ইতিহাসের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন। পদার্থবিজ্ঞান ও ক্যালকুলাসে তার অবদান অনস্বীকার্য। তবে তার মেধার আলোয় ঢেকে গেছে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। তিনি ছিলেন কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ। বয়স বাড়ার সঙ্গে নিউটনের আগ্রহ ভাগ হয়ে যায় যৌক্তিক বিজ্ঞান আর অযৌক্তিক বিশ্বাসে। এসব বিশ্বাসকে তাড়া করে কম পাগলামিও করেননি তিনি। তাহলে জেনে নেওয়া যাক নিউটনের কিছু পাগলামির ঘটনা।
নিজের মাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন নিউটন
নিউটন বেশ ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি যতটুকু ভালোবাসা ছিল, বাইবেলের প্রতি তার চেয়ে কম নয়। ২০ বছর বয়সে নিউটন ধার্মিক চিন্তা থেকেই নিজের ৫৭টি অপরাধের তালিকা বানান। এর মাঝে বেশিরভাগই ছিল ছোট ছোট কাজ, যা অপরাধ ভাবতেও দ্বিধা হয়, যেমন- চার্চে বসে আপেল খাওয়া, ছোটবোনকে ঘুষি মারা ইত্যাদি। কিন্তু এসব কাজকে পাপের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে ছিল তার ভবিষ্যৎ পাগলামির আভাস। এই তালিকার সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল নিউটন তার মা আর সৎ বাবাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন বলে ঈশ্বরের ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
পরশপাথরের খোঁজে নিউটন
নিউটনের সময়ে পরশপাথর নিয়ে হৈ হুল্লোড় কম হয়নি। অনেকের বিশ্বাস ছিল পরশপাথরের অস্তিত্ব আছে, আর বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা তৈরি করা সম্ভব। এই অনেকের তালিকায় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন নিউটন। পরশপাথর এমন বস্তু, যার ছোঁয়ায় সাধারণ ধাতু সোনায় পরিণত হয়, তার স্পর্শের পানি খেয়ে মানুষ হতে পারে অমর। জীবনের শেষের দিকে তার বিশ্বাস ছিল পরশপাথর আজগুবি কিছু নয়, বরং পরিপূর্ণ বিজ্ঞান।
অ্যালকেমির উপর যেখানে যে কাগজ পেয়েছেন পড়ে শেষ করেছেন তিনি। নিজের গবেষণাগারে তো সবসময় চেষ্টা করেই গেছেন অমরত্বের ওষুধ।
ধারণা করা হয়, নিউটন পারদকে পরশ পাথরের মতো ভাবতেন। নিজের কিছু লেখায় তিনি অন্য অ্যালকেমিস্টদের পারদ থেকে তৈরি বিশেষ ওষুধের কথা বলে গেছেন। দিনের পর দিন তিনি নিজের ল্যাবে পারদ বাষ্প শুষে গেছেন। আরো ধারণা করা হয়, পারদের বিষাক্ত বাষ্পের প্রতিক্রিয়াতেই তার মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। পারদের বিষ তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯৭০ সালে নিউটনের চুলের নমুনা পরীক্ষা করে তাতে স্বাভাবিকের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি পারদ পাওয়া গিয়েছিল।
২০৬০ সালে কেয়ামত
নিউটন বাইবেল ঘেঁটে, অঙ্ক কষে কেয়ামতের সাল জানতে পেরেছেন বলে দাবি করেছিলেন। তিনি বলেন, ২০৬০ সালে বেহেশত থেকে ফেরেশতা নেমে আসবে, ব্যাবিলনের সাম্রাজ্য পতন হবে আর যিশুখ্রিস্ট পুনর্জীবন পাবেন। এই কথাগুলো মোটেও কোনো ছদ্মবেশী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ছিল না। বরং তিনি আক্ষরিক অর্থেই দাবি করেছিলেন ফেরেশতা নেমে এসে আকাশে উড়ে বেড়াবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে নিউটন দাবি করেছিলেন কেয়ামত কিছুদিন পরে হতে পারে, তবে ২০৬০ সালের আগে হবে না। তার কাছে এটা ছিল আর দশটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতোই।
রজঃস্রাবের রক্তে জাদু
পরশপাথর বা ফিলোসফার স্টোনের খোঁজে নিউটন অদ্ভুত সব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। পদ্ধতিগুলোর উপাদান ছিল আরো অদ্ভুত। এদের ভেতর একটা ছিল ‘পতিতা নারীর রজঃস্রাবের রক্ত’!
শুনতে পাগলাটে লাগলেও ধারণা করা হয় এসব একধরনের কোড বা গোপন সংকেত। নিউটন চেয়েছিলে পরশপাথরের সন্ধান যথাসম্ভব গোপনে করবেন, কিন্তু তার মৃত্যুর পর এরকম অনেক কাগজ তার অন্যান্য জিনিসের সাথে থেকে যাওয়ায় প্রকাশিত হয়। গোপন অনুসন্ধান চালু রাখতেই নিউটন সাংকেতিকভাবে উপাদানের নাম লিখতেন। এর প্রমাণ একটা উপাদানের নাম ‘সবুজ সিংহ’। অধ্যাপক বিল নিউম্যানের মতে নিউটন ‘রজঃস্রাবের রক্ত’ বলতে আসলে ধাতব এন্টিমনিকে বুঝিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে ধাতব এন্টিমনির জাদুকরী গুণ আছে বলে বিশ্বাস করা হতো।
এমারেল্ড ট্যাবলেটের রহস্য
আইজ্যাক নিউটনের টুকরো অনেক লেখার মাঝ থেকে পাওয়া যায় নিউটনের হাতে লেখা এমারেল্ড ট্যাবলেটের অনুবাদ। এখানে জানিয়ে দেওয়া ভালো, এমারেল্ড ট্যাবলেট হলো আরেক রহস্যময় জিনিস। পান্নার প্রায় চৌকো এই পাথরে কিছু লেখা খোদাই করা আছে। কিংবদন্তি অনুসারে, এই লেখা স্বর্গীয়। কেউ কেউ বলেন, এটা তৈরি করেছিল হার্মিস ট্রিস্মেগিস্টাস। নি হলেন পাগান অবতার যিনি কিছুটা গ্রিক দেবতা হার্মিস কিছুটা মিশরীয় দেবতা থথ। বলা হয়, এই পাথরেই খোদিত আছে বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, মহাবিশ্বের আকারহীন প্রাথমিক উপাদান, যা কিনা সময়ের শুরুতে শূন্যে গড়ে তুলেছিল সৃষ্টি।
এমারেল্ড ট্যাবলেটের অনুবাদ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি করেছেন। নিউটন সৃষ্টির রহস্য জানতে এমারেল্ড ট্যাবলেটের উপর ভরসা করেছিলেন। আর সেটি যে বড় ঠুনকো নয়, আর তিনি যে কেবল সময় কাটাতে এর অনুবাদ করছেন না, তার প্রমাণ তিনি প্রাথমিক উপাদানের রহস্যভেদ সবসময়েই করতে চেয়েছিলেন। কারণ সেই উপাদান থেকে রূপান্তরিত হতে পারে যেকোনো পদার্থ। নিউটনের এই অনুসন্ধানটিও পরশপাথর ধরনের কিছু তৈরিতে নিয়োজিত ছিল।
সলোমনের মন্দির
নিউটন সলোমনের মন্দিরের বিশাল আর জটিল বিশ্লেষণ লিখেছিলেন। এতটাই গুরুত্বের সাথে কাজটা তিনি করেছিলেন যে নতুন করে হিব্রু আর ল্যাটিন ভাষা শিখেছিলেন, যাতে একটা ছোট সূত্রও তার চোখের আড়াল না হয়। এমনকি তিনি প্রতিটা ঘরের সঠিক দৈর্ঘ্য প্রস্থও পরিমাপ করার চেষ্টা করেছিলেন। নির্মাণশৈলীর প্রতি নতুন আগ্রহ নয়, বরং আরো অনেকের মতো নিউটন বিশ্বাস করতেন সলোমনের মন্দিরে বিশ্ব সৃষ্টির রহস্যের চাবিকাঠি আছে। তার মনে হতো, বাইবেলে অনেক সাংকেতিক সূত্র আছে, একমাত্র কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিই তার সমাধান করতে পারবে। তেমনই এক সূত্র সলোমনের মন্দির। যদি তিনি একবার সলোমনের মন্দিরের চেহারা বের করতে পারেন, তাহলে বিধাতার সৃষ্টিরহস্যও পরিষ্কার হবে তার কাছে।
