Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইউরো-জয়ের দৌড়ে যারা এগিয়ে: জোয়াখিম লো’র জার্মানি

জাতি হিসেবে জার্মানদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে নিয়মানুবর্তিতা ও দক্ষতা। তারা তাদের প্রতিটি সেক্টরেই তাদের এই বৈশিষ্ট্যটি নিয়ে গিয়েছে। তাদের ফুটবলেই বা সেটা বাদ থাকবে কেন? তাদের জাতীয় ফুটবল দলটিকে দেখবেন প্রচণ্ড সংগঠিত, শারীরিকভাবে মোটামুটি সবাই শক্তিশালী ও কর্মক্ষম। ফুটবলে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখা কিশোরদেরকেও দেখবেন কঠোরভাবে এই অনুশাসনগুলো মেনে চলতে। তাদের ট্রেইনিং সেশন কিংবা লাইফস্টাইল – সব ক্ষেত্রেই তারা সর্বস্ব উজার করে দিতে চায়। 

২০১৮ সালের বিশ্বকাপ ছিল জার্মানির জন্য একটি বড় দুঃস্বপ্ন। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপপর্বে চার পয়েন্ট নিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হয় তাদের। শেষ খেলায় একদম শেষ মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে দুই গোল খেয়ে হারতে হয় তাদের। দলের উপর বেশ কিছু কোপ পড়ে এর পরপরই। দোষ চাপানো হয় দলের সিনিয়র খেলোয়াড়দের উপরে। দল থেকে বাদ পরেন ওজিল, মুলার, খেদিরা, গোমেজসহ বেশ কিছু খেলোয়াড়। নতুন করে তাদের দলকে গোছানোর পরিকল্পনা করতে হয়। কোচ জোয়াখিম লো দলে নিয়ে আসেন বেশ কিছু তরুণকে। তাদের পরীক্ষার জন্য নামানো হয় ন্যাশনস লিগে। সেখানে তেমন আশানুরূপ ফল না এলেও জার্মান ফুটবলের নতুন সূর্যোদয় যে হচ্ছেই, তা অনুমেয়ই ছিল। তাদের শুধু দরকার ছিল একদম ফ্রেশ একটি স্টার্ট।

হতাশায় নিমজ্জিত জার্মান দল; Image Credit: D. Martinez

জার্মানি এই ফ্রেশ স্টার্টের সুযোগটাও পায় ভালোভাবেই। দলে নিয়মিত হওয়া তরুণদের মধ্যে ন্যাব্রি বায়ার্ন মিউনিখে, লেরয় সানে ম্যানচেস্টার সিটিতে, টিমো ভার্নার লাইপজিগে, কিমিখ বায়ার্ন মিউনিখে প্রতিপক্ষের উপর রীতিমতো স্টীম রোলার চালাচ্ছিলেন। তাদের দলে একসাথে খেলিয়ে কম্বিনেশন ঠিক করার সুযোগটি ভালোভাবেই কাজে লাগান লো। কিন্তু এরপরই সমস্যা দেখা দেয় ফুলব্যাক অপশনে। কোনোভাবেই এমন দুইজন ফুলব্যাককে পাচ্ছিল না জার্মানি, যাতে চারজনের রক্ষণভাগ খেলানো যায়। দেখা যাচ্ছিল, তাদের ভুলেই জার্মানির গোলপোস্টে বল বেশি আসছে।

লো তাই সিদ্ধান্ত নিলেন দীর্ঘদিনের ৪-২-৩-১ ফরমেশন থেকে সরে আসার। এবার জার্মান দলটিকে বিশ্ব দেখল নতুন করে ৩-৪-৩ ফরমেশনে। একজন ডিফেন্ডার বাড়তি যোগ করায় তাদের রক্ষণভাগ হয়ে গেল আরো শক্তিশালী। পাওয়ার ফুটবল, প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা জার্মানিকে দেখা গেল এবার রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতে। ২০১৮ সালের ভরাডুবিকে ভুলে ২০১৯ সালে আস্তে আস্তে ফিরছিল জার্মান দল আগের মতো করে।

