আমরা ছোটবেলায় অনেক ধরনের খেলনা দিয়েই খেলেছি। প্রতিটি খেলনার যান্ত্রিক ক্রিয়ার পেছনে ছিল বিজ্ঞানের বিভিন্ন নিয়ম ও সূত্রের কারসাজি। অবশ্য ছোটবেলায় খেলার সময় খেলনাগুলোর পেছনের বিজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়নি। সেটির দরকারও ছিল না। কিন্তু যদি এমন হয়, ছোটবেলার কোনো খেলনার আদলেই তৈরি করা হলো এমন এক যন্ত্র, যা দিয়ে হাজার হাজার মানুষের মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব? আক্ষরিক অর্থেই খেলনার আদলে তৈরি কোনো সাধারণ যন্ত্রের মাধ্যমে যদি হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়, তাহলে কিন্তু বিষয়টি দারুণ হয়। খেলনা তখন হয়ে উঠছে গবেষণার বিষয়। ভারতীয় এক বিজ্ঞানী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বসে আমাদের অতিপরিচিত খেলনার আদলে এমন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যেটি আফ্রিকাসহ পৃথিবীর অনেক অনুন্নত দেশের অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচানোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
সাধারণত গবেষণাগারে রক্ত পরীক্ষার জন্য ‘সেন্ট্রিফিউজ’ নামে একটি যন্ত্র থাকে। এই যন্ত্রে ঘূর্ণনের মাধ্যমে কোনো তরল পদার্থের বিভিন্ন উপাদান আলাদা করা হয়। একটি তরলে ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের বিভিন্ন উপাদান থাকতে পারে। সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রে বিদ্যুৎশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উচ্চগতিসম্পন্ন মোটরের মাধ্যমে কোনো তরল পদার্থকে ঘোরানো হয়। এরপর তরলের বেশি ঘনত্বের উপাদান অল্প ঘনত্বের উপাদান থেকে আলাদা হয়ে যায়। সাধারণত, রক্ত পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা সেন্ট্রিফিউজের মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন উপাদান আলাদা করেন। গবেষণাগারে রক্তের অন্যান্য উপাদান থেকে বিভিন্ন ভাইরাস আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য সেন্ট্রিফিউজ পুরো বিশ্বজুড়েই বহুল ব্যবহৃত একটি যন্ত্র।
কিন্তু সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। সেন্ট্রিফিউজ চালাতে বিদ্যুতের প্রয়োজন। আফ্রিকার অনেক দেশে এখনও বিদ্যুৎ সহজলভ্য হয়নি। এছাড়া, এই যন্ত্রের পরিবহনও একটি বড় বিষয়। পরিবহনের ক্ষেত্রে একটু অসতর্ক হলেই যন্ত্রের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার আফ্রিকার দেশগুলোতে ম্যালেরিয়া কিংবা এইচআইভি এইডসের মতো রোগের মৃত্যুবরণের হারও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি। তো যখন একটি অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই, আবার দেখা যাচ্ছে অন্য জায়গা থেকে সেন্ট্রিফিউজ আনতে গেলে বেশ কয়েক দিন সময় চলে যাবে, এদিকে রক্ত পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করাও জরুরি– সেক্ষেত্রে উপায় কী? উত্তর– এক্ষেত্রে ‘পেপারফিউজ’ হচ্ছে সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান। এটি অন্য জায়গা থেকে পরিবহন করার ঝামেলা নেই, আবার এটি চালানোর জন্য বিদ্যুৎশক্তিরও দরকার নেই। সেন্ট্রিফিউজ পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির দরকার রয়েছে, পেপারফিউজের ক্ষেত্রে এটাও দরকার নেই। সবদিক দিয়েই সেন্ট্রিফিউজের চেয়ে পেপারফিউজ এগিয়ে আছে।
পেপারফিউজ উদ্ভাবনের পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তার সম্পর্কেও কিছু জানা যাক। ভারতীয় বিজ্ঞানী মনু প্রকাশ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর। সেখানে ‘প্রকাশ সায়েন্স ল্যাব’ পরিচালনা করেন তিনি। ভারতের উত্তর প্রদেশের মীরাটে এমন এক জায়গায় জন্ম নেন তিনি, যেখানে বেশিরভাগ পরিবারের প্রধান পেশা ছিল আখ উৎপাদন। কানপুরের আইআইটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের উপর বি.টেক ডিগ্রি অর্জনের পর উচ্চশিক্ষার্থে চলে আসেন আমেরিকায়। এখানে এমআইটি থেকে এম.এস. এবং পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে যোগদান করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন পর্যন্ত এখানেই তিনি তার গবেষণা ও শিক্ষকতা করছেন। তার গবেষণাগার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উঠতি গবেষকের প্রধান আগ্রহের বিষয়।
প্রফেসর মনু প্রকাশের গবেষণার পেছনে মূল দর্শন হচ্ছে ‘ফ্রুগাল ফিলোসোফি’ (Frugal Philosophy)। এই দর্শনের মূল বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা। সহজ ভাষায়, বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত বিভিন্ন প্রযুক্তি থেকে অপ্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো বাদ দিয়ে খরচ কমিয়ে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে যেন প্রযুক্তি পৌঁছে দেয়া যায়– সেজন্য গবেষণা পরিচালনা করেন মনু প্রকাশ ও তার গবেষণাগারের সাথে জড়িত অন্যান্য ব্যক্তিরা। মনু প্রকাশের ভাষায়, “আমরা আসলে জানি না আমাদের গবেষণার ফলাফলে কার্যকর কিছু আসবে কিনা। তবে এটা নিশ্চিত, ‘কিছু একটা’ অবশ্যই আসবে।” কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, নতুন কিছু আবিষ্কারের চাপ নিয়ে তারা গবেষণা পরিচালনা করেন না। তাদের লক্ষ্য থাকে এমন কিছু নিয়ে কাজ করা করা, যা গতানুগতিক যন্ত্র থেকে খুবই সহজ গঠনের এবং অল্প খরচের হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। বাস্তবেই দেখুন, পেপারফিউজ মূলত সেন্ট্রিফিউজের কাজই করছে, কিন্তু অনেক সহজ পদ্ধতিতে, এবং এতে সেন্ট্রিফিউজের মতো ঝক্কিঝামেলা পোহাবার সম্ভাবনা নেই। পেপারফিউজের আগে ‘ফোল্ডস্কোপ’ নামের আরেক আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রকাশ সায়েন্স ল্যাবের বিজ্ঞানীরা তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রফেসর মনু প্রকাশের মাথায় পেপারফিউজের ধারণা এসেছিল হাজার বছরের পুরোনো একটি খেলনা থেকে। গোলাকৃতির কাগজ কিংবা প্লাস্টিককে সুতার মাধ্যমে খুব দ্রুত ঘোরানো যায়– এই ধরনের খেলনার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। অনেক সময় শিশুদের চিপসের প্যাকেটের সাথে খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের খেলনা উপহার দিয়ে থাকে। সেন্ট্রিফিউজের বিকল্প তৈরির জন্য মনু প্রকাশ ও তার সহকর্মীদের এমন কিছুর দরকার ছিল, যেগুলো খুব সহজেই অল্প শক্তি ব্যয়েই অনেক দ্রুত ঘোরানো যায়। সুতা ও শক্ত কাগজ কিংবা প্লাস্টিকের তৈরি এই খেলনার বিষয়টি তাদের মাথায় আসে। তাদের ধারণা ছিল, যদি দ্রুত ঘূর্ণায়মান প্লাস্টিকের ভেতর রক্তের নমুনা রাখা যায়, তাহলে অতি দ্রুত ঘূর্ণনের জন্য একসময় রক্তের উপাদানগুলো একটি আরেকটি থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এভাবে রক্তের নমুনায় যদি ভাইরাস থাকে, সেটিও নির্ণয় করা সম্ভব হবে। এই ধারণা থেকে তারা গবেষণা পরিচালনা করেন এবং সফল হন। শেষপর্যন্ত তারা দেখেন, এর মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতি অবলম্বনের পরিপ্রেক্ষিতে সত্যিই রক্তের নমুনা থেকে ভাইরাস চিহ্নিত করা যায়।
আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য পেপারফিউজ হতে পারে রোগ নির্ণয়ের জন্য আদর্শ সমাধান। আগেই বলা হয়েছে, আফ্রিকার অনেক দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ভালো নয়, বিদ্যুতশক্তিও সহজলভ্য হয়নি। এসব অঞ্চলে পেপারফিউজ খুব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মাত্র দেড় মিনিটেই এই যন্ত্রের সাহায্যে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব। এর খরচ এতটাই কম যে নিম্নবিত্ত পরিবারের কোনো সদস্যও অনায়াসে বাসায় বেশ কয়েকটি পেপারফিউজ রাখতে পারবে, যেগুলো প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যাবে। মনু প্রকাশ ও তার সহকর্মীদের গবেষণা পরিচালিত হয় মূলত সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য। পেপারফিউজের মাধ্যমে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর মানুষেরা উপকৃত হবে।