[৭ম পর্ব পড়ুন]
ইংল্যান্ডের সাথে সাময়িক শান্তি মিলেছে। ফলে ডাচরা মনোযোগী হলো নিজেদের অর্থনীতি মজবুত করতে। যুদ্ধের ফলে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো তো পুষিয়ে নিয়ে হবে। কিন্তু সাগরে রয়্যাল নেভির উৎপাত থেমে গেলেও ডাচ বাণিজ্যবহরগুলো প্রায়শই জিব্রাল্টার হয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূল ধরে চলার সময় বার্বার কর্সেয়ারদের হামলার শিকার হচ্ছিল। এদের বিরুদ্ধে কয়েকবারই অভিযান চালানো হয়েছে, স্বয়ং ডি রুইটার নিজেও তাদের ধাওয়া করেছেন। কিন্তু এরা বারে বারেই ফিরে আসছিল।
সালেকে কেন্দ্র করে বার্বার হামলা বন্ধ হয়েছিল ১৭৫৭-তে ডি রুইটারের নেতৃত্বে চুক্তি সম্পাদিত হবার পর। কিন্তু বার্বার কর্সেয়ারদের মূল ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল আলজিয়ার্স। ফলে ১৬৬১ সালের মে মাসে নয়টি রণতরী নিয়ে ডি রুইটার রওনা হন, পথে যোগ দিল আরো নয়টি যুদ্ধজাহাজ।
বার্বার হুমকি মোকাবেলা
ডি রুইটার কাদিজে ঘাঁটি করে জিব্রাল্টার পরিষ্কার করলেন। এরপর পালিয়ে যাওয়া জলদস্যুদের তাড়া করলেন তিনি। কিন্তু বিভিন্ন দেশের নৌবহরের তাড়ায় ততদিনে বার্বার জলদস্যুরা পোড়খাওয়া হয়ে উঠেছে। তারা এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিল যে ডাচরা মাল্টা পর্যন্ত গিয়েও তাদের টিকিটিও দেখতে পেল না। হতাশ হয়ে ফেরত আসার পথে তিউনিসে ডাচরা যখন যাত্রাবিরতি করছে তখন বার্তা পাঠালেন আলজিয়ার্সের অ্যাডমিরাল, যাকে এর আগে ডি রুইটার একবার ধাওয়া দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ডাচ জাহাজকে খোলা সাগরে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ দিলেন তিনি। ডি রুইটার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেও অ্যাডমিরাল শেষ পর্যন্ত তার মুখোমুখি হননি।
আগেরবারের মতো এবারও ডি রুইটারকে ডাচ প্রজাতন্ত্রের পক্ষ হয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূলবর্তী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আলোচনা করার অনুমতি দেয়া ছিল। ফলে তিনি নৌবহর পরিচালনা ছাড়া অনেকটা রাষ্ট্রদূতের কাজও করে যাচ্ছিলেন। তার চুক্তি করার অধিকার থাকলেও শর্ত ছিল যে এই চুক্তিগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন পাবার আগে এস্টেট জেনারেলরা পর্যালোচনা করে দেখবেন।
তিউনিসে বসে আলজিয়ার্সের দুতের সাথে আলাপ আলোচনা চলল। বার্বার জলদস্যুদের নিরাপত্তা দেয়া নিয়ে নেদারল্যান্ডসের সাথে আলজিয়ার্সের সংঘর্ষ তখন চলমান। সাত মাসের জন্য অস্ত্রবিরতিতে দুই পক্ষই সম্মত হল, এর ভেতর চূড়ান্ত একটি শান্তিচুক্তির রূপরেখা অনুমোদন করার কথা। ইংল্যান্ড ইতোমধ্যে আলজিয়ার্সের সাথে এরকম চুক্তি করেছে, যার ফলে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজ দস্যু হামলা থেকে নিরাপদ। ডি রুইটার সেরকম একটি চুক্তি করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তবে এস্টেট জেনারেলরা ডি রুইটারকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যাতে খোলা সাগরে ডাচ জাহাজ তল্লাশি করতে দেয়ার মতো কোনো ধারা চুক্তির অন্তর্ভুক্ত না হয়, যদিও এমন ধারার ভিত্তিতেই ইংল্যান্ডের সাথে চুক্তিতে হয়েছিল।