কিন্তু আবারও ছন্দপতন ২০২০ সালে। নিজেদের হারিয়ে খুঁজতে শুরু করলো জার্মানি, ধারাবাহিকতাটাও আর ছিল না। মাঠে অভিজ্ঞতার অভাবে ভুগেও বেশ কয়েকবার হারতে হয় তাদের। এই অনভিজ্ঞদের জন্য দরকার ছিল কিছু অভিজ্ঞ দলনেতার। ২০২০ সালের ইউরো পিছিয়ে ২০২১ সালে হওয়াতে তাই তাদের জন্য ভালোই হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় কিছু ফুটবলার এই সময়ে ফিরে পেয়েছেন তাদের হারানো ফর্ম। লো এবার দল গঠনের সময় তাদের নিয়েই দল গড়েছেন।

জার্মানির ইউরো স্কোয়াডের দিকে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যায়, দারুণভাবে ব্যালান্স করা হয়েছে সব পজিশনেই। বড় মঞ্চের অভিজ্ঞ টমাস মুলার ফিরে আসাতে তরুণরাও দারুণ সহায়তা পাবেন তার কাছ থেকে বিভিন্নভাবেই। এছাড়াও আরেক অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার ম্যাট হামেলসও জায়গা পেয়েছেন স্কোয়াডে।

২০১৬ সালের ইউরোর পর থেকে জার্মানি আর নিজেদের নামের সুবিচার করতে পারেনি। তবে এবারের স্কোয়াডটি জার্মান ভক্তদের মনে দারুণ আশা জাগাচ্ছে।

ম্যানুয়েল নয়্যারের মত নির্ভরযোগ্য হাতেই রয়েছে জার্মানদের নেতৃত্ব; Image Credit: A. Hassenstein

গোলরক্ষক

এবার ইউরোতে যদিও চারজন গোলরক্ষককে নেয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, জার্মানির এই দলে গোলরক্ষক হিসেবে জায়গা পেয়েছেন তিনজন – ম্যানুয়েল নয়্যার, বার্নড লেনো ও কেভিন ট্র্যাপ। ইনজুরির কারনে ছিটকে গিয়েছেন মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান। নয়্যারের পর তিনিই ছিলেন দলের দ্বিতীয় পছন্দ। দুই বদলি গোলরক্ষক লেনো ও ট্র্যাপের মান নিয়ে কোনো সংশয় না থাকলেও গত মৌসুমে তাদের পারফরম্যান্স তাদের ক্লাবের হয়ে খুব আহামরি কিছু ছিল না। তাই নয়্যারের নির্ভরযোগ্য কোনো বিকল্প দলে নেই, সেটা বলতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না।

তবে নয়্যারকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। গত দুই মৌসুম ধরে বায়ার্ন মিউনিখের মধুচন্দ্রিমা কাটছে। গত মৌসুমেই জিতেছেন ট্রেবল। চলতি মৌসুমে ৪৬টি খেলায় ৫৫টি গোল হজম করলেও ক্লিনশিট রেখেছেন ১৪টি খেলায়। তার বদলি থাকা অন্য দুই গোলরক্ষক লেনো ও ট্র্যাপ রাখতে পেরেছেন যথাক্রমে ৪৯টি খেলায় ২৬টি ও ৩৫টি খেলায় ৪টি ক্লিনশিট। ক্লিনশিটে বেশ খানিকটা পিছিয়ে থাকলেও লেনোর চাইতে নয়্যার এগিয়ে আছেন বল ডিস্ট্রিবিউশিন, কমান্ডিং ও পজিশনিং সেন্সের ক্ষেত্রে। নিজের ভুলে লেনোর গোল খাওয়ার পরিমাণও বেশি। সেদিক দিয়ে বলা যায়, ৩৫ বছর বয়সী ‘সুইপার কিপার’ নয়্যারই তাদের একমাত্র অপশন।