পৃথিবীর রহস্য খোঁজার কাজ কতটুকু সফল হয়েছিল, তা জানা যায়না।
হারানো শহর আটলান্টিসের খোঁজে
নিউটন বিশ্বাস করতেন তিনি আটলান্টিসকে খুঁজে পাবেন। প্লেটো আর হোমারের ছেড়ে যাওয়া সূত্র ধরে তিনি অনুমান করার চেষ্টা করেছেন আটলান্টিসের অবস্থান। নিউটনের লেখায় দেখা যায়, তার কাছে আটলান্টিস বেশ সাধারণ একটা শহর, যা মহাপ্লাবনে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু তা কিন্তু পানির নিচে ডুবে থাকেনি, বরং বহাল তবিয়তে টিকে ছিল তার কিছু জীবিত অধিবাসীসহ। সেই শহরের রাজকন্যা জীবিতদের একজন। তার নাম ক্যালিপসো। ওডিসিতে ওডিসাস যখন ক্যালিপসোর দ্বীপে নামে, নিউটনের মতে, সেই দ্বীপটি আটলান্টিস। সেখানে ওডিসাস তার জীবিত অধিবাসীদের দেখা পেয়েছিল।
নিউটনের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব অনুযায়ী, আটলান্টিস ১৭৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডুবে যায়। আর ইউলিসিসের অবতরণ ৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ ক্যালিপসোর বয়স তখন হাজার ছুঁয়েছে। নিউটন কিভাবে হিসাব মেলালেন, তা বলা মুশকিল।
শেষের দিকে নিউটন পুরোপুরি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। বেশিরভাগ সময় কাটাতেন আজগুবি সব রহস্যের পেছনে। বন্ধুদের সাথে দেখা হলে এমন সব কথা বলতেন, যার ফলে বন্ধুমহলে নিউটন বেশ অপ্রিয় হয়ে পড়েন। ২৪ ঘন্টায় খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা ঘুমাতেন, কখনো কখনো টানা পাঁচদিন না ঘুমিয়ে পার করতেন, তেমন কিছু মুখেও দিতেন না। সম্ভবত এ কারণে অনেকধরনের ভ্রম বা হ্যালুসিনেশনে পড়তে শুরু করেন। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে আক্রমণাত্মক ব্যবহার করে বসতেন। দার্শনিক জন লক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন নিউটন, বলেছিলেন, “তুমি মরে গেলেই খুশি হব”। এর কারণ হিসেবে নিউটন বলেন তার মনে হয় লক তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। মেরে ফেলার নয়, বরং এই বয়সে নিউটনকে আবার বিয়ে দেওয়ার! লককে দেওয়া এক চিঠিতে নিউটন আগের লেখা চিঠির বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে বলেন তিনি আগে যা বলেছেন, তার কিছুই মনে নেই, যদি খারাপ কিছু হয়, লক যেন তাকে ক্ষমা করেন।
বিজ্ঞানকে শতবর্ষ এগিয়ে দেওয়া লোকটাই কতরকম কুসংস্কারে বাঁধা পড়েছিল, ভাবতে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু তার অবদানের কল্যাণে এতসব পাগলামি অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায়।
ফিচার ইমেজ: mplus.com.tw