স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য সবে দূরের স্বচ্ছ আকাশে আভা ছড়াতে শুরু করেছে। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছিল। কিন্তু কে জানত এমন স্বচ্ছ দুনির্বার আকাশেও নিমেষেই বয়ে আসতে পারে মেঘের ভয়াল কালো থাবা। চারদিকে হঠাৎ-ই ঘনিয়ে আসে অচেনা এক দুর্যোগ।
-তোরা কী চাস, তোরা কী করতে চাস?
-আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
-কী! তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মি আমাকে মারতে পারেনি। আমি জাতির পিতা। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।
অতঃপর আচমকাই ঝড়! বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। শুধু তাকে আক্রমণ করেই ক্ষান্তি হয়নি, সেদিন রচনা হয় লাশের স্তূপ।
এভাবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর, ও ৭ নভেম্বর একের পর এক ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়ঙ্কর তিন-তিনটি অভ্যুত্থান; নেতৃত্বে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। পাল্টে যায় দেশের ইতিহাস, সামরিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঘটে ব্যাপক উত্থান-পতন। দুর্ভাগা জাতি হজম করে তিনটি রক্তাক্ত অধ্যায়। কিন্তু ‘বিহ্যাইন্ড দ্য স্ক্রিন’-এ কী ঘটেছে জাতি জানে না। সেসব নেপথ্যের অজানা কথাই উঠে এসেছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একজন স্টেশন কমান্ডার লে: কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদ-এর কলমে। বলছি ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’র কথা।
‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান’— এটুকু সবার জানা। এই অংশটুকু নিয়ে অনায়াসে অনেকগুলো বই পড়ে ফেলতে পারেন। কিন্তু যেটি অন্য কেউ লিখেননি, বা জানেন না সেটি হচ্ছে ‘কিছু না বলা কথা’। হ্যাঁ, ঠিক এই অংশটির জন্যই আপনাকে পড়তে হবে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি।
১৯৯৩ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তখনই বইটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে বইটির নবম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় সংসদ বিতর্ক, এবং মুজিব হত্যা মামলায়ও বইটি রেফারেন্স হিসেবে আলোচনায় এসেছে।
যারা এই অভ্যুত্থানগুলো নিয়ে লিখেছেন তাদের বেশিরভাগই কারো কাছ থেকে শুনে কিংবা কোনো সেকেন্ডারি সোর্সের উপর ভিত্তি করে ঘটনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। ঠিক এই জায়গায় লে: কর্নেল (অব.) এম. এ. হামিদের ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি ব্যতিক্রম। অভ্যুত্থানগুলোর সময় লেখক ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের স্টেশন কমান্ডার। যার সুবাদে তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন পরপর ঘটে যাওয়া তিন-তিনটি অভ্যুত্থান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি ঘটনারই সাক্ষী হয়েছেন।
যারা অভ্যুত্থানে সরাসরি জড়িত ছিলেন কিংবা পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়েছেন সকলেই ছিল কোনো না কোনোভাবে লেখকের পূর্ব পরিচিত, বন্ধু, কোর্সমেট। যার ফলে ঘটনাগুলো খুব কাছে থেকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন লেখক। তিনি তার নিজস্ব জায়গা থেকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বইটি রচনার চেষ্টা করেছেন। বন্ধু বা পূর্ব পরিচিত হওয়ার খাতিরে কোথাও কোনো তথ্য উপস্থাপনে কৃপণতা বা ঘটনা আড়ালের চেষ্টা দেখা যায়নি বইটিতে। এজন্যই হয়তো পাঠকসমাজে বইটি পেয়েছে দারুণ জনপ্রিয়তা।