রক্ষণভাগ

জার্মানি তাদের দলের জন্য মোট ১১ জন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়কে স্কোয়াডে নিয়েছে। এই লিস্টে আছেন ম্যাথিয়াস গিন্টার, রবিন গোসেন্স, ক্রিস্টিয়ান গান্টার, মারসেল হ্যালস্টেনবার্গ, ম্যাট হামেলস, লুকাস ক্লস্টারম্যান, রবিন কচ, অ্যান্তোনিও রুডিগার, নিকোলাস শ্যুল ও জোনাস হফম্যান।

ম্যাট হামেলস দলে ফিরে আসাতে গত দুই বছর ধরে জার্মান রক্ষণভাগ যে অনভিজ্ঞতায় ভুগছিল, তার অনেকটাই দূর হবে আশা করা যায়। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হয়ে তার সাম্প্রতিক ফর্ম তাকে দলে ফিরিয়ে এনেছে। এই মৌসুমে ডর্টমুন্ডকে জিতিয়েছেন ডিএফবি-পোকাল ট্রফিও। যদি হামেলস নামেন, তবে শ্যুল হতে পারেন তার সবচেয়ে যোগ্য পার্টনার। বায়ার্ন মিউনিখের এই বিশালদেহী সেন্টারব্যাক চাইলে খেলতে পারেন রাইটব্যাকেও।

রক্ষণভাগে চমক ম্যাট হামেলসের ফিরে আসা; Image Credit: Thomas Eisenhuth

বরুশিয়া মুনশেনগ্ল্যাডবাখের রক্ষণভাগ এই মৌসুম ছিল বুন্দেসলিগার দ্বিতীয় সেরা। সেই রক্ষণভাগের সদস্য গিন্টারকে দলের বাইরে রাখা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে, চেলসিতে থাকা অ্যান্তোনিও রুডিগারও আছেন দারুণ ফর্মে। চেলসির প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষ চারে ও চ্যাম্পিয়নস লিগে দুর্দান্ত সাফল্যের পেছলে রুডিগারের অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। জার্মানির ডিফেন্সের অন্যতম সিনিয়র এই খেলোয়াড় ক্লাবে নতুন কোচ টমাস টুখেলের অধীনে ২৭ ম্যাচে রেখেছেন ১৮টি ক্লিনশিট। অন্য চারজন সেন্টারব্যাকের মধ্যে শ্যুল, হালস্টেনবার্গ ও গ্লিন্টার দারুণ ছন্দে ছিলেন তাদের ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ, লাইপজিগ ও বরুশিয়া মুনশেনগ্ল্যাডবাখে। ক্লাবের প্রথম একাদশের নিয়মিত এই তিনজন খেলেছেন ৩০টিরও বেশি খেলায়। আর তরুণ ডিফেন্ডার রবিন কচ কিছুটা সুযোগ কম পেলেও তার ক্লাব লিডস ইউনাইটেডের হয়ে নেমেছিলেন ১৭টি খেলায়।

এই টুর্নামেন্টে জার্মানির ফুলব্যাকে আগের মতো কোনো ওয়ার্ল্ড ক্লাস খেলোয়াড় নেই। এই দলে লেফটব্যাক বা লেফট উইংব্যাকে খেলার জন্য লড়বেন রবিন গোসেন্স ও ক্রিস্টিয়ান গান্টার। আর ডানদিকে থাকবেন লুকাস ক্লস্টারম্যান বা জোনাস হফম্যান। কোচ জোয়াখিম লো তার দলের ‘বেস্ট ফিট’ রাইটব্যাক হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন। সম্প্রতি বুন্দেসলিগার দ্বিতীয় দল লাইপজিগে সন্তোষজনক ফর্মেই রয়েছেন ক্লস্টারম্যান। তাকেই খুব সম্ভবত রাইট উইংব্যাক হিসেবে খেলাবেন লো। আর সিরি-আ’র দল আটালান্টায় খেলা গোসেন্স এই মৌসুমে করেছেন ১২টি গোল ও করিয়েছেন ৮টি গোল। রক্ষণভাগের দায়িত্ব সামলে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের জন্য ভয়াবহ একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেন তিনি।

মধ্যমাঠ

জার্মানির মধ্যমাঠ ইউরোর অন্য যেকোনো দল থেকে অবশ্যই এগিয়ে থাকবে। জোয়াকিম লো তার স্কোয়াডে এবার ডেকেছেন এমরি চান, লিওন গোরেৎজকা, ইলকায় গুন্ডোয়ান, জশুয়া কিমিখ, টনি ক্রুস, ফ্লোরিন নেউহাউস, সার্জ ন্যাব্রি, টমাস মুলার, জামাল মুসিয়ালা ও লেরয় সানেকে।

দলের মূল ইঞ্জিন হিসেবে বিবেচিত টনি ক্রুস; Image Credit: AS

 

জশুয়া কিমিখকে বর্তমানে বিশ্বের সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের একজন ধরা হয়। ২৬ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে নিয়মিতই মাঠ কাঁপাচ্ছেন। অ্যাসিস্টের দিক দিয়ে মুলারের পরই তিনি আছে দ্বিতীয় স্থানে। জেরোম বোয়াটেংয়ের পরই সবচেয়ে বেশি পাসিং অ্যাক্যুরেসি তার। অনেকদিন রাইটব্যাক হিসেবে খেললেও হ্যান্সি ফ্লিকের অধীনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবেই বেশি সুনাম কুড়ান তিনি। অন্যদিকে জার্মান স্নাইপার টনি ক্রুসও বিশ্বের সেরা কিছু নাম্বার এইটদের একজন। তার পাসিং অ্যাক্যুরেসি, রেজিস্ট্যান্স ও বল দখলের ক্ষমতা অন্য যে কারোর থেকেই ভালো। ডিপে খেলে লাইন ব্রেকিং পাসের মাধ্যমে ভাল সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেন তিনি দলের জন্য। আরেক ‘নাম্বার এইট’ ইলকায় গুন্ডোয়ান এই মৌসুমে তার ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটির অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। আর বায়ার্ন মিউনিখে গত দুই মৌসুম ধরে খুবই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স করছেন গোরেৎজকা। মাংসপেশীর ইনজুরির জন্য গোরেৎজকাকে এবার দলে কম দেখা যেতে পারে। তার পরিবর্তে গুন্ডোয়ানই খেলতে পারেন তার মোবিলিটি আর পাসিং সিস্টেমে খেলা খেলোয়াড় হিসেবে।  এমরি চ্যানকে এই মৌসুমের বেশিরভাগ সময়ই তার ক্লাব বরুশিয়া ডর্টমুন্ডে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলতে হলেও কিমিখের যোগ্য ব্যাকআপ তাকেই ধরা হচ্ছে। তরুণদের মধ্যে নেউহাউস দারুণ খেললেও এই টুর্নামেন্টে শুধু দলের সাথে থেকে অভিজ্ঞতারই সঞ্চার করার সম্ভাবনা বেশি তার।

এছাড়া ‘রমডয়টার’ টমাস মুলার ফিরে আসাতে জার্মান অ্যাটাকে আলাদা করে স্কিল আর শক্তি বৃদ্ধি পাবে। ৩১ বছর বয়সী মুলার এই মৌসুমে করেছেন ১৫টি গোল ও করিয়েছেন ২৪টি গোল। জার্মানির সবচেয়ে ভালো ফর্মে থাকা খেলোয়াড় এখন তিনিই। মুলারকে খেলালে একই সাথে স্ট্রাইকার, উইঙ্গার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার সব জায়গাতেই সার্ভিস পাওয়া যাবে তার কাছ থেকে। গোল করা বা অন্যকে দিয়ে করানো – সব দিক থেকেই মুলার সেই ২০১০ বিশ্বকাপ, ২০১৪ বিশ্বকাপ কিংবা ২০১৬ ইউরোতে দলের অপরিহার্য সদস্য ছিলেন। ২০১৮ সালে দলে তাকে শেষ দেখা গেলেও টানা নয়বার লিগ জেতা বায়ার্ন মিউনিখের অপরিহার্য সদস্য তিনি।

মুলার ছাড়াও আরো আছেন তার তিন ক্লাবমেট ন্যাব্রি, সানে ও মুসিয়ালা। ওয়াইড মিডফিল্ডার রোলে তাদের মাঠে দেখা যেতে পারে। সানে ও ন্যাব্রির মূল একাদশে খেলার সম্ভাবনা খুবই বেশি। ন্যাব্রি কিছুটা ইনজুরিপ্রবণ হলেও জাতীয় দলে প্রতি ৯৮ মিনিটে ১ গোল করা এই খেলোয়াড়কে কোচ বেঞ্চে বসিয়েও রাখতে চাইবেন না। সানেকেও কোচ যেকোনো উইংয়েই চাইলে খেলাতে পারবেন। জামাল মুসিয়ালা এই দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ খেলোয়াড়। ১৮ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার মুলারের ব্যাকআপ হিসেবেই এসেছেন দলে।

তারুণ্যনির্ভর জার্মানির আক্রমণভাগ ও মধ্যমাঠ; Image Credit: Observer

 

আক্রমণ

জার্মানির আক্রমণভাগ নিয়েই বাধবে গণ্ডগোল। স্ট্রাইকার পজিশনে এই স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছেন টিমো ভার্নার, কাই হ্যাভার্টজ ও কেভিন ভোল্যান্ড। সমস্যা হচ্ছে, কেউই খুব একটা ভরসা যোগাতে পারছেন না। 

গত মৌসুমে অনেক আশা তৈরি করে লাইপজিগ থেকে চেলসিতে যোগ দেওয়া ভার্নারের মৌসুম মোটেও স্ট্রাইকারসুলভ ছিল না। বেশ কিছু সহজ সুযোগ কাজে লাগাতে না পেরে চেলসিকে বিপদে ফেলেছিলেন। তবে অন্যকে দিয়ে গোল করানোর কাজটা মোটামুটি ভালোই করেছিলেন। প্রচুর মিস করেও ১২টি গোল ও ১৫টি অ্যাসিস্ট রয়েছে তার নামের পাশে।

চেলসির আরেক নতুন সাইনিং কাই হ্যাভার্টজের মৌসুমও শুরুর দিকে ভালো না হলেও আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছিলেন চেলসির সিস্টেমের সাথে। ‘ফলস নাইন’ হিসেবে নতুন রোলে খেলার সুবাদে তার ফর্মের উন্নতিও হয়েছে অনেক। তার করা একমাত্র গোলে চেলসি জিতেছে এই মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ।

তবে তাদের ছাপিয়ে এই মৌসুমের সেরা জার্মান স্ট্রাইকার ছিলেন মোনাকোর কেভিন ভোল্যান্ড। মোনাকোর হয়ে এই মৌসুমে করেছেন ১৬টি গোল, যা টপ পাঁচ লিগে খেলা যেকোনো জার্মান খেলোয়াড়ের চাইতে বেশি।

জার্মানদের আশার প্রতীক হাভার্টজ ও ভার্নার; Image Credit: Sky Sports

 

খেলার ধরন

শুরুতেই বলা হচ্ছিল জার্মানদের গুছিয়ে কাজ করার স্বভাবটা নিয়ে, বলা হয়েছিল শৃঙ্খলার দিক থেকে তাদের কড়াকড়ির ব্যাপারটাও। জার্মানি ফুটবল দলটাও প্রচণ্ডরকম গোছানো এবং কার্যকর। ডিসিপ্লিনড ও হার্ডওয়ার্কিং ফুটবলই তাদের বৈশিষ্ট্য। 

লং পাসে খেলার জন্য দলের খেলোয়াড়দের ফিজিক্যালি একটু শক্তিশালি হতে হয়, যাতে এরিয়াল ব্যাটল জিতে বল দখলে নিতে পারে তারা। সচরাচর একজন টার্গেটম্যানকে সামনে রেখে খেলে তারা। এই টার্গেটম্যানকেই সব বল সাপ্লাই দেওয়া হয়। নিজের দৈহিক গড়নের সুবিধা নিয়ে তিনি বলটি নিজে নিয়ে নেবেন কিংবা বল হোল্ড করে টিমমেটের কাছে পাস দেবেন। তবে এই পদ্ধতিতে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে খেলতে নেমে টিমো ভার্নারের ফিজিক্যালিটির অভাবে উপযুক্ত টার্গেটম্যান না পেয়ে স্ট্রাইকার দিয়ে কোনো গোলই করতে পারেনি জার্মানি।

মাঠে থাকা খেলোয়াড়দের সবার জন্য আলাদা একটি নির্দিষ্ট রোল ঠিক করা থাকে। খুব কমই দেখা যায় তাদেরকে তাদের জায়গা ছেড়ে চলে আসতে। একমাত্র ‘রমডয়টার’ টমাস মুলারেরই এইদিকে স্বাধীনতা পেয়েছেন। তাদের এই দৃঢ়ভাবে ফরমেশন ধরে রাখার পর তারা আক্রমণে যায় ‘ডিরেক্ট পাসিং’ পদ্ধতিতে। ছোট ছোট পাসে বিল্ডআপ বা অহেতুক কোনো ব্যাকপাস তাদের খেলায় আশা করা চলে না। হয়তো এই পদ্ধতিটি শৈল্পিক নয়, তবে জার্মানির জন্য সাফল্য ঠিকই নিয়ে আসে।

প্রতিটি পজিশনে এই শক্তিমত্তা ধরে রাখায় যেকোনো মুহূর্তে নিজেদের উপরে পড়া চাপ প্রতিপক্ষের উপর আবার চাপিয়ে দিতে পারে তারা। এতে করে কুইক কাউন্টার অ্যাটাক আর দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে তারা গোল পেয়ে যায়। এইরকম অ্যাটাকিং ফুটবল খেলার ফলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি প্রতিযোগিতাতেই জার্মানির কোনো খেলোয়াড় প্রথম পাঁচজন গোলদাতার তালিকায় আছেন।

দলের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট টমাস মুলারের ফেরা; Image Credit: Getty Image

দুর্বলতা

এই ইউরোতে জার্মানি দলের দুর্বলতা বললে বলতে হবে তাদের ফুলব্যাক অপশন আর ফিনিশিং নিয়ে। ফুলব্যাক অপশন হিসেবে যাদের নেয়া হয়েছে, তারা ফুলব্যাক পজিশনে তুলনামূলক কম নির্ভরযোগ্য। তাদের উইংব্যাক হিসেবে খেলানো যাবে ভালোভাবেই, কিন্তু ফুলব্যাক হিসেবে তারা ঠিক পূর্বসূরী জার্মান ফুলব্যাকদের মতো নিশ্ছিদ্র নন।

অন্যদিকে ফরোয়ার্ড অপশনে থাকা টিমো ভার্নার আর কাই হ্যাভার্টজ গত মৌসুমের ফর্মের ছিঁটেফোটাও এই মৌসুমে দেখাতে পারেননি। চেলসির হয়ে মৌসুমের শুরুতে তাদের নিয়ে যে হাইপ তৈরি হয়েছিল, তার বিচারে তাদের অসফলই বলা যায়। টিমো ভার্নার এর আগেও ২০১৮ বিশ্বকাপ ট্র্যাজেডির সাক্ষী ছিলেন। সেখানে খেলা তিন ম্যাচের তিনটিতেই সুপার ফ্লপ ছিলেন তিনি।

তাই তাদের প্রতিপক্ষ যদি তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উইং দিয়ে অ্যাটাক করে আর জার্মানির অ্যাটাকিং থার্ডে বল পৌঁছাতে না দেয়, তবে জার্মানিকে তারা সহজেই থামাতে পারবে। আবার কোনো কারণে যদি নয়্যার ইনজুরিতে পড়েন, তবে এই সুইপার কিপারের অভাবে জার্মানির রক্ষণভাগটা আরো দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে জার্মানির মূল শক্তি তাদের গোলপোস্টের নিচে আর মিডফিল্ডে। যদি নয়্যার ঠিকভাবে ইনজুরিমুক্ত অবস্থায় এই টুর্নামেন্টটি শেষ করতে পারেন, তবে প্রতিপক্ষের জন্য জার্মানির জাল খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হবে। আর তাদের মিডফিল্ডে থাকা টমাস মুলার, টনি ক্রুস, ইলকায় গুন্ডোয়ান ও জশুয়া কিমিখ চারজনই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। মুলারের স্পেস খুজে নেওয়া, ক্রুসের পিনপয়েন্ট নির্ভুল পাস, গুন্ডোয়ানের শ্যাডো মুভিং, আর কিমিখের ইন্টারসেপশন প্রতিপক্ষের জন্য দুঃস্বপ্ন নিয়ে আসতে যথেষ্ট।

জার্মানির ইউরো ২০২০ স্কোয়াড লিস্ট; Image Credit: DFB

 

সম্ভাব্য লাইনআপ

জার্মানি এবার ৩-৪-৩ ফরমেশনে তাদের দল নামাতে পারে। গোলমুখে থাকবেন যথারীতি নয়্যার। তার সামনে রক্ষণদূর্গ গড়বেন শ্যুল, হামেলস, এবং গিন্টার। মিডফিল্ডে ক্লস্টারম্যান, কিমিখ, ক্রুস, এবং গোসেন্স হতে পারেন জোয়াখিম লো’র প্রথম পছন্দ। আর অ্যাটাকে ন্যাব্রি-মুলার-ভার্নার ত্রয়ীর উপরই হয়তো ভরসা রাখবেন কোচ। 

জার্মানি কাগজে-কলমে টুর্নামেন্টের সেরা দল ঠিক নয়। তবে তাদের সম্ভাবনাটাও নেহায়েত উড়িয়ে দেওয়া চলে না। দ্য অ্যানালিস্টের প্রেডিকশন মডেল বলছে, জার্মানদের এই টুর্নামেন্ট জয়ের সম্ভাবনা ৯.৮ শতাংশ, যা কি না ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল থেকে বেশি; তাদের চেয়ে বেশি টুর্নামেন্ট জয়ের সম্ভাব্যতা কেবল ফ্রান্স (২০.৫%), বেলজিয়াম (১৫.৭%), এবং স্পেনের (১১.৩%)।

কিন্তু দিনশেষে ফুটবল একটি দলগত খেলা। যাদের মধ্যে বোঝাপড়া ও সমঝোতা ভাল থাকবে, তারাই সফল হবে। জার্মানির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমন। একটি ইউনিট হিসেবে খেলা জার্মানি অন্য যেকোনো দলের চেয়েই বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ইঞ্জিনের মতো প্রচণ্ড হাই-প্রেসিংয়ে ফুটবল খেলে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে তারা বরাবরই পারঙ্গম। দলে সম্ভাবনার অভাব নেই, তরুণ এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মিশ্রণটাও হয়েছে আশাজাগানিয়া। ১৫ বছর ধরে দলের হাল ধরে রাখা জোয়াখিম লো’র দলের সাথে এটিই শেষ সফর। তিনিও চাইবেন বিদায়বেলায় জার্মানির ক্যাবিনেটে আরেকটি ট্রফি যোগ করে যেতে। সব মিলিয়ে ১৯৯৬ সালের পর আবারও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের সুবর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে এবার তাদের সামনে। তবে সেগুলোর আগে তাদেরকে পার হতে হবে গ্রুপপর্ব, যেখানে তাদের মোকাবেলা করতে হবে ২০১৮ বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স এবং সর্বশেষ ইউরোজয়ী পর্তুগালকে। রাস্তাটা যে খুব একটা পুষ্পসজ্জিত হবে না, সেটা তো বলাই বাহুল্য!  

Related Articles