রক্তদান বা ব্লাড ডোনেশনের সাথে নিশ্চয়ই সবাই কমবেশি পরিচিত। এছাড়া আই ডোনেশন, কিডনি ডোনেশন, স্পার্ম ডোনেশন প্রভৃতির কথাও শুনে থাকার কথা। কিন্তু পুপ বা স্টুল ডোনেশন, সহজ বাংলায় যাকে বলা চলে মলদান; শুনেছেন কখনও এটির বিষয়ে? না শোনার সম্ভাবনাই বেশি। অনেকে হয়তো ভাবছেন, আমি নেহাতই মজা করছি আপনাদের সাথে। কিন্তু না, বাস্তবিকই প্রচলন রয়েছে এমন একটি ব্যবস্থার, যার মাধ্যমে প্রতি বছর বাঁচতে পারে হাজার হাজার মানুষের জীবন।
একজন মানুষের রক্ত যেমন অন্য আরেকজনের রক্তনালীতে প্রবেশ করানো যায়, কিংবা একজনের কিডনি আরেকজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়, তেমনই একজন মানুষের মলের উপকারী ব্যাকটেরিয়া অন্য আরেকজন মানুষের পরিপাকতন্ত্রে সংস্থাপন করা যায়। একে বলে ফিকাল ট্রান্সপ্লান্ট বা মল সংস্থাপন। ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল (C. difficile) নামক এক বিশেষ শ্রেণীর ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মানুষের অন্ত্রে ইনফেকশন হয়, যা পরবর্তীতে এমনকি প্রাণঘাতি রূপও ধারণ করতে পারে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে ফিকাল ট্রান্সপ্লান্ট।
ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল কী?
মানুষ আজকাল অ্যান্টিবায়োটিকের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ছোটখাট যেকোনো রোগের দ্রুত নিরাময়েও তারা শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করছে। এর ফলে তাৎক্ষণিক ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু কখনও কখনও অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে হিতে বিপরীতও হতে পারে।
মানুষের অন্ত্রের ভেতর বাস করে অসংখ্য রকমের অণুজীব, বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া। সব ব্যাকটেরিয়াই যে খারাপ তা তো নয়। কিছু কিছু উপকারী, ভালো ব্যাকটেরিয়াও রয়েছে। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা নেই। তাই সে মানুষের অন্ত্রে প্রবেশের পর খারাপ ব্যাকটেরিয়াগুলোর পাশাপাশি ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও সমূলে ধ্বংস করে দেয়।
সব ব্যাকটেরিয়া নির্মূল হয়ে যাওয়ার পর, অন্ত্রের ভেতর এক বিরান পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল নামক বিশেষ ব্যাকটেরিয়াটির বংশবৃদ্ধিতে খুবই সহায়ক। তাই অধিক অ্যান্টিবায়োটিকের সংস্পর্শে এসেছে, এমন অন্ত্রে ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল ব্যাকটেরিয়ার ঘাঁটি গাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
এবং এই ব্যাকটেরিয়া মানুষের পেটের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটি মানুষের পরিপাকতন্ত্রে এমন ডায়রিয়া তৈরি করে, যার সাথে রক্তপাত, জ্বর ও পেট ব্যথাও দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো এটি এতটাই গুরুতর আকার ধারণ করে বসে যে, তখন আর আক্রান্ত রোগীর জীবন বাঁচানোই সম্ভব হয় না।
যেসব দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত, অর্থাৎ যেসব দেশের অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত অধিক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকে, সেসব দেশে এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার মাত্রা বেশি থাকে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ১৪,০০০ মানুষ এর ফলে মারা যায়। ৬৫ বা ততোধিক বছরের মানুষের এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ও ফলস্বরূপ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল নির্মূলে ফিকাল ট্রান্সপ্লান্ট
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষের অন্ত্রে বাসা বাঁধা ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিল নির্মূলের ক্ষেত্রে করণীয় কী? স্বাভাবিকভাবে এক্ষেত্রেও অ্যান্টিবায়োটিকের কথাই প্রথম মাথায় আসবে। কিন্তু যে অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, পুনরায় আবার সেই অ্যান্টিবায়োটিকই যদি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে রোগীর হয়তো সাময়িক উপশম ঘটবে, কিন্তু পরবর্তীতে আবারো এই ব্যাকটেরিয়ার উৎপাতের আশঙ্কা বহুগুণে বেড়ে যাবে।
