ওয়া জাতির সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। হিমালয়ের পূর্বপাশে, তিব্বতের মালভূমিসহ সুদূর দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত সুবিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলে বাস করে অসংখ্য জাতি। সেই আদ্যিকাল থেকে পাহাড়ি এই জনগোষ্ঠী জুমচাষ, পশুপালন এবং গোত্রনির্ভর যে বৈচিত্র্যময় সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তা স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা একরকম অসম্ভব। ওয়ারা এমনই একটি পার্বত্য জাতি। বাস তাদের মায়ানমারের ওয়া প্রদেশে। চীনের দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশেও কয়েক লক্ষ ওয়া জনগণ থাকে।
ওয়ারা স্বাধীনচেতা জাতি। ওয়া ভাষার নিজস্ব কোনো লেখ্যরুপ না থাকায় তাদের ইতিহাস একরকম অন্ধকারাচ্ছন্ন। জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য, যুদ্ধ বা স্রেফ বীরত্ব চরিতার্থ করবার জন্যেই প্রতিবেশী গোত্রগুলোর মানুষের মাথা কেটে নেওয়ার একটি বাজে অভ্যাস ছিল তাদের। এজন্য প্রতিবেশীরা এই হিংস্র জাতিটিকে বিশেষ সুনজরে দেখতো না। ব্রিটিশরাও পাহাড়ি এই জাতির সাথে ব্যয়সাধ্য যুদ্ধের বদলে সামান্য ট্রিবিউট বা ভেটের বদলে ওয়াদেরকে নিজেদের মতো থাকতে দেওয়াটাই শ্রেয় মনে করে।
১৯৪৮ সাল। স্বাধীনতা এলো বার্মায়। ওয়ারা প্রথমে নির্বিঘ্নে থাকলেও পরবর্তী সামরিক জান্তাদের আমলে বেঁধে গেলো যুদ্ধ। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে দু’পক্ষেরই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। শেষমেষ বর্মী জান্তাও ব্রিটিশদের পন্থা অনুসরণ করলো। ওয়ারা একরকম স্বাধীনভাবেই থাকতে লাগলো তাদের প্রদেশে। গৃহযুদ্ধ আমলের জবরদস্ত সেনাদলটাকেও অক্ষুণ্ন রাখবার অধিকার পেয়েছিল ওয়ারা। একরকম স্বাধীন দেশই বলা চলে। সংক্ষেপে এই হলো তাদের ইতিহাস। সমৃদ্ধ এক সংস্কৃতি আছে তাদের, যদিও ব্রিটিশ বা অন্যান্য পক্ষরা তাদেরকে বর্বর হিসেবেই প্রচার চালিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের ইয়াবা সমস্যা
এবারে আসা যাক বাংলাদেশ আর এখানকার ইয়াবা সমস্যা নিয়ে। ক্যাফেইন আর মেথাঅ্যাম্ফেটামাইনের সমন্বয়ে বানানো উজ্জ্বল রঙের এই বড়িগুলো কম-বেশি একযুগ ধরে বাংলাদেশের সরকারের অন্যতম মাথাব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের আইন শৃংখলা বাহিনী কেবল ২০১৬ সালেই তিন কোটির মতো ইয়াবা বড়ি বাজেয়াপ্ত করেছে। ২০১০ সালে ধরা পড়া ইয়াবা বড়ির তুলনায় সংখ্যাটা ৩৫ গুণ বেশি।
এই ছোট্ট উপাত্ত থেকেই পরিষ্কার কী বিপুল পরিমাণে ইয়াবা বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রবেশ করছে! ভয়ের ব্যাপার হলো, খুব সামান্য সংখ্যক ইয়াবাই আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। বেশিরভাগই চলে যায় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরে। আর এই মাদকে আসক্তির প্রভাব যে কী ভয়ানক, তা ২০১৩ সালের একটি ঘটনার কথা স্মরণ করলেই পরিষ্কার হবে। ১৭ বছর বয়সী ঐশী রহমানের হাতে তার বাবা-মা খুন হওয়ার ঘটনায় গোটা দেশে ভীষণ তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল সে সময়। এবং ভয়ের কথা হচ্ছে, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মাদকাসক্তদের হাতে পরিচিতজনের খুন হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এবং আমাদের দেশে এই ঘটনাগুলোর পেছনে অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে এই ইয়াবা।
