শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকের চক্ষু চড়কগাছ! ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরাসরি অভিযুক্ত হয়েছিলেন, এমন তথ্য হয়তো অনেকেরই অজানা। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই ক্রমবর্ধমান ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব নির্দিষ্ট ভারতীয় সীমানাকে ছাড়িয়ে একই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থী ও অভিবাসীদের মধ্যেও জাতীয়তাবাদী অনুভূতির উত্থান ঘটিয়েছিল। এভাবেই জন্ম নেয় ‘গদর পার্টি’ নামে প্রবাসী ভারতীয়দের সম্মিলিত এক আন্দোলন, যার লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী পন্থায় ব্রিটিশদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা।
সেই সাথে ব্রিটিশবিরোধী কিছু আন্তর্জাতিক মদদ আন্দোলনকে বহুল আলোচিত করে তোলে। এই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আমেরিকা এ আন্দোলনের বিচারকার্য ‘হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র‘ নামে পরিচালনা করে। এ ষড়যন্ত্রে দেশি-বিদেশি অভিযুক্তদের মধ্যে উঠে এসেছিল বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও। কিন্তু কেন?
গদর পার্টির উত্থান
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ফলে সৃষ্ট মনোভাব সহিংসতায় বিশ্বাসী বিপ্লবীদের কাছে ব্রিটিশ শাসন অবসানের একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় সশস্ত্র আন্দোলন, যা ব্রিটিশদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় দর্শন ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক লালা হার দয়াল জাতীয়তাবাদী ধারণা দেওয়ার সময় অভিবাসী ও ছাত্রদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সোহান সিং ভকনাকে প্রেসিডেন্ট করে ‘প্যাসিফিক কোস্ট হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন‘ গঠিত হয়।
হরদয়ালের সম্পাদনায় গদর (অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের উর্দু প্রতিশব্দ) নামে একটি উর্দু পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে ‘হিন্দুস্তান গদর’ রাখা হয়। এ নাম থেকেই তাদের সংগঠনের নাম হয়ে যায় ‘গদর পার্টি’। গদর দলটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া, ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ভারতীয় প্রবাসীদের মধ্যে এক বড় সমর্থনের সন্ধান পায়।
মূলত গদর পার্টির ক্রিয়াকলাপ যখন শুরু হয়, ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। সেই সাথে ব্রিটিশ বিরোধী বৃহৎ শক্তিগুলোর থেকে বড় ধরনের সাহায্যের সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশবিরোধী ইম্পেরিয়াল জার্মানি এবং অটোম্যান সাম্রাজ্য উভয়ই ‘গদর পার্টিকে’ সমর্থন যুগিয়েছিল। ভারতীয় মাটিতে বিপ্লব জোরদার করার জন্য আপাতদৃষ্টিতে তখন ছিল উপযুক্ত সময়। গদর পার্টির কিছু সদস্য পাঞ্জাবে এসেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লব চালাতে। তারা অস্ত্র পাচার এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সেনাদের বিদ্রোহের দিকে উদ্বুদ্ধ করতেও সফল হয়েছিল।
বার্লিন ভারত কমিটির সদস্য লালা হার দয়াল, মওলানা বরকতউল্লাহ, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ, ভাই পরমানন্দ প্রমুখ প্রায়শই মস্কো, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ক্যারিবিয়ান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে যাতায়াত করতেন। তারা বিপ্লবের জন্য সম্ভাব্য সবধরনের সহায়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময় তারা জার্মানির আর্থিক সহযোগিতায় চীন থেকে জাহাজভর্তি অস্ত্র কিনে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত স্বদেশীদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। গোপন এ পরিকল্পনা কিছু মূল কুশীলবকে ধরার পরই প্রকাশ পায়।