কিন্তু আলজিয়ার্স অনুমিতভাবেই এই ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, এমনকি ইংল্যান্ডের সাথে সম্পাদিত চুক্তির কপি উদাহরণ হিসেবেও পেশ করে। অনেক তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে ডি রুইটার আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই ত্রিপোলির দিকে চলে যানে। সেখানকার শাসকের সাথে অনুরূপ চুক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আলজিয়ার্সে ফিরে এসে ডি রুইটার কথাবার্তা জারি রাখেন। অবশেষে ১৬৬২ সালের নভেম্বরে ১৫ মাসের অস্ত্রবিরতি কার্যকর করে একটি খসড়া চুক্তি সম্পাদিত হলো। চূড়ান্ত মিটমাটের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা চুক্তিতে ছিল।
যৌথ বাহিনীর প্রস্তাব
জিব্রাল্টারে কিছুদিন অবস্থান করে ১৬৬৩ সালের ১৯ এপ্রিল দেশে ফিরে এলেন ডি রুইটার। প্রায় এক বছর পরিবারের সাথে শান্তিতেই কাটান তিনি। কিন্তু আলজিয়ার্সের সাথে ১৫ মাসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি সত্ত্বেও বার্বারি জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য আবার বেড়ে যাওয়ায় পরের বছর মে মাসের ৮ তারিখে তিনি আবার সাগরে বেরিয়ে পড়বার নির্দেশ পেলেন। এবারের অভিযানে তার সঙ্গী হলেন সবেমাত্র নৌবাহিনীতে যোগ দেয়া পুত্র এঙ্গেল ডি রুইটার।
৪ জুন মালাগার উপকূলে ডাচ বহরের ১২টি জাহাজ ডি রুইটারের অধীনে একত্রিত হলো। আলজিয়ার্স থেকে বার্বার জলদস্যুরা তখন প্রায়ই ডাচ বানিজ্য জাহাজ আক্রমণ করছে, যদিও ১৫ মাসের অস্ত্রবিরতি চুক্তি বর্ধিত করে ১৯ মাস করা হয়েছিল। এবার আলোচনা চালানোর জন্য ডি রুইটারের সাথে ছিলেন অভিজ্ঞ কূটনীতিক ভ্যান ডেন বার্গ।
এদিকে বার্বারি উপকূলের নিরাপত্তা সমস্ত ইউরোপিয়ান পরাশক্তিরই চাওয়া। এতদিন তারা আলাদা আলাদা করে আলজিয়ার্সসহ বার্বারি উপকূলের রাষ্ট্রগুলোর সাথে কথা বলছিল। ডাচ এস্টেট জেনারেলরা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর স্পেনের সম্রাটের কাছে প্রস্তাব আনলেন একটি যৌথ নৌবহরের, যারা সম্মিলিতভাবে এই জলদস্যুদের একটা চূড়ান্ত বিহিত করবে।
ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই রাজি ছিলেন, তবে তার সাহায্য সীমাবদ্ধ ছিল ভূমধ্যসাগরে তুঁলো আর মার্সেই বন্দর ডাচ নৌবহরের ব্যবহারের অনুমতি পর্যন্তই। ফরাসি কোনো রণতরী তাদের সাথে যোগ দিল না। স্পেনের সম্রাটও অনুরূপ তার ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরগুলো জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাকারী ডাচ জাহাজের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন।
দ্বিতীয় চার্লস তার বহর প্রস্তুত করলেও ডাচদের সাথে মিলিত হয়ে জলদস্যুদের হেস্তনেস্ত তার উদ্দেশ্য নয়, বরঞ্চ নেদারল্যান্ডসের দফারফা করাই তার পরিকল্পনা। তিনি রয়্যাল নেভিকে নির্দেশ দিলেন সাগরে বন্ধুদেশের কোনো জাহাজের দেখা পেলেও রীতি অনুযায়ী পতাকা নামিয়ে বন্ধুত্বের নিদর্শন দেখানো যাবে না, যদিও ১৬৬২ সালের দ্বিতীয় ওয়েস্টমিন্সটার চুক্তির একটি ধারায় ডাচ জাহাজের একই কাজের বিপরীতে ব্রিটিশ জাহাজ পতাকা নামাতে বাধ্য ছিল।
চার্লসের এই আদেশের প্রেক্ষিতে ডি রুইটার যখন মালাগা বন্দরের বাইরের সাগরে রয়্যাল নেভির জাহাজের দেখা পেয়ে তার পতাকা নামালেন, তখন অনুরূপ কাজ করতে ব্রিটিশ কম্যান্ডার অ্যাডমিরাল লসন ব্যর্থ হন। ডি রুইটার একইসাথে আহত ও বিস্মিত হলেন। তিনি জবাব চেয়ে পাঠালে লসন তাকে রাজার নির্দেশ জানিয়ে দেন।
