প্রথম পর্বে আমরা রশিদ নাজমুদ্দিনোভের শৈশব, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, এতিমখানায় থাকা, দাবায় হাতেখড়ি প্রভৃতি বিষয়ে জেনেছি। এই পর্বে থাকবে বিশ্বযুদ্ধ ও পরবর্তী ঘটনাবলী। শেষ পর্বে আমরা তার শেষজীবন ও তার সম্মানে অন্যান্যদের উক্তি নিয়ে জানবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
রশিদ নাজমুদ্দিনোভকে ৫,০০০ মাইল পূর্বে বৈকাল এলাকায় পূর্বেকার মঙ্গোলীয় সীমান্তের এলাকায় পোস্টিং দেয়া হয়। ১৯৪১ সালে সেখানেই তিনি লেক বৈকাল ডিসট্রিক্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। এখানে তিনি ভিক্টর বাতুরিন্সকি এবং কন্সট্যান্টিন ক্লামানের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে দেন।
এসময় শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার ক্যারিয়ারকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। সর্বমোট সাড়ে পাঁচ বছর তিনি সব ধরনের খেলা থেকে বঞ্চিত থাকেন। আসলে তিনি অসম্ভব সৌভাগ্যবান ছিলেন। বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান; কোনোগুলোতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে গিয়ে ঘুরে এসে, আবার কোথাও যুদ্ধ শেষ হবার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, বৈকালের যুদ্ধের ঠিক পরে তিনি সেখানে উপস্থিত হন, যেখানে রাশিয়ানরা জাপানীদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এরপর তাকে বার্লিনে পাঠানো হয়, ঠিক রুশরা শহর দখলের পরপরই। হিসেব করে দেখা যায়, রশিদ যতগুলো যুদ্ধ থেকে একটুর জন্য সংঘর্ষ থেকে এড়িয়ে গেছেন, সেগুলোতে সর্বমোট ১১ মিলিয়ন সোভিয়েত সৈন্য নিহত হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে বার্লিনে আয়োজিত হওয়া মিলিটারি চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ১৫ এর মাঝে ১৪ স্কোর করে চ্যাম্পিয়ন হন।
প্রত্যাবর্তন
১৯৪৬ সালে তিনি সম্পূর্ণ বেসামরিক জীবনে ফিরে কাজানে আসেন ও দাবায় পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। এসময় তার বয়স ছিল ৩৪। যদিও তিনি শুরুতে হোঁচট খান, তবুও ১৯৪৭ সালে তিনি অল ইউনিয়ন ক্যান্ডিডেট মাস্টার টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় হন। তিনি সেবছর মাস্টার টাইটেল খেলার জন্য মনোনীত হন, তার এক্সামিনার ছিলেন মিকেনাস। এখানেও দারুণ খেলেন রশিদ, অসাধারণ একটি অ্যাটাকিং ম্যাচও আছে তাদের উভয়ের। পুরো সিরিজটি ড্র হওয়ায় সোভিয়েত মাস্টার সেবার হতে পারেননি তিনি।
১৯৪৭ সালেই অ্যালেক্স সুয়েটিনের সাথে খেলা একটি ম্যাচ বিখ্যাত হয়ে আছে। এই ম্যাচে তার কুইনের বিপরীতে সুয়েটিনের দুটি রুক টিকতে না পারায় সুয়েটিন রিজাইন করেন। পরবর্তী দুই বছর হতাশাজনক কাটে তার, সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি। কিন্তু ১৯৪৮ সালে কিশেনাভে আয়োজিত মলদোভিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ভি. বাস্কিনের সাথে দারুণ এক ম্যাচ খেলেন। এই ম্যাচে রশিদের একটি রুক এবং একটি নাইটের সাথে বাস্কিনের দুটি রুক পেরে উঠতে না পারায় তিনি রিজাইন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি নিঝনি নভগ্রদে আয়োজিত রাশিয়ান ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ (আরএসএফএসআর) খেলার সুযোগ পান।
টুর্নামেন্টের হট ফেবারিট বলেস্লাভস্কিকে হারিয়ে দিয়ে তিনি বহুল প্রতীক্ষিত খেতাব সোভিয়েত মাস্টার অফ স্পোর্টস ইন চেস অর্জন করেন। পরের বছরও তিনি এই টুর্নামেন্টে জেতেন।
১৯৫১ সালে বাকুতে অনুষ্ঠিত ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত যান রশিদ। সেখানে লিলিয়েন্থালের সাথে খেলা তাঁর ম্যাচটি বিখ্যাত হয়ে আছে। রশিদই প্রথম তাতার ভাষায় দাবা বিষয়ক কোনো বই লেখেন। তিনি তৃতীয়বারের মতো রাশিয়ান ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ (আরএসএফএসআর) জিতে নেন ১৯৫৩ সালে সারাতভে, যেখানে তিনি শেষ ছয় ম্যাচ টানা জেতেন। এর মাধ্যমে তিনি ১৯৫৪ সালে কিয়েভে আয়োজিত ২১ তম ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার সুযোগ পান। এখানে তিনি রুশ গ্র্যান্ডমাস্টারদের সাথে জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হন। যদিও এই টুর্নামেন্টে তিনি সপ্তম হন, কিন্তু তিনি গ্র্যান্ডমাস্টারদের সাথে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেন ৭ এ ৪.৫ পয়েন্ট পেয়ে। এই টুর্নামেন্টে তিগ্রান পেত্রসিয়ানের সাথে তার একটি ম্যাচ বিখ্যাত হয়ে আছে। তারা উভয়ে খেলার ধরনের দিক থেকে পুরো বিপরীত ছিলেন। এই ম্যাচে রশিদ হেরে যান।
স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা খ্রুশ্চেভ সোভিয়েত খেলোয়াড়দের অন্যান্য দেশে ভ্রমণে কড়াকড়ি কমিয়ে দেন। ১৯৫৪ সালে বুকারেস্তে আয়োজিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার ডাক পান তিনি। এতে তিনি দ্বিতীয় হলেও পঞ্চম রাউন্ডে এনরিকো পাওলির সাথের অসাধারণ ম্যাচটি খেলে সবার নজর কাড়েন। এতে তিনি দুটি ঘোড়া স্যাক্রিফাইস করে এক অসামান্য আক্রমণ শানান। অভূতপূর্ব এই ম্যাচটি ইতিহাসে অন্যতম সেরা অ্যাটাক হিসেবে স্বীকৃত। এই ম্যাচের আগের দিনে ছেলের জন্মের সুসংবাদ পান তিনি। ম্যাচটি তিনি সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলেকেই উৎসর্গ করেন। এই টুর্নামেন্টের অনবদ্য পারফরম্যান্স তাকে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার খেতাব এনে দেয়।
১৯৫৭ সালে ইউএসএসআর চ্যাম্পিয়নশিপে খুব বেশি ভালো না খেললেও (১৩ তম স্থান অর্জন) দুটি উল্লেখযোগ্য ম্যাচ খেলেন। একটি পরবর্তী বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মিখাইল তালের সাথে। ষষ্ঠ পর্বের ম্যাচটির খেলার একপর্যায়ে তাল কার্যত কোনো কাউন্টার-অ্যাটাক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এই সুযোগই কাজে লাগান রশিদ, ধারণাতীত আক্রমণ করে বসেন তিনি। তাল রিজাইন করতে বাধ্য হন। তাদের এই ম্যাচটিও ইতিহাসে অন্যতম সেরা হয়ে থাকবে।
আরেকটি হলো ১৩ তম রাউন্ডের বরিস স্পাস্কির সাথে ম্যাচ। এখানেও রশিদের তুমুল আক্রমণে টিকতে না পেরে বরিস রিজাইন করতে বাধ্য হন। তাছাড়াও এই টুর্নামেন্টে ইউরি কটকভের সাথে জেতা ম্যাচটিও বিখ্যাত। এতসব দারুণ ম্যাচের পরেও রশিদ তার খেলা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার মতে, তিনি একা একা যখন দাবা নিয়ে গবেষণা করেন তখনই সৃজনশীল খেলাগুলো বেশি মাথায় আসে, খেলতে পারেন। আসল ম্যাচের সময় অধিকাংশ সময়েই তার খেলা কলাপ্স করতো তার নিজের মতে। টুর্নামেন্টটি তাল জিতে ইতিহাসে কনিষ্ঠতম সোভিয়েত মাস্টার হন। রশিদ এবং তাল পরস্পরকে সম্মান করতেন, এবং তাদের মধ্যে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তালকে সোভিয়েত চ্যাম্পিয়ন হবার শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন রশিদ।
সেবার কাজানে ফিরে রশিদ দুঃখজনক খবর পান, তাঁর ভাই কাভি নাদজমি নিজের সৃষ্টিশীল ক্যারিয়ারের শিখরে থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ভাই তাকে অনেকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন জীবনভর। ভাইয়ের মৃত্যু রশিদের জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। সেবছরই শেষের দিকে তাকে শৈল্পিক দাবা খেলার স্বীকৃতিস্বরূপ গভর্নমেন্ট মেডেলে ভূষিত করা হয়। ১৯৫৭ সালে তিনি চতুর্থবারের মতো আরএসএফএসআর চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। পরের বছর সাচিতে আয়োজিত রাশিয়ান ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ তিনি পঞ্চমবারের মতো নিজের করে নেন। সেখানেই তিনি লেভ পোলগেভস্কির সাথে তার অবিস্মরণীয় ম্যাচটি খেলেন। অনেক বোদ্ধার মতে, এটি সর্বকালের সেরা দাবা ম্যাচ হবার দাবিদার। এ ম্যাচের এক মুহূর্তে কালো ঘুঁটির রশিদের আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিলো কোনো ভালো চাল নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে রশিদ এমন আঘাত হেনে বসেন যে, পোলগেভস্কি সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণে বলেন,
আমি চোখ বন্ধ করলাম, বুঝতে পারলাম যে আমার সবধরনের আশাকে বিদায় জানাতে হবে। আমি এমন এক ম্যাচ হারতে চলেছি যার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে।
এই বিশেষ ম্যাচটি নিয়ে পরবর্তীতে একটি পেইন্টিংও তৈরি হয়।
ম্যাচটির সৌন্দর্য সম্পর্কে লেভ আরও বলেন,
I beat Nezhmetdinov a dozen times, but I would trade all my wins against him to win a game like this one.
আমরা এই পর্ব শেষ করলাম ঠিক সেই সময় যখন কি না রশিদ তার ফর্মের চূড়ায় অবস্থান করছেন। পরবর্তী পর্ব আমরা এখান থেকেই শুরু করবো। সাথে তার শেষজীবন, লেগ্যাসি ও তার সম্পর্কে অন্যান্য কিংবদন্তী দাবা খেলোয়াড়ের উক্তিগুলোও জানব।
এই সিরিজের পূর্বের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১) রশিদ নাজমুদ্দিনোভ (পর্ব ১): দাবার ইতিহাসে এক মুকুটহীন সম্রাট