সুকুমার চ্যাটার্জি একজন বিপ্লবী যাকে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ১৯১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের পর থেকেই অনুসরণ করছিল এবং ১৯১৭ সালে তাকে ব্যাংককে গ্রেপ্তার করা হয়। চ্যাটার্জি তদন্তকারীদের জার্মান রিয়েল এস্টেট এজেন্ট থেকে অর্থ গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করেন। তার হাতে থাকা পরিকল্পনার মধ্যে ছিল ভারতে বিদ্রোহীদের কাছে মণিলা এবং ব্যাংককের মাধ্যমে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রেরণ। পরে দেখা যায় চ্যাটার্জি এবং তার সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা প্রয়োজনীয় অস্ত্র কেনার জন্য জার্মান কূটনীতিক এবং অর্থদাতাদের কাছ থেকে সত্যিই অর্থ যোগান পেয়েছিলেন। যা-ই হোক, ব্যাপক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারি এড়িয়ে বিপ্লবটি সফল হতে পারেনি। উল্টো নিজেদের ভূখণ্ডে বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য গদর পার্টির কর্মীদের বিচার শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
চক্রান্তে যেভাবে জড়াল রবীন্দ্রনাথের নাম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালের ২৭ অক্টোবর প্রথমবার যখন আমেরিকায় পৌঁছান, তখন হরদয়ালের সঙ্গে তার দেখা হয়নি, যদিও কবি তাকে চিনতেন। তবে দেখা যার সঙ্গে হয়েছিল, তিনি হলেন ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম রবি-জীবনীর লেখক বসন্ত কুমার রায়। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্মৃতিকথা অনুসারে, বসন্ত কুমার বিপ্লবী না হলেও অন্যান্য ভারতীয় বিপ্লবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। তবে ধন গোপাল মুখোপাধ্যায়ের সাথে কবির সাক্ষাৎ হয়েছিল, যিনি নিজে ছিলেন বিপ্লবী এবং যার সঙ্গে বিপ্লবীদের সবার পরিচয় ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম আমেরিকা সফরের চেয়ে দ্বিতীয়টি ছিল অনেক বেশি চাঞ্চল্যকর। সাহিত্যে প্রথম এশীয় হিসেবে নোবেলপ্রাপ্তি আমেরিকায় তাকে ক্রমশ জনপ্রিয়তার চূড়ায় নিয়ে যায়। ১৯১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছালে তাকে নিয়ে বিপুল সংবর্ধনার খবর ঢালাওভাবে প্রচার করে মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর পৌঁছান সান ফ্রান্সিসকোতে।
আমেরিকায় যাওয়ার পথে জাপান ভ্রমণকালে কট্টর জাতীয়তাবাদের যে নিন্দা কবি করেছিলেন, তা প্রবাসী ভারতীয়দের নিকট সুখপ্রদ হয়নি। ২রা অক্টোবর সেন্ট ফ্রান্সিস হোটেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বক্তৃতায় বলেন, “মোগল সাম্রাজ্য এবং অন্য সব শাসকবর্গের তুলনায় ব্রিটিশ শাসক শ্রেয়।” এখানেই শেষ নয়, তিনি নিজের বক্তব্যে এটাও যুক্ত করেন যে, “ভারত স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রস্তুত নয়”। তার এমন সব কথাবার্তা যেন আগুনে ঘি ঢালে। প্রবাসী বিপ্লবীদের মনে সন্দেহ হতে শুরু করে, কবির আমেরিকা যাত্রার উদ্দেশ্য হিন্দু বিপ্লবকে মন্থর করা। তাই তারা তার বক্তৃতা বন্ধ করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
