প্রিয় দিয়েগো,
আপনাকে ঠিক দেখা হয়নি আমাদের। সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা ওই ঘোলা ঘোলা ছবিগুলো গুলে খেলেও আপনাকে কি পুরোটা দেখা যায়? আপনাকে চেনার সূত্র তাই কখনো বই-পত্রিকার গোটা গোটা অক্ষর, কখনো বা আপনাকে জানতে হয় অন্য কোনো ফুটবলারের গুণকীর্তন গাওয়ার বর্ণনায়। কিংবা আপনি প্রাসঙ্গিক হয়ে ফেরত আসেন ফুটবলের নিতান্ত অবুঝ দর্শক মায়ের করা ওই প্রশ্নটায়,
‘এত যে মেসি-রোনালদো করো, ওরা কি ম্যারাডোনার চেয়েও ভালো?’
প্রথমে তো জেনেছিলাম দুটো গোলের কথা। প্রথম গোলটা তো পুরোদস্তুর জোচ্চুরি, রেফারি-লাইনসম্যানের শ্যেনচক্ষু ফাঁকি দিয়ে ফুটবলকে বানিয়ে দিয়েছিলেন হাতের খেলা। যে গোলের বর্ণনা দিতে বসলে আপনার চোখে-মুখের দীপ্তিচ্ছটায় মনে হতো, ‘গোলটা ঈশ্বরের হাত করেছে’ কথাটায় অতিরঞ্জন নেই একরত্তিও।
এর চার মিনিট পরের গোলটা অবশ্য আপনিই করেছিলেন। ওই পার্থিব জগতের সঙ্গে ‘কোনোরকম সংযোগ থাকা অসম্ভব’ গোলটা আপনি ছাড়া আর কেউ করতে পারে নাকি? লোকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল, এক… দুই… তিন… চার… করে গোটা ইংল্যান্ড দলটাই মন্ত্রাহত ফণিনীর মতো বশ মেনে গেল আপনার পায়ের জাদুতে। আর জানল, সৎ-অসৎ’এর ব্যবধানটা নাকি চার মিনিটের; দু’য়ের ব্যবধানটা বেশ সূক্ষ্ম।
আপনি যে ‘সবার চেয়ে ভালো’, এ কথাটায় তো আপনারও বিশ্বাস ছিল। ভিয়া ফিওরিতোতে জন্মেছিলেন, বুয়েনোস আইরেসের ওই জায়গাটাকে কেউ বস্তি বলতে পারবে না। কিন্তু সেখানে সংগ্রামেরও অভাব ছিল না। শীতকালগুলো কাটত প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, গ্রীষ্মে আবার ঠাঁ ঠাঁ রোদ। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর গল্পটা সেখানে রোজকের ঘটনা। দু’বেলা দু’মুঠো আহার যোগাতেই আপনার বাবাকে ঘর ছাড়তে হতো সূর্যোদয়েরও ঘণ্টাখানেক আগে। কাজে যেতে হতো মাকেও। এরই ফাঁকে যেটুকু সময় তাকে কাছে পেতেন আপনি, তাতেই তিনি আপনাকে বিশ্বাস করিয়ে ফেলেছিলেন, ‘দিয়েগো, তুমি সবার সেরা।’ আর মায়েরা তো কখনো মিথ্যা বলেন না।
মা অবশ্য ভাবতেন, পড়ালেখাতে সেরা হবেন আপনি। কিন্তু আপনার মন ছিল খেলাতে। ভিয়া ফিওরিতোর এক ভাগাড়ে খেলার শুরু, খেলতেন সিয়েতে কাঞ্চিতাসেও। ওই মাঠে খেলতে খেলতেই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন গোয়োকে। ‘আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সে ট্রায়াল হচ্ছে’ খবরটা প্রথম উনিই দিয়েছিলেন আপনাকে।
প্রথম দিন ট্রায়ালে দেখেই আপনাকে মনে ধরেছিল কোচের। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল ‘লস সেবোয়িতোস’-এর হয়েই তাই পেশাদার ফুটবলে পা রাখা। সেখানেই ফুটবল বিশ্বকে জানিয়েছিলেন, ‘ম্যারাডোনা বলে কেউ একজন আসছে।’ মনে আছে, একবার রেসিংয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে মাঠে নামানো হয়েছিল আপনাকে, ১২ বছর বয়সী আপনি দুই গোল করে ম্যাচ জিতিয়েই ফিরেছিলেন? কিংবা আপনাকে দলে রাখতে আর্জেন্টিনোসের কোচরা চেষ্টা করেছিল সর্বপ্রকারে? ওই যে একবার, বোকার মাঠে যেমন খেলে গিয়েছিলেন ‘মন্তানিয়া’ নাম নিয়ে!
শেষ পর্যন্ত আপনার গন্তব্য অবশ্য বোকাই হয়েছিল। আর বোকা নিয়ে আপনার জীবনে সুখস্মৃতিও তো কম নেই। বোকার বিপক্ষে এক ম্যাচে চার গোল করলেও ওদের দর্শকেরা আপনাকে দারুণ অভ্যর্থনাও জানিয়েছিল। বোকার হয়ে প্রথম দফায় মাত্র এক মৌসুমই খেলেছিলেন, কিন্তু সেটাই তো আপনার জন্য স্বপ্ন সত্যি হওয়া মুহূর্ত। নাকি স্বপ্নটা আপনার বাবার ছিল? ওই যে আর্জেন্টিনোসে খেলার সময় এক বিকেলে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি বলেছিলেন,
‘স্বপ্নে দেখলাম, তুই বোকার জার্সি পরেছিস, গোল করেছিস, আমরা উল্লাস করছি।’
ওই বার্সেলোনা অধ্যায় নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই অবশ্য৷ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, বার্সেলোনাতে দুই মৌসুমে ৪৯ ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৩৩ গোল আর ১৮ অ্যাসিস্ট। কিন্তু কোচের সঙ্গে গণ্ডগোল, কর্তাদের সঙ্গে ঝুটঝামেলা, মাঠের মধ্যে মারামারির কাণ্ডে কাতালান ক্লাবটাকে কখনোই মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি আপনি। কাগজে-কলমে ‘৮৪ সাল পর্যন্ত সেখানে থাকলেও মনটা তো আপনার ক্লাবছাড়া হয়েছিল এক মহাকাল আগেই।
ওই নরকবাস শেষে স্বর্গের দরকার ছিল আপনার। যে স্বর্গের সন্ধান পেয়েছিলেন নাপোলিতে। ভুল বলা হলো অবশ্য, স্বর্গটা তো আপনিই গড়েছিলেন। তা ‘ঈশ্বর’ কী না পারেন!
বারো মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ইতালির দক্ষিণ দিকের ওই অঞ্চলটায় যখন পা ফেলেছিলেন আপনি, তখন সেখানে যেতে চাইত না কেউ। ‘নোংরা’, ‘আবর্জনা’, ‘নর্দমার কীট’… কত কিছুই না শুনতে হতো নেপোলিতানাদের, শহরটা ছিল মাফিয়াদের দখলে। ওই শহরটার অধিবাসীদের আপনি জাতে তুললেন একটু একটু করে। দুটো সিরি-আ জেতালেন, জিতিয়েছিলেন উয়েফা কাপের শিরোপা। নেপোলিতানারা বুঝল, ঈশ্বর শুধু তাদের দিকে তাকানইনি, স্বয়ং নিজে নেমে এসেছেন।
অনেকে আপনাকে বলে বিশ্বকাপের নায়ক। তবে এই বিশ্বকাপ ছিল আপনার জীবনে নাটকীয়তার ভিন্ন চার অধ্যায়।
‘৭৮ সালে আসর বসলো ঘরের মাটিতে। আপনার গায়ে তখন ‘বিস্ময়বালক’-এর তকমা। কিন্তু খ্যাপাটে কোচ মেনোত্তি আপনাকে বাদ দিয়ে দল ঘোষণা করলেন। কারণ দর্শাতে তিনি জানালেন, তার মনে হয়েছে, আপনি বিশ্বকাপের জন্য এখনও প্রস্তুত নন। পরের বছর অনূর্ধ্ব-২০ দলের হয়ে বিশ্ব যুব চ্যাম্পিয়নশিপে দেখালেন বাম পায়ের জাদু। ডাগআউটে সিগারেট হাতে স্বয়ং মেনোত্তি আপনার খেলা দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন।
তবে মেনোত্তি ঠিকই ভেবেছিলেন। আপনি বিশ্বকাপে খেলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এত বড় মঞ্চে খেলার জন্য যে মানসিকতা এবং দক্ষতা লাগে, সেটা যে আপনার তখনও গড়ে ওঠেনি। ‘৮২ আসরে হাঙ্গেরির বিপক্ষে দুটো গোল করলেন। কিন্তু পরের ম্যাচেই বেলজিয়াম বের করে ফেলল “ম্যারাডোনাকে আটকাও, আটকে যাবে আর্জেন্টিনা” নীতি।
এরপর, সবাই অনুসরণ করতে লাগল বেলজিয়ামের দেখানো পথ। আপনি রইলেন বাক্সবন্দী হয়ে। সে বছর হতাশায় নতমুখে বিদায় নিলেও আপনি শিক্ষা নিয়েছিলেন।
স্তাদিও অ্যাজতেকে আপনার মেক্সিকো বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু হয় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষের ম্যাচ দিয়ে। প্রথম ম্যাচে তারা বেছে নেয় পুরনো সেই কৌশল। আপনাকে অসম্ভব কড়া মার্কিয়ে একের পর এক ফাউল করে গেল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আপনি নির্বাক; ফাউলের স্বীকার হয়ে তেড়েফুঁড়ে লড়াই করতে যাচ্ছেন না, হতাশ হবার কোনো নিশানা নেই আপনার মুখে, নীরবে মেনে নিয়ে আবার এগিয়ে যাচ্ছেন লড়াইয়ের মাঠে। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কড়া মার্ক ও ট্যাকল এড়িয়েও যাচ্ছেন সুকৌশলে।
মেক্সিকো বিশ্বকাপ ছিল আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। অবিশ্বাস্য জাদু দেখিয়ে গেছেন প্রতিটা ম্যাচে, দর্শক বুঁদ হয়ে থেকেছে আপনার পায়ের জাদুতে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচে একসাথে করেছেন দু-দুটো অমর কীর্তি। একটি তর্কসাপেক্ষে শতাব্দীর অন্যতম সেরা গোল, অন্যটি শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিতর্কিত কাণ্ড।
আলোচনার টেবিলে ঝড় উঠলে ঘুরেফিরে এ প্রসঙ্গগুলোই সামনে আসে। কিন্তু কেউ বলে না, কীভাবে আপনি নিজেকে বদলে ফেলেছিলেন। মানসিক এবং শারীরিক উভর দিক থেকেই আপনি ছিলেন দারুণ পরিণত একজন ফুটবলার। আপনি তখন জানতেন, একজন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের কী ধরনের গুণাবলী থাকা উচিত। আয়ত্তে এনেছিলেন, ব্যর্থতাগুলোকে সফলতায় পরিণত করার গুপ্তমন্ত্র।
নিজের তৃতীয় বিশ্বকাপের সময় আপনার গায়ে বিশ্বসেরার তকমা। চারিদিকে চলছে ম্যারাডোনা-বন্দনা। আর্জেন্টিনার চোট-জর্জরিত দলে সেবার আপনি আবর্তিত হয়েছিলেন আদর্শ দলনেতার ভুমিকায়। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে থেকে। অনেক কাছে গিয়েও আরও একবার সেই সোনালী শিরোপাতে চুমু খাওয়া হয়নি। তবে বিশ্ব চিনেছিল নতুন এক ম্যারাডোনাকে; যিনি অদম্য, যিনি পথপ্রদর্শক।
কানাঘুষো ছিল মাদকের নেশা পেয়ে বসেছে আপনাকে। ফুটবলের ভালোবাসা সরে যাচ্ছে মাদকের কাছে। একদিন গুজব সব সত্য বলে প্রমাণিত হল ভরা মজলিশে। ফুটবল থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখা হল টানা ১৫ মাস। ভিখারির বেশে বেরিয়ে যেতে হলো ইতালি থেকে। ফিরে গেলেন আপনার জন্মস্থানে। বেছে নিলেন ফুটবলবিহীন এক নির্বাসিত জীবন, যেখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।
চার বিশ্বকাপে নিজেকে দুটো ভিন্ন ভূমিকায় প্রমাণ করে ফেলেছিলেন আপনি। খুব কী দরকার ছিল আপনার অন্ধকার জগতে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার? রঙধনুর সাত রঙে রাঙানো আপনার ফুটবল ক্যারিয়ারে লেগে গেল বিশাল বড় কালো দাগ। ‘৯৪ বিশ্বকাপে আরও একবার ফিরে এসে সে দাগ আরও বড় করে তুললেন আপনি। চাঁদের কলঙ্কের মতো সে দাগ আর কখনও তোলা যাবে না।
আপনি নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন সবার থেকে উপরে, আবার নিজেই ঠেলে নামিয়েছেন সবার নিচে। কোচ কার্লোস বিলার্দোর সাথে মারামারি, বার্সেলোনার ট্রফিঘরে শিরোপা ভাঙার কাহিনী, কোকেনে আসক্তি, ‘৯৪ বিশ্বকাপে ডোপ কেলেঙ্কারি… আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে অজস্র।
কিন্তু আপনার দোষ, আপনার অন্ধকার জীবনের গল্প… সবকিছু আমলে নিতে গিয়েও ওই নেপোলিতানার কথাটাই কড়া নেড়ে যায় মনের দ্বারে,
‘ম্যারাডোনার ভুল ধরছো মানে তুমি ঈশ্বরের ভুল ধরছো। ঈশ্বরের তো ভুল ধরতে নেই…’