Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাচীন মিশরে জাদু চর্চা

বিভিন্ন প্রকার জাদুকরী ভাবনা ও অলৌকিকতা পৃথিবীতে প্রচলিত প্রায় সকল ধর্মেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, জাদু বিশ্বাস ছিল তৎকালীন পৃথিবীর অতি সাধারণ এক জিনিস। এমনকি জাদুর সাথে সম্পৃক্ত দেবতাদেরকে মাঝে মাঝে আত্মার পথপ্রদর্শক বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। জাদু ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করতে হলে তা বর্ণনা করতে হয় স্বাভাবিক ঘটনার বাইরে গিয়ে, অতিপ্রাকৃতের আশ্রয়ে। যেমন, মুসা (আ) সমুদ্রের পানি সরিয়ে এর মাঝখান দিয়ে নিজের অনুসারীদের নিয়ে ওপারে চলে গিয়েছেন- একে চিহ্নিত করা হয় স্বাভাবিক ঘটনার বাইরে একটি জাদু হিসেবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই জাদুর একটি নাম সেঁটে দেওয়া হয়েছে- তা হলো ‘মিরাকল’ বা ‘অলৌকিকতা’। বলা হয়ে থাকে, ঈশ্বরের সাহায্য নিয়ে মুসা (আ) এই অলৌকিকতা দেখিয়েছিলেন। এই অলৌকিকতা দেখাতে যে শক্তি প্রয়োজন হয়েছে, প্রাচীন মিশরীয় পুরাণ শাস্ত্রে বর্ণনায় সে শক্তিকে ‘হেকা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাচীন মিশরে ধর্মের সাথে জাদু ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। সহজ ভাষায়, একে ছিল অন্যের পরিপূরক।

মুসা (আ) সমুদ্রের পানি সরিয়ে পথ তৈরি করছেন; Image Source: Jehovah’s Witnesses

জাদুর দেবতা হেকা

বর্তমান বিশ্বের কাছে মিশর হচ্ছে জাদু ও রহস্যে আবৃত এক দেশ। প্রাচীন মিশরে হেকা নামে একটি শব্দের বহুল ব্যবহার ছিল। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, জাদু। তবে আমরা ‘হ্যারি পটার’, ‘লর্ড অভ দ্য রিং’, বা ‘গেম অভ থ্রোন্স’ থেকে জাদুর যে সংজ্ঞা বুঝে নিয়েছি, হেকা বৈশিষ্ট্য, উপাদান, ও প্রায়োগিক দিক দিয়ে সে জাদুর সাথে মোটা দাগে বিভক্ত। যে জাদু আজ সমাজে নিষিদ্ধ, প্রাচীন মিশরে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল মিশরে রোমান আধিপত্যের পর থেকে। সেক্ষেত্রে সমাজবিরুদ্ধ বা অগ্রহণযোগ্য জাদুর ব্যবহার বহুল প্রচলন ছিল অ-মিশরীয়দের মাঝে। মিশর-তত্ত্ববিদ জেমস হেনরি ব্রেস্টেডের মতে, “ঘুমানো বা খাওয়া-দাওয়ার মতোই জাদু ছিল প্রাচীন মিশরের এক নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।”

হেকার মূর্তি; Image Source: Zeinab Mohamed

হেকা হলো সে শক্তি বা প্রভাবক, যা নতুন কিছুর সৃষ্টিকে সম্ভব করে তুলে। হেকা সেই শক্তির নামে নামকরণকৃত এক দেবতার ব্যক্তিরূপের প্রকাশক। মিশরীয় উপকথার সৃষ্টিতত্ত্ব অংশ অনুসারে, পৃথিবী সৃষ্টির সময় হেকা ছিল ‘সিয়া’ এবং ‘হু’ এর সাথে। সিয়া বলতে বোঝায় ‘স্বর্গীয় জ্ঞান’ ও হু বলতে বুঝায় ‘স্বর্গীয় উচ্চারণ’। অতিপ্রাকৃত শক্তি হিসেবে হেকাকে ভালো বা মন্দ দুইদিকেই ব্যবহার করা যেত। তবে, প্রাচীন মিশরীয়রা এর ইতিবাচক দিকটিকেই অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

