সুস্থ দেহে সুন্দর মন। আর সুস্থ দেহ নিশ্চিত করতে হলে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিকল্প নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরের ধাপে মানুষের লক্ষ্য থাকে পুষ্টিকর খাদ্য নিরাপত্তার দিকে। বাংলাদেশেও বর্তমানে সকলের জন্য পুষ্টিকর খাবার নিশ্চয়তার দিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য চলছে বিস্তর গবেষণা। সারা পৃথিবী থেকেই নিয়ে আসা হচ্ছে এমন সব অধিক পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার যেগুলো হবে সকলের জন্য সাশ্রয়ী এবং বাংলাদেশেও যেসব উৎপাদন করা যাবে অন্যান্য ফসলের সাথে। এমনই কিছু সুপারফুড সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে এদেশে চাষযোগ্য করে তোলা হয়েছে। চিয়া, পেরিলা কিংবা কিনোয়া নামের এসকল সুপারফুডের বাংলাদেশে উৎপাদনযোগ্য প্রজাতির ফলন শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে এগুলো গ্রহণের প্রতি আগ্রহ।
সাধারণত প্রচুর পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারগুলোকেই সুপারফুড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অর্থাৎ, এরা যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান এবং খুব কম ক্যালোরি সরবরাহ করে। এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ, ভিটামিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকতে হবে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হলো একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা নির্দিষ্ট কিছু খাবারে পাওয়া যায়। এগুলো আমাদের শরীরে থাকা ফ্রি রেডিক্যাল নিষ্ক্রিয়করণে সাহায্য করে। ফ্রি রেডিক্যালস হলো শক্তি উৎপাদনের প্রাকৃতিক উপজাত যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অণুগুলো ফ্রি রেডিক্যালের প্রভাব হ্রাস করে যা নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য সমস্যার সাথে সম্পর্কিত:
- হৃদরোগ
- ক্যান্সার
- বাত
- স্ট্রোক
- শ্বাসযন্ত্রের রোগ
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব
- এমফিসেমা
- পারকিনসন্স রোগ
সুপারফুডগুলো সব ধরনের রোগের নিরাময় করবে বিষয়টি এমন নয়। ডায়েটিশিয়ান পেনি ক্রিস-ইথারটনের মতে,
“অনেকের কাছে এই খাবারগুলো সম্পর্কে অবাস্তব প্রত্যাশা রয়েছে। তারা মনে করে যে শুধু এই খাবারগুলোই তাদের দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে রক্ষা করবে। তারা আসলে খুব খারাপ খাদ্যাভাসের সাথে এরকম দুই-একটি পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে।”
আসলে দৈনিক পুষ্টি গ্রহণের অংশ হিসেবে সুপারফুডগুলো অন্তর্ভুক্ত করা ভাল স্বাস্থ্যের জন্য দুর্দান্ত; তবে কেবল তখনই যখন সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করা হয়।
চিয়া
চিয়া বীজের উপকারিতা বলতে গেলে অনেকদিকই উঠে আসবে। মানুষের শরীর এবং মস্তিষ্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক উপাদানই এই খাবারের মধ্যে আছে। পুষ্টিগুণে ভরপুর বীজটির বিভিন্ন উপকারী দিক সম্পর্কে চলুন আলোচনা করা যাক:
চিয়া বীজে প্রচুর পুষ্টি এবং অল্প ক্যালরি
মিন্ট জাতীয় গাছের সাথে সম্পর্কিত গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Salvia hispanica, যা মায়া ও অ্যাজটেক সভ্যতার মানুষের জন্য ছিল অন্যতম প্রধান খাবার। চিয়া তাদের কাছে প্রয়োজনীয় কর্মশক্তি যোগানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনকি প্রাচীন মায়ান শব্দ ‘চিয়া’র অর্থ ছিল ‘বল’। প্রাচীন ইতিহাসে প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত এই খাবারকে বর্তমানে বলা হচ্ছে আধুনিক সুপারফুড এবং স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে ক্রমেই বেড়ে চলছে এর গুরুত্ব। প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়াতে ৩৫ গ্রাম ফাইবার, ১৬ গ্রাম প্রোটিন, ৩১ গ্রাম চর্বি (যার মধ্যে ১৮ গ্রামই ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড) ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, অল্প পরিমাণে জিংক, পটাসিয়াম, ভিটামিন বি১, বি২ ও বি৩ রয়েছে। অসাধারণ এই খাবারের এত পুষ্টিগুণ থাকলেও এর ১০০ গ্রামে মাত্র ৪৮৬ ক্যালোরি শক্তি এবং ৪২ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট থাকে।
এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্যাভ্যাস
চিয়া বীজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য এন্টিঅক্সিডেন্টের প্রাচুর্য। বিভিন্ন গবেষণা থেকে চিয়াকে খাবার হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল তৈরিতে বাধা দেয়, যা মানুষের বয়স বৃদ্ধি এবং শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগ তৈরি হওয়ার জন্য দায়ী। এছাড়াও চিয়া বীজে রয়েছে—
- উচ্চ গুণমান সমৃদ্ধ প্রোটিন
- ওজন কমাতে সহায়ক ফাইবার ও প্রোটিন
- হৃদরোগ কমাতে সহায়ক খাদ্যগুণ
- প্রচুর পরিমাণে হাড় গঠনকারী পুষ্টি উপাদান
- রক্তে শর্করা হ্রাসকারী উপাদান
- দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ হ্রাসকারী খাদ্যগুণ
বহু গুনের অধিকারী খাবারটি খুব সহজেই মানুষ তার খাদ্যাভ্যাসে পরিণত করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের খাবারের (দই, শাক-সবজি, পুডিং, স্মুদি, জুস ইত্যাদি) সাথেই এই বীজ মিশিয়ে খাওয়া যায়। এমনকি এই বীজটি কাঁচাও খাওয়া যায়। তবে অনেকে পানিতে ভিজিয়ে খাবারটি খেয়ে থাকেন। বাংলাদেশেও বর্তমানে চিয়া বীজের চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের রবি ফসল চাষযোগ্য যেকোনো জমিতে চিয়া চাষ করা সম্ভব।
পেরিলা
ল্যামিয়াসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত পেরিলা একটি তেলবীজ ফসল। তৃণজাতীয় এই উদ্ভিদ পেরিলা ফ্রুটেসেন্স বা কোরিয়ান পেরিলা নামেও পরিচিত। পেরিলা মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়। পেরিলা তার সুগন্ধের জন্য এবং বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালীতে, বিশেষ করে জাপানি কিংবা কোরিয়ান খাদ্যসামগ্রীতে স্বাদবৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি ভারতের বেশ কিছু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যেও মশলা হিসেবে জনপ্রিয়।
পেরিলা বীজের উপকার
পেরিলা বীজ প্রচুর পুষ্টির সাথে ঘন বাদামি স্বাদযুক্ত একটি খাবার। এই বীজে ওমেগা-৩-৬-৯ এর মতো স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকে। এটি প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন, ও খনিজ পদার্থ, যেমন- ফসফরাস, তামা, আয়রন, ভিটামিন এ, ভিটামিন ই, ভিটামিন কে, এবং কোএনজাইম কিউ-১০ সমৃদ্ধ। পেরিলা বীজে উপস্থিত স্বাস্থ্যকর চর্বি প্রায় ৬০%, এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, আলফা-লিনোলেনিক এসিড (ALA) এর মাত্রা ৫৪-৬৪%। এই অপরিহার্য ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের সঠিক কার্যক্রমে সাহায্য করে। এছাড়াও পেরিলায় থাকা ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড ওমেগা-৩ এর সংমিশ্রণে কাজ করে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং মানুষের ত্বকের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। পেরিলা বীজে উপস্থিত ওমেগা-৯ (ওলিক অ্যাসিড) হৃদরোগ এবং রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতি ১৫০ গ্রাম (১ কাপ) পেরিলা বীজে ৮১৬ ক্যালোরি শক্তি থাকে। যার মধ্যে—
- প্রোটিনের পরিমাণ = ৫৫ গ্রাম (১০৬.২ ক্যালরি)
- ফ্যাটের পরিমাণ = ১ গ্রাম (৫৮৫.৯ ক্যালোরি)
- কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ = ৪৪.১ গ্রাম (১৭৬.৪ ক্যালোরি)
এছাড়াও পেরিলাতে ভিটামিন, খনিজ এবং ডায়াটরি ফাইবার থাকে।
পেরিলা পাতার উপকারিতা
পেরিলাগুল্মের রয়েছে আরও অনেক ব্যবহার। ক্ষেত্রবিশেষে এটি বিফস্টেক নামেও পরিচিত। রান্নাঘরে পেরিলা পাতাগুলো তাদের প্রাণবন্ত বেগুনি রঙের কারণে খাবার সাজানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। পেরিলার রয়েছে কিছু ঔষধি গুণ। এটি হাঁপানি, বমি বমি ভাব এবং সানস্ট্রোকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এটি ঘাম প্ররোচিত করতে এবং পেশীর খিঁচুনি কমাতেও ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ুর সাথে এই ফসলের সফল অভিযোজন ঘটাতে পেরেছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
কিনোয়া
কিনোয়া একটি শস্য ফসল, যা তার ভোজ্য বীজের জন্য উৎপাদিত হয়। এটি সিরিয়াল শস্য নয়, বরং সিউডো-সিরিয়াল। অন্য কথায়, এটি মূলত একটি বীজ, যা শস্যের অনুরূপ প্রস্তুত করা হয় এবং খাওয়া হয়। কিনোয়া ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। তারা একে ‘সমস্ত শস্যের মা’ হিসাবে উল্লেখ করত এবং পবিত্র বলে বিশ্বাস করত। এটি দক্ষিণ আমেরিকায় হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং সম্প্রতি একটি ট্রেন্ড ফুডে পরিণত হয়েছে, এমনকি সুপারফুড মর্যাদায় পৌঁছেছে। যারা ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন তাদের কাছে কিনোয়া ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উচ্চ প্রোটিন এবং অন্যান্য খনিজ উপাদানের কারণে এটি একটি সম্পূর্ণ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হয়। কিনোয়ার কিছু চিত্তাকর্ষক দিক রয়েছে, যেমন- এতে কার্বোহাইড্রেট কম যা রক্তে শর্করার মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে। উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল কমায়। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাদ্যতালিকায় একটি দুর্দান্ত সংযোজন হতে পারে।
আজকাল, সারা বিশ্বে কিনোয়া এবং কিনোয়াজাত পণ্যগুলো খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত স্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান এবং রেস্তোরাঁগুলোতে যারা প্রাকৃতিক খাবারের উপর জোর দিয়ে থাকে। কিনোয়ার তিনটি প্রধান প্রকার রয়েছে: সাদা, লাল এবং কালো।
কিনোয়া বীজের উপকারি দিক
বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি হ্রাসে কিনোয়া কার্যকরী খাদ্যের একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। কার্যকরী বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে খনিজ, ভিটামিন, ফ্যাটি অ্যাসিড, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা পুষ্টি চাহিদায় বিশেষ অবদান রাখতে পারে। বিশেষ করে কোষের ঝিল্লি রক্ষা করতে, মস্তিষ্কের নিউরোনাল ফাংশনে ভূমিকা রাখে। এর খনিজগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এনজাইমে সহ-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে এবং এর সমৃদ্ধ প্রোটিনে উচ্চ ভ্যালু যোগ করে। কিনোয়াতে ফাইটোহরমোনও রয়েছে, যা মানুষের পুষ্টির জন্য অন্যান্য উদ্ভিদ খাবারের তুলনায় একে এগিয়ে রাখবে।
প্রতি ১ কাপ (১৮৫ গ্রাম) রান্না করা কিনোয়ার পুষ্টি উপাদান:
- প্রোটিন: ৮ গ্রাম
- ফাইবার: ৫ গ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ: ৫৮% (RDA)
- ম্যাগনেসিয়াম: ৩০% (RDA)
এছাড়াও রয়েছে ফসফরাস, ফোলেট, তামা, আয়রন, দস্তা, পটাশিয়াম, ভিটামিন বি১, বি২, এবং বি৬ ইত্যাদি। অল্প পরিমাণে ক্যালসিয়াম, বি৩ (নিয়াসিন), এবং ভিটামিন ই। এতে অল্প পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডও রয়েছে। এছাড়াও কিনোয়ার আরো কিছু উপকারি দিক—
- কিনোয়া ফাইবার সমৃদ্ধ এবং গ্লুটেন-মুক্ত
- কিনোয়া রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
- এতে রয়েছে আয়রন এবং লাইসিন
- এটি মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
- কিনোয়ায় ম্যাঙ্গানিজ রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য করে
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি বাংলাদেশে চাষের উপযোগী সাউ কিনোয়া-১ জাতের উদ্ভাবন করেছে, যা এই সুপারফুডটি বাংলাদেশে উৎপাদন এবং তার বাজারজাতকরণের জন্য অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে।