
১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত জার্মানির বার্লিন শহরের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক কনক্রিটের দেয়াল, যা ইতিহাসের পাতায় বার্লিন প্রাচীর নামে খ্যাত। প্রহরী, সেনা চৌকি, বাঙ্কার, মাইন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, কাঁটাতার আর দুই সারি কনক্রিটের দেয়াল দিয়ে দুই বার্লিনকে পৃথক করা এ প্রাচীরটি স্নায়ুযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক প্রতীক। এ যেন দুই বিপরীত আদর্শের মধ্যকার বিভাজন সীমান্ত।
যখন বার্লিনকে বিভক্ত করা এ দেয়াল নির্মাণ শুরু হয়, তখন এটি নির্মাণের কারণ হিসেবে পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সরকার তাদের দাপ্তরিক ভাষ্যে বলেছিল, পশ্চিমা ফ্যাসিস্ট লোকজন যেন পূর্ব জার্মানিতে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য এ প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু সে সময় ঘটনা ঘটছিল ঠিক উল্টো। পশ্চিমারা যতজন পূর্বে প্রবেশ করছিল, তার তুলনায় অনেক বেশি পূর্ব জার্মানির অধিবাসীরা রাতের আঁধারে পক্ষ ত্যাগ করে পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে যাচ্ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর মিত্র বাহিনীর উপস্থিতি জার্মানিকে চারটি আলাদা অঞ্চলে বিভক্ত করে ফেলে। ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা নিয়ন্ত্রিত জার্মান অংশে যুদ্ধ শেষে চারটি আলাদা অঞ্চল গড়ে ওঠে। যুদ্ধ শেষে বার্লিন পড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন জোনে। পরবর্তীতে চার পরাশক্তির মাঝে বার্লিনকে ভাগ করে দেয়া হয়, যা থেকে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের অংশ মিলে গঠিত হয় পশ্চিম বার্লিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ নিয়ে তৈরি হয় পূর্ব বার্লিন। পশ্চিম বার্লিনের চারদিকে ছিল পূর্ব জার্মানির ভূখন্ড। এজন্য পশ্চিম বার্লিনকে তখন আইল্যান্ড অব ফ্রিডম বলেও ডাকা হত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার ফাঁকেই ১৯৪২ সাল থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে মিত্র বাহিনীর পক্ষগুলোর মধ্যে টানাপোড়ন শুরু হয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনীর জয় যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে আসে, তখন যুদ্ধোত্তর ইউরোপের পুনর্গঠন এবং যুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে বিপরীত অবস্থান নিতে শুরু করে। যুদ্ধোত্তর জার্মানি এই দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হয়, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালে জার্মানিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। জন্ম হয় দুটি স্বাধীন জার্মান রাষ্ট্রের। দুই জার্মান রাষ্ট্রের ভেতর ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি বা পশ্চিম জার্মানি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহযোগী আর জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক বা পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত ব্লকে।

Image Source: Rare Historical Photos
শুরুতে উভয় জার্মানির ভেতর জার্মান নাগরিকরা অবাধে চলাচল করতে পারলেও ১৯৫২ সালে দুই জার্মানির মধ্যকার সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বার্লিনের উভয় অংশে নাগরিকদের অবাধ চলাচল অব্যাহত থাকে। এ সময় পূর্ব জার্মানির অভ্যন্তরে অবস্থিত দুই বার্লিনের মধ্যকার সীমান্ত দিয়ে প্রচুর মানুষ রাতের আঁধারে পশ্চিম বার্লিনে পালিয়ে যেতে শুরু করে। মাঝে মাঝে উভয় পাশের সেনা সদস্যদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরও তৈরি হতো, যার জের ওয়াশিংটন ও মস্কো পর্যন্ত গড়াতো।
দুই বার্লিনকে ঘিরে মিত্র শক্তির ভেতর চলমান উত্তেজনা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৪৮ সালে, যখন চারদিক থেকে ঘিরে থাকা সোভিয়েত সেনারা পশ্চিম বার্লিনে অবস্থিত মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ সেনাদের রসদ সরবরাহের পথগুলো বন্ধ করে দেয়। সরাসরি সংঘাতে না জড়িয়ে মার্কিনপন্থীরা এ সময় আকাশপথ ব্যবহার করে পশ্চিম বার্লিনবাসীদের জন্য রসদ যোগান দিতে শুরু করে। এক বছর অবরোধ করার পর ১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়।
এরপর প্রায় এক দশক শান্ত থাকার পর ১৯৫৮ সালে পুনরায় উভয় পক্ষের মধ্যে বার্লিন নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ উত্তেজনার মূল কারণ ছিল বার্লিন ব্যবহার করে পূর্ব জার্মানদের পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়ার হিড়িক। ১৯৬১ সালের জুন মাসে বার্লিন দিয়ে ১৯,০০০ জার্মান পূর্ব থেকে পশ্চিমে পালিয়ে যায়। সে বছরের জুলাইয়ে বার্লিন দিয়ে পালায় আরও ৩০ হাজার। আগষ্টের প্রথম ১১ দিনে বার্লিন দিয়ে পালিয়ে যায় ১৬ হাজার। ১২ই আগস্ট, ১৯৬১ সালে বার্লিনের পথ দিয়ে পালিয়ে যায় ২,৪০০ জন, যা ছিল দুই জার্মানির ইতিহাসে একদিনে সবোর্চ্চ সংখ্যক পক্ষ ত্যাগের সরকারী পরিসংখ্যান।

Image Source: jackbarsky.com
১৯৬১ সালের গোড়া থেকেই চারদিকে বলাবলি শুরু হয়, পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করার জন্য পূর্ব জার্মানির সরকার আরও কড়া পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। পূর্ব জার্মানির সরকার শুরুতে বার্লিনের ভেতর কোনো দেয়াল তৈরির পরিকল্পনা নাকচ করে দিলেও সেই বছরের ১২-১৩ আগস্ট রাতের আঁধারে তারা বার্লিন শহরের বিভাজন রেখা অনুসারে কাঁটাতারের বেড়া বসিয়ে দেয় এবং পশ্চিম বার্লিনকে চারপাশ থেকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলে। উভয় শহরের ভেতর চলাচলের মূল পয়েন্টগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। বার্লিনবাসী পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে তারা তাদের পরিবার ও প্রতিবেশী থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে।
পরবর্তীতে এই কাঁটাতারের জায়গায় কংক্রিটের দেয়াল গড়ে ওঠে। বার্লিন দেয়াল মূলত দুই প্রস্থ দেয়ালের সমন্বয়ে গঠিত ছিলো, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার। দেয়ালের উচ্চতা ছিল ১৩ ফুট। পুরো দেয়াল জুড়ে সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব জার্মান সেনাদের বলা হয়েছিল কেউ দেয়াল টপকে পশ্চিম বার্লিনে পালানোর চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে গুলি করে তাকে হত্যা করতে। ১৯৮৯ সাল নাগাদ দেয়াল ঘেঁষে ৩০২টি ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করা হয়। দেয়ালটির ২৮ বছরের ইতিহাসে শতাধিক লোক পালাতে গিয়ে সৈন্যদের গুলিতে নিহত হয়।

১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পট পরিবর্তন হতে শুরু করলে তা পূর্ব জার্মানিকেও ধাক্কা দেয়। গণ দাবীর মুখে পূর্ব জার্মানির সরকার তার নাগরিকদের পশ্চিম জার্মানি ভ্রমণের উপর আরোপ করা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতে বাধ্য হয়। সেই বছরের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র ঘোষণা করেন, এখন থেকে পূর্ব জার্মানির নাগরিকরা বিনা বাঁধায় পশ্চিম জার্মানিতে ভ্রমণ করতে পারবে। তবে এ ধরনের ভ্রমণে যে কিছু বিধি নিষেধও আছে তা তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বললেন না। এদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যম পুরো ঘটনা না জেনেই প্রচার করতে শুরু করে, বার্লিন সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।
এ ঘোষণার সাথে সাথে উভয় বার্লিনের লোকেরা প্রাচীরের দুই পাশে জড়ো হতে শুরু করে। হঠাৎ করে এত বিপুল মানুষের উপস্থিতি পূর্ব জার্মান সীমান্ত চৌকির সেনাদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। করণীয় সম্পর্কে তারা বারবার উপর মহলের কাছে জানতে চাইলেও মানুষের জনস্রোতের উপর শক্তি প্রয়োগ করে রক্তপাত করার দায় পূর্ব জার্মান সরকারের কোনো নেতা নিতে রাজি হলেন না। একসময় সীমান্ত চৌকির সেনা অফিসাররা অনেকটা নিজস্ব সিদ্ধান্তেই বিনা পাসপোর্টে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভ্রমণের অনুমতি দিতে শুরু করে। ফলে উভয় অংশের যাতায়াতে পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তা সেদিন থেকে ফুরিয়ে যায়, আর উৎসাহী তরুণরা সেদিনই শুরু করে দেয়াল ভাঙার কাজ।

বার্লিন দেয়াল পতনের ফলে যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা পূর্ব জার্মানিকে এসে আঘাত করে তা সমস্যা সংকুল পূর্ব জার্মান সরকারকে আরও নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। বার্লিন দেয়ালের পতন ছিল দুই জার্মানি একত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ। বার্লিন দেয়াল পতনের মাত্র ১১ মাস পর ১৯৯০ সনের ৩০ অক্টোবর দুই জার্মানি এক হয়ে নতুন জার্মান রাষ্ট্র গঠন করে।
বার্লিন প্রাচীরের পতন কেবলই দুই জার্মানির এক হওয়ার গল্প নয়। এই দেয়াল ছিল স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বিবাদমান দুই পক্ষের বিভাজনের প্রতীক, যার এক পাশে ছিল পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, আর অপরপাশে একদলীয় সমাজতন্ত্র। বার্লিন দেয়ালের পতনকে ধরা হয় পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের চিহ্ন হিসেবে। তবে একত্রীকরণের পর পূর্ব জার্মানির নাগরিকরা রাতারাতি জীবনমানের যে উন্নতির আশা করেছিল তা এখনও পূরণ হয়নি। পূর্ব জার্মানির অধিকাংশ নাগরিক রাষ্ট্রীয় চাকরি ও কল্যাণকর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে নতুন রাষ্ট্রে মানবেতর জীবনযাপনের মুখোমুখি হয়। দুই জার্মানির নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের যে বৈষম্য বিভক্তির সময় তৈরি হয়েছিল, তার সমাধান আজও হয়নি।