১৯৪৭ সালের জুন মাস। নিউ মেক্সিকোর রোজওয়েলে খামারের মালিক উইলিয়াম ব্রাজেল ও তার ছেলে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘নিউ মেক্সিকো’ নামটি শুনে আপনার মনে হতে পারে এটি হয়তো মেক্সিকোর কোনো জায়গা। বাস্তবে তা নয়; এটি আমেরিকার ৪৭তম অঙ্গরাজ্য।
যা-ই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। উইলিয়াম ব্রাজেল ও তার ছেলে নিজেদের বিশাল খামারের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছিলেন। নিউ মেক্সিকোতে এই ধরনের অসংখ্য বিশালাকৃতির খামার রয়েছে যেগুলোতে পশু চড়ানো কিংবা কৃষিকাজ করা হয়। গাড়ি চালাতে চালাতে বাপ-বেটার চোখ হঠাৎ আটকে গেল। ভালো করে তাকিয়ে তারা এমন জিনিস দেখতে পান যেটি আগে কখনও দেখেননি। উইলিয়াম ব্রাজেলের ভাষায়, “খামারের বেশ বড় জায়গা জুড়ে টিনের পাতলা পাত, রাবারের টুকরা, শক্ত কাগজ ও কিছু লাঠিসদৃশ বস্তুর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল।“
নিউ মেক্সিকোর রোজওয়েল থেকে উইলিয়াম ব্রাজেলের খামার ছিল প্রায় ৮০ মাইল দূরে। সেরকম অজপাড়াগাঁয়ে এসব দেখতে পাওয়া বাস্তবেই অদ্ভুতুড়ে। গাড়ি চালানোর সময় প্রথম যখন তিনি সেসব দেখলেন, তখন আসলে বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী করতে হবে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভেবেও কোনো কূলকিনারা না পাওয়ায় তিনি শেষমেশ কর্তৃপক্ষকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। জুলাই মাসের ৪ তারিখে খামার থেকে যত ধ্বংসাবশেষ ছিল, সব সংগ্রহ করে গাড়িতে রোজওয়েল শহরের দিকে রওনা দেন। উদ্দেশ্য শহরের উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার কাছে সেগুলো হস্তান্তর করা। রোজওয়েল শহরের শেরিফ জর্জ উইলকক্সের সামনে যখন ধ্বংসাবশেষগুলো উপস্থাপন করা হলো, তখন তিনিও চমকে উঠলেন।
জর্জ উইলকক্স সিদ্ধান্ত নিলেন সামরিক বাহিনীর কারও সাথে যোগাযোগ করবেন। সেজন্যেই তিনি শহর থেকে কিছু দূরে অবস্থিত রোজওয়েল আর্মি এয়ারফিল্ডের কর্ণেল বুচ ব্লাংকার্ডের সাথে দেখা করে সেগুলো দেখালেন। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, তিনিও অনেক ভেবেচিন্তে কিছুই বের করতে না পেরে ‘চেইন অব কমান্ড’ অনুযায়ী তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করলেন। কর্ণেল ব্লাংকার্ড তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ধ্বংসাবশেষের পাশাপাশি একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাও পাঠান, যাতে সেই কর্মকর্তার তদন্তে সুবিধা হয়। একটু খেয়াল করুন। খামার মালিক উইলিয়াম ব্রাজেল থেকে শেরিফ জর্জ উইলকক্স, তারপর সেখান থেকে কর্নেল ব্লাংকার্ড ও সবশেষে উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল রজার রেইমি– প্রতিটি পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ ধ্বংসাবশেষগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন, কিন্তু কেউই কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। এতটাই চমকপ্রদ ছিল ধ্বংসাবশেষগুলো!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের মতাদর্শের সম্প্রসারণ ঘটায়। অপরদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম ইউরোপের পুনর্গঠনে আমেরিকা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে, পুঁজিবাদী মতাদর্শের বিপরীতে যেন কোনোভাবেই কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা লাভ না করে– সেই সম্পর্কে সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করে। তবে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে নিজ নিজ মতাদর্শের লড়াই আসলে শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে দুই দেশই সামরিক শক্তিতে একে অপরের থেকে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছিল, যেটি শুনতে রোমাঞ্চকর মনে হলেও বিশ্বশান্তির জন্য মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। কিন্তু এই অপ্রিয় প্রতিযোগিতা থেকে কখনই এই দুই পরাশক্তি পিছিয়ে আসেনি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো বেশ কয়েকবার প্রেক্ষাপট তৈরি হওয়ার পরও কোনো যুদ্ধ বাধেনি– বিশ্ববাসীকে সৌভাগ্যবানই বলতে হবে।
১৯৪৫ সালে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক হামলা চালানোর মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর সামনে নিজেদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দেয়। তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি, কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৪৭ সালের দিকেই আমেরিকার গোয়েন্দারা খবর পেতে শুরু করে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন অল্প সময়ের মধ্যেই পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে। বলে রাখা ভালো, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক বোমা তৈরির সমস্ত প্রকল্প গোপনে পরিচালনা করছিল। এমনকি ধারণা করা হয়, তুখোড় গোয়েন্দাদের মাধ্যমেই তারা আমেরিকার পারমাণবিক বোমা তৈরির পরিকল্পনা চুরি করেছিল। যা-ই হোক, আমেরিকা যখন টের পেয়ে যায় যে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরীক্ষা চালাবে, তখন গোপনে আমেরিকাও একটি সামরিক প্রকল্প গ্রহণ করে। ‘প্রজেক্ট মোগুল’ নামের সেই গোপন প্রকল্পের মাধ্যমে আমেরিকা অনেক উঁচুতে ভাসতে থাকা বেলুনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক পরীক্ষার উপর নজরদারি চালাতে চেয়েছিল।
রোজওয়েল থেকে প্রায় আশি মাইল দূরে অবস্থিত উইলিয়াম ব্রাজেলের খামারে যে ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল– সেটি ছিল আসলে এই গোপন প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা অনেকগুলো বেলুনের মধ্যে একটির ধ্বংসাবশেষ। বেলুনগুলোতে মাইক্রোফোন ও অন্যান্য যন্ত্র সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছিল, যাতে করে সেগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার শব্দতরঙ্গ সংগ্রহ করে রাখতে পারে। সেসময় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য আকাশে বিশাল বেলুন ভাসিয়ে দেয়া হতো, যেগুলোকে বলা হয় ‘ওয়েদার বেলুন’ (Weather Balloon)। প্রজেক্ট মোগুলের অধীনে যে মাইক্রোফোন সংযুক্ত বেলুন তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো যেন কেউ বুঝতে না পারে তাই আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বেলুনের আদলেই আকাশে ভাসানো হয়েছিল। প্রজেক্ট মোগুলের ডিক্লাসিফাইড ফাইলের মাধ্যমে দেখা যায়, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বেলুনগুলো নিউ মেক্সিকো থেকেই ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল।
কর্ণেল বুচ ব্লাংকার্ড যখন ‘চেইন অব কমান্ড’ অনুযায়ী তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জেনারেল রজার নেইমিকে ধ্বংসাবশেষগুলো প্রেরণ করেছিলেন, তার পরের দিন রোজওয়েল আর্মি এয়ার ফোর্সের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে দাবি করা হয় যে, তারা রোজওয়েলের সেই জায়গায় ‘ফ্লায়িং ডিস্ক’ এর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এরপর সরকারি বিজ্ঞানীরা এসে আলামত সংগ্রহ করে যখন বুঝতে পারেন যে সেগুলো আসলে প্রজেক্ট মোগুলের অধীনে তৈরি করা বেলুনের ধ্বংসাবশেষ, তখন বিবৃতি সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে পুরো আমেরিকায় তোলপাড় হয়ে গিয়েছে। এলিয়েনদের নিয়ে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর গল্প, কাহিনী প্রচলিত থাকলেও কেউ চাক্ষুষ প্রমাণ দিতে না পারায় সেগুলো সর্বগ্রাহ্য হয়ে উঠছিল না। রোজওয়েলের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর বাড়তি কাটতির আশায় সংবাদপত্রগুলোও কল্পনাশ্রয়ী বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে।
রোজওয়েলের ঘটনাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, সেই তত্ত্বে বলা হয়েছিল যে আমেরিকার সামরিক বাহিনী ধ্বংসাবশেষের সাথে ঠিকই ভিনগ্রহের প্রাণীদের দেহ (সেটি হোক জীবিত কিংবা মৃত) উদ্ধার করেছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়টি পুরোপুরি চেপে যাওয়া হয়, যাতে তারা নির্বিঘ্নে উদ্ধার করা ভিনগ্রহের প্রাণীর দেহ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে পারে। অনেকে আবার তৎকালীন সরকারের সমর্থনে বলে থাকেন যে, ধ্বংসাবশেষ নিয়ে বেশি আলোচনা হতে থাকলে শেষ পর্যন্ত প্রজেক্ট মোগুল জনসমক্ষে ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এজন্য এই ধরনের ঘটনা থেকে দূরে থাকার জন্য ‘ফ্লায়িং সসার’ তত্ত্বের অবতারণা করা হয়। এই ধরনের দাবির পক্ষে অবশ্য প্রমাণও মেলে।
যে সময় রোজওয়েলের ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমেরিকায় গল্প-কাহিনী-উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচিত হচ্ছে। এলিয়েন দেখেছেন, এলিয়েনের সাথে কথা বলেছেন, এলিয়েনের মাধ্যমে অপহৃত হয়েছেন– এরকম অসংখ্য প্রমাণবিহীন মিথ আমেরিকার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এমন কোনো প্রমাণ দরকার ছিল, যেটার মাধ্যমে এলিয়েনের অস্তিত্ব একেবারে শতভাগ প্রমাণ করা যাবে। রোজওয়েলের ঘটনাটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতিনিধিদের সামনে বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নিরাশ হতে হয়েছে। এটি আমাদের সামনে আরেকটি সত্য উন্মোচন করে দেয়। আমাদের অগোচরেই হয়তো রাষ্ট্র বিভিন্ন গোপন প্রকল্প পরিচালনা করছে, কিন্তু আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমেরিকার সাধারণ মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না যে তাদের সরকার রাশিয়ার পারমাণবিক প্রকল্পের উপর গোপন নজরদারি চালানোর জন্য প্রকল্প পরিচালনা করছে তাদের সামনেই, কিন্তু তারপরও কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না।