এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যার নাম মাদকাসক্তি।
মাদকাসক্তি বলতে বোঝায় মাদকদ্রব্যের প্রতি নেশাকে। যেসব দ্রব্য সেবন করতে আসক্তির সৃষ্টি হয়, জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা ও স্মৃতিশক্তি কমে যায়, সেগুলো বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে অভিহিত করা হয়েছে মাদকদ্রব্য হিসেবে।
ব্যাপক অর্থে, যেসব দ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং ঐসব দ্রব্যের প্রতি নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হয়, পাশাপাশি সেসব দ্রব্য গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশই বাড়তে থাকে, এমন দ্রব্যসমূহকে মাদকদ্রব্য বলে। আর কোনো ব্যক্তির এরূপ অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি।
সিগারেট, বিড়ি, তামাক, চুরুট, মদ, তাড়ি, গাঁজা, চরস, ভাং, মারিজুয়ানা, হেরোইন, ফেনসিডিল, মরফিন, ইয়াবা ইত্যাদি হলো মাদকদ্রব্য।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে মাদকাসক্তদের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও, ২০১৯ সালের এক বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭৫ লাখের উপর। মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস) এর তরফে এমন তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, এ সকল মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কিশোর ও তরুণ। ২০২১ সালে এসেও কিশোর ও তরুণ মাদকসেবীদের এই পরিসংখ্যান অপরিবর্তিত রয়েছে।
ঐ একই বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী ২০১৮ সালে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে ২৫ লাখ শিশু-কিশোর তথা অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সী মাদকসেবী রয়েছে।
সুতরাং এ কথা বলাই বাহুল্য যে, মাদকাসক্তি বিষয়ক যেকোনো আলোচনায় দেশের শিশু-কিশোরদের কীভাবে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে নিরাপদ রাখা যায়, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এবং অবশ্যই, শিশু-কিশোরদের মাদকসেবন থেকে বিরত রাখতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বাবা-মা।
আপনি যদি একজন বাবা বা মা হয়ে থাকেন এবং আপনার ছেলে বা মেয়ে সন্তান থাকে, তাহলে আপনাকে অবশ্যই তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, এবং নিশ্চিত করতে যেন তারা কোনোভাবে মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে।
কীভাবে নিশ্চিত করবেন সেটি? চলুন জানা যাক সেগুলো।
শিশু-কিশোররা মাদকসেবন করে কেন
আপনাকে প্রথমেই জানতে হবে, শিশু-কিশোররা কেন মাদকসেবন করে থাকে।
শিশু-কিশোরদের মাদকসেবনের পেছনে নানা ধরনের ফ্যাক্টর থাকতে পারে। প্রথমবার শিশু-কিশোররা মাদকের সঙ্গে পরিচিত হয় সাধারণত কোনো সোশ্যাল সেটিংসে, যেখানে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা রয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ শিশু-কিশোরের মাদকসেবনে হাতেখড়ি ঘটে সাধারণত স্কুলে কিংবা পাড়া-মহল্লায় সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে।
চলতি বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টার বিভাগের বিজ্ঞান সংস্কৃতি পরিষদ আয়োজিত ‘মাদকাসক্তি সমস্যা বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এক সেমিনারে বলা হয় যে, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শতকরা ৬ ভাগ ছাত্র মাদকাসক্ত এবং কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও মাদকাসক্তির প্রবণতা বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদকদ্রব্যের সঙ্গে প্রথম পরিচয় প্রধানত হয়ে থাকে সাধারণত ধূমপানের মাধ্যমে, কেননা সিগারেট এদেশে অত্যন্ত সহজলভ্য, এবং শিশু-কিশোররাও বড়দের নাম করে খুব সহজেই দোকান থেকে সিগারেট কিনে আনতে পারে।
