Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তর কোরিয়ার গোপন ‘কিডন্যাপিং প্রোগ্রাম’

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে গণমাধ্যমগুলো রয়েছে, তার প্রায় সবগুলো ইউরোপ ও আমেরিকাভিত্তিক। এই গণমাধ্যমগুলোতে উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রচার করা হয়, তার একটি বড় অংশ ‘পশ্চিমা প্রোপাগাণ্ডা’। উত্তর কোরিয়ার সাথে ইউরোপের বড় বড় দেশগুলো কিংবা পুঁজিবাদী বিশ্বের সবচেয়ে বড় নেতা আমেরিকা, কারোরই কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো নেই। তাই পশ্চিমা দেশগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বাকি বিশ্বের দেশগুলোর সামনে যেন উত্তর কোরিয়ায় খুবই নেতিবাচক একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করা যায়। তবে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে যা প্রচারিত হয় উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে, তা সবগুলোই যে ‘প্রোপাগাণ্ডামূলক তথ্য’, এটি ভাবলে আবার ভুল হবে। কারণ, যা রটে তা কিছু তো বটে! উত্তর কোরিয়া একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে অনেক কাজ করে থাকে, যেগুলো গণমাধ্যমে খুব কমই এসেছে, অথচ এসব ঘটনা রীতিমতো চোখ কপালে তুলে দেয়।

Hfjgkg
পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায়ই উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে প্রোপাগান্ডামূলত তথ্য প্রচার করে (ছবিতে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার একটি নমুনা); image source: voanews.com

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ার আধিপত্য নিয়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঝামেলা শুরু হলে দুই দেশই ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর কোরিয়া উপদ্বীপকে ভাগ করতে একমত হয়। তবে ১৯৫০ সালের দিকে কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়া তার মতাদর্শিক প্রতিপক্ষ পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়ায় হামলা চালালে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বেধে যায়। এই যুদ্ধের সময়ে উত্তর কোরিয়ার অসংখ্য কবি, লেখক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী নিরাপদ জীবিকার আশায় পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে আসেন। তাই যুদ্ধের পর উত্তর কোরিয়ায় বুদ্ধিজীবী সংকটের কারণে জাতীয় উন্নয়ন থমকে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উত্তর কোরিয়ার জাতির পিতা কিম ইল-সাং পরিকল্পনা করেন বাইরের দেশ থেকে সুযোগমতো প্রতিভাবান ব্যক্তিদের অপহরণ করে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে আসা হবে। এমনকি সুপরিকল্পিতভাবে অপহরণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিভাগও খোলা হয়েছিল! সেরকমই কিছু অপহরণের ঘটনা জানা যাক।

Ufufkgk
মানচিত্রে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান; image source: medium.com

দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো সময় গিয়েছিল গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। এই সময়ে পরিচালক ও প্রযোজক শিন স্যাং-ওক প্রায় সত্তরটি চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রায় একশোটি চলচ্চিত্রে প্রযোজনা করেন। তার পরিচালনায় পুরো দক্ষিণ কোরিয়ার ফিল্প ইন্ডাস্ট্রি জেগে উঠেছিল, তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে তার অসংখ্য চলচ্চিত্র। তাকে সেই সময়ে বলা হতো ‘প্রিন্স অব সাউথ কোরিয়ান সিনেমা’। কিন্তু পরবর্তীতে তার ব্যক্তিজীবনে ঝামেলা, কিংবদন্তি অভিনেত্রী চয় ইউং-হির সাথে তার বিচ্ছেদ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের মাত্রাতিরিক্ত সেন্সরশিপ আরোপের কারণে তার একচ্ছত্র জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। এই সুযোগ কাজে লাগায় উত্তর কোরিয়া। দেশটির গোয়েন্দারা প্রযোজক সেজে তার কাছে ধরনা দেয়, তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাপারে আলোচনার জন্য হংকংয়ে গমন করতে বলে। পরে সেখান থেকে তাকে অপহরণের পর উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। প্রায় একইভাবে তার সাবেক স্ত্রী চয় ইউং-হি-কেও উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে আসা হয়। উত্তর কোরিয়ায় তাদেরকে বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ করে দেয়া হয়, এবং উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম ইল-সাংয়ের অনুরোধে তিনি প্রায় পনেরটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরবর্তীতে।

Jgigkbm
‘প্রিন্স অব সাউথ কোরিয়ান ফিল্ম’ শিন স্যাং-ওক এবং অভিনেত্রী চয় ইউং-হি; image source: celebritynine.com.au

১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে এক বিকেলে বান্ধবীদের সাথে খেলা শেষ করে ঘরে ফিরছিল তের বছর বয়সী জাপানি শিশু মেগুমি ইয়াকোতা। বাড়ি থেকে যখন তার দূরত্ব অতি অল্প, তখনই সে নিখোঁজ হয়। যথাসময়ে বাড়িতে ফিরে না আসায় তারা বাবা-মাও বুঝতে পারে যে সর্বনাশা কিছু ঘটেছে। তারা বাড়ির আশেপাশে তন্নতন্ন করে খোঁজ চালান, কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায়নি। এদিকে নিখোঁজ হওয়ার পর যখন মেগুমি ইয়াকোতা চোখ খোলেন, তখন তিনি দেখতে পান- তাকে একটি মাছ ধরার অত্যাধুনিক স্পিডবোটে করে উত্তর কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মেগুমি ইয়াকোতা ছিলেন সেই সতের দুর্ভাগা জাপানি নাগরিকের একজন, যাদের উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারা অপহরণ করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক হিসেবে সংখ্যাটি মাত্র সতের হলেও বাস্তবে নাকি শতাধিকও হতে পারে, এমনটা দাবি করেন অনেক জাপানি। ১৯৭৭-৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি জাপানি নাগরিককে অপহরণ করা হয়েছে।

Dhsjsnssksk
অপহরণের কাজ করে থাকে উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা; image source:. sputniknews.com

তবে উত্তর কোরিয়ার অপহরণ প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভিকটিম জাতিতে জাপানি হলেও অন্যান্য দেশ থেকেও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। জাপানিদের বেশি অপহরণের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। উত্তর কোরিয়া ও জাপানের দূরত্ব মাত্র ৬৩০ মাইল। পূর্ব এশিয়ায় জাপানি ভাষার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, দেশটির প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সাংয়ের দর্শন ‘জুচে’, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘আত্মনির্ভরতা’, সেই দর্শন ছড়িয়ে দিতে জাপানি ভাষা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আরেকটি বড় কারণ জাপানি পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করা যায়, যেটি উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার জন্য পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারা জাপানি নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে এত নিখুঁতভাবে অপহরণ করে থাকে যে, জাপানি সরকারের কিছুই করার থাকে না।

জাপান ও অন্যান্য দেশ থেকে উত্তর কোরিয়ায় যাদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের মোটামুটি একটা ভালো জীবনযাপনের পরিবেশ দেয়া হয়। তাদের মূল দায়িত্ব থাকে উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভাষা শিক্ষা দেয়া। যেমন- জাপান থেকে যাদের অপহরণ করা হয়, তাদের দায়িত্ব থাকে উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের জাপানি ভাষা শিক্ষা দেয়া। এর বিনিময়ে তাদের মোটামুটি ভালো পারিশ্রমিক দেয়া হয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও বেশ কিছু সুবিধা দেয়া হয়, যেগুলো উত্তর কোরিয়ার সাধারণ নাগরিকেরা পান না। এতে উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারা জাপানের অভ্যন্তরে মিশন পরিচালনার সময় যেন ভাষাগত কোনো জটিলতায় না পড়েন, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তবে সবার আগে অপহরণের পর ভিকটিমদের উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ংয়ের সবচেয়ে ভালো এলাকাগুলো ঘুরিয়ে দেখানো হয়, যাতে তারা মনে করেন পুরো দেশটিই সেসব এলাকার মতো উন্নত। এরপর প্রশিক্ষিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ভিকটিমদের ‘ব্রেইন ওয়াশ’ করা হয়। তাদেরকে বোঝানো হয়, তারা এতদিন যে দেশে ছিল, সেই দেশের চেয়ে উত্তর কোরিয়া অনেক এগিয়ে আছে। সুতরাং তাদের উচিত মাতৃভূমিতে ফিরে না গিয়ে উত্তর কোরিয়ার সমৃদ্ধির জন্য আত্মনিয়োগ করা।

উত্তর কোরিয়ার এই প্রকল্পের কথা সম্প্রতি একটি বইয়ের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে এসেছে। ‘দ্য ইনভাইটেশন-অনলি জোন: দ্য এক্সট্রাঅর্ডিনারি স্টোরি অব নর্থ কোরিয়া’জ অ্যাবডাকশন প্রজেক্ট’ নামের সেই বইয়ে লেখক রবার্ট এস. বয়েন্টন দেখিয়েছেন কীভাবে উত্তর কোরিয়া বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদেশি নাগরিকদের অপহরণ করে নিজ দেশে নিয়ে এসেছে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রকল্পের অধীনে সবসময় বেসামরিক মানুষদের উদ্দেশ্য করে অপহরণ কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে, যাদের হাতে কখনও অস্ত্র থাকে না কিংবা যাদের বাধা দেয়ার তেমন সক্ষমতা নেই। বর্তমানে এই প্রকল্পের কথা প্রতিবেশী দেশগুলো জেনে ফেলায় আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুরো বিশ্বেই।

Related Articles