ব্রিটিশদের সাথে ঘনিয়ে আসা সংঘাতের চিন্তা মাথায় নিয়ে জিব্রাল্টার পাড়ি দিয়ে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে এসে ভিড়লেন ডি রুইটার। এখানে ভ্যান ডেন বার্গকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে যান স্পেনের বন্দরে। বার্গ আলজিয়ার্সের সাথে আলোচনা শুরু করলেও অচিরেই উপলব্ধি করলেন- এরা সাগরে ডাচ জাহাজের তল্লাশির ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। কিন্তু এস্টেট জেনারেলদের পরিষ্কার নির্দেশ, এই শর্তে রাজি হওয়া যাবে না। ফলে আলজিয়ার্সের ক্ষুব্ধ শাসকগোষ্ঠী নানাভাবে বার্গকে হুমকি প্রদান করতে থাকে। তিনি অনেকটা তাদের হাতে বন্দি অবস্থায় পড়ে যান।
স্পেনের অ্যালিক্যান্ট (Alicante) বন্দরে বসে ডি রুইটার তখন ব্রিটিশদের সাথে চলমান উত্তেজনার সংবাদ পর্যালোচনা করছিলেন। এস্টেট জেনারেলদের কথা ছিল ডাচরা কেবল সরাসরি আক্রমণের শিকার হলেই ব্রিটিশদের জবাব দেবে, তার আগপর্যন্ত ওয়েস্টমিন্সটার চুক্তি তারা পালন করবে।
আসন্ন সংঘর্ষের ব্যাপারে অনেকটা নিশ্চিত হয়ে ডি রুইটার ফেরত এলেন আলজিয়ার্সে। বার্গের দুর্দশা দেখে দ্রুত সাথে বন্দি ৩৭ জলদস্যুর বিনিময়ে তিনি বার্গ ও তার লোকদের ছাড়িয়ে নেন। এরপর আলজিয়ার্সের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে ৫ জুলাই মালাগা চলে যান। এখানেই পয়লা সেপ্টেম্বর ব্রিটিশদের তরফ থেকে যুদ্ধের তোড়জোড়ের খবর এসে পৌঁছে।
ডাচ-ব্রিটিশ বিবাদ
প্রথম অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ পরাজিত হলেও ডাচরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর সম্পদশালী হয়ে উঠছিল। তাদের সিংহভাগ বাণিজ্য উপকরণই আসত উপনিবেশগুলো থেকে। ভারত উপমহাদেশেও তাই ব্রিটিশ, ফরাসি আর পর্তুগিজদের সাথে ডাচদেরও কিছু উপনিবেশ ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের মূল ঘাঁটি বানিয়েছিল মাদ্রাজে। বোম্বে বা বর্তমান মুম্বাইতে জয়জয়কার পর্তুগিজদের ।
দ্বিতীয় চার্লস বিয়ে করলেন পর্তুগালের রাজা চতুর্থ জনের মেয়ে ক্যাথেরিনকে (Catharine of Braganza), উপহার হিসেবে পেয়ে গেলেন তৎকালীন বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই)। মাদ্রাজ আর বোম্বেকে কেন্দ্র করে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা। এরা আফ্রিকার উপকূল ধরে বিপুল ব্যবসা শুরু করলে ডাচদের বাণিজ্য হুমকির সম্মুখিন হয়।
এই সময় কিছু কারণে ডাচরা তাদের জলসীমা দিয়ে উপমহাদেশে যাবার সময় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুটি সরবরাহ জাহাজ জব্দ করে। দ্বিতীয় চার্লস সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির পক্ষে ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। নেদারল্যান্ডস জাহাজ আর মালামালের দাম পরিশোধে রাজি ছিল, কিন্তু ব্রিটিশদের কথা ছিল সময়মতো সরবরাহ না পৌছানোয় উপমহাদেশে তাদের উপনিবেশগুলোতে প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, কাজেই সেই ক্ষতিপূরণও যোগ করতে হবে।
ডাচরা ব্রিটিশদের শর্তে রাজি হলো না। ফলে দ্বিতীয় চার্লস রয়্যাল নেভিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তার চোখ ছিল আফ্রিকার দিকে। সেখানে ডাচদের রমরমা ব্যবসায় আঘাত করলে তাদের অর্থনীতি তো মার খাবেই, সাথে সাথে ডাচদের অহমে আঘাত দিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলা সম্ভব হতে পারে। চার্লস তক্কে তক্কে ছিলেন শুধু একটি সুযোগের, তার মাথায় তখন নেদারল্যান্ডসকে নিজের বশংবদে পরিণত করবার চিন্তা।