সিগারেট খাওয়াকে অনেকে মাদকাসক্তি হিসেবে স্বীকার করতে না চাইলেও, এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। অবস্থাটা এমন যে, অন্য কোনো মাদকের প্রতি আকৃষ্ট না হলেও সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান করে থাকে অনেকে, এবং যারা অন্যান্য মাদকসেবন করে, তারা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই ধূমপায়ী হয়ে থাকে। তাই কেউ যদি ধূমপায়ী হয়, তাহলে একজন অধূমপায়ীর চেয়ে তার অন্যান্য মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
শিশু-কিশোরদের নিয়মিত ধূমপান বা অন্যান্য মাদকসেবন হতে পারে মূলত অনিরাপত্তাবোধ থেকে, কিংবা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভের আকাঙ্ক্ষার ফলে। অনেকে মাদকসেবনকে ‘বয়সের দোষ’ হিসেবেও অভিহিত করে থাকে। আদতেই, এই বয়সে শিশু-কিশোররা হয় অনেক বেশি বেপরোয়া, এবং যেকোনো কাজে তারা পরিণামের কথা চিন্তা না করেই অংশগ্রহণ করে ফেলে। এই অপরিণামদর্শিতাই শিশু-কিশোরদের মাদকের অপব্যবহারের দিকে ঠেলে দেয়।
শিশু-কিশোরদের মাদকসেবনের রিস্ক ফ্যাক্টর
- পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের মাদকসেবনের ইতিহাস;
- মানসিক বা আচরণিক অবস্থা, যেমন ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি অথবা অ্যাটেনশন ডেফিসিট/হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি);
- আবেগপ্রবণ অথবা অহেতুক ঝুঁকি গ্রহণের স্বভাব;
- কোনো ট্রমাটিক ঘটনার ইতিহাস, যেমন কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা চোখের সামনে দেখা কিংবা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া;
- ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাস অথবা সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অনুভূতি।
শিশু-কিশোরদের মাদকাসক্তির পরিণাম
শিশু-কিশোরদের মাদকাসক্তির নেতিবাচক পরিণতিসমূহের মধ্যে রয়েছে:
- মাদক নির্ভরশীলতা : যেসব শিশু-কিশোর কম বয়স থেকেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তাদের পরবর্তী জীবনে এর হার বৃদ্ধি এবং মাদকের প্রতি পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
- দুর্বল বিচারবুদ্ধি : মাদকাসক্ত হওয়ার সঙ্গে বিচারবুদ্ধি লোপ পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। যেসব শিশু-কিশোর মাদকাসক্ত, তাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মিথস্ক্রিয়ায় বারবার ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশঙ্কা রয়েছে।
- অনিরাপদ যৌনতা : মাদকসেবন প্রায়ই শিশু-কিশোরদের উদ্বুদ্ধ করে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ যৌন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে, যার ফলস্বরূপ অনেকে অপরিকল্পিতভাবে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, কিংবা যৌন রোগের শিকার হয়।
- মানসিক স্বাস্থ্যহানি : কোনো শিশু-কিশোরের যদি আগে থেকেই বিভিন্ন মানসিক অবস্থা যেমন ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি প্রভৃতি থাকে, মাদকাসক্তির ফলে সেগুলো আরো বৃদ্ধি পেতে পারে।
- দুর্ঘটনার হার বৃদ্ধি : অ্যালকোহল কিংবা অন্য কোনো মাদকসেবনের পর অনেক শিশু-কিশোরই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেমন অনেকেই চায় নিজেদের গাড়ি বা মোটরসাইকেল চালানোর দক্ষতা অন্যদেরকে দেখাতে। এতে করে রাস্তায় তাদের নিজেদের তো বটেই, অন্যান্য যাতায়াতকারী বা পথচারীদেরও দুর্ঘটনায় প্রাণসংশয় দেখা দিতে পারে।
