে কনসার্টের বিভিন্ন সরঞ্জাম রাখার বাক্সের মতো। টেলর কানসাই আসার কিছু সময় পরই টেলর তার রোপোঙ্গি হিলসের ভাড়া বাসা থেকে বের হন। তখন তার মাথায় একটি ক্যাপ এবং মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক ছিল। তবে এতে সন্দেহ করার মতো তেমন কিছুই ছিল না।

টেলরের দলের দক্ষ সদস্যরা খুব সতর্কতার সাথে ঘোনের পরবর্তী গন্তব্য নির্ধারণ করেন। তারা প্রায় একমাস ধরে ঘোনের চারপাশে থাকা আন্ডারকভার এজেন্টদের উপর নজরদারি চালান। এতে তারা একটি বিষয় বুঝতে পারেন যে, জাপানের সেই এজেন্টরা যাকে অনুসরণ করেন, তিনি যদি কোনো হোটেল কিংবা শপিংমলে প্রবেশ করেন তখন সাময়িকভাবে আর তার উপর নজরদারি চালান না।

এদিকে কিছু সময়ের মধ্যে রোপোঙ্গি হিলসের পাশে গ্র্যান্ড হায়াত টোকিং নামে বিশাল এক শপিংমল ও অফিস কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রবেশ করেন। ভবনটিতে ঢোকা এবং বের হওয়ার পথগুলো বেশ গোলমেলে ছিল। সেই সুযোগে ঘোন সেখান থেকে শিনাগাওয়া স্টেশনে চলে যান। এরপর বুলেট ট্রেনে করে ওসাকা। তবে ঘোনের জাপানের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করার অনুমতি ছিল।

ঘোনের জাপান ছাড়ার প্রত্যেকটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে যাচাই-বাছাই করে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তার পক্ষে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিমানে ওঠা সম্ভব ছিল না। কারণ জাপানে প্রবেশের সময় বিমানবন্দরে পাসপোর্টের উপর একটি কিউআর কোড দিয়ে সিল মারা হয়, যেটি স্ক্যান করলেই সব তথ্য বের হয়ে আসে। তাই বিকল্প হিসেবে একটি কার্গো কেনা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন জটিলতার কারণে তা পরে বাতিল করে দেওয়া হয়।

এর আগে টেলরের লোকজন জাপানের প্রায় প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনুসন্ধান চালায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোন বিমানবন্দরে নিরাপত্তায় ঘাটতি রয়েছে তা খুঁজে বের করা। তারা অবশেষে খেয়াল করেন যে কানসাই বিমানবন্দরের প্রাইভেট টার্মিনালে যে এক্স-রে মেশিন রয়েছে তা অত্যন্ত ছোট। এর মাধ্যমে বড় কোনো বাক্স ভালোভাবে এক্স-রে করা যায় না।

কানসাই বিমানবন্দরের এই সমস্যা ঘোনের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়। টেলরের লোকজন তার দেহের আকারের চেয়ে বড় এবং তার সাথে ছোট সাইজের আরো কয়েকটি বাক্স তৈরি করে। যেগুলো দেখতে বাদ্যযন্ত্র এবং কনসার্টের সরঞ্জাম রাখার বাক্সের মতো। এর মধ্যে সূক্ষ্মভাবে ছিদ্র করা হয়, যাতে ঘোন তার মধ্যে প্রবেশ করলে শ্বাস নিতে পারেন।

ঠিক এমন বাক্সের ভেতরে ঢুকে জাপান থেকে পালান কার্লোস ঘোন; Image Source: The Wall Street Journal

 

২৯ তারিখ রাতে পূর্ব পরিকল্পনা মতো ঘোন সেই বিশাল বাক্সে ঢুকে টেলরের সাথে কানসাই বিমানবন্দরে আসেন। এক্স-রে মেশিনের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে তিনি ভাড়া করা চার্টার্ড বিমানে উঠে যান। রাত ১১ টায় তার বিমান কানসাই থেকে যাত্রা শুরু করে। এর ১২ ঘণ্টা পর সেটি ইস্তাম্বুলের কামাল আতার্তুক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এমএনজির অপারেশন ম্যানেজার ওকান কোসেমেন। তিনি যখন বিমানের ভেতরে প্রবেশ করেন ঘোন তখন কেবিনের বাথরুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন।

এরপর বিমানের ক্রুরা বের হয়ে গেলে টেলর, জায়েক ও ঘোনকে ফোর্ডের একটি গাড়ীতে করে দ্বিতীয় বিমানে তুলে দেন। সেখান থেকে তারা বৈরুত চলে যান। ঘোনের তিনটি পাসপোর্ট জাপান জমা নিয়ে নেয়। তবে তার কাছে ফ্রান্সের দুটি পাসপোর্ট ছিল। এর মধ্যে একটি তার কাছে রাখার অনুমতি ছিল। কারণ জাপানের আইন অনুযায়ী বিদেশি নাগরিকদের কাছে সবসময় তার পরিচয় বহন করে এমন কাগজপত্র রাখতে হবে। তবে ঘোনের কাছে যে পাসপোর্ট ছিল সেটি একটি ব্যাগে ভরে তালা দিয়ে রাখতে হবে, যে তালা খোলার কম্বিনেশন নম্বর একমাত্র তার আইনজীবী জানবেন। কিন্তু ঘোন তা মানেননি। ফ্রান্সের সেই পাসপোর্ট দেখিয়ে তিনি লেবাননে প্রবেশ করেন।

ঘোন জাপান ছাড়ার পর দেশটির সরকার হতভম্ব হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে থেকে শুরু করে দেশটির সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ বুঝতেই পারছিলেন না যে তারা কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। সময় অতিবাহিত হতে থাকলে জাপানের অনেকে মনে করেন যে ঘোন হয়তো সরকারের অনুমতি নিয়েই চলে গেছেন। পরবর্তীতে জাপান সরকার ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করে। কিন্তু লেবানন তার নাগরিকদের অন্য দেশের হাতে হস্তান্তর করে না। ফলে সেখান থেকে ঘোনকে পাওয়া জাপানের পক্ষে সম্ভব না।

লেবাননে পৌঁছানোর পর এক সপ্তাহ পর সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন কার্লোস ঘোন © JOSEPH EID/AFP/GETTY IMAGES

 

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি জনসম্মুখে আসেন ঘোন। তিনি সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। সেই সাথে তিনি কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাপান ছাড়লেন তা-ও ব্যাখা করেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারবেন কি না সেই ব্যাপারে সন্দেহ আছে।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মাইকেল টেলর এবং তার ছেলে পিটার টেলর আটক হয়েছেন। তাকে সাহায্য করার অপরাধে তুরস্কও সাতজনকে আটক করেছে। এছাড়া ঘোনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে তদন্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাফল্যের শীর্ষে থাকা একজন মানুষের বিস্ময়কর পতন। কার্লোস ঘোন সম্ভবত আর তার স্বাভাবিক ক্যারিয়ারে ফিরতে পারবেন না। তবে তার এই অভিযান পুঁজিবাদের শক্তি প্রদর্শনও বটে। অর্থের জোরে হয়তো সবকিছু কাটিয়ে উঠতেও পারেন!

Related Articles