এই সমস্যার সমাধানে আবিষ্কৃত হয়েছে ফিকাল ট্রান্সপ্লান্টের ধারণাটি। এই ধারণার মূল কথা হলো: একজন সুস্থ-স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যবান মানুষের মলের ভালো ব্যাকটেরিয়া সংগ্রহ করে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। এর ফলে ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো ওই ব্যক্তির অন্ত্রে প্রবেশ করে ক্লস্ট্রিডিয়াম ডিফিসিলের বাঁচার উপযোগী বিরান পরিবেশ নস্যাৎ করে দেবে, আর ঐ ব্যক্তির প্রাণ হারানোর শঙ্কা দূর হবে।
ফিকাল ট্রান্সপ্লান্টের উপায়
ফিকাল ট্রান্সপ্লান্ট কীভাবে করা হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মল থেকে প্রাপ্ত ভালো ব্যাকটেরিয়া সহযোগে এক ধরনের গিলে খাওয়ার ক্যাপসুল তৈরি হয়, যা খুব সহজেই সেবন করে রোগমুক্তি সম্ভব। কিন্তু এই সহজ উপায়টি অনুসরণেই আপত্তি রয়েছে অধিকাংশ মানুষের। অন্যের মলের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে তৈরি করা ক্যাপসুল মুখে নেয়া যাবে না, এমন মানসিকতার কারণে তাই তারা অন্যান্য অপেক্ষাকৃত কঠিন ও কষ্টসাধ্য উপায় বেছে নেয়। যেমন: কোলনোস্কপির মাধ্যমে এক সলিউশন স্যালাইনের সাথে ভালো ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে দেয়া। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, গিলে খাওয়া ক্যাপসুলই একসময় সবচেয়ে বেশি প্রচলিত উপায়ে পরিণত হবে। কারণ মানুষের যে ঘৃণা লাগার প্রবণতাটি রয়েছে, ধীরে ধীরে তা প্রশমিত হবে। তখন তারা সুলভ ও সহজ পন্থাটিকেই বেছে নেবে।
স্টুল ব্যাংক
ব্লাড ব্যাংক বা আই ব্যাংকের মতো, স্টুল ব্যাংকও রয়েছে, যেখানে সুস্থ-স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যবান মানুষের মল ভবিষ্যতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এক্ষেত্রে অগ্রপথিক হলো যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ভিত্তিক স্টুল ব্যাংক ওপেনবায়োম। ২০১২ সালে ম্যাসেচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির শিক্ষার্থী মার্ক স্মিথ ও জেমস বার্গেস মিলে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগ পর্যন্ত স্টুল ডোনার পাওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দরকারের সময় ডোনার খুঁজে পাওয়া যেত না। কখনো কখনো রোগীরা এতটাই মরিয়া হয়ে উঠতেন যে, তাদের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কারো মল দিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। স্মিথ ও বার্গেসের এক বন্ধুর ঠিক এমনই একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যার ফলে তারা একটি স্টুল ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন, এবং নিজেরাই এমন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন স্টুল ব্যাংক আছে। তাছাড়া ব্যাংক ছাড়াও অনেক ক্লিনিক বা হাসপাতাল মল সংগ্রহ করে থাকে।
ডোনার হওয়ার যোগ্যতা
মলত্যাগ মানুষের দৈনন্দিন রুটিনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে খেতে হয়, আর যা সে খায়, তা তাকে মলত্যাগের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। মলত্যাগ না করে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। তাই সবাইকেই মলত্যাগ করতে হয়, এবং কারো কারো কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলেও, অনেকের কাছেই মলত্যাগ করা মোটেই দুঃসাধ্য কোনো কাজ নয়। কিন্তু মলত্যাগ ও মলদানের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কেউ যদি ভেবে থাকেন, আমি তো প্রতিদিন অনায়াসেই মলত্যাগ করি, তাহলে সেই মলই তো দান করা যায়, তাহলে তিনি অনেক বড় ভুল করছেন। কারণ একজন স্টুল ডোনার হতে চাইলে আপনাকে কেবল রোগমুক্ত, সুস্থ শরীরের অধিকারী হলেই চলবে না, আপনাকে অতি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে!
একজন ব্যক্তি অতি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কি না, তা প্রমাণ করতে তাকে অসংখ্য নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ওপেনবায়োম একজন ডোনার নির্বাচন করে এভাবে:
- আগ্রহী ব্যক্তিকে ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হতে হবে;
- কোনো রোগাক্রান্ত হলে বা তার শরীরে ইনফেকশন ও অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি থাকলে চলবে না;
- তাকে প্রথমে অনলাইনে আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে;
- নির্ধারিত দিনে তাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য হাজির হতে হবে;
- ক্লিনিক্যাল ইন্টারভিউয়ের পাশাপাশি তার শরীরে সম্ভাব্য সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে;
- তার মল ও রক্ত পরীক্ষা করা হবে।
প্রাথমিক এই পরীক্ষাতেই পাস করতে পারে ৩ শতাংশেরও কম আগ্রহী ব্যক্তি। কেননা ওপেনবায়োম নিশ্চিত করার চেষ্টা করে, ডোনারদের মলের ব্যাকটেরিয়া যেন রোগীর শরীরে নতুন অন্য কোনো রোগের সৃষ্টি করতে না পারে। যেমন- ২০১৫ সালে একবার ফিকাল ট্রান্সপ্লান্টের পর এক নারী অতিমাত্রায় মোটা হয়ে গিয়েছিলেন।
মলদানের জন্য উপযুক্ত ডোনারদেরকে পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু প্রক্রিয়াধীন থাকতে হয়:
- প্রতি ৬০ দিন অন্তর পুনরায় সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে;
- মলদানের জন্য প্রতিটি মলের ওজন কমপক্ষে ২ আউন্স (৫৫ গ্রাম) হতে হবে;
- মলদানের সময় তার শরীরে কোনো মৌসুমী রোগের ন্যূনতম উপসর্গও থাকা যাবে না;
- ন্যূনতম ৬০ বার মলদানে সম্মত থাকতে হবে।
ডোনারের লাভ
ভাবছেন এত নিয়মকানুন মেনে মলদান করে একজন ডোনারের লাভ কী? লাভটি হলো অর্থনৈতিক। প্রতিটি মলের নমুনার জন্য একজন ডোনার পেয়ে থাকেন ৪০ ডলার করে। কিন্তু যদি তিনি চুক্তিবদ্ধ থাকেন যে সপ্তাহে পাঁচদিন একবার করে মলদান করবেন, তাহলেই তার প্রতিটি নমুনার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ ডলার, আর তার সাপ্তাহিক আয় হয় ২৫০ ডলার। অর্থাৎ এভাবে তিনি বছরে ১৩,০০০ ডলার পর্যন্ত আয় করতে পারেন।
তবে অর্থ উপার্জনই ডোনারদের একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। ওপেনবায়োমের প্রতিষ্ঠাতা স্মিথ বলেন, “আমাদের অধিকাংশ ডোনারই সপ্তাহে তিন থেকে চারবার মলদান করতে আসে। এটি এক কথায় অসাধারণ। কারণ প্রতিটি মলের নমুনার মাধ্যমেই অন্তত তিন থেকে চারজন রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।”
অপরদিকে ওপেনবায়োমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ক্যারোলিন এডেলস্টেইনের মতে, বিষয়টি কেবল অর্থের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
“বাইরে থেকে অনেকেই মনে করে তারা (ডোনাররা) খুব সহজ একটি কাজ করেই এত অর্থ আয় করে ফেলছে। কিন্তু বিষয়টি শুধু তা-ই নয়। তারা এটিও শুনতে ভালোবাসে যে, ‘দেখো, তোমার মল নয় বছর ধরে ভোগা একজন মহিলাকে পুরোপুরি সুস্থ করে দিয়েছে। এখন তিনি তার মেয়ের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানেও যেতে পারবেন!'”
মলদানের ভবিষ্যৎ
এখন পর্যন্ত মল দিয়ে কেবল ক্লস্ট্রোডিয়াম ডিফিসিলের সংক্রমণই দূর করা যাচ্ছে, কিন্তু এর ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল বলেই মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই আবিষ্কার করেছেন যে, পেটের রোগ, ডায়াবেটিস, পার্কিনসন্স, বিষণ্ণতা, অটিজম প্রভৃতিতে আক্রান্ত মানুষের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের সাথে সাধারণ মানুষের মাইক্রোবায়োমের তফাৎ রয়েছে। তাই এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন যে, ফিকাল ট্রান্সপ্লান্টের মাধ্যমে ভবিষ্যতে মানুষের এসব রোগ প্রতিরোধের চিকিৎসায়ও কোনো নতুন মাত্রা যোগ করা যায় কি না। খুব শীঘ্রই হয়তো বিজ্ঞানীরা তেমন কিছুর সন্ধান পেয়ে যাবেন, আর তখন মলের চাহিদাও বহুগুণে বেড়ে যাবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/