মাউন্ট ভিসুভিয়াসের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল রোমান সাম্রাজ্যের প্রাচীন নগরী পোম্পেই। পাশেই ছিল হেরকুলানাম নামের আরেকটি নগরী। তৎকালীন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপূর্ণ নগরী হিসেবে পরিচিত পোম্পেই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি নগরী। এর অবস্থান ছিল দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে, যেখানে প্রায়ই ভূমিকম্প আঘাত হানতো। তাছাড়া নগরীর সন্নিকটে ভিসুভিয়াস তো ছিলই। ৬২ সালের ভূমিকম্পে যখন গোটা ইতালি কেঁপে উঠেছিল, তখন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পোম্পেই নগরীও। এই ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই গোটা পোম্পেই নগরীসহ হেরকুলানামে নেমে আসে চূড়ান্ত বিপর্যয়, যে বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায় গোটা পোম্পেই নগরী।
৭৯ খ্রিস্টাব্দে জেগে উঠে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরি। উত্তপ্ত লাভা, কালো মেঘ ও বিষাক্ত ধোয়ায় ছেয়ে যায় পোম্পেই ও হেরকুলানাম। লাভা, কাদা, ছাইয়ে ঢাকা পড়ে গোটা পোম্পেই। নিহত হয় প্রায় ২০০০ মানুষ। পার্শ্ববর্তী হেরকুলানাম নগরীসহ পোম্পেইতে বসবাস করতো প্রায় ১৫,০০০ থেকে ১৬,০০০ জনগণ।
ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে গোটা পোম্পেই নগরী ধ্বংসাবশেষে পরিণত হলেও মারা যাননি সবাই। ছাই ও মাটিতে ঢেকে যাওয়া নগরীতে ফিরতেও পারেননি বেঁচে যাওয়া বাসিন্দারা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার পরও কেউ কেউ ফিরে এসেছিলেন হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়-স্বজন ও ফেলে যাওয়া মূল্যবান সম্পদের জন্য কিন্তু খুঁজে পাওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না তখন। তাহলে বাকি অধিবাসীদের কী হয়েছিল, কোথায় খুঁজে নিয়েছিলেন পরবর্তী গন্তব্য?
প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে সহজেই অনুমেয় যে, ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া বাসিন্দাদের বেশিরভাগই খুব বেশি দূরে গিয়ে নতুন করে বসতি গড়েননি কিংবা গড়তে সক্ষম হয়নি। ইতালির দক্ষিণ উপকূলের আশেপাশেই নতুন আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন উদ্বাস্তুরা।
ওহাইওর মিয়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন টাক বেঁচে থাকা এই অধিবাসীদের সম্ভাব্য পরিণতি ও গন্তব্য নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তার মতে, বেশিরভাগ অধিবাসী নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিলেন নিকটবর্তী কুমাই, পুতেওলি, নেপলস ও অস্তিয়া ইত্যাদি অঞ্চলগুলোতে। সুপ্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দাদের পরবর্তী গন্তব্যের সন্ধান করা যথেষ্ট কঠিন। কারণ প্রয়োজনীয় দলিল কিংবা রেকর্ড সাধারণত কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।
ভিসুভিয়াসের দুর্ঘটনায় এই অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। কারণ গোটা নগরীই হারিয়ে গিয়েছিল উত্তপ্ত লাভা ও ছাইয়ের আবরণে। এই অবস্থায় শতশত বছর কাটিয়ে দিয়েছে প্রাচীন এই নগরীটি। পোম্পেই ও এই নগরীর আশেপাশের অধিবাসীদের নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অধ্যাপক টাক ব্যবহার করেছিলেন খুঁজে পাওয়া পোম্পেই সংক্রান্ত নথিপত্র, হস্তশিল্প, প্রাচীন অবকাঠামো ইত্যাদি। সেই সাথে গবেষণার ক্ষেত্রে এই গবেষক সুনির্দিষ্ট কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করেছেন।
অধ্যাপক স্টিভেন টাক তার গবেষণায় পারিবারিক নাম ব্যবহার করে খোঁজার চেষ্টা করেছেন পোম্পেই বাসিন্দাদের পরবর্তী বাসস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী পোম্পেই যেমন পরিচিত ছিল রোমান সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আমোদ-প্রমোদের স্থান হিসেবে, তেমনি এই অঞ্চলে দাস, অভিবাসী ও বিদেশিদেরও আনাগোনা ছিল। তাই স্থানীয় বাসিন্দা ব্যতীত অন্যান্যদের পারিবারিক নাম ব্যবহার করে এই কাজ করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার ছিল।
পোম্পেই ও হারকুলানাম নগরীর বাসিন্দাদের পারিবারিক নামের তালিকা তৈরির পর মিলিয়ে দেখা হয়েছে যে, ৭৯ খ্রিস্টাব্দের পর এই নামের অধিকারী ব্যক্তিবর্গ ইতালির কোন কোন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পোম্পেই ও হারকুলানামের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার, অবকাঠামো, দেবদেবীর আরাধনার রীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে যেসব অঞ্চলে নতুন করে দেখা গেছে, ধরে নেওয়া যায় সেসব অঞ্চলেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া নগরীর বাসিন্দাদের পা পড়েছে সেসব জায়গায়।
কর্নেলিয়াস ফুসকাস নামের একজনের নাম খুঁজে পাওয়া গেছে একটি নথিতে, যে পোম্পেই থেকে নেপলসে পাড়ি দিয়েছিল। যেখানে বলা আছে যে, তিনি পোম্পেই নগরীর বাসিন্দা ছিলেন। এরপর তিনি নেপলসে আসেন এবং সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। নথি অনুযায়ী দেখা যায় যে, উল্লেখিত ব্যক্তি পরবর্তীতে রোমানিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
পোম্পেই নগরীর দেয়ালের বাইরে প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি সিন্দুক খুঁজে পেয়েছিলেন, যেখানে প্রায় অক্ষত অবস্থায় সুলপিকিউস পরিবারের অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিলের সন্ধান পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য হলো, নগরীর ভিতর থেকে অনেকদূর পর্যন্ত সিন্দুকটি টেনে আনা হয়েছিল। সম্ভবত শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় সুলপিকিউস পরিবারের কেউ বা অন্য কেউ এটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার পাশেই ফেলে রেখে যেতে বাধ্য হয়। যা-ই হোক, সিন্দুকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায় যে, এই পরিবারের সাথে কুমাই অঞ্চলে ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল। হিসাব অনুযায়ী পরিবারটি পুনর্বাসিত হয়েছিল কুমাই অঞ্চলে।
ভেত্তিয়া সাবিনা নামের একজন নারীর কবর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল নেপলসের একটি পারিবারিক কবরস্থানে। কবরটির সামনে খোদাই করা ছিল ‘HAVE’ শব্দটি। পোম্পেই নগরীর স্থানীয় অস্কান ভাষার শব্দ এটি। যার অর্থ ‘স্বাগতম’। সাধারণর পোম্পেই নগরীতে দরজার সামনের মেঝেতে স্বাগতম জানিয়ে এটি খোদাই করা থাকতো। গবেষণায় আরো বেশ কয়েকজন নারীর পুনর্বাসনের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বেশ কিছু দাসের পরবর্তী আবাসনেরও।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি হলো, ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষেরা যেসব অঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলেন, সেসব অঞ্চলে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য তৎকালীন রোমান সম্রাট অর্থায়ন করেছিলেন। গবেষকের মতে, এসব অর্থ ছিল মূলত হারকুলানাম ও পোম্পেই নগরীর সেসব বাসিন্দাদের, যাদের কোনো উত্তরাধিকার ছিল না। আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের অর্থায়ন করার কৃতিত্ব অবশ্য সম্রাট একাই নিয়েছিলেন, যাদের অর্থে মূলত কাজ হয়েছিল তাদের কোন কৃতিত্বই দেওয়া হয়নি।
যেভাবেই হোক, নতুন শহরে আশ্রয়প্রার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য নতুন অবকাঠামো তৈরি করার উদ্যোগটি ছিল প্রশংসনীয়। এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই অপেক্ষাকৃত কম সময় ও জটিলতা ছাড়াই নতুন জীবন শুরু করতে পেরেছিলেন পোম্পেই ও হারকুলানাম নগরীর অধিবাসীরা।
ধ্বংসস্তুপে ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পত্তি ও আত্মীয়স্বজন ফেলে এসে, নিকটবর্তী নগরীতে জীবন শুরু করা সহজ ছিল না ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীদের জন্য। নিজেদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অনেকেই শুরু করেছিলেন নতুন জীবন। সবকিছু পেছনে ফেলে এই মানুষরা সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন, সাথে করে যথাসম্ভব নিয়ে এসেছিলেন নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় রীতি। হাজার বছর পর এগুলোর উপর ভিত্তি করেই জানা সম্ভব হয়েছে ভিসুভিয়াসের অগ্নুৎপাতের দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া সেই পোম্পেই ও আশেপাশের নগরীর অধিবাসীদের পরবর্তী ভাগ্য কীভাবে ও কোথায় নির্ধারিত হয়েছিল।