ইয়াবা দামে সস্তা, চোরাকারবারীদের জন্য এই ছোট্ট বড়িগুলো বহন করাও অনেক সহজ। সম্প্রতি মায়ানমার থেকে বিপুল রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে হাজির হওয়ায় ইয়াবা বহন সংক্রান্ত সমস্যাও অনেক মিটে গিয়েছে। গরীব শরণার্থীরা সামান্য অর্থের লোভে এই মাদক পাচার করে। একটি বহুল ব্যবহৃত ধরণ হচ্ছে প্লাস্টিকে মুড়ে অনেকগুলো ইয়াবা গিলে ফেলা। পরে মলের সাথে সাথে এই বড়িগুলো আবার বের করে আনা হয়। ইয়াবা দামেও সস্তা। বাংলাদেশে সবথেকে প্রচলিত ইয়াবা বড়ি আর-৭ এর একেকটির দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা বলে জানা যায়। তবে দামের ব্যাপারটা খুব বেশি নির্ভরযোগ্য নয়। সরবরাহের ওপরে নির্ভর করে দাম ওঠা-নামা করে।
মায়ানমার আর থাইল্যান্ডের দুর্গম পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে অসংখ্য ইয়াবা ল্যাবরেটরি গড়ে উঠেছে। এখান থেকে ইয়াবা চলে যায় ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, চীনসহ নানা দেশে। সরকারি উদ্যোগের কারণে থাইল্যান্ডের ইয়াবা উৎপাদন অনেক কমে গিয়েছে, আর সেই জায়গাটা দখল করেছে মায়ানমার। চীনে যত ইয়াবা ধরা পড়ে তার ৯০ ভাগই মায়ানমারে তৈরি। মায়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো নানা কড়া ব্যবস্থা নেওয়ায় এসব ইয়াবার মূল গন্তব্য এখন বাংলাদেশ।
আমাদের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ কমবয়সী। মোদক রেঞ্জ সহ দুর্গম পর্বতমালা আর ঘন জঙ্গলের কারণে ২৭০ কিলোমিটার লম্বা বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমানা পাহারা দেওয়াটাও কঠিন এক কাজ। মায়ানমার তার কুখ্যাত নাসাকা বাহিনী বিলুপ্ত করলেও দেশটির বর্তমান সীমান্ত প্রহরীরা আর যা-ই হোক, বিশেষ বন্ধুসুলভ নয়। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের প্রতি ১০টি আহ্বানের বিপরীতে তারা সাড়া দেয় মাত্র একবার। এর সাথে যোগ করুন আমাদের দেশের দুর্নীতি সমস্যা। কাজেই ইয়াবা আসছে, ধ্বংস হচ্ছে দেশের যুবসমাজ।
ওয়া এবং ইয়াবা
১৯৮৯ সালে বার্মিজ কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে যেয়ে বাও ইউজিয়াং ওরফে তাক্স লং পাং ওরফে পাউ ইয়ু চ্যাং নামের এক গেরিলা নেতা ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি গঠন করেন। মায়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী, তাতমাদাও এর এতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এই ওয়া সেনাদল তাতমাদাও এর সাথে মিলে প্রতিবেশী শানদের মাদক কারবারী ওরফে গেরিলা নেতা খুন সা এর মং তাই আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়। অনেকটা এরই পুরস্কার হিসেবে মায়ানমার সরকার ওয়াদেরকে ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের একটি পার্বত্য জমি ছেড়ে দেয়। যদিও কাগজে-কলমে বেলজিয়ামের সমান এই অঞ্চল মায়ানমারের অধীনে, কিন্তু বাও ইউজিয়াং অনেকটা স্বাধীনভাবেই শাসন করেন। সাজোঁয়া যানসহ নানা ভারী যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ওয়া সেনাদের চোখ এড়িয়ে এই অঞ্চলে কোনো কিছু করাটা একরকম অসম্ভব।
