লুক্সেমবার্গ
‘লুক্সেমবার্গ গ্র্যান্ড ডাচি’ (লুক্সেমবার্গিশ: Groussherzogtum Lëtzebuerg; ফরাসি: Grand-Duché de Luxembourg; জার্মান: Großherzogtum Luxemburg) পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ২,৫৮৬.৪ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তর ও পশ্চিমে বেলজিয়াম, দক্ষিণে ফ্রান্স এবং পূর্বে জার্মানি অবস্থিত। রাষ্ট্রটির সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই, কিন্তু বহু সংখ্যক যুদ্ধে ব্রিটিশরা লুক্সেমবার্গের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতে যুদ্ধ করেছে। সুতরাং ব্রিটেনের পক্ষে লুক্সেমবার্গ আক্রমণ করা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য–উপাত্ত অনুযায়ী, ব্রিটেন কখনো লুক্সেমবার্গের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
নেপোলিয়নীয় যুদ্ধসমূহের অবসানের পর ১৮১৫ সালে লুক্সেমবার্গ ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, কিন্তু রাষ্ট্রটি একইসঙ্গে ‘জার্মান কনফেডারেশনে’র (বিভিন্ন জার্মানিক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত একটি কনফেডারেশন) অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে একটি ‘ব্যক্তিগত ইউনিয়নে’ (personal union) সংযুক্ত হয়। উল্লেখ্য, ‘ব্যক্তিগত ইউনিয়ন’ হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে দুটি রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পৃথক থাকে, কিন্তু রাষ্ট্র দুটির রাষ্ট্রপ্রধানের পদে একই ব্যক্তি অধিষ্ঠিত থাকেন। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের রাজা লুক্সেমবার্গের ডিউক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। অবশ্য ১৮৬৬ সালে জার্মান কনফেডারেশন বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং ১৮৯০ সালে নেদারল্যান্ডস ও লুক্সেমবার্গের মধ্যবর্তী ব্যক্তিগত ইউনিয়নের অবসান ঘটে। এর মধ্য দিয়ে লুক্সেমবার্গ একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানি লুক্সেমবার্গ দখল করে নেয়, কিন্তু এ সময় ব্রিটেন লুক্সেমবার্গের ভূখণ্ডে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হয় এবং যুদ্ধের পর লুক্সেমবার্গ পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জার্মানি পুনরায় লুক্সেমবার্গ দখল করে নেয়, কিন্তু এবারও ব্রিটেন লুক্সেমবার্গের ভূখণ্ডে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি। অবশেষে ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন সৈন্যরা লুক্সেমবার্গ পুনর্দখল করে নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে লুক্সেমবার্গ আবার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
কৌতূহলের বিষয় হচ্ছে, মার্কিন সৈন্যদের লুক্সেমবার্গ আক্রমণে ব্রিটেন অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা এই অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উক্ত কর্মকর্তা ছিলেন লুক্সেমবার্গের তদানীন্তন গ্র্যান্ড ডিউক জাঁ। জাঁ ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ‘আইরিশ গার্ডসে’ স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৪৪ সালে লুক্সেমবার্গে পরিচালিত মার্কিন অভিযানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়, লুক্সেমবার্গ থেকে জার্মানদের বিতাড়িত করার পর তিনি পশ্চিমা মিত্রশক্তির জার্মানি আক্রমণেও অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু জাঁ যেহেতু লুক্সেমবার্গের শাসক ছিলেন এবং লুক্সেমবার্গকে জার্মান দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করার মার্কিন অভিযানে যেহেতু ব্রিটেন জড়িত ছিল না, তাই একে লুক্সেমবার্গের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
সাও তোমে ও প্রিন্সিপি
‘সাও তোমে ও প্রিন্সিপি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ (পর্তুগিজ: República Democrática de São Tomé e Príncipe) গিনি উপসাগরে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র (island state)। ১,০০১ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এই দ্বীপরাষ্ট্রটি দুইটি মূল দ্বীপ (সাও তোমে এবং প্রিন্সিপি) ও তাদের চারপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে ব্রিটেন কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি, কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিকরা একবার রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে ব্যক্তিগত উদ্যোগে আক্রমণ চালিয়েছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা প্রথম সাও তোমে ও প্রিন্সিপির ভূখণ্ডে পৌঁছায় এবং ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে তারা অঞ্চলটিকে একটি পর্তুগিজ উপনিবেশে পরিণত করে। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্রিটেন ও পর্তুগালের মধ্যে একটি মৈত্রী স্থাপিত হয় এবং এখন পর্যন্ত এই মৈত্রী বজায় রয়েছে। সাও তোমে ও প্রিন্সিপি যেহেতু একটি পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল, সেহেতু ব্রিটেন এই অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু একবার কিছু ব্রিটিশ নাগরিক নিজেদের উদ্যোগে অঞ্চলটিতে আক্রমণ চালিয়েছিল।
এই আক্রমণের জন্য যে ব্যক্তি দায়ী ছিল, সে হচ্ছে ওয়েলশ জাতিভুক্ত ব্রিটিশ জলদস্যু হাওয়েল ডেভিস। একবার ডেভিস ব্রিটিশ উপনিবেশ গাম্বিয়ায় অবস্থিত ‘রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানি’র একটি দুর্গের কমান্ডারকে এই বলে ধোঁকা দিয়েছিল যে, সে একজন প্রাইভেটিয়ার (privateer)। উল্লেখ্য, প্রাইভেটিয়ার বলতে এমন কোনো জাহাজের মালিককে বুঝানো হতো যার বিদেশি জাহাজ আক্রমণ করার অনুমতি ছিল। সেসময় বহু জাহাজের মালিককেই অনুরূপ অনুমতি দেয়া হতো। উক্ত কমান্ডার ডেভিসকে এরকম একজন প্রাইভেটিয়ার ভেবে তাকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। এই সুযোগে ডেভিস তাকে অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ হিসেবে ২০০ পাউন্ড স্বর্ণ আদায় করে নেয়।
এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ডেভিস প্রিন্সিপি দ্বীপের পর্তুগিজ গভর্নরকে অনুরূপভাবে অপহরণ করার পরিকল্পনা করে। ১৭১৯ সালের জুনে সে তার জাহাজে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পতাকা উড়িয়ে দ্বীপটিতে উপস্থিত হয় এবং দ্বীপটির গভর্নর তাকে নৈশভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানান। ডেভিস ধারণা করেছিল যে, গভর্নর তার ফাঁদে পা দিয়েছেন। কিন্তু গভর্নর ডেভিসের আসল পরিচয় অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং এজন্য তিনি ডেভিসের জন্য পাল্টা ফাঁদ পাতেন। ডেভিস ও তার সঙ্গীরা গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছানোর পরপরই গভর্নরের রক্ষীরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং ডেভিস তাদের গুলিতে নিহত হয়।
ডেভিসের মৃত্যুর পর তার দলের জলদস্যুরা আরেক ওয়েলশ জাতিভুক্ত ব্রিটিশ নাগরিক বার্থোলোমিউ রবার্টসকে নিজেদের দলনেতা নির্বাচন করে। রবার্টস ডেভিসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং এই উদ্দেশ্যে ছয় সপ্তাহ পর এক রাতে অতর্কিতে প্রিন্সিপি দ্বীপে সদলবলে আক্রমণ চালায়। তারা প্রিন্সিপির অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসীকে হত্যা করে এবং বহনযোগ্য সমস্ত মূল্যবান সামগ্রী লুণ্ঠন করে। রবার্টস ব্রিটিশ নাগরিক ছিল, কিন্তু প্রিন্সিপির ওপরে তার পরিচালিত আক্রমণে ব্রিটিশ সরকারের অনুমোদন ছিল না এবং রবার্টসের জলদস্যুদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণও ছিল না। এজন্য এই ঘটনাকে সাও তোমে ও প্রিন্সিপির ভূখণ্ডে পরিচালিত ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না।
পরবর্তীতে অবশ্য ব্রিটিশ নৌবাহিনী কখনো কখনো নিজেদের প্রয়োজনে সাও তোমে ও প্রিন্সিপির ভূখণ্ডকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু পর্তুগিজ সরকারের অনুমোদন ছিল, সেহেতু এটিকেও সাও তোমে ও প্রিন্সিপির ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। অবশ্য ১৯৭৫ সালে দ্বীপরাষ্ট্রটিতে পর্তুগিজ শাসনের অবসান ঘটে এবং সাও তোমে ও প্রিন্সিপি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
সুইডেন
