Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অটো ওয়ার্মবিয়ার: উত্তর কোরিয়ায় গ্রেপ্তার এক দুর্ভাগা আমেরিকান । শেষ পর্ব

(পর্ব ৫-এর পর থেকে) 

৯. 

অটোর কী হয়েছিল তা নিয়ে যেসব তত্ত্ব দেওয়া হয়েছিল, তার সাথে অটোর ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে ভর্তির সময় মিলছিল না। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী- অটোকে যদি বার বার আঘাত করা হয়, তাহলে এটা হওয়ার কথা তার রায় দেওয়ার দুই থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে। কারণ ভিডিওতে কোনোপ্রকার শারীরিক নির্যাতনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। আর উত্তর কোরিয়ার ব্রেন স্ক্যান রিপোর্ট অনুযায়ী সেই সময়টা এপ্রিল। কিন্তু অটো পরের দিন সকাল থেকেই অচেতন অবস্থায় ছিলেন। এদিকে করনারও অটোর শরীর পরীক্ষা করে কোনো নির্যাতনের চিহ্ন খুঁজে পাননি। অটোকে আঘাতের মূল সূত্র নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক অজ্ঞাত কর্মকর্তার বার্তা। ফলে অটোর ওপর আসলেই নির্যাতন চালানো হয়েছিল কিনা এই সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে যায়।

জনসাধারণের কাছে অটোর ওপর নির্যাতনের গল্প জনপ্রিয়তা পেলেও এর পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ না পাওয়া যাওয়ায় উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান ছিলেন গোয়েন্দা প্রতিবেদন আদৌ সঠিক কিনা। আমি ডজনখানেক বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে কেবল একজন মনে করেছেন অটোর ওপর নির্যাতনের দূরবর্তী সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে। আন্দ্রেই ল্যানকভ সিউলে তার অফিস থেকে বলেন,

আমি মনে করি না অটোকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল। অটোকে উত্তর কোরিয়ার নিষ্ঠুরতার প্রতীক বানানোর যে প্রচার চলছে, তা মিলিটারি অপারেশনের জন্য জনগণের সম্মতি আদায় ছাড়া কিছুই না।

আন্দ্রেই ল্যানকভ; Image Source: S. Kim

অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেন, উত্তর কোরিয়াকে মিডিয়ায় অযৌক্তিক আচরণ করার বিষয়ে দেখানো হলেও কিম পরিবারকে বিশ্বমঞ্চে তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে একইসাথে নিষ্ঠুর ও স্মার্ট আচরণ করতে হয়, বিশেষ করে দেশটা যখন অনগ্রসর। তারা কী উদ্দেশ্যে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ দর কষাকষির অস্ত্র ধ্বংস করে দেবে, যেখানে এর আগে তাদের এমন কখনো করতে দেখা যায়নি? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অটোকে অন্যান্য আমেরিকান বন্দীদের মতোই রাখা হয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে এটাই যুক্তিযুক্ত ছিল, এবং ওই বিপর্যয় অপ্রত্যাশিতভাবে হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের সংশয় থাকলেও তারা গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে মিথ্যাও প্রমাণ করতে পারছিলেন না।

এক জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের আমেরিকান কর্মকর্তা, যিনি ওই প্রতিবেদনটা দেখেছেন, তিনি আমাকে বলেন,

সাধারণভাবে বললে, ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনটা ভুল ছিল। মেডিকেল পরীক্ষাতেও তা-ই প্রমাণ হয়েছে। এমনকি অটোকে কোথায় আঘাত করা হয়েছিল, বা কবে আঘাত করা হয়েছিল, সেটা নিয়েও তারা সঠিক তথ্য দেয়নি। সম্ভবত প্রতিবেদনটা করা হয়েছে জনশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে। তিন বা চারজন মানুষ ঘোরার পর কেউ শুনেছে অটো অসুস্থ ছিল, তারপর ওই লোক হয়তো একে বানিয়ে নিয়েছে তাকে মারধোর করা হয়েছে। উত্তর কোরীয়রা কখনো কোনো শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানকে শারীরিক নির্যাতন করেনি। কখনো না।

ওই কর্মকর্তা জানান, তিনি জানেন না অটোকে নির্যাতন করার ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের আর কোনো তথ্যের উৎস ছিল কিনা।

আরেক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা আমাকে বলেন,

আমি আপনাকে বলতে পারি অটো দেশে ফেরার আগে ও পরে তাকে নিয়ে হওয়া বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকে আমি ছিলাম। আমি আগে থেকেই শুনছিলাম অটোকে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু সেটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে শুনিনি। তারা সেটা কখনো সেটা সমর্থন করেনি। কিন্তু এমনও হতে পারে আরো গোয়েন্দা কার্যক্রম চলছিল যা আমি দেখিনি।

গোয়েন্দা প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করা আরেক কর্মকর্তা জানান, অটোকে আমেরিকায় আনার আগপর্যন্ত তারা আসলে জানতেন না কী হচ্ছে সেখানে। শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যেটা দেখে মনে হয়েছে অটোকে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি আরো জানান, সরকার আর কোনো গোয়েন্দা প্রতিবেদন পায়নি যেখানে বলা হয়েছে অটোকে নির্যাতন করা হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার তিন দিন পর ওয়াশিংটন পোস্ট জানায়, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ আমেরিকান কর্মকর্তা উত্তর কোরিয়ার হেফাজতে থাকা অটোর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার ব্যাপার উড়িয়ে দিয়েছেন। সাধারণভাবে উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য সরবরাহ করার ব্যবস্থা আছে বলে মনে করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার। কিন্তু তারাও অটোর ওপর নির্যাতনের নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পায়নি।

কিন্তু অটোকে ক্রমাগত আঘাত করার ব্যাপারটা যদি প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভুল প্রমাণিত হয়, তাহলে অটোর প্রতিক্রিয়াশীল না হওয়ার কারণ কী ছিল? ট্রাম্প প্রশাসনই বা কেন সত্যতা যাচাই না করা গুজব ছড়ানোর অনুমতি দিল?     

১০.

অটোর আঘাত নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলতে থাকি। তারা জানালেন অটো হয়তো কোনো ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এলার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া, যার কারণে অটোর অচেতন অবস্থা হয়েছিল। তার রায়ের পরপরই মস্তিষ্কের ক্ষতের বিষয়টা আত্মহত্যার চেষ্টার সম্ভাবনাও তুলে ধরে।

কল্পনা করুন, ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড শোনার পর অটোর কী অনুভূতি হয়েছিল। তিনি হয়তো ভাবছিলেন কোনো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তাকে নিয়ে রাখা হবে। আমেরিকান সরকার তাকে কোনো সাহায্য করবে না- ২ মাস ধরে ক্রমাগত এমন কথা শুনতে শুনতে তিনি হয়তো ভাবছিলেন তার পরিবার, প্রেমিকা, ওয়াল স্ট্রিটে কাজ করার সম্ভাবনা- সবই হারিয়ে গেছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া ছাড়া তিনি আর কী আশা করতে পারতেন ওই সময়ে?

উত্তর কোরিয়া ভ্রমণের সময় অটোর সর্বশেষ ছবিগুলোর একটি, সাথে সফরে তার রুমমেট ড্যানি গ্রেটন; Image Source: Danny Gratton

উত্তর কোরিয়ায় দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া অন্তত দুজন আমেরিকান আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এইজেলন গোমেজ তার কবজি কেটে ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে থার্মোমিটারের পারদ গিলে ফেলেন। পরবর্তীতে ব্যাখ্যা করেন, তাকে উদ্ধার করার ব্যাপারে আমেরিকার ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। জিমি কার্টারের আমলে তার মুক্তি হলেও তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার থেকে মুক্তি পাননি। সাত বছর পর তিনি আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেন। এক আমেরিকান কর্মকর্তা জানান, ইভান হাঞ্জিকার গ্রেপ্তার থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তাকে ফিরিয়ে আনার এক মাস পার হওয়ার আগেই মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন। রবার্ট পার্কও তাকে ফিরিয়ে আনার সময় আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন।

উত্তর কোরিয়া যদি অটোকে মারধোর না-ও করে থাকে, তার মানে এই নয় যে তিনি নির্যাতনের শিকার হননি। উত্তর কোরিয়ার রেজিম তাকে যে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, সেটাও জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে। জাতিসংঘের উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক টমাস ওজিয়া কুইন্টানা বলেন, “অটোর মানবাধিকার প্রতিটি পর্যায়েই লঙ্ঘন করা হয়েছে।

১১.

ব্যাক চ্যানেলে কূটনীতিক হিসেবে কাজ করা গভর্নর রিচার্ডসন অটোর মুক্তি পাওয়ার আগে তার আঘাত সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে মনে করেন, পিয়ংইয়ং তার সাথে প্রতারণা করেছে। তবে উত্তর কোরিয়ার এক রাষ্ট্রদূত দ্রতই তার সাথে যোগাযোগ করে ব্যাখ্যা করেন, তিনি তার সাথে কূটনৈতিক আলোচনা নিষ্ফল করতে চাননি, এবং তিনি নিজেও অটোর ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন। রিচার্ডসন আমাকে বলেন,

আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। ১৫ বছর ধরে আমি তার সাথে কূটনৈতিক আলোচনা করে আসছি, এবং তিনি সবসময়ই সৎ ছিলেন।

সিনেটর পোর্টম্যান ও উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরে কাজ করা সোর্স থেকেও জানা যায় তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অটোর ব্যাপারে জানত না। উত্তর কোরিয়ার নেতৃবৃন্দদের নজর রাখা নিয়ে কাজ করা এক বিশেষজ্ঞ মাইকেল ম্যাডেন জানান, অটোর ব্যাপারে যে মন্ত্রী দায়িত্বে ছিলেন তাকে অবনমন করা হয় এবং একসময় গুম করে ফেলা হয়। এমনকি অটোকে পাহারা দেওয়ার জন্য যে গার্ডরা দায়িত্বে ছিল, তাদেরকেও সম্ভবত কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রকৃত সত্য হয়তো কেবলমাত্র কিম জং উন ও তার বিশ্বস্ত কর্মীরাই জানেন, এবং তা কখনো বহির্বিশ্বের সামনে আসবে না।

এতসব অজানার ভীড়ে একটা বিষয় নিশ্চিত, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ভুল এটা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও ট্রাম্প প্রশাসন অটোর শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টা প্রচার করে গেছে। এদিকে নির্যাতনের কোনোপ্রকার শারীরিক চিহ্ন না থাকার বিষয়টাও মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়। প্রশাসনকে সঠিক সময়রেখা সম্পর্কে জানানো হয়, এবং অটোর ব্যাপারে কাজ করা স্ররকারি কর্মকর্তারাও এটা সম্পর্কে জানতেন। জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের আমেরিকান কর্মকর্তা ও কংগ্রেসের কর্মীরাও জানান, সরকার তাদের কাছে অটোর শারীরিক নির্যাতনের স্পষ্ট কোনো প্রমাণ দেয়নি।

স্পষ্ট প্রমাণ না থাকার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অটোর শারীরিক নির্যাতনের গল্প প্রচার করে গিয়েছেন; Image Source: Michael M. Santiago / Getty Images

তবে এজন্য ট্রাম্প প্রশাসনকে উত্তর কোরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করার ব্যাপারে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ একজন আমেরিকান নাগরিক তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মস্তিষ্কে ক্ষত তৈরি হওয়ার মতো ঘটনা শাস্তি দাবি করে। একইসাথে ওই জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাকেও নিউ ইয়র্ক টাইমসের কাছে ভুল তথ্য সরবরাহ করার দোষ দেওয়া যায় না। ওই ব্যক্তি হয়তো ঠিকভাবেই বর্ণনা করেছিলেন। অটোকে উদ্ধার করে আনা ট্রাম্প প্রশাসনের সাহসিকতা হিসেবে দেখানো হয়েছিল। সেই হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের স্বার্থের পক্ষে যাওয়ার জন্য হয়তো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ভুল তথ্য দেখানো হয়েছিল।   

ট্রাম্প ফ্রেড ওয়ার্মবিয়ারের ফক্স ইন্টারভিউ দেখে শারীরিক নির্যাতনের ব্যাপারে সমর্থন দেওয়ার আগে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখেছিলেন কিনা বা সেগুলোকে বিকৃত করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে বলা অসম্ভব। অথবা, যখন দক্ষিণ কোরিয়ার সংসদে বলেছিলেন অটোকে ‘নির্যাতন’ করা হয়েছিল। সম্ভবত এগুলো ওয়াশিংটন পোস্টের ফ্যাক্ট চেক ডেটাবেজ অনুযায়ী তার প্রথম ৪৬৬ দিনের ৩,০০১টি মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর দাবিগুলোর আরো দুই সংযোজন। অথবা এটা কোনো পরিকল্পিত কৌশলের অংশই ছিল। যা-ই হোক, ওই ভুল ব্যাখ্যা যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধাবস্থায় যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে যেতে সাহায্য করেছে। যদিও খুব দ্রুতই প্রশাসন ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে।

১২.

ওই রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে অটোকে আনার পর প্রথমবারের মতো যখন ফ্রেড তাকে জড়িয়ে ধরেন, তখন তিনি অনুভব করেন অটোর সাথে ঠিক যোগাযোগ করতে পারছেন না। অটো তখন খুবই অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। কিন্তু একদিনের মধ্যেই অটোর মুখাবয়ব পরিবর্তন হয়ে যায়। অটো তাদের সাথে কথা বলার মতো অবস্থায় না থাকলেও তারা অনুভব করছিলেন অটো দেশে ফিরতে পেরে শান্তিতে ছিলেন।  

অটোর কী হয়েছিল, তা নিয়ে কেউ নিশ্চিতভাবে প্রমাণ দেখাতে না পারলেও ট্রাম্প নির্যাতনের বিষয়টাই প্রচার করতে উৎসাহিত করেন এবং হোয়াইট হাউজ থেকেও সেই গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। প্রশাসন থেকে জনসাধারণের মনে অটোর পরিণতি সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়।       

কিন্তু এটা করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত ওয়ার্মবিয়ার পরিবারের মধ্যেও ভুল ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে। অটোর শারীরিক নির্যাতনের খবর প্রচার পাওয়ার পর থেকে ট্রাম্প ফ্রেড ও সিন্ডিকে বিভিন্ন হাই-প্রোফাইল অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান। তাদের প্রশংসা করেন ও “ভালো বন্ধু” হিসেবে সম্বোধন করেন। কিন্তু ফ্রেড ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় টেলিভিশনে জানান, তিনি মিডিয়ার সংবাদের বাইরে তার ছেলে সম্পর্কে আর কোনো তথ্য জানেন না।

২০১৮ সালের এপ্রিলে ওয়ার্মবিয়ার পরিবার অটোর মৃত্যুর জন্য উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যখন মামলা করেন, তখনও তারা ধারাবাহিক নির্যাতনের প্রমাণের কথা উল্লেখ করেন। তারা যদি বিশ্বাস করতে চান তাদের ছেলের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কেটেছে ভয় আর শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে, তাহলে সেটা হয়তো এই ঘটনা নিয়ে প্রশাসনের অন্য কোনো ব্যাখ্যা খোঁজার অনাগ্রহের কারণে হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তারা যেটাই বিশ্বাস করে থাকুন, এটা স্পষ্ট যে তারা তাদের ছেলেকে ভালোবাসতেন। তারা অকল্পনীয় দুঃখজনক ক্ষতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, এবং অটোর আত্মত্যাগকে সম্মান জানানোর চেষ্টা করছিলেন।

ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে এই প্রতিবেদনের ফলাফল নিয়ে কথা বলতে গেলে তারা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

জাতিসংঘে বক্তব্য দিচ্ছেন ওয়ার্মবিয়ার পরিবার; Image Source: Shannon Stapleton/Reuters

এই প্রতিবেদনে অটোর শারীরিক নির্যাতনের বিষয়টি সমর্থন দেওয়া হয়নি, এবং তার মৃত্যু আত্মহত্যা প্রচেষ্টার কারণে হয়ে থাকতে পারে- এমন বিষয় শুনতে পেরে ওয়ার্মবিয়ার পরিবার এই প্রতিবেদনের জন্য পূর্বে দেওয়া তাদের বক্তব্য পরিহার করে নেন। আত্মহত্যার সম্ভাবনা তাদের আইনজীবীর মাধ্যমে তারা উড়িয়ে দেন। শেষপর্যন্ত তারা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

প্রমাণ না থাকায় অটোর পরিণতি নিয়ে আমরা যে ধরনের গল্পে বিশ্বাস করতে চাই, সেটাই গ্রহণ করে নিতে হবে। বর্তমান রাজনীতির সময়ে সত্য অনেক সময়ই ক্ষমতাবানদের এজেন্ডা দ্বারা প্রভাবিত থাকে। তাই আমরা কোন গল্প বিশ্বাস করছি এবং কেন করছি, সেটা নিয়ে আমাদের ধারণা থাকা উচিত। শেষপর্যন্ত আমরা যেসব গল্প নিজেদের ও অন্যদের বলি, তা-ই আমাদের ভাগ্য গড়ে দেয়, এবং একইসাথে জাতি, বিশ্ব ও অন্য মানুষদের পরবর্তী প্রজন্মকেও গড়ে দেয়।

শেষপর্যন্ত অটোর মৃত্যু নিয়ে যতই ধোঁয়াশা থাকুক, দুটি বিষয় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই- অটোর মৃত্যু এবং তার পরিবারের হারানোর বেদনা।

১৩.

২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার শীতকালীন অলিম্পিকের সময় ফ্রেড ওয়ার্মবিয়ার অটোর মৃত্যুর জন্য দায়ীদের মুখোমুখি হন। অবরোধের চাপে ও অটোর নামে আমেরিকার যুদ্ধের প্রস্তুতির ভয়ে উত্তর কোরিয়া ২০১৮ সালের শুরু থেকে বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে থাকে। এই কূটনীতির কেন্দ্রীয় অংশে ছিল ফেব্রুয়ারির ওই অলিম্পিকে চিয়ারলিডারদের দিয়ে দুই কোরিয়া একত্রীকরণ নিয়ে লোকসঙ্গীত গাওয়ানো, এবং হাস্যোজ্জ্বল কিম জং উনের বোন কিম ইয়ো জংকে বিশ্বনেতাদের সাথে হাত মেলাতে দেখা। এমনকি উত্তর কোরীয়রা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে জিজ্ঞেস করে তিনি কিম ইয়ো জংয়ের সাথে দেখা করতে চান কিনা, যদিও অটোর ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু পেন্স সেটা না করে ফ্রেড ওয়ার্মবিয়ারকে ভিআইপি বক্সে ডেকে এনে তার সাথে বসান। তারা কিমের বোনের চেয়ে দশ ফুটেরও কম দূরত্বে ছিলেন। ফ্রেড দুঃখভারাক্রন্ত মন নিয়ে সেখানে বসেছিলেন। তিনি কিমের বোনের দিকে তাকানইনি। তার শোকাবহ অভিব্যক্তি যেন কিমের বোনের কূটনৈতিক কৃত্রিম হাসিকে তিরস্কার করছিল।

ভিআইপি বক্সে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন নিচের দিকে সর্বডানে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও উপরে বাম থেকে দ্বিতীয় স্থানে কিম জং উনের বোন; Image Source: CBS/AP

ওই বছরের মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার দুই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পিয়ংইয়ংয়ে গিয়ে কিম জং উনের সাথে চার ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেন এবং ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান পানীয় পান করেন। কিম জং উন তাদের কাছে বিশেষ বার্তা দেন ট্রাম্পের কাছে পাঠানোর জন্য। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা দ্রুত ওয়াশিংটন গিয়ে ট্রাম্পের সাথে দেখা করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই প্রস্তাবনা শুনে তার উপদেষ্টাদের সাথে আলোচনা না করেই সম্মতি দিয়ে দেন। তারপর দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের একজন হোয়াইট হাউজে বিশ্ববাসীর কাছে জানান, দুই নেতা ব্যক্তি পর্যায়ে দেখা করে অনন্তকাল ধরে চলে আসা যুদ্ধ সমাপ্ত করার চেষ্টা করবেন।

ওই সময়ের পর থেকে হোয়াইট হাউজ অটোর ট্রাজেডিকে আর গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তাদের কার্যক্রম পুরো উল্টো পথে চলে যায়। অধিকারকর্মীরা অভিযোগ করেন, সিঙ্গাপুরে হতে যাওয়া সম্মেলনে মানবাধিকার বিষয়কে এজেন্ডাতে স্থান দেওয়া হয়নি। মে মাসে যখন বাকি তিন আমেরিকান বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়, ট্রাম্প তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে বলেন,

আমরা কিম জং উনকে ধন্যবাদ দিতে চাই, যিনি এই তিন অসাধারণ ব্যক্তির প্রতি চমৎকার আচরণ করেছেন।

অটোকে নির্দয়ভাবে নির্যাতনের গল্পেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন।

জুনের শুরুতে ট্রাম্প ও কিম করমর্দন করেন দুই দেশের পতাকার লাল, সাদা ও নীল রঙের সামনে। তারা এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেখানে উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দেয় তারা পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করবে, এবং আমেরিকা অঙ্গীকার করে তারা উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণ করবে না।

সিঙ্গাপুরের সম্মেলন পরবর্তী সময়ে করমর্দন করছেন কিম জং উন ও ডনাল্ড ট্রাম্প; Image Source: SAUL LOEB, AFP/Getty Images

ওই সম্মেলন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পকে প্রথম প্রশ্নেই জিজ্ঞেস করা হয় তিনি অটোর মৃত্যুর জন্য দায়ী স্বৈরশাসক কিমের প্রশংসা করছেন কেন।

ট্রাম্প উত্তর দেন,

অটো ওয়ার্মবিয়ার একজন অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি। আমি মনে করি অটোকে ছাড়া এটা (চুক্তি) কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।

এরপর তিনি দুবার বলেন, “অটোর মৃত্যু বৃথা যায়নি।” যেন এটা ছিল দ্বিগুণ সত্য, অথবা তিনি নিজেকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন।

Related Articles