- স্কুলের ফলাফলের অধঃপতন : মাদকাসক্তির ফলে স্বভাবতই পড়াশোনায় মন বসে না, স্মৃতিশক্তিও লোপ পায়। এসবের ফলে অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স নিম্নগামী হতে থাকে।
- শারীরিক ক্ষতি : মাদকসেবন একপর্যায়ে মাদকাসক্তিতে পরিণত হয়, এবং তা পরবর্তীতে মানুষকে বিভিন্ন শারীরিক অক্ষমতা ও দুর্বলতা, অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর দিকেও ঠেলে দেয়। একেক ধরনের মাদক মানুষের শরীরে একেক রকমের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, সিজার, লিভার ফেইলিয়র, হার্ট ফেইলিয়র, হার্ট-লিভার-ফুসফুস-কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়া, সিজোফ্রেনিয়া, হ্যালুসিনেশন, প্যারানয়া ইত্যাদি।
সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন মাদকের ব্যাপারে
যেকোনো বিষয়ে শিশু-কিশোরদের সচেতন করতে বা তাদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ উপায় হলো সোজাসুজি, খোলামেলা তাদের সঙ্গে ওই প্রসঙ্গে কথা বলা। আপনার শিশু বা কিশোর বয়সী সন্তান যদি মাদকসেবী না-ও হয়, কিন্তু আপনি তার ভবিষ্যতের ব্যাপারে চিন্তিত হন, তাহলে অবশ্যই আপনাকে তার সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে সিগারেট, অ্যালকোহল ও অন্যান্য নেশাদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে, এবং কেন তার এগুলো সেবন করা উচিত না।
মাত্র একবারের আলাপচারিতার মাধ্যমেই আপনার শিশু বা কিশোর বয়সী সন্তান পুরোপুরি মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে জেনে যাবে এবং আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে মানবে, এমন আশা করা হবে বোকামি। তার সঙ্গে আপনার প্রয়োজনে বেশ কয়েকবার কথোপকথনে অংশ নিতে হতে পারে। এবং এক্ষেত্রে আপনাকে এমন কোনো সময় বেছে নিতে হবে, যখন অন্য কোনো কারণে, যেমন- ফোন আসা বা কাজের চাপে, আপনাদের আলোচনা ব্যাহত না হয়।
এছাড়া কোন সময়ে এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে কথা বলা উচিত নয়, সেটিও আপনাকে বুঝতে হবে। যেমন: যখন আপনি আপনার সন্তানের উপর রেগে রয়েছে, যখন আপনি আপনার সন্তানের করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নন, কিংবা যখন আপনার সন্তান মাদকদ্রব্যের প্রভাবে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে রয়েছে, তখন কোনোভাবেই এ ধরনের আলোচনা শুরু করা যাবে না।
সন্তানের সঙ্গে মাদকদ্রব্য সম্পর্কে যেসব কথা বলবেন
- দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চান: শুরুতেই কোনো লেকচার দেয়া আরম্ভ করবেন না, কেননা শিশু-কিশোররা লেকচার শুনতে পছন্দ করে না। আপনি বরং আপনার সন্তানের কাছে তার মতামত জানতে চান যে সে মাদকদ্রব্য ব্যবহার সম্পর্কে কী ভাবে। এবং এক্ষেত্রে সত্যিটা সন্তানের মুখ থেকে বের করে আনার জন্য আপনাকে অবশ্যই তাকে সেই আশ্বাস বা নির্ভরতা দিতে হবে যে তার কথা শুনে আপনি কোনো বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না।
- মাদকদ্রব্য ব্যবহার না করার কারণ আলোচনা করুন: আপনি যদি মাদকসেবনের কুফল বা ক্ষতিকর দিকসমূহ সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত হন, তারপরও আপনার উচিত হবে না সেগুলো পরপর বলে আপনার সন্তানকে ভয় দেখানো। কেননা শিশু-কিশোররা এই বয়সে ভয় দেখানোও পছন্দ করে না। বরং তাদেরকে যদি কেউ কোনো ব্যাপারে ভয় দেখায়, তাহলে তাদের মনে আরো বেশি করে জেদ চাপে ওই কাজটি করার। তাই আপনাকে ভয় দেখানোর ফন্দি থেকে বের হয়ে এসে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকে জানাতে হবে যে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কীভাবে তার পড়াশোনা, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য, চেহারা প্রভৃতির ক্ষতি করতে পারে।
- গণমাধ্যমের মেসেজ সম্পর্কে সচেতন হোন: আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে টেলিভিশন অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র, গান ইত্যাদিতে মাদকসেবনকে গ্ল্যামারাইজ করে দেখানো হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে এগুলোকে এতটাই স্বাভাবিক কাজ হিসেবে দেখানো হয় যেন সকলেই মাদকসেবী হয়ে থাকে। গণমাধ্যমের এ ধরনের কনটেন্ট শিশু-কিশোরদের মনে মাদকদ্রব্য সম্পর্কে ভুল ধারণার বীজ বপন করে দিতে পারে। তাই আপনার সন্তান কোন ধরনের গণমাধ্যম বা কনটেন্টের সংস্পর্শে আসছে, এবং সেগুলো তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে কি না, সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
- পিয়ার প্রেশারকে না বলতে শেখান: মাদকসেবনের কুফলের পাশাপাশি আপনার সন্তানকে পিয়ার প্রেশার সম্পর্কেও অবহিত করুন। তাকে জানান, জীবনে চলার পথে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী অনেকের কাছ থেকেই অনেক ধরনের প্রস্তাব বা প্ররোচনা আসতে পারে, এবং সেগুলো মানার জন্য তাদের উপর চাপও প্রয়োগ করা হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের পিয়ার প্রেশারে কোনোভাবেই হার মানা যাবে না। নিজের বিচারবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সবসময় নিজে থেকেই নিজের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে হবে।
- নিজের মাদকসেবনের কথাও আলোচনা করুন: আপনি হয়তো ইতঃপূর্বে একজন মাদকসেবী ছিলেন, কিন্তু এখন ছেড়ে দিয়েছেন। তাহলে আপনার সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন যে ঠিক কী কারণে আপনি মাদকদ্রব্যকে বিদায় জানালেন। আবার যদি এমন হয় যে আপনি কখনোই মাদকসেবী ছিলেন না, তাহলে কেন ছিলেন না, সে কারণ এবং আপনার ব্যক্তিগত অনুভূতি আপনার সন্তানের সঙ্গে শেয়ার করুন।
- সন্তানের রোল মডেল হয়ে উঠুন: সন্তানের সামনে একজন প্রকৃত রোল মডেল হয়ে ওঠা সবচেয়ে জরুরি। আপনি যদি নিজে কোনো বাজে কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই আপনার সন্তানও আপনার দেখাদেখি সেই কাজ করতে শিখবে। তাই আপনি নিজে যদি একজন মাদকসেবী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি হাজার চেষ্টা করেও আপনার সন্তানকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে পারবেন না যে মাদকসেবন আসলেই ক্ষতিকর। তাই আগে নিজে মাদকসেবন ছাড়ুন, তারপর নিজের সেই আদর্শটি আপনার সন্তানের সামনে তুলে ধরুন।
অন্যান্য করণীয়
সন্তানকে মাদকদ্রব্যের হাত থেকে রক্ষার্থে আপনার রয়েছে আরো কিছু করণীয়। যেমন:
- আপনার সন্তান কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে মেশে, সে ব্যাপারে সবসময় খবরাখবর নিন।
- আপনার সন্তানের বন্ধুবান্ধবদের ভালো করে চিনুন, তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিশ্চিত হোন যে তারা আপনার সন্তানের জন্য অসৎ সঙ্গ নয়।
- আপনার পরিবারের কিছু নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ তৈরি করুন, এবং আপনার সন্তানকে সেসব বিধি-নিষেধের নেপথ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যাখ্যা করুন। তাকে আরো জানান ঐসব বিধি-নিষেধ অমান্য করার ফলাফল কী হতে পারে।
- আপনার সন্তানের প্রেসক্রিপশনের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখুন। যেকোনো অসুস্থতায় তাকে যদি ডাক্তার কর্তৃক প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খেতে বলা হয়, তাহলে কেবল সেই ওষুধগুলোই সে সঠিক পরিমাণে খাচ্ছে কি না, এবং সেসব ওষুধের বাইরে আর কিছু খাচ্ছে কি না, তা খেয়াল রাখুন।
- সন্তানের ভালো বন্ধু হয়ে উঠুন, তার মনের খবর রাখুন, যেকোনো সময় তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। মনে রাখবেন, আপনার মানসিক সহায়তা যদি সে সবসময় পায়, এবং ব্যক্তিগত, পারিবার ও সামাজিক জীবন নিয়ে যদি তার মধ্যে কোনো অনিরাপত্তাবোধ না থাকে, তবে তার মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেকাংশেই কমে যায়।
মাদকাসক্তির রেড ফ্ল্যাগ
হঠাৎ করে যদি নিম্নলিখিত আচরণগুলো আপনার সন্তানের মধ্যে দেখতে পান, তাহলে ধারণা করতে পারেন যে আপনার সন্তান সম্ভবত মাদকাসক্ত হয়ে উঠেছে:
- মারমুখী ও আগ্রাসী আচরণ করলে;
- চুপচাপ হয়ে গেলে বা নিজেকে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া থেকে গুটিয়ে নিলে;
- খাওয়া ও ঘুমের প্যাটার্ন পরিবর্তিত হলে;
- শারীরিক অবয়বের পরিবর্তন বা আকস্মিক স্বাস্থ্যহানি ঘটলে;
- বারবার অদায়িত্বশীল আচরণ, দুর্বল বিচারবুদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে আগ্রহের অভাব দেখা দিলে;
- বারবার পারিবারিক বিধি-নিষেধ অমান্য করলে;
- কোনো ধরনের অসুস্থতা না থাকা সত্ত্বেও তার ঘরে ওষুধের শিশি বা পাতা দেখা গেলে।
সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে করণীয়
যদি আপনি সন্দেহ করতে শুরু করেন বা প্রমাণ পেয়ে যান যে আপনার সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, তাহলে নিম্নলিখিত কাজগুলো করুন:
- কথা বলুন : শুরুতেই মাথা গরম করে তাকে বকাবকি করবেন না বা তার কোনো কাজে বাধা দেবেন না। বরং ঠান্ডা মাথায় তার সঙ্গে কথা বলুন, নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন যে সে আসলেই মাদকসেবন করছে কি না।
- সৎ হতে উৎসাহ দিন : প্রাথমিকভাবে আলাপচারিতার মাধ্যমেও যদি আপনি নিশ্চিত হতে না পারেন, তাহলে শান্তভাবে তাকে আপনার প্রশ্নটি সরাসরি করুন। এছাড়া অন্য যেসব কারণে প্রথম আপনার মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারেও জানতে চেয়ে দেখুন সন্তোষজনক উত্তর পান কি না।
- ব্যক্তিকে নয়, আচরণকে গুরুত্ব দিন : যদি প্রমাণ পেয়ে যান যে আসলেই আপনার সন্তান মাদকসেবন করছে, তাহলে ভুলেও এর জন্য আপনার সন্তানকে সরাসরি দায়ী করবেন না, কিংবা তাকে রাগের মাথায় কোনো নেতিবাচক বিশেষণে অভিহিত করবেন না। মনে রাখবেন, আপনাকে কথা বলতে হবে কেবল তার ক্ষতিকর অভ্যাস ও আচরণ নিয়ে, এবং তাকে বোঝাতে হবে যে মাদকসেবনের ফলে ঐসব অভ্যাস ও আচরণ ভবিষ্যতে আরো ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।
- নিয়মিত খবর নিন : নিয়মিত আপনার সন্তানের খবরাখবর নিতে শুরু করুন। বাসায় ফেরার পর বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে সে কোথায় গিয়েছিল, কী করছিল এসব জানতে চান, এবং অন্য কোনো উপায়ে তার উত্তরগুলোর সত্যতা যাচাই করে নিন।
- পেশাদারের সাহায্য নিন : যদি নিজে নিজে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, খবরাখবর নিয়েও সন্তানকে মাদকের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে না পারেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই পেশাদার কারো সাহায্য নিতে হবে। সেটি হতে পারে কোনো চিকিৎসক, কাউন্সেলর বা স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞ। এরপর তার পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নিন।
পরিশেষে মনে রাখবেন, একজন বাবা বা মা হিসেবে আপনার সন্তানের ভালোমন্দ খেয়াল রাখার দায়িত্ব আপনারই। কিন্তু সেই ভালোমন্দ নিশ্চিত করতে হবে সুকৌশলে, সঠিক উপায়ে। তাছাড়া আজ আপনি আপনার সন্তানকে যা বলবেন, তার সঙ্গে যে আচরণ করবেন, সেটিই নির্ধারণ করে দেবে তার ভবিষ্যৎ। তাই আপনার সন্তান মাদকাসক্ত হোক বা না-হোক, আজ থেকেই শুরু করে দিন তার সঙ্গে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা। নিশ্চিত করুন যেন আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ হয় সুখী, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর।