সুমিষ্ট এবং পুষ্টিগুণের বিচারে খেজুরের খ্যাতি রয়েছে সারাবিশ্বে। বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে খেজুরের রয়েছে ধর্মীয় গুরুত্বও। প্রতিবছর রমজানে তাই মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে খেজুরের চাহিদা বাড়ে বহুগুণে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) এক তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন খেজুর উৎপাদিত হয়। কিন্তু এত খেজুর উৎপাদন হয় কোথায়? কেনই বা খেজুরের এত গুরুত্ব?
একটি খেজুর গাছের উৎপাদন হার কেমন?
হাজার বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে খেজুর উৎপাদন হচ্ছে। এটা অনেকটা তাল গাছের মতো দেখতে শাখাবিহীন বৃক্ষ। এই গাছ সবচেয়ে বেশি জন্মে মরু এলাকায়। একেকটি খেজুর গাছ লম্বায় ১৫-২৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। গাছের পাতাগুলো দেখতে অনেকটা পাখির পালকের ন্যায়, তবে এর মাথায় ধারালো ও চোখা কাঁটা রয়েছে। এই গাছে যে ফল ধরে এটাই মূলত খেজুর হিসেবে খাওয়া হয়। আরবি ভাষায় খেজুরকে ‘তুমুর’ বলা হয়ে থাকে।
খেজুর গাছ পুরুষ এবং স্ত্রী দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। তবে ফল দেয় শুধু স্ত্রী গাছই। একটি পরিপক্ব খেজুর গাছে মৌসুমে প্রায় ১০০ কেজির উপর খেজুর উৎপাদন হয়, সংখ্যার বিবেচনায় প্রায় ১০ হাজার।
খেজুরের রকমফের
সারাবিশ্বে প্রায় তিন হাজারের অধিক খেজুরের জাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে খেজুর উৎপাদনের জন্য সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে ধরা হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে। এই অঞ্চলের বিখ্যাত কিছু খেজুরের ব্যাপারে জানা যাক।
আজওয়া: মুসলমানদের পুণ্যভূমি বলে পরিচিত সৌদি আরবে এই খেজুর ব্যাপকহারে উৎপাদিত হয়। খেজুরের মধ্যে আজওয়া অনেক উন্নত এবং দামি। এতে রয়েছে মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী উপাদানও।
মেডজুল: এই জাতের খেজুর বাংলাদেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মিশর ও জর্ডানে উৎপাদিত এই খেজুরের আঁটি ছোট হলেও মাংসল অংশ বেশি।
মারিয়াম: লালচে রঙের এই খেজুর এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এই খেজুরের মধ্যে প্রাকৃতিক আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় এর উপকারিতা ও গুরুত্ব অনেক।
আম্বার: আম্বার জাতের খেজুর দৈর্ঘ্যে অন্যান্য খেজুর থেকে লম্বা। এটাও বেশ দামি। ফল হিসেবে এই খেজুরের চাহিদা আজওয়ার কাছাকাছি। আম্বারের রং বাদামি।
সাফাওয়ি: কালো রঙের এই খেজুর ভিটামিনে পরিপূর্ণ। এই খেজুর সাধারণত মদিনায় উৎপন্ন হয়। এটি কালমি নামেও বিক্রি হতে দেখা যায়।
সুগায়ি: এই খেজুর ছোট ও বড় দুই রকমেরই উৎপাদিত হয়। এর বাইরের অংশ নরম আবরণে ঢাকা। খেতে মিষ্টি হলেও মুখে দিলে কিছুটা কষ লাগে।
খেজুর উৎপাদনে কোন দেশ এগিয়ে?
উত্তপ্ত সূর্যের আলো বেশি সময় ধরে পাওয়া যায় এমন অঞ্চলেই সাধারণত খেজুর ভালো জন্মে। এই কারণ বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্য ও তার আশেপাশে মূলত খেজুর বেশি উৎপাদিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ মিশর এই তালিকায় সবার উপরে অবস্থান করছে। দেশটি বিশ্বের মোট খেজুরের চাহিদার এক-পঞ্চমাংশের যোগান দেয় প্রতি বছর। মিশরে বছরে ১.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন খেজুর উৎপাদিত হয়।
উৎপাদনের এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সৌদি আরব। দেশটিতে বাৎসরিক উৎপাদিত খেজুরের পরিমাণ প্রায় ১.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। খেজুর উৎপাদন করে এমন তালিকায় শীর্ষ দশটি দেশের বাকি আটটি স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইরান (১.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন), আলজেরিয়া (১.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন), ইরাক (৬,৩৯,০০০ মেট্রিক টন), পাকিস্তান (৪,৮৩,০০০ মেট্রিক টন), সুদান (৪,৩৮,০০০ মেট্রিক টন), ওমান (৩,৭২,০০০ মেট্রিক টন), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৩,২৩,০০০ মেট্রিক টন) এবং তিউনিসিয়া (২,৮৮,০০০ মেট্রিক টন)।
কেন এত গুরুত্ব খেজুরের?
খেজুর, সেটা তাজা হোক কিংবা শুকনো, সাধারণত উচ্চ মাত্রার ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবারে পরিপূর্ণ থাকে। এতে আরও থাকে এন্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা করে। খেজুরে বিদ্যমান উচ্চ মাত্রার ফ্রুক্টোজও একে শক্তির এক বড় উৎসে পরিণত করেছে। একেকটি খেজুরে থাকা শক্তির পরিমাণ প্রায় ২০ ক্যালরি। এছাড়া ৫.৩ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৪ গ্রাম চিনি, ০.৬ গ্রাম ফাইবার, ০.২ গ্রাম প্রোটিন এবং ০.১৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম রয়েছে একেকটি খেজুরে।
মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছেও তাই শক্তির উৎস হিসেবে আলাদা গুরুত্ব রয়েছে এই ফলের। রমজানে সারাদিনের রোজায় পানাহার থেকে বিরত থাকার পর ইফতারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসুল্লিরা খেজুর দিয়েই রোজা ভাঙেন।
খেজুর সহজে পঁচে না। সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়া যায় সহজেই। সংরক্ষিত শুকনো খেজুর যেকোনো সময়ই পুষ্টিকর খাবারের একটি উপযুক্ত বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
মানবদেহের সুস্থতায় খেজুর
মানবদেহের সুস্থ থাকায় হাজার বছর ধরেই খেজুরের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়ে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি হাদিসের উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যেতে পারে। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া, ইবনু আয়্যুব ও ইবনু হুজর (রহঃ) বলেন, আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, মদিনার আলিয়া অঞ্চলের (উঁচু ভূমির) আজওয়া খেজুরে শেফা (রোগমুক্তি) রয়েছে। অথবা তিনি বলেছেন, প্রতিদিন সকালের এর আহার বিষনাশক (ঔষধের কাজ করে)। (সহীহ মুসলিম, ৫১৬৮)
এমন করে যুগে যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানেও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে খেজুরের কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেছে। গেল বছরের এক গবেষণা বলছে, খেজুরে থাকা এন্টি-অক্সিডেন্ট শরীরের অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সম্পর্কিত অসুস্থতায় বেশ কাজে দেয়। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তখনই দেখা দেয়, যখন কোষকে ধ্বংসকারী মুক্ত রেডিক্যাল এবং এই রেডিক্যালগুলোর বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে শরীরে নানা রোগ দানা বাধার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঠিক এই জায়গাতেই কাজ করে খেজুর। এতে থাকা ক্যারোটিনয়েড, পলিফেনলস আর অ্যান্থোসায়ানিনস ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য অনেক ব্যাধির ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রতিদিন অন্তত তিনটি খেজুর আমাদের ফাইবারের চাহিদা মেটানোয় বেশ কার্যকর। এই ফাইবার হজম প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। ফাইবারের আরেকটি অনন্য গুণ হচ্ছে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
খেজুরের সুরক্ষামূলক যৌগগুলো মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে সহায়তা করে বলেও মনে করা হয়। নিউরাল রিজেনারেশন রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, মস্তিস্কে প্রদাহ এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দক্ষতার কারণে খেজুর আলঝেইমার রোগের বিরুদ্ধে চিকিৎসা সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি দেয়।
আছে ক্ষতিকর দিকও!
খেজুরের এত উপকারী গুণ শুনে একের পর এক খেজুর খেয়ে ফেললে কিন্তু বিপদ। প্রচন্ড মিষ্টি এই শুকনো ফল অতিরিক্ত খেলে বাড়তে পারে দেহের ওজন।
খেজুর অতিরিক্ত খাওয়ার দরুণ এতে থাকা ফ্রুক্টোজ যখন আপনার অন্ত্রে পৌঁছে যায় তখন এটি ডায়রিয়া এবং গ্যাসের সাথে সাথে পেটে ব্যথা হতে পারে, কারণ এটি আপনার পেটের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়াগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে।
খেজুর একইসাথে ব্লাড সুগার লেভেলও বাড়িয়ে দিতে পারে। খেজুরের মতো ফার্মেনেন্টেশন করে সংরক্ষিত করা শুকনো ফলে হিস্টামিন থাকে, যা অনেকের এলার্জির কারণ হয়ে উঠতে পারে প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ছোট্ট শিশুদের খেজুর খাওয়া থেকে বিরত রাখার কথা বলে থাকেন চিকিৎসকরা। কারণ শিশুদের অপরিপক্ব অন্ত্র এবং দাঁতের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খেজুর ক্ষতিকর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পরিমিত পরিমাণেই খেজুর খাওয়ার অভ্যাস করা উচিত।