এবার আসা যাক বইটিতে আসলে কী আছে। তখন আবার উল্টো প্রশ্নটি চলে আসে বইটিতে কী নেই? যেকোনো ফিকশনাল থ্রিলার উপন্যাসে চেয়েও অনেক বেশি টানটান উত্তেজনাপূর্ণ রোমহর্ষক বর্ণনা এবং ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো এক নির্মম ইতিহাস। যে ইতিহাস পাল্টে দেয় দেশের ভবিষ্যৎ, পাল্টে দেয় দেশের রাজনীতি।
বইটির শুরু ১৯৭১-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো দিয়ে। অতিদ্রুত ঘটনা পৌঁছে যাবে ‘৭৪-এ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ধূমায়িত অসন্তোষে, এবং মোড় নেবে সেই ‘৭৫-এর ভয়াল কালরাত্রি ও ষড়যন্ত্রের আদ্যোপান্তের দিকে। অতঃপর একেরপর এক ষড়যন্ত্রের কালো জাল আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।
১৫ আগস্টের মূল হোতা ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের মেজর ফারুক ও টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ। তাদের মধ্যে ছিল পারিবারিক ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। এদিকে মেজর ফারুক এত জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও এমন দুঃসাহসিকতার প্রসঙ্গক্রমে লেখক লিখেছেন,
তবে অনেকের প্রশ্ন, ফারুকের মতো জুনিয়র অফিসারের শক্তির উৎস ছিল কোথায়? জবাবটা সবার জানা নেই। তার সকল শক্তির উৎস ছিল বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। পারিবারিক সম্পর্কেও ফারুক ছিল খালেদের ভাগিনা।
এমনই নানান সম্পর্কের সমীকরণ আর রহস্যের জট খুলে এগিয়ে চলেছে ঘটনা। ১৫ আগস্ট রাতে কে ছিল নেপথ্যে, কারা ছিল মৌন সম্মতিতে আর কাদের তৎপরতায় হয়েছে এই অভ্যুত্থান; চিফ অব স্টাফ শফিউল্লাহ, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, কর্নেল শাফায়েত জামিল, খন্দকার মোশাররফসহ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভূমিকা কেমন ছিল সরাসরি উঠে এসেছে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’-বইটিতে। জানা যাবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সরাসরি বক্তব্য থেকে।
পরবর্তীতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নানান নাটকীয়তা, চিফ অব স্টাফ হাইজ্যাক ও পরে গদি দখল, ৪৬ বিগ্রেডের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা, মোশতাকের ট্যাংক মিছিল ও শপথ গ্রহণ, রাতের আঁধারে লাশ দাফনের চেষ্টা, বৈদেশিক শক্তির হস্তক্ষেপের আশঙ্কা এমনই বিভিন্ন উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা পাঠকের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক জন্মাতে যথেষ্ট বলেই মনে হয়।
বঙ্গবন্ধুকে কি আসলেই বাঁচানো যেত না? বঙ্গভবনে আক্রমণ জানার পরও কেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য মুভ করেনি? কিছু ঐচ্ছিক সময় বিভ্রাটের কারণ কী? ফারুক-রশিদের সাফল্যের পেছনে কী ছিল? বইটিতে এমনই নানান অজানা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক।
অতঃপর ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। ঘটে যায় অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান, জিয়াউর রহমানের গৃহবন্দী, বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের উত্থান-পতন, জেলহত্যার ভয়াল রাত্রি, মেজরদের দেশত্যাগ, এবং দিনশেষে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পর্কে লেখক বইয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে,
৩ নভেম্বরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, ওটার প্রস্তুতি হয়েছিল ঘটা করে প্রায় সবাইকে জানিয়েই। কিন্তু এসেছিল অতি নীরবে, নিঃশব্দে, মধ্যরাতে। একটি বুলেটও ফায়ার হয়নি, একটি হত্যাকাণ্ডও ঘটেনি। ভোরবেলা সবাই ঘুম থেকে উঠে জানতে পারে, আর্মির ক্ষমতা বদল হয়েছে। জিয়া আর চীফ অব স্টাফ নেই। তিনি বন্দি। খালেদ মোশাররফ নতুন অধিনায়ক।