দেবতা হেকা মিশরের প্রাক-রাজবংশ থেকে পরিচিত হলেও, তার চর্চার বিকাশ ঘটেছিল প্রারম্ভিক রাজবংশের সময়কালে। তিনি মিশরের প্রতিটি মানুষের জীবনে এতো গুরুত্বের সাথে স্থান করে নিয়েছিলেন যে, তাঁর জন্য আলাদা কোনো মন্দির, ধর্মীয় অনুসারী বা আনুষ্ঠানিক পূজার চল ছিল না। প্রাচীন পিরামিডের পাঠ, ও প্রাক-মধ্যবর্তীকালীন সময়ে নির্মিত কফিনগুলোতে হেকার প্রচুর নিদর্শন বিদ্যমান। কফিনে প্রাপ্ত এক শাস্ত্র অনুসারে, হেকা দেবতা নিজেকে আদিম ও পুরাকালীন শক্তি হিসেবে দাবি করেছেন। তার মতে, “দেবতাদের জন্মের পূর্বেই আমি এই মহাবিশ্বে অধিষ্ঠিত ছিলাম। আমার কারণেই দেবতারা এই মহাবিশ্বে আসতে পেরেছেন।”

সৃষ্টির পর তিনি দেবতাদেরকে যে শক্তি দান করেছিলেন, সে শক্তি দিয়েই তিনি মহাবিশ্ব পরিচালনা করতেন। কিছু কিছু প্যাপিরি থেকে জানা যায়, দেবতারাও তাকে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চলতেন। মিশরবীদ রিচার্ড উইলকিনসনের ভাষায়, “হেকাকে অপ্রতিরোধ্য শক্তির দেবতা হিসাবে গণ্য করা হতো।”

মন্দিরের দেয়ালে হেকা; Image Source: Scott Noegel.

জাদুকর

প্রাচীন মিশরীয়রা প্রতিটি সমাজে একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে বাছাই করতেন। এই জ্ঞানী ব্যক্তিই দেবতা হেকার সাহায্য নিয়ে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন। মানুষের নানাবিধ সমস্যা সমাধান, উপদেশ প্রদান, প্রয়োজনে সাহায্য করতেন তিনিই। কাজের এই ধারা প্রবাহিত হতো বংশ পরম্পরায়। যেমন, মৃত্যুর পূর্বে পিতা তার পুত্রকে, মাতা তার কন্যাকে এই পেশা অর্পণ করে দিয়ে যেতেন। তাই দেখা গেছে, একটি সমাজ বা সম্প্রদায়ে শুধু একটি নির্দিষ্ট পরিবারই ছিল জাদুবিদ্যার আচার-অনুষ্ঠানে দক্ষ ও পারদর্শী।

প্রাচীন মিশরে মুখ উন্মোচন অনুষ্ঠান; Image Source: The British Museum.

প্রাচীন মিশরের জাদুকরদের ‘হেকাও’ বলে সম্বোধন করা হতো। পশ্চিম থিবসে মধ্যবর্তী রাজবংশের শেষ সময়ে এক কবরের কাঠের বাক্সের গায়ে একটি লেখার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। লিখাটি ছিল এরকম – ‘Hery Sheshta’ বা ‘Chief of mysteries or secrets’। ধারণা করা হয়, এটি হয়তো জাদুকরদের কোনো উপাধি হতে পারে। কাঠের জাদু সংক্রান্ত কিছু দ্রব্যাদি সেসময়ে জাদুর সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা দেয়। এর মধ্যে ধর্মীয় প্যাপিরাস, তামার তৈরি সাপ আকৃতির জাদুর ছড়ি, একটা জাদু ছড়ির অংশবিশেষ ইত্যাদি। তবে বস্তুগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কাঠের এক নারী মূর্তি, যার হাতে ছিল সাপের জাদুর ছড়ি আর মুখে ছিল বেসেটের মুখোশ।

প্রাচীন মিশরে জাদুবিদ্যা; Image Source: Ancient Origins

ধারণা অনুযায়ী, এসব উপাদান নিয়ে যিনি সর্বদা নাড়াচাড়া করতেন তিনি ছিলেন একজন পুরোহিত, যিনি স্থানীয় সমাজ বা মন্দিরে গুরুত্বপূর্ণ এক পদে আসীন ছিলেন। এই পুরোহিতদের ডাকা হতো ‘লেক্টর পুরোহিত’ নামে। তাদের মূল কাজ ছিল মন্দিরে মন্ত্র পাঠ করা। তবে শুধু মন্দিরেই নয়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও মমিকরণের সময়ও তারা বিড়বিড় করে প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় মৃতদের সামনে মন্ত্র আওড়িয়ে গেছেন। মিশরের অধিকাংশ মন্দিরে ‘হাউজ অভ লাইফ’ বা ‘জীবনঘর’ নামে একটা জায়গা বরাদ্দ ছিল, যেটাকে ব্যবহার করা হতো বিদ্যা-শিক্ষা ও গবেষণার কাজে। ‘হেকাও অভ দ্য হাউজ অভ লাইফ’ এবং ‘স্ক্রাইব অভ দ্য হাউজ অভ লাইফ’ নামে এরকম কিছু উপাধি জাদুকরদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।

লেক্টর পুরোহিত; Image Source: Ted Grudowski

প্রাচীন মিশরীয় ভাষায় ‘সা’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো ‘রক্ষা করা’ এবং ‘তাবিজ’ এই দুইটি অর্থ বোঝানোর জন্য। কিন্তু একপ্রকার মানুষকে ‘সাউ’ বলে ডাকা হতো। এই সাউ শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য মিশর-তত্ত্ববিদেরা এখনো উদ্ধার করতে পারেননি। তাই, সা-এর কাছাকাছি শব্দ হিসেবে অনুমান করা হয় সাউ-কে, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘তাবিজ প্রস্ততকারক’। কারিগর থেকে তাবিজ বানিয়ে আনার পর হেকা দেবতার মাধ্যমে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালন দ্বারা তাবিজ প্রস্তুতকারী তাবিজে জাদু প্রবেশ করাতেন।

পালিশ করা চিনামাটির একটি রক্ষাকবচ; Image Source: Walters Art Museum

কেউ যদি ভাবতেন, তিনি কোনো কারণে কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মাকে রাগিয়ে দিয়েছেন, তবে সাথে সাথে শরণাপন্ন হতেন ‘রেখেত’ এর। উদ্দেশ্য একটাই, ‘রেখেত’ যাতে বলে দেন- ঠিক কী কী করলে ওই ব্যক্তির উপর থেকে মৃত আত্মার রাগ নামবে। প্রাচীন মিশরে শুধু নারীরাই রেখেত হতে পারতেন। তাই, এই রেখেত শব্দের অর্থ ‘বিদুষী নারী’।

স্থানীয় সাপুড়েদের ডাকা হতো ‘খেরেপ সেলকেত’ নামে। যাদের কাজ ছিল বিভিন্ন বিষধর সাপ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য মন্ত্র পাঠ করা। মজার ব্যাপার হলো, এই সাপুড়ে বংশ মিশরে এখনো বসবাস করছে।

মিশরীয় পুরোহিতেরা হাতে সাপ আকৃতির দণ্ড ধরে রেখেছে; Image Source: Scott Noegel

মরুর শুষ্ক ও ধুলাময় পরিবেশের কারণে আদিম মিশরীয়রা শ্বাসকষ্ট, খোস-পাঁচড়ার মতো বিভিন্ন রোগ-বালাই এবং শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এজন্য তারা দায়ী করত দেবতার কঠোর অভিশাপ বা কোনো খারাপ জাদুকরের কর্মকাণ্ডকে। সে সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথও ছিল শুধু একটা, জাদুবিদ্যা। যেসকল পুরোহিত একইসাথে জাদুবিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, রোগীরা তাদেরই শরণাপন্ন হতেন। চিকিৎসার পদ্ধতিটাও ছিল বেশ অদ্ভুত! রোগ সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য চিকিৎসক প্রথমে অসুস্থ ব্যক্তিকে খুব ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার পাশাপাশি কিছু প্রশ্ন করতেন। পরে তিনি তৎকালীন ধর্মীয় রীতিতে আরোগ্য লাভের জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতেন।

প্রার্থনার মন্ত্রসমূহ জপ করা হতো সেসকল দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে, যারা চিকিৎসাশাস্ত্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। থোথ ছিলেন জ্ঞানের দেবতা। সেজন্য তাকে উদ্দেশ্য করেই মন্ত্র পাঠ করা হতো, যাতে মন্ত্রে কোনো ভুল না হয়। প্রতিটি মন্ত্রই পড়া হতো নির্দিষ্ট কোনো দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে। মহামারি থেকে বাঁচার জন্য দেবী সেখমেতের কাছে প্রার্থনা, বিষের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছিলেন বিছার দেবী সেলকেট।

ফারাও তৃতীয় রামেসিসের মন্দিরের সামনে সেখমেতের মূর্তি; Image Source: Simon Connor

প্রত্যেক জিনিসের জন্য মন্ত্রের রকমের হেরফের রয়েছে। যেমন- তাবিজ বা কবচের জন্য এক প্রকার মন্ত্র, মমিকরণের সময় একরকমের মন্ত্র, আবার সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য আরেক রকম মন্ত্র। কেউ চাইলেই হঠাৎ মন্ত্র পড়ে ফেলতে পারত না। এজন্য নির্দিষ্ট রীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মন্ত্র পাঠের পরিবেশ তৈরি করে নিতে হতো। সর্বোপরি, আচার-অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার প্রয়োজন হতো দক্ষ এক জাদুকরের, যেটাকে আজকের যুগের যজ্ঞ পরিচালনার পুরোহিতের সাথে তুলনা করা যায়। জাদুর আগে জাদুকরকে পরিচ্ছন্ন ও পূত-পবিত্র থাকতে হতো। মন্ত্রপাঠ করার পূর্বে তিনি গোসল করে ধবধবে নতুন পোশাক পরিধান করতে নিতেন। এই সময় তিনি কোনো প্রকার যৌনমিলন থেকেও বিরত থাকতেন। মন্ত্রগুলো প্রধাণত দুই প্রকারে বিভক্ত ছিল- একপ্রকার মন্ত্র মুখে উচ্চারিত হত, অন্যটি দেখানো হতো কার্যকলাপে।

বুক অভ দ্য ডেডের একটি অংশ। তৃতীয় মধ্যবর্তী যুগ, ২১ তম রাজবংশ, খ্রিঃ পূঃ ১০৭০- খ্রিঃ পূঃ ৯৪৬ অব্দ; Image Source: Egyptian Museum

প্রত্যুষকে প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে পবিত্র সময় বলে বিবেচনা করা হতো বিধায় সেসময়েই বেশিরভাগ জাদুকার্য সম্পাদন করা হতো। জাদুতে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে হোরাসের চোখ, আইসিসের গাঁট, আঁখ, পদ্মফুল, কার্তুশ, স্কারাব উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন মিশরীয়রা ভাবত, তাদের চারদিকে বহু অশুভ শক্তির কালোছায়া ভাসমান, যা যেকোনো সময় তাদের ক্ষতি সাধন করে দিতে পারে। অশুভ এই শক্তিগুলোর উৎস ছিল প্রেত, শয়তান, ও রাগান্বিত দেবতা। আবার কখনো কখনো তা আসতো ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চাকারী কোনো শত্রুর কাছ থেকে। অমঙ্গল ডেকে আনা এই শক্তিগুলোর সুরক্ষার জন্য প্রচলিত ছিল হোয়াইট ম্যাজিকের অনুশীলন এবং তাবিজ-কবজ পরিধান। বিশ্বাস অনুযায়ী, এর দরুন অশুভ শক্তিরা তাদের কাছে ঘেঁষতে পারত না।

প্রাচীন মিশরীয় জাদুর ছড়ি; Image Source: BBC

ইট-পাথরের বিলাসবহুল প্রাসাদের ফারাও থেকে একজন দিনমজুর পর্যন্ত জাদুর উপর বিশ্বাস রাখতো। শত্রুকে অভিশাপ দেওয়া, বন্ধ্যত্ব দূরীকরণ, বশীকরণ, ব্যবসায় উন্নতি, উন্নত স্বাস্থ্য প্রভৃতি কারণে মিশরে জাদুর ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। অবাক করা বিষয় হলো- প্রাচীন মিশরে প্রত্যেক ব্যক্তির দুটি করে নাম থাকত। একটি নাম ছিল জনসম্মুখে উন্মুক্ত, অর্থাৎ সবাই তাকে এই নামেই চিনতো। অপরটি জন্মের সময় রাখা হতো গোপনে, যে নাম শুধু ওই ব্যক্তির জন্মদাত্রী মা’ই জানতো। কারও উপর জাদু প্রয়োগ করতে হলে ওই গোপন নামের প্রয়োজন হতো।

রোজালি ডেভিড তার ‘রিলিজিয়ন অ্যান্ড ম্যাজিক ইন দ্য অ্যানসিয়েন্ট ইজিপ্ট’ বইয়ে বলেছেন, “মিশরীয় দেবতারা মানবজাতিকে জাদু শিখিয়েছিলেন আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে। এটি প্রয়োগ করতেন ফারাও বা জাদুকরেরা, যারা সেসময় কার্যকরভাবে দেবতাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।”

নেসকনের শাবতি বাক্স। ২৬ তম রাজবংশ, খ্রিঃ পূঃ ৬৫০ অব্দ; Image Source: The British Museum
ডেমোটিক ভাষায় লিখিত প্রাচীন মিশরের চিকিৎসার একটি পুঁথি; Image Source: The British Museum

শুধু জীবনের ক্ষেত্রে জাদু নিয়ে মাতামাতিতে থেমে থাকেনি মিশরীয়রা। মৃত্যুর পরেও এর বহুল ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। উচ্চবংশীয় কারও মৃত্যুর পর পুরোহিতেরা ওই মৃতদেহের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাদুকরী বস্তু স্পর্শ করার সময় মন্ত্র পাঠ করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, জাদুকরী এই আচার-অনুষ্ঠানের ফলেই মৃত ব্যক্তির বিদেহী আত্মা পরকালের জীবনে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন। মৃত ব্যক্তি যাতে মৃত্যুর পরের জীবনে ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য জাদুর সাথে সম্পৃক্ত কিছু পণ্য দেওয়ার রীতি ছিল তখন।

এগুলোর কথা বললে সবার আগে চলে আসে শাবতি পুতুলের নাম। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই শাবতি পুতুল দিয়ে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে চাষাবাদ করা যাবে। প্রাচীন মিশরের ‘দ্য বুক অভ ডেড’এ প্রায় ১৯২টি জাদুকরী মন্ত্রের উল্লেখ ছিল। তৎকালীন বিশ্বাস অনুযায়ী, এই মন্ত্রগুলো মৃত ব্যক্তির আত্মাকে নিরাপদে স্বর্গের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে।

বুক অভ দ্য ডেড। খ্রিঃ পূঃ ১৪২৫- খ্রিঃ পূঃ ১৩৫৩ অব্দ; Image Source: The British Museum

তাদের এই মন্ত্র প্রয়োগ থেকে রক্ষা পায়নি বহির্ভূত ও বিদেশী শত্রুরাও। দেশের শত্রুর ধ্বংস কামনা করে বিভিন্ন জাদুকরী মন্ত্র ব্যবহার করা হতো। শত্রুর নাম খোদাই করার যোগ্য-স্থান ছিল কাদামাটির পাত্র, মাটির সরু তাল, বা ছোট ছোট মূর্তি। তারপর সেগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা, ভাঙা, বা মাটিতে পুঁতে ফেলা হতো। চোর-ডাকাতের লুটপাটের হাত থেকে ফারাওদের সমাধিগৃহের মূল্যবান ধনসম্পদ রক্ষার জন্য জাদুমন্ত্র বা অভিশাপ লেখা হতো। ফারাও তুতেনখামেনের মমির অভিশাপটি এজন্য সারাবিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। (ফারাও তুতের অভিশপ্ত মমির আদ্যোপান্ত জানতে পড়ে ফেলতে পারেন – ফারাও তুতেনখামেনের অভিশপ্ত মমি: সত্য না মিথ্যা?)

পুরোহিত আমুন আমেনহোতেপের শাবতি বাক্স। ২১ তম রাজবংশ, খ্রিঃ পূঃ ১০৭০ – খ্রিঃ পূঃ ৯৪৫ অব্দ; Image Source: The British Museum

প্রাচীন মিশরবাসীদের কাছে জাদু কোনো ভেল্কিবাজি বা বিভ্রমের অংশ ছিল না। বরং, এই অতিপ্রাকৃত শক্তি সত্ত্বাকে ব্যবহার করা হতো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। তারা বিশ্বাস করতো, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করা হয়েছে জাদুর মাধ্যমে, জাদুকরী এক বলয় টিকিয়ে রেখেছে মলয়-শীতলা এই পৃথিবীকে। একজন মানুষের সুস্থতা-অসুস্থতা নির্ভর করে এই জাদুর উপরেই। এমনকি মানুষের মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকালের অসীমের যাত্রা নিশ্চিত করা হয় এই জাদুর মাধ্যমেই। এসব ধ্বংসাত্মক জাদুকরী মন্ত্র ছিল রাষ্ট্র সমর্থিত।

Related Articles