‘খালসা দিওয়ান সোসাইটি’র প্রধান অধ্যাপক, বিষেণ সিং মাট্টু তার দুই সঙ্গী নিয়ে হোটেলে রবীন্দ্রনাথকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে গেলে বিপ্লবী রামচন্দ্রের দুই সহযোগী এক হাত কাটা জিওয়ান সিং ও এইচ সিং হাতেশি তাদের বাধা দেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। একপর্যায়ে বিষেণ সিংয়ের পাগড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাধাদানকারীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করলে তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়। বিচারে যে অর্থদণ্ড হয় তাদের, সেটি পরিশোধ করেন রামচন্দ্র।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রামচন্দ্র কে? ‘প্যাসিফিক কোস্ট হিন্দুস্তান অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা লালা হার দয়াল হিন্দুস্তান গদর প্রকাশের জন্য জার্মানি থেকে অর্থ সাহায্য নিতেন। ফলস্বরূপ, পুলিশি ঝামেলায় পড়ে তিনি নিজেই একসময় আমেরিকা ছাড়তে বাধ্য হন। আর তখন গদর পার্টির দায়িত্ব এসে পড়ে রামচন্দ্র ভরদ্বাজের ওপর। যা-ই হোক, বিষেণ সিং আর রামচন্দ্রের অনুসারীদের মারামারির ঘটনা সাধারণ হলেও সংবাদমাধ্যম মসলা মাখিয়ে তবেই প্রচার করে। যেমন- ‘ট্যাগোর ভিজিটর হিট বাই হিন্দুস’ থেকে শুরু করে ‘প্লট এগেইনস্ট হিন্দু পোয়েট’।
এমনকি রবীন্দ্রনাথ শহর থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন, এমন সংবাদও ছাপা হয়েছিল- ‘হিন্দু পোয়েট ফ্লিস ফ্রম রিপোর্টেড অ্যাসাসিনেশন প্লট’। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন লিখেছিল, ‘ইউএস জুরি শিফটিং ইন্ডিয়া প্লট টু গেট ভন আইগেল’স পেপারস’। অভিযুক্ত হিসেবে যাদের নাম ছাপা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী। খবরে বলা হয়েছে, চন্দ্র নিয়মিত রামচন্দ্রের নিকট সংবাদ পাঠাতেন। দীর্ঘ সংবাদের নিচে আরও একটি সম্পর্কযুক্ত সংবাদ হলো, ‘জার্মান প্লটস টু এইড রেভল্যুশনস ইন ইন্ডিয়া নৌন অ্যাট ওয়াশিংটন’। একই তারিখে দ্য ডে বুক পত্রিকাটি সংবাদ ছেপেছিল, ‘সান ফ্রান্সিসকো হিন্দুস প্ল্যান্ট রেভল্যুশন’ শিরোনামে। বলা হয়েছিল, দু’মাস তদন্ত শেষে প্রমাণিত হয়েছে যে সানফ্রান্সিসকোতে বসবাসরত হিন্দুদের ইন্ধনে চীনের সহযোগিতায় ভারত জুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশ দখলের ষড়যন্ত্র চলছে।
৮ এপ্রিল, ১৯১৭ সালে ডেইলি মিসৌরিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে, রামচন্দ্রসহ মোট নয়জনকে আটক করেছে পুলিশ। ১৯১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এল পাসো হেরাল্ড পত্রিকাটি ব্যানার হেডিং করে লেখে ‘ল্যান্সিং টু টেস্টিফাই ইন হিন্দু প্লট’। প্রতিবেদনের একটি উপশিরোনাম ছিল, ‘ট্যাগোর’স টেস্টিমোনি’। তখন জাপান ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ ‘টেস্টিমোনি’ করতে আমেরিকায় যাবেন, স্বীকারোক্তিতে এমন কথা বলেছিলেন রামচন্দ্র।
দু’দিন পরেই, ২৮ ফেব্রুয়ারির সংবাদে বোমা ফাটিয়ে নিউ ইয়র্ক ট্রিবিউন লিখল: ‘ট্যাগোর নেমড উইথ জাপানিজ অ্যাট প্লট ট্রায়াল’। উপশিরোনাম হিসেবে এলো, ‘অকুমা অ্যান্ড তেরাউচি ফিগার ইন হিন্দু কারেসপন্ডেন্স’। উল্লেখ করে বলা হলো, সরকার কর্তৃক গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতে এটি দাবি করা হয় যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভারতীয় ষড়যন্ত্রীদের যোগাযোগ রয়েছে।
১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে এসে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলায় রবীন্দ্রনাথের নামটি যুক্ত হয়ে যায়। যুক্ত করার পেছনের মানুষটি ছিলেন চন্দ্রকান্ত। ভারতে বিপ্লব চালনার জন্য তিনি জার্মানি থেকে আর্থিক সহায়তা পেতেন। ১৯১৬ সালের ২১ নভেম্বর এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
“Rabindranath has come at our suggestion and saw Count Okuma, Baron Shrimpei Goto, Massaburo Suzuki, Marquis Yamanuchi, Count Terauchi and others. Terauchi is favourable and others are sympathetic.” 10 Jan 1917
অর্থাৎ,
রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরামর্শে এসে দেখেছেন কাউন্ট ওকুমা, ব্যারন শ্রিম্পেই গোটো, ম্যাসাবুরো সুজুকি, মারকুইস ইয়ামানুচি, কাউন্ট তেরাউচি প্রমুখ। তেরাউচি অবিরুদ্ধ এবং অন্যেরা সহানুভূতিশীল।
পরে, ১৯১৭ সালে গদর পার্টি বার্লিন কমিটিকে তিনি লিখেছিলেন,
“Rabindranath Tagore thinks, if he now goes to Sweden, he may be suspected and his usefulness curtailed. His intention is to hasten home and do whatever he can…. We have given him 12,000 dollars. ”
অর্থাৎ,
“রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন, তিনি যদি এখন সুইডেনে যান, তবে তিনি অভিযুক্ত হতে পারেন এবং তার সুবিধাজনকতা হ্রাস পেতে পারে। তার উদ্দেশ্য হলো, বাড়িতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসা এবং ফিরে এসে তিনি যা কিছু করতে পারেন …. আমরা তাকে ১২,০০০ ডলার দিয়েছি।”
আর এভাবেই হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথি অনুযায়ী এসব তথ্য একে একে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
মামলার রায় ও রবি ঠাকুরের ভাগ্য
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের বিচার শুরু হয় ১৯১৭ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে। ১৫৫ দিন ধরে চলা এই বিচারকার্য পরের বছরের ২৪ এপ্রিল শেষ হয়। বিচারটি পরিচালনা করতে মার্কিন সরকারকে ৪,৫০,০০০ ডলার ব্যয় করতে হয়। ব্রিটিশদের জন্যও এটি ছিল ২.৫ মিলিয়ন ডলারের এক বিরাট অঙ্ক। এ মামলায় আসামিদের মধ্যে ছিলেন নয়জন জার্মান নাগরিক (ওয়াশিংটন ডিসি এবং সান ফ্রান্সিসকোতে কনস্যুলার অফিসের বেশ কয়েকজন কূটনীতিকসহ), নয়জন আমেরিকান এবং ১৭ জন ভারতীয়, যারা মূলত গদর পার্টির কর্মী ছিলেন। ভারতীয়দের মধ্যে তারকনাথ দাস, চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী, রামচন্দ্র, গোবিন্দ বিহারী লাল, ভগবান সিং, গোপাল সিং এবং সন্তোষ সিংহ অন্যতম।
এই মামলার সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে রায় ঘোষণার দিন আদালত প্রাঙ্গণে, যখন রামচন্দ্রকে তার সহযোগী রাম সিং পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। পরে কোর্টে দায়িত্বরত অস্ত্র বহনকারী কর্মকর্তা (মার্শাল) পিস্তলের গুলিতে ভূপতিত করেন রাম সিংকে।
এবার আসা যাক রবি ঠাকুরের কাছে। মজার কথা হচ্ছে, নিজের নাম যে এই মামলায় জড়িয়ে গেছে, এ খবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আসার আগেই রায় ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল।
সংবাদটি পেয়ে ১৯১৮-এর ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের কাছে একটি চিঠি পাঠান রবীন্দ্রনাথ। চিঠি পৌঁছাতে দেরি হতে পারে ভেবে তাকে একটি টেলিগ্রামও করেছিলেন।
পরে ১৭ জুন ভারতবর্ষের তৎকালীন ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল লর্ড চেমসফোর্ডের ব্যক্তিগত সচিব রবীন্দ্রনাথকে একটি সহমর্মিতামূলক টেলিগ্রাম পাঠান, যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত থাকায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং কবি যে সকল অভিযোগ থেকে মুক্ত- এ বিষয়ে তাকে নিশ্চিত করেন।
ব্যাপক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এ মামলার নিষ্পত্তি হলেও আন্দোলন থেমে যায়নি। বরং গদর পার্টির স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। এ আন্দোলনকে চরম বীরত্ব, কঠোর পরিশ্রমের কাহিনী হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এর নেতাদের শক্তিশালী বক্তৃতা দূরবর্তী উপকূলে বসবাসকারী প্রতিটি ভারতীয়ের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। এটি সত্যিকার অর্থে একটি বড় লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন করে, যা মানুষকে স্বাধীনতার জন্য নতুন উদ্যমে লড়াই করতে উৎসাহিত করে এবং ভবিষ্যতের আন্দোলনগুলোর বীজ বপন করে।