বছর জুড়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করা সেরা এগারো ক্রিকেটারকে নিয়ে সাজানো হয়েছে রোর বাংলার বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশ। ২০১৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে অন্যতম, ইংল্যান্ডের প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতা। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের পর সম্পূর্ণ নতুন দল এবং নতুন মুখদের নিয়ে ‘অলআউট অ্যাটাক’ স্টাইলে খেলে সফলতা পাওয়া শুরু করে ইংল্যান্ড। যার ফল হিসাবে চার বছর পর বিশ্বকাপ জিতে তারা।
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজিত হয়ে বিদায় নেওয়া বাদ দিলে পুরো বছরে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছিল ভারত। তাই বর্ষসেরা একাদশে ভারতের চারজন এবং চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের তিনজন জায়গা করে নিয়েছেন। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে একজন করে জায়গা করে নিয়েছেন রোর বাংলার বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশে।
১. রোহিত শর্মা (ভারত)
ওয়ানডে ক্রিকেটে ওপেনার হিসাবে ব্যাট করতে নামার পর ধারাবাহিকভাবে সফলতা পাওয়া রোহিত শর্মা ২০১৯ সালেও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করা রোহিত নয় ম্যাচে পাঁচটি শতক হাঁকিয়ে ৮১.০০ ব্যাটিং গড়ে ৬৪৮ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে সব মিলিয়ে ২৭ ইনিংসে সাতটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৭.৩০ ব্যাটিং গড়ে ১,৪৯০ রান সংগ্রহ করেছেন।
২. জেসন রয় (ইংল্যান্ড)
ইনিংসের শুরু থেকেই বোলারদের উপর চড়াও হয়ে ম্যাচ নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে বড় ভূমিকা পালন করেন ইংল্যান্ডের লিমিটেড ওভার ক্রিকেটের ওপেনার জেসন রয়। তিনি ওপেনার হিসাবে ব্যাট করে ইতঃমধ্যে তিন হাজারের অধিক রান করেছেন ১০৭.৪০ স্ট্রাইকরেটে। জেসন রয় ২০১৯ সাল শুরু করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮৫ বলে ১২৩ রানের ইনিংসের মধ্য দিয়ে। বিশ্বকাপের আগে সর্বশেষ ওয়ানডে ইনিংসেও ৮৯ বলে ১১৪ রান করেন।
এই বিধ্বংসী ওপেনার ইনজুরির কারণে বিশ্বকাপে চার ইনিংস ব্যাট করতে পারেননি। মাত্র সাত ইনিংস ব্যাট করেই দলকে শিরোপা-লড়াইয়ে টিকিয়ে রাখেন তিনি। বিশ্বকাপে সাত ইনিংসে একটি শতক এবং চারটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৪৩ রান করেছিলেন। পুরো বছরে মাত্র ১২ ইনিংসে ব্যাটিং করে তিনটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৭০.৪১ ব্যাটিং গড়ে এবং ১১৮.১৮ স্ট্রাইকরেটে ৮৪৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
৩. বিরাট কোহলি – অধিনায়ক (ভারত)
বরাবরের মতো ২০১৯ সালেও ব্যাট রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন ভারতের অধিনায়ক এবং বর্তমানের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলি। এইবছর তার ব্যর্থতা হিসাবে থাকবে বিশ্বকাপ। পুরো আসরে দুর্দান্ত খেলার পরেও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে আধঘণ্টা খারাপ খেলে সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে তার দল। ইনিংস বড় করার ক্ষেত্রে অতুলনীয় কোহলি ২০১৯ সালে পাঁচটি শতক হাঁকালেও বিশ্বকাপে নয় ম্যাচে পাঁচটি অর্ধশতকের বিপরীতে একটিও শতক হাঁকাতে পারেননি তিনি। বিশ্বকাপে টানা পাঁচ ইনিংসে অর্ধশতক হাঁকানো কোহলি আসরে মোট ৪৪৩ রান করেছিলেন ৫৫.৩৭ ব্যাটিং গড়ে। ওয়ানডে ক্রিকেটে ২০১৯ সালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক কোহলি ২৫ ইনিংসে পাঁচটি শতক এবং সাতটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫৯.৮৬ ব্যাটিং গড়ে ১,৩৭৭ রান সংগ্রহ করেছেন।
৪. বাবর আজম (পাকিস্তান)
পাকিস্তানের ‘পরবর্তী ব্যাটিং কিংবদন্তি’ বাবর আজম ইতঃমধ্যে নিজের প্রতিভা প্রদর্শন করে ফেলেছেন। তার দৃষ্টিনন্দন কাভার ড্রাইভগুলো একেবারে বইয়ের ভাষার মতো। বিশ্বকাপে তার দল শেষ চারে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হলেও তিনি ব্যাট হাতে সফল ছিলেন। আট ইনিংসে একটি শতক এবং তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬৭.৭১ ব্যাটিং গড়ে ৪৭৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন বাবর আজম। পাকিস্তানের নড়বড়ে ব্যাটিং লাইনআপের মূল স্তম্ভ হয়ে এই ডানহাতি টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান ২০১৯ সালে ২০ ইনিংস ব্যাটিং করে তিনটি শতক এবং ছয়টি অর্ধশতকের সাহায্যে ৬০.৬৬ ব্যাটিং গড়ে ১,০৯২ রান করেছেন।
৫. সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)
বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। বাংলাদেশের জয় পাওয়া তিন ম্যাচেই তিনি ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন। আসরের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ রানের ইনিংস দিয়ে শুরু করার পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২১ রান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৯ বলে অপরাজিত ১২৪ রানে ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বকাপে আট ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছিলেন। বাকি এক ম্যাচে করেছিলেন ৪১ রান।
বিশ্বকাপে আট ইনিংসে ৮৬.৫৭ ব্যাটিং গড়ে ৬০৬ রান করা সাকিব আল হাসান ২০১৯ সালে ১১ ইনিংসে দু’টি শতক এবং সাতটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৯৩.২৫ ব্যাটিং গড়ে ৭৪৬ রান সংগ্রহ করেছেন। ২০১৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে স্পিনাররা তেমন সফলতা না পাওয়া সত্ত্বেও সাকিব ১১ ইনিংসে ১৩ উইকেট শিকার করেছেন। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপে ২৯ রানের বিনিময়ে পাঁচ উইকেট শিকার করে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি।
৬. বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)
২০১৯ সালের আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতানো অলরাউন্ডার বেন স্টোকস। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৮৯ রানের ম্যাচজয়ী ইনিংস দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন স্টোকস। আসর শেষ করেছিলেন ফাইনালে ৮৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে। তার ৯৮ বল এবং ১৪৭ মিনিটের দুর্দান্ত ইনিংসের কল্যাণেই ইংল্যান্ড শিরোপা ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
বেন স্টোকস বিশ্বকাপে দশ ইনিংস ব্যাট করে পাঁচটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৬৬.৪২ ব্যাটিং গড়ে ৪৬৫ রান সংগ্রহ করেছেন। ম্যাচের মোড় ঘুরানো এই অলরাউন্ডার ২০১৯ সালে ওয়ানডেতে ১৭ ইনিংসে সাতটি অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৫৯.৯১ ব্যাটিং গড়ে ৭১৯ রান সংগ্রহ করেছেন। বল হাতেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়া স্টোকস ১৯ ইনিংসে বোলিং করে ১২ উইকেট শিকার করেছেন।
৭. জস বাটলার (উইকেটরক্ষক)
বিশ্বকাপের নাটকীয় ফাইনালের সুপার ওভারে মার্টিন গাপটিলকে রান আউট করে ইংল্যান্ডের শিরোপা জয় নিশ্চিত করেছিলেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান জস বাটলার। এই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ইনিংসের শেষ পর্যায়ে ব্যাট করতে এসে চোখের পলকে ম্যাচের দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
বাটলার ২০১৯ সালে ১৬ ইনিংসে তিনটি শতক এবং দুটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪৭.৬৪ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৩৫.৫৬ স্ট্রাইকরেটে ৬৬৭ রান সংগ্রহ করেছেন। উইকেটরক্ষক হিসাবে তার ডিসমিসাল সংখ্যা ২৪টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০১৯ সালের শুরুতে মাত্র ৭৭ বলে ১৫০ রানের ইনিংস খেলার পর বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলেছিলেন ৫৫ বলে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংস। তবে ২০১৯ সালে তার সেরা ইনিংস হিসাবে আলোচনায় আসবে ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬০ বলে ৫৯ রানের ইনিংসটি।
৮. মিচেল স্টার্ক (অস্ট্রেলিয়া)
ইনজুরির কারণে ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার খেলা মোট ওয়ানডে ম্যাচের অর্ধেকের বেশি ম্যাচে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল বাঁহাতি পেসার মিচেল স্টার্ককে। বছরের দ্বিপাক্ষিক ওয়ানডে সিরিজের ম্যাচ খেলতে না পারলেও বিশ্বকাপের সবক’টি ম্যাচ খেলেছিলেন স্টার্ক। বিশ্বকাপে দশ ম্যাচে দুইবার চার উইকেট এবং দুইবার পাঁচ উইকেট শিকার করে সর্বোচ্চ ২৭ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। মাত্র ১৮.৫৯ বোলিং গড়ে এবং ২০.৫ স্ট্রাইকরেটে তিনি এই উইকেট শিকার করেন।
৯. ট্রেন্ট বোল্ট (নিউ জিল্যান্ড)
২০১৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারিদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন নিউ জিল্যান্ডের পেসার ট্রেন্ট বোল্ট। নতুন বলে দুইদিকেই সুইং আদায় করে নিতে পারা বোল্ট তার উদ্বোধনী স্পেলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন। তার এক স্পেলেই ম্যাচের গতিপথ নির্ধারণ হয়ে যায়। তিনি ২০১৯ সালে ২০ ম্যাচে ২৩.৯৭ বোলিং গড়ে ও ৩০.৫০ স্ট্রাইকরেইটে ৩৮ উইকেট শিকার করেছেন। তার ৩৮ উইকেটের ১৭ উইকেটই এসেছে বিশ্বকাপে। মাত্র দুই বিশ্বকাপ খেলেই তিনি নিউ জিল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের কীর্তি গড়েছেন।
১০. মোহাম্মদ শামি (ভারত)
২০১৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামি। তিনি ২১ ম্যাচে ২২.৬৪ বোলিং গড়ে এবং ২৫.৩০ স্ট্রাইকরেটে ৪২ উইকেট শিকার করেছেন। বছরজুড়ে ধারাবাহিকভাবে সফলতা অর্জন করা এই পেসার বিশ্বকাপে ভারতের ব্যাকআপ পেসার হিসাবে খেলেছিলেন। তিনি মাত্র চার ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েই ১৪ উইকেট শিকারের পরও সেমিফাইনালে ভারতের মূল একাদশে খেলার সুযোগ পাননি।
১১. কুলদ্বীপ যাদব (ভারত)
২০১৯ সালে সব ফরম্যাটেই পেসারদের সাফল্যের পাল্লা ছিল ভারী। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেরা ১৮ উইকেট সংগ্রাহকদের সবাই ছিলেন পেসার। গত বছরে স্পিনারদের মধ্যে সফলতা পেয়েছিলেন ভারতের দুই স্পিনার কুলদ্বীপ এবং চাহাল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকার করেছেন কুলদ্বীপ। এই চায়নাম্যান বোলার ২৩ ম্যাচে ৩৪.৬৮ বোলিং গড়ে ৩২ উইকেট শিকার করেছিলেন। বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশে সাকিব আল হাসানের পাশাপাশি একমাত্র স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসাবে তাই জায়গা করে নিয়েছেন কুলদ্বীপ। তিনি আইসিসির ২০১৯ সালের বর্ষসেরা ওয়ানডে একাদশেও একমাত্র স্পিনার হিসাবে জায়গা করে নিয়েছেন।