৭ নভেম্বর, ১৯৭৫। দিন গড়িয়ে রাত্রি নামার সাথে সাথে বেজে উঠলো আরেকটি অভ্যুত্থানের দামামা। আবারো উৎপত্তিস্থল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। খালেদ মোশাররফ হত্যা, সেপাই-জনতার বিপ্লব, জিয়ার গৃহ-মুক্তি, জিয়া-তাহেরের ঠাণ্ডা লড়াই; অতঃপর সব মিলিয়ে এক নাটকীয় রক্তাক্ত রাত। বিপ্লবটা সাধারণ সেপাইদের হলেও কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতার আধিপত্য লাভ করেছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
বলা বাহুল্য, লেখক ও জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কোর্সমেট ছিলেন। তাদের সম্পর্কটাও অনেকটা তুই-তুকারির। এতদ্বসত্ত্বেও লেখকের সাবলীলভাবে ঘটনা বর্ণনা এবং বিশ্লেষণে কোনো ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়নি। নিরপেক্ষ এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেষ্টা করেছেন প্রতিটি ঘটনা। কখনো জিয়ার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করেছেন, আবার কখনো বা ঘটনার নিরপেক্ষতার প্রয়োজনে হয়েছেন সমালোচকও। এমনকি পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের সাথে মনোমালিন্যতার সূত্র ধরেই লেখক সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন।
অতঃপর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের আগমন এবং আকস্মিক পদন্নোতি নিয়ে লেখক লিখেছেন,
এরশাদ ছিলেন তখন সাধারণ সৈনিকদের কাছে একেবারেই একটি ‘অজ্ঞাত’ নাম। অথচ জিয়ার বদৌলতে তিনি একলাফে সামনের কাতারে। জিয়ার এই ‘সাধাসিধে-নম্র বেচারা’ মানুষটিই দেখতে দেখতে একদিন পূর্ণ ব্যাঘ্রে পরিণত হয়েছিল।
এরশাদ কতটুকু পূর্ণ ব্যাঘ্রে পরিণত হতে পেরেছিল, তা বোধ হয় নব্বইয়ের দশকের রাজনীতিতে চোখ রাখলে পাঠকই ভালো অনুভব করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, ‘৮১-এর বিদ্রোহে জিয়ার নিহত হওয়ার পেছনের কলকাঠি নিয়েও প্রশ্ন রেখেছেন লেখক, এসেছে বিশ্লেষণও। এভাবেই তিন-তিনটি অভ্যুত্থান রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। সেদিন ঠিক কী হয়েছিল, কে ছিল নেপথ্যে জানতে হলেও ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি অসাধারণ উৎস।
এদিকে বইটি পাঠক জনপ্রিয়তায় শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন তো থেকেই যায়। লেখক এম. এ. হামিদ বইটি লিখেছেন একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। ১৫ আগস্ট এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা আর বৈদেশিক গোয়েন্দাদের তৎপরতা কেমন ছিল, সেই দিকগুলো বেশ অস্পষ্টই রয়ে গেছে তার লেখায়। লেখক অবশ্য বইটিতে অকপটে স্বীকারও করেছেন তার সেই সীমাবদ্ধতার কথা।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে অন্তত এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, লেখক নিখুঁতভাবে নিরপেক্ষ যে বিবরণ দিয়েছেন, তা পড়তে পড়তে প্রতিটি ভয়াবহ ঘটনা, উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, রাতারাতি ক্ষমতার হাতবদল, এবং প্রতিটি উত্থান-পতনের অধ্যায়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে পাঠক। কী চমৎকার, স্বচ্ছ উপস্থাপন, ও সাবলীল লিখন! ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ও ৭ নভেম্বরের প্রতিটি ঘটনা ছিল অভাবনীয়, নাটকীয় ও রোমহর্ষক। সেসব রুদ্ধশ্বাস ঘটনা, নেপথ্যে কাহিনী আর ‘কিছু না বলা কথা’ জানতে আগ্রহী হলে ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইটি আপনার জন্যই।
বই: তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা || লেখক: লে: কর্নেল (অব.) এম .এ. হামিদ, পিএসসি
প্রকাশক: হাওলাদার প্রকাশনী || পৃষ্ঠা: ২৫৬