‘সুইডেন রাজ্য’ (সুইডিশ: Konungariket Sverige) উত্তর ইউরোপে অবস্থিত একটি মাঝারি আকৃতির ‘নর্ডিক’ রাষ্ট্র। ৪,৫০,২৯৫ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির পশ্চিমে নরওয়ে, উত্তর–পূর্বে ফিনল্যান্ড, পূর্বে বথনিয়া উপসাগর এবং দক্ষিণে বাল্টিক সাগর অবস্থিত। সুইডেন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আগত ভাইকিংরা এক সময়ে ব্রিটেনের ভূখণ্ডে প্রায়ই আক্রমণ চালাত এবং ব্যাপক হারে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজ চালাত। কিন্তু ব্রিটেন কখনো সুইডেনে অনুরূপ কোনো পাল্টা আক্রমণ পরিচালনা করেনি। শুধু তাই নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু সেই যুদ্ধে কেউ মারা যায়নি!
দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ উত্তর ইউরোপে একটি একত্রিত সুইডিশ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৯৭ সালে সুইডেন ডেনমার্ক ও নরওয়ের সঙ্গে মিলে ‘কালমার ইউনিয়ন’ গঠন করে, কিন্তু ১৫২৩ সালে এই ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যায়। ১৫৯২ সালে সুইডেন ও পোল্যান্ড একটি ‘ব্যক্তিগত ইউনিয়নে’র মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং এসময় পোল্যান্ডের রাজা সুইডেনের রাজার পদে অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু ১৫৯৯ সালে এই ইউনিয়ন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ সুইডেন ইউরোপের একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয় ও একটি বিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে তারা তাদের সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে এবং ১৮০৯ সালে রাশিয়ার কাছে ফিনল্যান্ড হারানোর মধ্য দিয়ে তাদের সাম্রাজ্যের সর্বশেষ অংশও তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
১৮১০ সালের জানুয়ারিতে সুইডেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ‘প্যারিস চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সুইডেন ফ্রান্সের ব্রিটেনবিরোধী ‘মহাদেশীয় ব্যবস্থা’য় (Continental System) যোগদান করতে সম্মত হয়। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী সুইডেনের ব্রিটেনের সঙ্গে সমস্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু ব্রিটেন ছিল সুইডেনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং এজন্য নিজস্ব অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সুইডেন ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করেনি। এই পরিস্থিতিতে ১৮১০ সালের নভেম্বরে ফ্রান্স সুইডেনকে একটি চরমপত্র প্রদান করে এবং ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার জন্য সুইডেনকে চাপ প্রদান করে। অন্যথায় ফ্রান্স সুইডেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে বলে হুমকি দেয়।
ফ্রান্সের চাপে সুইডেন ১৮১০ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ–সুইডিশ যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধ ঘোষণার পর সুইডেন ব্রিটেনের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি। অনুরূপভাবে, ব্রিটেনও সুইডেনের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি এবং সুইডেনের ভূখণ্ডে কোনো আক্রমণ চালায়নি। এসময় ব্রিটিশ নৌবহর সুইডেনের কাছাকাছিই অবস্থান করছিল এবং তাদের প্রয়োজনীয় রসদপত্র সুইডিশরাই তাদেরকে সরবরাহ করছিল। বছর দেড়েক এই নামকাওয়াস্তে যুদ্ধ চালানোর পর ১৮১২ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটেন ও সুইডেন শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং এর মধ্য দিয়ে এই রক্তপাতহীন যুদ্ধের অবসান ঘটে।
এই যুদ্ধে একজন ব্রিটিশ বা সুইডিশ সৈন্যও নিহত হয়নি। কিন্তু সুইডেনের জন্য এই যুদ্ধ পুরোপুরি রক্তপাতহীন ছিল না। যুদ্ধ চলাকালে সুইডিশ সরকার পুরুষদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের নিয়ম প্রবর্তন করেছিল। সুইডিশ কৃষকরা এই নিয়ম নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল এবং এই নিয়ে সুইডেনের একটি অঞ্চলে দাঙ্গা দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে সুইডিশ সৈন্যরা গুলিবর্ষণ করলে অন্তত ৩০ জন কৃষক নিহত হয়।
১৮১৪ সালে সুইডেন নরওয়ে আক্রমণ করে এবং নরওয়েকে একটি ‘ব্যক্তিগত ইউনিয়নে’র মাধ্যমে জোরপূর্বক সুইডেনের সঙ্গে যুক্ত করে। ১৯০৫ সালে নরওয়ে এই ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে সুইডেন নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে এবং এজন্য এসময় সুইডেনের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ/সামরিক অভিযান পরিচালনার কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। এজন্য সামগ্রিকভাবে, সুইডেন সেই স্বল্প সংখ্যক রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যাদের ভূখণ্ডে কখনো ব্রিটিশ আক্রমণ পরিচালিত হয়নি।
উপসংহার
সব মিলিয়ে, বর্তমান বিশ্বে মোট ২২টি রাষ্ট্র রয়েছে, যাদের ভূখণ্ডে ব্রিটেন কখনো সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করেনি বা করতে পারেনি। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ২১টি জাতিসংঘের সদস্য এবং একটি (ভ্যাটিকান) জাতিসংঘের সদস্য নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্রিটেন যে রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডে আক্রমণ চালায়নি, সেগুলোর মধ্যে ১৭টিই সম্পূর্ণভাবে বা প্রায় সম্পূর্ণভাবে স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র, অর্থাৎ ঔপনিবেশিক যুগে এই রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ চালানো পরাক্রমশালী ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না বা খুবই কঠিন ছিল। তদুপরি, এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্তত ৭টি রাষ্ট্রই (অ্যান্ডোরা, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মোনাকো, ভ্যাটিকান, লিখটেনস্টাইন, লুক্সেমবার্গ এবং সাও তোমে ও প্রিন্সিপি) হচ্ছে আয়তনের দিক থেকে অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র এবং সেসময় এগুলোর বিশেষ অর্থনৈতিক বা কৌশলগত তাৎপর্য ছিল না, সুতরাং ব্রিটিশরা এই রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ চালানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, যে রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডে ব্রিটেন কখনো আক্রমণ পরিচালনা করেনি, সেগুলোর বড় একটি অংশ কোনো বৃহৎ শক্তির প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, উক্ত ২২টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৭টি ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ (আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, শাদ, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও মালি) এবং ২টি ছিল ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত (অ্যান্ডোরা ও মোনাকো)। অনুরূপভাবে, উক্ত ২২টি রাষ্ট্রের মধ্যে ৪টি ছিল রাশিয়া/সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ (উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও বেলারুশ) এবং ১টি ছিল রুশ/সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত (মঙ্গোলিয়া)। বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে ব্রিটেন আগ্রহী ছিল না এবং এটি ছিল এই রাষ্ট্রগুলোতে আক্রমণ পরিচালনা থেকে ব্রিটিশদের বিরত থাকার অন্যতম কারণ।
এটাও উল্লেখ্য যে, ব্রিটেন উক্ত রাষ্ট্রগুলোর ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা না করলেও রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশেই হয় কোনো ধরনের সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, নয়তো সেগুলোকে নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত করার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মাত্র একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেনের কোনো সংশ্রব ছিল না বললেই চলে, আর সেই রাষ্ট্রটি হচ্ছে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। সামগ্রিকভাবে, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ২০০টি রাষ্ট্রের মধ্যে যে কেবল ২২টি রাষ্ট্র ব্রিটিশ আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, এই বিষয়টি থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটেনের সমতুল্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর একটিও ছিল না।