ওয়ারা যুদ্ধবাজ জাতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আধুনিক যুগে তো আর ওসব চলে না। ওয়া পাহাড়গুলো পপি চাষের জন্য অতি উত্তম। কাজেই ওয়ারা ঝুঁকে পড়লো পপি আর তা থেকে আফিম আর হেরোইন উৎপাদনের সাথে। এ থেকেই শাসনকাজ বা সেনাবাহিনীর খরচাপাতি উঠে আসতো। মায়ানমার সরকারের কাছে মাদকের থেকে ওই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় ওয়াদের এই রমরমা ব্যবসায় বিশেষ কোনো ছেদ পড়েনি, অন্তত নব্বই এর দশক পর্যন্ত। পরে চীন, থাইল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে পড়ে হেরোইন উৎপাদন বন্ধ হয়। লক্ষাধিক ওয়াকে জোরপূর্বক সমতলের উর্বর জমিতে নিয়ে আসা হয়। তবে এতে সমস্যার সমাধান হয়নি।
ধান, রাবার বা চা থেকে যে আয় হয়, মাদকের আয় তার তুলনায় বহুগুণ বেশি। এছাড়া প্রকান্ড একটি সামরিক বাহিনী থাকায় ওয়া অঞ্চলে মাদক চাষে ঝুট ঝামেলাও কম। কাজেই ওয়ারা হেরোইন উৎপাদন বাতিল করলো বটে, কিন্তু তার জায়গা দখল করে নিল ইয়াবা। আগেই বলা হয়েছে, ইয়াবা পরিবহন বা উৎপাদন করা অনেক সহজ। তাছাড়া ইয়াবার সবথেকে বড় বাজার, বাংলাদেশে ইয়াবা প্রেরণ করার ঝামেলাও কম। মায়ানমার সরকার বা বাও ইউজিয়াং তাই ইয়াবা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না।
ওয়াদের সেনাদল এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবথেকে বড় মাদক কারবারী দল হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশে তারা নিষিদ্ধ। কিন্তু মায়ানমারের মতো বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র, যেখানে খোদ সরকারই পাহাড়-পর্বতে ছাওয়া দুর্গম অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায়, সেখানে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব খুবই সামান্য। কাজেই ওয়া আর্মির তত্ত্বাবধানে নির্বিঘ্নে তৈরি হচ্ছে এই ভয়ানক মাদকদ্রব্য। যদিও ওয়া নেতারা এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেন।
পরিশেষে
মায়ানমারের প্রতিবেশী সরকারগুলো ইতোমধ্যেই ইয়াবা দমন করবার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এরপরেও ধারণা করা হয়, মোট উৎপাদিত ইয়াবার মাত্র ১০ ভাগ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর হাতে ধরা পড়ে। অথচ উদ্যোগ নিলে এটা বন্ধ করাই যায়।
মায়ানমারে বসবাসরত ওয়াদের সংখ্যা লাখ ছয়েক হবে। বিকল্প কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে সহজেই এদেরকে ইয়াবার উৎপাদন থেকে সরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু মায়ানমার সরকারের তেমন কোনো সদিচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। অসমর্থিত বেশ কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী, খোদ তাতমাদাও এর অনেক কর্মকর্তা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে ইয়াবা চালানের সাথে জড়িত। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মাদক কারবারীদের কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। হেরোইনের থেকে ইয়াবা উৎপাদনে খরচ অনেক কম, অথচ ইয়াবার বাজারমূল্য অনেক বেশি। কাজেই দারুণ লাভজনক এই মাদকের সাথে জড়িত রুই-কাতলারা এত সহজে হার মানবে বলে মনে হয় না। আর সেই অবসরে ধ্বংস হতে থাকবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ।