গত ১০ মে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের আগ্রাসন এবং ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। এই হামলার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বাহিনী ‘হামাস’ ইসরায়েলের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ শহরকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন পাল্লা এবং আকারের রকেট নিক্ষেপ করে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর তথ্যানুসারে, ২১ মে যুদ্ধবিরতির পূর্বে হামাস ইসরায়েলের অভিমুখে ৪,৩৬৯টি রকেট ছুড়েছিল। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ রকেট লক্ষ্যচ্যুত হয়ে বিরানভূমি এবং মাঠে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এরপরেও প্রায় ১,৫০০ রকেট ইসরায়েলের ভূখণ্ডের দিকে তীব্র গতিতে ধেয়ে আসে।
কিন্তু এতে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল একেবারেই নগণ্য। কারণ তাদের আকাশে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোৎকৃষ্ট প্রয়োগে সৃষ্ট এক দুর্ভেদ্য অদৃশ্য দেয়াল। সেই দেয়ালেই আটকে গেছে প্রায় ৯০ শতাংশ রকেট। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এখানে আয়রন ডোমের কথাই বলা হচ্ছে। আজ আমরা আয়রন ডোমের উৎপত্তি এবং এর অভাবনীয় কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।
সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল ভূমি দখল করে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার পর থেকেই প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর চক্ষুশূলে পরিণত হয়। প্রতিনিয়তই তাদের মাঝে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। ‘৯০ এর দশক থেকে লেবাননের সশন্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের জনবহুল অঞ্চলে রকেট নিক্ষেপ শুরু করে। এর ফলে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাই রকেট হামলা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ২০০৪ সালে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা করে।
২০০৬ সালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধে হিজবুল্লাহ পাঁচ সপ্তাহে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে ৪,০০০ এর মতো স্বল্প পাল্লার Katyusha রকেট নিক্ষেপ করে। সেই রকেট হামলায় ইসরায়েলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হাইফাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই যুদ্ধে ৪৪ জন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়। কমপক্ষে আড়াই লাখ মানুষকে দেশের অন্যত্র সরিয়ে আনা হয়। প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ রকেটের হাত থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়।
এদিকে গাজা থেকে ইসরায়েলের দক্ষিণে মাঝে মাঝেই হামাস রকেট নিক্ষেপ করত। তারাও ২০০০-০৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় ৪,০০০ রকেট এবং ৪,০০০ মর্টার নিক্ষেপ করে। তাদের ছোড়া স্বল্প পাল্লার রকেটের অধিকাংশই ছিল কাস্সাম (Qassam) রকেট।
ইসরায়েল সরকার তখন তাদের আকাশসীমায় শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে ২০০৭ সালে নতুন প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। সেই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (সংক্ষেপে MAFAT) তাদের আকাশসীমায় আগত রকেটের গতিপথ পরিবর্তনে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং উপযুক্ত প্রযুক্তির খোঁজ শুরু করে।
আমেরিকার প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান Northrop Grumman লেজার বিমের সাহায্যে ধেয়ে আসা রকেট বা মিসাইলগুলোকে ভস্ম করে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। তাদের তৈরি পণ্য নটিলাসকে ‘স্কাইগার্ড’ হিসেবে নতুন নামে বিক্রি করার ইচ্ছা পোষণ করে। এছাড়াও Raytheon কোম্পানি রকেট ধ্বংসের জন্য ফায়ার গান প্রয়োগের প্রস্তাবনা দেয়। তাদের সেই পদ্ধতির নাম দেয় Phalanx system। আমেরিকার নৌবাহিনীর জাহাজের নিরাপত্তায় এই সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। তবে ইসরায়েলের স্বদেশী প্রতিষ্ঠান রাফায়েল সম্পূর্ণ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। তারা রকেট বিধ্বংসী মিসাইল (Interceptor missile) তৈরির কথা জানায়। এই মিসাইলগুলো আকাশপথে আগত রকেটের গতিপথ অনুসন্ধান করে সেগুলো আকাশেই ধ্বংস করে দেবে। ফলে ভূমিতে কোনোরূপ হতাহত ঘটার সম্ভাবনা থাকবে না।
স্বদেশী পণ্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণের জন্য ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আমির পেরেটজ ‘রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম’ কোম্পানিকে ইসরায়েলের আকাশরক্ষার দায়িত্ব দেন। তাদের সেই প্রকল্পে ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ সহায়তা প্রদান করে।
তবে প্রকল্পটির জন্য রাফায়েলকে দুটি শর্ত দেওয়া হয়। প্রতিটি রকেট প্রতিহত করার ব্যয় ১ লাখ ডলারের কম হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ৩০ মাসের মধ্যে তৈরি করতে হবে। এই ধরনের প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে সাধারণত ১৫ বছর সময় লাগে। তাছাড়া ইসরায়েলের কারখানাতে তৈরি করা ভূমি থেকে বায়ুতে উৎক্ষেপণযোগ্য একটি আধুনিক মিসাইল তৈরিতে প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রাফায়েল এই প্রজেক্টে কাজ করতে সম্মত হয়।
নামকরণের ইতিহাস
আকাশ প্রতিরক্ষা প্রকল্প গৃহীত হলেও এর কোনো নাম তখনও ছিল না। প্রজেক্টের পরিচালক কর্নেল চ্যানোচ লেভিন এবং তার সহকর্মীরা তখন প্রকল্পের নাম নির্বাচনে লেগে পড়েন। লেভিন প্রথমে ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের নাম ভেবেছিলেন Anti-Qassam। তবে প্রকল্পের কাজ শুরু হলে তিনি এই নাম নিয়ে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
একদিন তিনি তার স্ত্রীর সাথে বাসায় বসেছিলেন। তিনি সেই নামকরণের সমস্যার কথা স্ত্রীকে জানান। তখন তারা দুজন মিলে রকেট বিধ্বংসী মিসাইলের নতুন নাম খোঁজা শুরু করেন। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর তার স্ত্রী অ্যান্টি মিসাইলের নাম প্রস্তাব করেন ‘তামির’ (হিব্রু ভাষায় এর নাম Til Meyaret)। তারা দুজন মিলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাম দেন ‘গোল্ডেন ডোম’ (হিব্রু ভাষায় Kippat Zahav)।
তিনি এই দুটি নামের প্রস্তাব দিলে কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের নাম হিসেবে তামির ( Tamir) নির্বাচিত করে। তবে গোল্ডেন ডোম নামটি নিয়ে তারা আপত্তি জানায়। তারা ভেবেছিল, এই নাম ব্যবহার করলে প্রকল্পটি অনেক ব্যয়বহুল বলে ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হতে পারে। তাই তারা আরেকটি সহজলভ্য ও তুলনামূলক কম দামী ধাতুর নাম ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। অনেক আলাপ-আলোচনা করার পর সর্বসম্মতিক্রমে ইসরায়েল আকাশ প্রতিরক্ষা প্রকল্পের নাম রাখা হয় ‘আয়রন ডোম’ (হিব্রু ভাষায় Kippat Barzel)।
আয়রন ডোমে ব্যবহৃত করা যন্ত্রসমূহের বিবরণ
আয়রন ডোম সিস্টেমটি মূলত তিনটি যন্ত্রের পারস্পরিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত।
১) রাডার সিস্টেম: আয়রন ডোম সিস্টেমের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি অংশ হলো রাডার সিস্টেম। শত্রুপক্ষের ছোড়া প্রতিটি মিসাইল বা রকেট ও এর গতিপথ সঠিকভাবে শনাক্ত করতে রাডারের বিকল্প নেই। তবে সময় স্বল্পতার কারণে নতুন কোনো রাডার অ্যারে তৈরির সুযোগ ছিল না। তাই রাফায়েল কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পে ইসরায়েলি রাডার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ELTA Systems এর তৈরি ভূমিতে স্থাপিত রাডার EL/M-2084 ব্যবহার করে। রাডারটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এর চারপাশের প্রায় ৭০ কিলোমিটারের (৪৩ মাইল) মধ্যে থাকা বস্তুগুলোকে নিয়মিত স্ক্যান করতে থাকে।
২) কন্ট্রোল ইউনিট: আয়রন ডোমের কন্ট্রোল ইউনিটকে বলে Battle Management & Weapon Control (BMC) ইউনিট। ইসরায়েলি সফটওয়্যার কোম্পানি mPrest Systems রাফায়েলের নির্দেশনা অনুযায়ী এই যন্ত্রটি তৈরি করে। এর মূল কাজ হলো রাডার থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে অ্যাডভান্সড অ্যালগরিদমের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যেই মিসাইল বা রকেটকে শনাক্ত ও এর গতি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করা। রকেটের গতি সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাশিগুলোর (গতিবেগ, নিক্ষেপণ কোণ, লক্ষ্যবস্তু,পাল্লা, পতনকাল, বিচরণকাল ইত্যাদি) মান জানতে ঊচ্চমাধ্যমিকের পদার্থবিজ্ঞানের বইয়ে থাকা প্রাস বা নিক্ষিপ্ত বস্তুর দ্বিমাত্রিক গতির সমীকরণগুলো কন্ট্রোল ইউনিটের অ্যালগরিদমে ব্যবহার করা হয়। কন্ট্রোল ইউনিটই মূলত রাডার এবং রকেট ধ্বংসকারী মিসাইলের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
৩) মিসাইল ফায়ারিং ইউনিট: রাফায়েলের নিজেদের তৈরি করা এই ইউনিটের মাধ্যমে আকাশপথে ধাবমান রকেটকে ধ্বংস করতে তামির মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। সবচেয়ে সূক্ষ্ম এবং সংবেদী এই মিসাইল উৎক্ষেপক যন্ত্রের কর্মদক্ষতার উপরই আয়রন ডোম সিস্টেমের সফলতা নির্ভর করে। তাই তামিরকে নিক্ষেপ করলে সেটা তার চারপাশের সকল ক্ষুদ্র বস্তুকে যেন নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারে সেই ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ প্রতিবার লক্ষ্যবস্তুকে সফলভাবে আঘাত করা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিটি মিসাইলের সাথেই সুইচ সদৃশ লেজার নিয়ন্ত্রিত একধরনের ফিউজ ব্যবহার করা হয়। এর ফলে টার্গেট করা রকেট বা মিসাইল তামিরের গতিপথের ১০ মিটারের মধ্যে আসলেই ফিউজটি সক্রিয় হয় এবং মিসাইল বিস্ফোরিত হয়ে যায়। সেই বিস্ফোরণ থেকে উৎপন্ন তাপ এবং উত্তপ্ত বস্তুর প্রভাবে রকেটটি ধ্বংস হয়ে যায়।
এই তিনটি ইউনিট ধারণকারী অংশকে আয়রন ডোম ব্যাটারি বলে। প্রতিটি ডোম ব্যাটারিতে ৩-৪টি মিসাইল উৎক্ষেপক বা লঞ্চার থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে ২০টি তামির মিসাইল থাকে। একটি তামির মিসাইল দশ ফুট লম্বা এবং এর ওজন ২০০ পাউন্ড। প্রতিটি লঞ্চারকে পৃথকভাবে স্থাপন করা হয়। সেগুলো দূরবর্তী স্থান থেকে তারবিহীন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। আয়রন ডোম ব্যাটারিগুলো সবসময় সচল এবং গতিশীল থাকে। ব্যাটারির কন্ট্রোল ইউনিটের কর্মকর্তাদের তাই সবসময় দৌড়ের উপর থাকতে হয়। কারণ রকেট যেকোনো সময় যেকোনো দিক থেকেই আসতে পারে। তাই সীমান্তবর্তী অঞ্চল রক্ষার্থে তাদের ইসরায়েলের এক প্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে যেতে হয়। বর্তমানে ইসরায়েলের কাছে ১০টি আয়রন ডোম ব্যাটারি আছে। আইডিএফের ধারণানুযায়ী, আকাশপথের হামলা থেকে পুরো ভূখণ্ডকে সুরক্ষিত রাখতে তাদের সর্বমোট ১৩টি আয়রন ডোম ব্যাটারি প্রয়োজন।
আয়রন ডোম যেভাবে কাজ করে
ইসরায়েলের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তবর্তী স্থানে আয়রন ডোম ব্যাটারিগুলোকে রাখা হয়। আয়রন ডোমের রাডার তার নির্ধারিত সীমার মাঝে অনবরত স্ক্যানিং চালাতে থাকে। ফিলিস্তিনের গাজা অথবা লেবানন থেকে ছোড়া স্বল্পপাল্লার রকেটগুলোকে শনাক্ত করার সাথে সাথে রকেট সাইরেন অ্যালার্ট বেজে ওঠে। সেই সাইরেনের সাথে নারীকণ্ঠে বিপদ সংকেত হিসেবে ‘কালার রেড! কালার রেড!’ শব্দগুলো ধ্বনিত হয়। সাইরেন এবং শব্দ শুনলেই হামলার সম্ভাব্য স্থানের লোকজন দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। অনেকে রাস্তায় চলতে থাকলে মাটিতে শুয়ে পড়ে অথবা গাড়িতে ঢুকে যায়।
সাইরেন শোনার সাথে সাথে কন্ট্রোল ইউনিটের (BMC) পাঁচজন সামরিক ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তারা সজাগ হয়ে ওঠে। তারা তখন কম্পিউটারে চলমান প্রোগ্রামিং অ্যালগরিদমের সহায়তায় রকেটের গতিবেগ, গতিপথ, পাল্লা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। এই তথ্য-উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করে তারা রকেটের পতনের সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করে। রকেটটি জনবহুল কোনো জায়গা বা লোকালয়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকলে একমাত্র তখনই ফায়ারিং ইউনিটকে লঞ্চার থেকে ইন্টারসেপ্টর মিসাইল নিক্ষেপের জন্য ফায়ার বাটন চেপে কমান্ড দেয়া হয়। তারবিহীন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পাঠানো সেই ইলেক্ট্রনিক সংকেত পাওয়া মাত্রই ফায়ারিং ইউনিটের লঞ্চার থেকে রকেটকে ধ্বংস করতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তামির মিসাইল ছোড়া হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে আয়রন ডোম সিস্টেমের কর্মকর্তারা হামলার জায়গাভেদে সর্বনিম্ন ১৫ সেকেন্ড থেকে সর্বোচ্চ ৯০ সেকেন্ড বা দেড় মিনিট সময় পান! এই ক্ষুদ্র সময়ের আগে রকেট বিধ্বংসী মিসাইল নিক্ষেপ করতে না পারলে সেটা লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করবে।
কিন্তু আয়রন ডোম সিস্টেমের নিয়োজিত সদস্যরা এই স্বল্প সময়ের মাঝেই তাদের কাজ শেষ করে। যার ফলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তামির মিসাইল আকাশপথে ধাবমান স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার রকেট বা মিসাইলকে আকাশেই গুড়িয়ে দেয়। এভাবে একটি আয়রন ডোম ব্যাটারি তার চারপাশের আড়াই থেকে ৪০ মাইল এলাকা জুড়ে আকাশপথে এক অদৃশ্য নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করে।
এমন ক্ষিপ্র ও কার্যকরী আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থার নজির পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। আর সেই কারণেই আয়রন ডোমের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
অ্যানিমেশনের মাধ্যমে আয়রন ডোম সিস্টেমের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপস্থাপন; video credit: businessinsider.com
আয়রন ডোমের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
যেকোনো প্রজেক্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিস হলো বাজেট আর সময়। আয়রন ডোম প্রজেক্টও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এই প্রজেক্টের বেধে দেয়া সময় আর বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাই প্রকল্পে রকেট ধ্বংস করার পেছনে অর্থব্যয় কমাতে প্রকল্পের নীতিনির্ধারক মহল সবসময় সচেষ্ট ছিল। এই প্রসঙ্গে প্রজেক্টের পরিচালক কর্নেল চ্যানোচ লেভিনের দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়।
প্রথমটি ছিল তামির মিসাইলকে নিয়ে। লেভিন চেয়েছিলেন, ইন্টারসেপ্টর মিসাইল তামির যেন তার ইলেক্ট্রনিক চোখ আর কম্পিউটার চিপের নির্দেশনা নিখুঁতভাবে পালন করে উপযুক্ত সময়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। আর সেজন্য তামিরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে টেকসই ও নির্ভরযোগ্য সুইচের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থের সীমাবদ্ধতায় তার সেই আশায় গুড়েবালি। এবার তার সমস্যার সমাধান দিল তার ছেলে!
একদিন সকালে লেভিন তার ছেলেকে রেডিও নিয়ন্ত্রিত খেলনা গাড়ি চালাতে দেখেন। বিষয়টি তার মাঝে কৌতূহলের সৃষ্টি করে। তিনি একটি পকেট ছুরি আর স্ক্রুডাইভার দিয়ে গাড়িটিকে চিড়ে ফেলে সকল যন্ত্রাংশ আলাদা করে ফেলেন। এরপর গাড়িটির ভেতরে থাকা সুইচ নিয়ে তিনি বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। পরীক্ষণ শেষে তিনি দেখলেন, তামিরের জন্য এই সুইচই যথেষ্ট। রাফায়েলের সহায়তায় তিনি এই গাড়ির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা সংগ্রহ করলেন। এরপর একজন সাধারণ ক্রেতা হিসেবে এশিয়ার সেই কোম্পানিকে তাদের গাড়ির সুইচের বড় একটি অর্ডার দেন। এত বড় অর্ডার পেয়ে কোম্পানিটিও খুশি মনে সুইচ সরবরাহে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি তাদের কাস্টমার আসলে একজন ইসরায়েলি আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদক।
সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ইসরায়েলের স্থানীয় খেলনা গাড়ির ডিজাইনার হানান শ্পেত্রিক আয়রন ডোম সিস্টেমের আদলে খেলনা গাড়িই বানিয়ে ফেলেছেন! গাড়িটিকে আয়রন ডোমের ক্ষুদ্র সংস্করণই বলা চলে। আসল আয়রন ডোম ব্যাটারি বানাতে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার খরচ হয়। কিন্তু গাড়িভক্তরা মাত্র ৭৮ ডলারের (আনুমানিক ৬,৬০০ টাকা) বিনিময়ে এর রেপ্লিকা কিনে তাদের সংগ্রহে রাখতে পারবে।
পরের ঘটনাটি মিসাইল নিক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার সাথে জড়িত। লেভিন তাদের অফিসের বাথরুমে বসে ভাবছিলেন কীভাবে তাদের প্রজেক্টকে অর্থনৈতিকভাবে আরও সাশ্রয়ী করা যায়। হঠাৎ করেই তার মাথায় এক আইডিয়া আসে। আইডিএফের তথ্যানুসারে, গাজা থেকে হামাস বা অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর ছোড়া রকেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম। তার মানে প্রায় ৭৫ শতাংশ রকেটই বাস্তবে কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করতে পারে না। তাই আকাশ থেকে আসা রকেট জনশূন্য অঞ্চলে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে তামির মিসাইল নিক্ষেপে কোনো লাভ নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি তার এই পরিকল্পনার বিষয়ে প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নেন, যে রকেটগুলো জনবহুল স্থান কিংবা উঁচু ইমারতে আঘাত হানতে পারে, শুধুমাত্র সেসবই ধ্বংস করতে অ্যান্টি মিসাইল নিক্ষেপ করা হবে।
তবে শত চেষ্টার পরেও আয়রন ডোম সিস্টেমকে একটি ব্যয়বহুল প্রজেক্ট হিসেবেই গণ্য করা যায়। একটি অত্যাধুনিক আয়রন ডোম ব্যাটারি নির্মাণে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলারের (আনুমানিক ৮৪৬ কোটি টাকা) প্রয়োজন হয়। একটি ইন্টারসেপ্টর তামির মিসাইলের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৫০ হাজার ডলার (আনুমানিক ৪২ লক্ষাধিক টাকা)। অপরদিকে তাদের ধ্বংস করা একটি রকেট বানাতে কয়েক শত ডলারই যথেষ্ট। তাই আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি মশা মারতে কামান দাগানোর মতো মনে হয়। এই ব্যাপারে আইডিএফের দেয়া যুক্তিতে বলা হয়, রকেটকে রুখতে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেশি মনে হলেও রকেটের হামলায় জনজীবন এবং রাষ্ট্রীয় স্থাপনার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় সেটা কমই আছে।
আয়রন ডোমের প্রয়োগ ও সফলতার গল্প
১৮ মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম এবং কম্পিউটারের জটিল হিসাবনিকাশ ও সিমুলেশন শেষে ২০০৯ সালের জুন মাসে ইসরায়েলের নেগেভ মরুভূমিতে আয়রন ডোমের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু প্রথম পরীক্ষাতে আয়রন ডোম সিস্টেম ব্যর্থ হয়। মিসাইল ফায়ারের কাউন্টডাউন শেষ হলেও রকেট বিধ্বংসী মিসাইল তামির লঞ্চার থেকে অবমুক্ত হতে পারেনি। পরদিন আবার পরীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু ফলাফল একই। পুরো প্রজেক্টের সদস্যরা তখন হতাশ হয়ে পড়ে। রাফায়েলের ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনের লোকজন এই ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে লেগে পড়ে। তারা লেভিনকে বলে, কোম্পানির আরোপিত নিয়মানুসারে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শেষ হতে তাদের প্রায় এক বছর লেগে যাবে।
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে হাইফাতে নিজের অফিসে বিমর্ষ লেভিন রাত দশটার সময় একটি ফোন কল পান। তাকে ফোন করেছিলেন রাফায়েলের সিনিয়র ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার ইসরায়েল অরবাচ। তার তত্ত্বানুসারে, একটি তারের ভুল সংযোগের কারণেই তামির লঞ্চ করেনি। লেভিন পরীক্ষা করে দেখেন, অরবাচের আন্দাজ পুরোপুরি সঠিক। তারটির পজিটিভ এবং নেগেটিভ প্রান্তের সংযোগ উল্টে দিলেই পুরো সিস্টেম সচল হবে। কিন্তু এই সহজ ব্যাখ্যা প্রধান প্রকৌশলীর মন ভরাতে পারল না। তার বিশ্বাস এই গুরুতর সমস্যার এত সহজ সমাধান হতে পারে না। তাই তিনি লেভিনের আয়রন ডোমের পুনঃপরীক্ষার আবেদন খারিজ করে দেন। লেভিন তখন রাফায়েলের প্রেসিডেন্ট ও তার পুরনো সহকর্মী ইয়েদিদিয়া ইয়ারির শরণাপন্ন হন। তিনি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে দাবি করেন।
তার সেই দাবির উপর বিশ্বাস রেখে এক মাস পর নেগেভ মরুভূমিতে আবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। আয়রন ডোম ব্যাটারির অপর প্রান্ত থেকে রকেট ছোড়া হয়। রাডারে ধরা পড়ার পর ইন্টারসেপ্টর মিসাইল উড্ডয়নের জন্য কাউন্টডাউন শুরু হয়। কিন্তু গননা শেষ হওয়ার তিন সেকেন্ড আগেই এবার তামির মিসাইল লঞ্চারের টিউব ছেড়ে আকাশের বুকে উড়াল দেয়। তামিরের নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই উড্ডয়ন লেভিনকে কিছুটা ভাবিয়ে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন, রাডার এবং কম্পিউটার থেকে তামিরকে দেওয়া কোনো বার্তা হয়তো তারা সঠিকভাবে ধরতে পারেনি। তবে তামিরের উড্ডয়নে তিনি বেশ খুশি হন।
আকাশে থাকা দুটি মিসাইলের গতিবিধি তারা দুটি আলাদা ভিডিও স্ক্রিনে পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথমে ছোড়া রকেটটি আকাশপথ পাড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিল। অপরদিকে তামির মিসাইলটি একটি বাঁক নিয়ে ঠিক যেন অদেখা কোন সুতার টানে সোজা উপরের দিকে উঠে গেল। এরপর সেটা উপরে উঠে একদিকে কিছুটা হেলে গেল। তারপর বিপরীত দিকে কিছুটা সরে যাওয়ার পরেই বুম! একেবারে নিখুঁত সংঘর্ষে রকেটটি ধ্বংস হয়ে গেল।
তবে প্রকল্পের প্রাথমিক সফলতা এলেও সেই তিন সেকেন্ডের হিসাব মেলাতে সকলে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। এরপর আরও অনেকবার টেস্ট করেছে লেভিন ও তার পরীক্ষক দল। প্রতিটি টেস্ট থেকেই তারা প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে আয়রন ডোম সিস্টেমের ত্রুটিগুলো দূর করে আরও নিখুঁত করার চেষ্টা করে।
২০১১ সালের ২৭ মার্চ ইসরায়েলের নেগেভ প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর বীরশেবার উত্তর প্রান্তে প্রথমবারের মতো আয়রন ডোম ইউনিট স্থাপন করা হয়। বীরশেবার ৩০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত গাজা নগরী থেকে অনবরত Katyusha রকেট নিক্ষেপের কারণে পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই আয়রন ডোম স্থাপিত হয়। গাজার উত্তরে থাকা আশকেলন এবং আশদোদ বন্দর নগরীতেও একটি করে আয়রন ডোম ব্যাটারি বসানো হয়।
২০১১ সালের ৭ এপ্রিল। সন্ধ্যা ৬টা বেজে ১৬ মিনিট। গাজা থেকে নিক্ষিপ্ত হামাসের একটি গ্র্যাড রকেটকে আশকেলনে প্রথমবারের মতো সফলভাবে প্রতিহত করে আয়রন ডোম সিস্টেম। এরই মাধ্যমে এক কল্পকাহিনী যেন বাস্তবে রূপ নিল।
ভূরাজনীতিতে আয়রন ডোমের প্রভাব
আয়রন ডোম সিস্টেমের সফলতার ফলে বিশ্বদরবারে ইসরায়েলের সামরিক শক্তির এক মহাবিজয় অর্জিত হয়। এই সিস্টেমের গুরুত্ব সবার আগে বুঝতে পারে আমেরিকা। ২০১১ সালে আমেরিকা ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের নিদর্শন হিসেবে আয়রন ডোমের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আয়রন ডোম সিস্টেমের উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ১.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। যার মধ্যে দুটি আয়রন ডোম ব্যাটারি কেনার জন্য ইসরায়েলকে ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে আমেরিকা। তাদের কেনা আয়রন ডোম ব্যাটারি দুটি টেক্সাসের ফোর্ট ব্লিসে এনে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে।
আয়রন ডোমে বিনিয়োগ করার ফলে আমেরিকান কংগ্রেস ইসরায়েলকে এই সিস্টেমের প্রযুক্তি আদানপ্রদান এবং একত্রে উৎপাদনের জন্য আহবান জানায়। আর সেই সুযোগটি লুফে নেয় আমেরিকান কোম্পানি Raytheon। তারা ইন্টারসেপ্টরের বিভিন্ন উপাদান তৈরি শুরু করে। বর্তমানে অ্যান্টি রকেট মিসাইল ব্যাটারির প্রায় ৫০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়। সম্প্রতি হামাসের রকেট হামলায় আয়রন ডোম সিস্টেমের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং সিস্টেম আপগ্রেডের জন্য আমেরিকার কাছে ইসরায়েল সরকার ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তার আবেদন করেছে।
আমেরিকার পাশাপাশি অন্যান্য দেশও তাদের প্রতিরক্ষার কাজে আয়রন ডোম সিস্টেম ব্যবহারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত এই সিস্টেম কিনতে খুবই আগ্রহী। ২০১৯ সালে রাষ্ট্রীয় সমঝোতার মাধ্যমে চেক প্রজাতন্ত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে আয়রন ডোমে ব্যাবহার উপযোগী ৮টি EL/M-2084 রাডার কেনে। এছাড়াও যুক্তরাজ্য ২০১৭ সালে আয়রন ডোমের প্রধান কম্পিউটার ইউনিট বা কন্ট্রোল ইউনিট (BMC) কেনার জন্য রাফায়েলের সাথে ৭৮ মিলিয়ন পাউণ্ডের (১০৫ মিলিয়ন ডলার) চুক্তি করে। ২০২১ সালের মার্চে স্লোভাকিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের মতই ১৭টি আয়রন ডোমের রাডার ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে। এছাড়াও রোমানিয়া, আজারবাইজান ও ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও মজবুতের উদ্দেশ্যে আয়রন ডোম সিস্টেম কিনতে ইসরায়েলের দ্বারস্থ হয়েছে। তাই আয়রন ডোম সিস্টেম নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ইসরায়েলকে একটি অপরিহার্য এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সর্বদা অবদান রেখে চলেছে।
আয়রন ডোমকে ফাঁকি দেয়ার কৌশলসমূহ
আয়রন ডোম সিস্টেম ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রিত একটি অপ্রতিরোধ্য আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সকল প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আবহাওয়াতে (ঝড়, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বৃষ্টিপাত, দিন-রাত ইত্যাদি) আয়রন ডোম স্বয়ংক্রিয়ভাবে দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে। এই সিস্টেম স্বল্প ও মাঝারী পাল্লার রকেট বা মিসাইলের পাশাপাশি ড্রোন বা মানুষচালিত বিমানকেও ধ্বংস করতে পারে। এমনকি একে গতিশীল কোনো বস্তুতে স্থাপন করেও চালানো যায়। ইসরায়েল নৌবাহিনীর জাহাজে তেমনই বিশেষ ধরনের আয়রন ডোম সিস্টেম ব্যাবহার করা হয়। এর নাম দেওয়া হয়েছে C-Dome।
তবে আয়রন ডোম দুর্ভেদ্য হলেও পুরোপুরি অভেদ্য নয়। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গবেষক জিয়ান লুপ সামান সেটাই মনে করেন। তিনি বহু বছর ধরে ইসরায়েলের মিসাইল প্রতিরক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার ভাষ্যমতে, আয়রন ডোম সিস্টেম ফিলিস্তিন ও লেবাননের সশস্ত্র বাহিনীদের ছোড়া রকেট থেকে বেসামরিক মানুষ এবং স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি অভাবনীয়ভাবে হ্রাস করলেও এই সিস্টেমকেও কৌশলে এড়িয়ে হামলা করা সম্ভব।
১) কম সময়ে অনেক বেশি মাত্রায় রকেট নিক্ষেপ করা: ক্ষুদ্র সময়ের ব্যবধানে যত বেশি রকেট ছোড়া হবে, সেগুলো প্রতিহত করাটা তত কঠিন হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি আয়রন ডোম ব্যাটারিতে সর্বোচ্চ ৪টি লঞ্চার থাকে। প্রতিটি লঞ্চারের ২০টি ইন্টারসেপ্টর মিসাইলসহ সর্বমোট ৮০টি মিসাইল একবারে নিক্ষেপ করা সম্ভব। রকেটের সংখ্যা যদি বেশি হয় তবে সেগুলো ধ্বংস করতে তত বেশি মিসাইল লাগবে। সবগুলো মিসাইল একসাথে ছেড়ে দিলে লঞ্চারের টিউবে তামির মিসাইল পুনরায় প্রবেশ করাতে একটু সময় লাগে। ঐ সময়ে কোনো রকেট আয়রন ডোমের সংরক্ষিত স্থানে প্রবেশ করলে সেটা আর আটকানো যায় না। হামাস এবার সেই পদ্ধতিই বেছে নিয়েছিল।
২) বিভিন্ন দিক থেকে রকেট নিক্ষেপ করে সিস্টেমকে বিভ্রান্ত করা: একই সময়ে গাজা এবং দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলে কোনো স্থান লক্ষ্য করে মাত্রাতিরিক্ত রকেট ছুড়লে আয়রন ডোমের পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন দিকে একই সময়ে অ্যান্টি রকেট মিসাইল নিক্ষেপ করা বেশ কঠিন। সিস্টেমের ধারণক্ষমতাও তখন হুমকির মুখে পড়বে। ফলে পুরো সিস্টেমটি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
৩) রাডার ও লঞ্চারকে ফাঁকি দিকে হামলা করা: আয়রন ডোম বানানো হয়েছে গাজা বা লেবানন থেকে আসা রকেট প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু সুড়ঙ্গ তৈরি করে গাজা থেকে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে রকেট হামলা চালালে সেটা রাডারে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। যার ফলে লঞ্চারও সেই রকেটকে শনাক্ত করতে পারবে না। ২০১৪ সালে হামাস হামলার উদ্দেশ্যে একবার গাজা থেকে ইসরায়েল অভিমুখে তেমন একটি সুড়ঙ্গ খনন করেছিল। এটি গাজা টানেল নামে পরিচিত। পরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সেটা টের পেলে ধ্বংস করে দেয়।
তবে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স নিজেদের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষায় শুধুমাত্র আয়রন ডোমের উপর নির্ভরশীল নয়। তারা বহুস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা ইরান থেকে আগত দূর পাল্লার ব্যালাস্টিক মিসাইল ধ্বংসের জন্য David’s sling নামক অ্যান্টি মিসাইল সিস্টেমের অবতারণা করে। এছাড়াও মধ্যম পাল্লার মিসাইল প্রতিহত করতে Arrow নামে তাদের একটি প্রকল্প বর্তমানে চালু রয়েছে।
শেষ কথা
খ্যাতনামা তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মিশিও কাকু তার ‘ফিজিক্স অব দ্য ইম্পসিবল’ বইয়ে উল্লিখিত প্রথম শ্রেণীর সম্ভাব্যতার মধ্যে ফোর্স ফিল্ডের ধারণাকে সবার উপরে রেখেছিলেন। বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন সিরিজ স্টার ট্রেকের বিভিন্ন পর্বে এই পাতলা, অদৃশ্য কিন্তু অপ্রবেশ্য দেয়ালের একটি কাল্পনিক দৃশ্যপট দেখানো হয়। আয়রন ডোম সিস্টেমের আবিস্কার ও এর অভাবনীয় ক্ষমতা কল্পনাপ্রসূত সেই ধারণাকেই আজ যেন বাস্তবে পরিণত করেছে।
Cover photo image credit: Moti MIlrod / AP