নীতি ও নৈতিকতার মতো বিমূর্ত ধারণাগুলোর পরিমাপ অাদৌ কি সম্ভব? অার যদি সম্ভবই হয়, তবে সেটির অাদর্শ মাপকাঠিই বা কী? যুগে যুগে অাসা যত মনোবিদ থেকে দার্শনিক, সকলকেই তাড়িয়ে বেড়িয়েছে এই একটি প্রশ্ন।
অাসলেই তো! নীতি ও নৈতিকতার সংজ্ঞাই যেখানে ব্যক্তি, সমাজ এবং সভ্যতাভেদে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, সেখানে মাপকাঠির অাশা করাটা বেশ কঠিনই।
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের হাত ধরে জন্ম নিয়েছে নানা তত্ত্ব, স্বীকার্য, অনুকল্প, ডিলেমা অার প্যারাডক্সের। বিজ্ঞানী কোলবার্গ উদ্ভাবিত একটি ডিলেমার কথা বলবো অাজ। এর নাম হেইনজ ডিলেমা।
হেইনজের কাহিনী
বহুদিন আগের কথা। কোনো এক অচেনা শহরে বাস করতেন একজন নারী। তিনি এক ভয়াবহ দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে বিছানায় শয্যা নিয়েছিলেন। কোনো চিকিৎসক বা ওষুধ তার রোগ সারাতে পারছিলো না। তার স্বামীর নাম ছিলো হেইনজ, স্ত্রীর এহেন দুর্দশা দেখে তিনি যারপরনাই চিন্তিত থাকতেন।
একদিন হেইনজ এমন একটি নতুন ওষুধের খবর পেলেন, যা কিনা তার স্ত্রীর রোগের নিরাময় করতে সক্ষম। এটি একধরনের রেডিয়ামজাত ওষুধ, যা একই শহরের এক ওষুধ প্রস্তুতকারক কিছুদিন আগেই অাবিষ্কার করেছে। রোগিনীর স্বামী, অামাদের কাহিনীর নায়ক হেইনজ ছুটে গেলেন সেই ওষুধ নির্মাতার দ্বারে। হেইনজের উদ্দেশ্য, ওষুধটি কিনে স্ত্রীর রোগ নিরাময় করা।
![](https://assets.roar.media/assets/a72cbQNwWeNp00VZ_IMG_20190630_205014.jpg)
কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধলো অন্য জায়গায়। হেইনজ সেখানে পৌঁছে দেখলেন, বেরসিক প্রস্তুতকারক ওষুধের বোতলের গায়ে উচ্চমূল্যের ছিপি সেঁটে রেখেছে, যা ওষুধটি বানাতে খরচ হওয়া অর্থের দশগুণ। অর্থাৎ ওষুধটি প্রস্তুত করতে ১০০ ডলার খরচ হলেও সেটির মূল্য নির্ধারণ করে হয়েছে ১০০০ ডলার।
কিন্তু হেইনজ নিরুপায়। কেননা, এই একটি ওষুধই পারে তার স্ত্রীর রোগের নিরাময় করতে, যা না পেলে তার স্ত্রীর চিকিৎসা! তাই হেইনজ বেরিয়ে পড়লেন অর্থের সন্ধানে। শহরে তার পরিচিত যত মানুষ অাছে, সবার দুয়ারে হাত পাতলেন তিনি। প্রায় সকল সম্ভাব্য উৎস থেকে অনেক খেটেখুটে ৫০০ ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেন তিনি। যা ওষুধ প্রস্তুতকারকের দাবিকৃত অর্থের অর্ধেক মাত্র।
![](https://assets.roar.media/assets/rxoLBPhRnII7Udgm_IMG_20190630_205800.jpg)
এই অর্থকে সম্বল করেই ওষুধ প্রস্তুতকারকের বাড়ির দিকে ছুটলেন হেইনজ। পৌঁছে ওষুধ প্রস্তুতকারককে জানালেন, দাবিকৃত অর্থের অর্ধেকই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। এখন সে যদি তিনি বিশ্বাস করে ওষুধটি দেয়, তবে তার বড় উপকার হয়। সেইসাথে কিছুদিন বাদেই যে তিনি বাকি অর্থ পরিশোধ করে দেবেন, এ কথাটিও জানাতে ভুল করলেন না হেইনজ।
কিন্তু বিধিবাম! ওষুধ প্রস্তুতকারক হেইনজের মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিলো যে, ওষুধ বানানোই হলো তার ব্যবসা। অার ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য যে মুনাফা করা, এটা কে না জানে? তাই নির্ধারিত মূল্য, অর্থাৎ ১০০০ ডলারের এক সেন্ট কমেও হেইনজের কাছে ওষুধ বিক্রি করবে না সে।
![](https://assets.roar.media/assets/PlG127LITXQ8Q4Wc_IMG_20190630_205204.jpg)
হেইনজ অনেক কাকুতি-মিনতি করলেন। কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। শত অাকুতিতেও ওষুধ প্রস্তুতকারকের মন গললো না। অগত্যা হেইনজকে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হলো।
বাড়ি ফিরে হেইনজ দেখলেন, তার স্ত্রী মৃত্যুশয্যায়। ওষুধটি না হলে তার স্ত্রীকে অার কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব হবে না।
তিনি অারো অনেকভাবে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো উপায় বের করতে পারলেন না। শেষমেশ হেইনজ এক ফন্দি অাঁটলেন। সেটা হলো ওষুধ প্রস্তুতকারকের বাড়ি থেকে ওষুধটি চুরি করে নিজের স্ত্রীর চিকিৎসা করাবেন।
মোটামুটি এখানে এসেই হেইনজের কাহিনীর ইতি টানতে হচ্ছে। তবে ঝামেলা কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বরং শুরু হয়েছে মাত্র বললে ভালো হয়।
ধরুন, হেইনজের হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে অাপনাকে! তবে হেইনজের ওষুধ চুরি করা উচিত হবে কি হবে না, তা এখানে বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য বিষয়টি হলো, কোন যুক্তিতে হেইনজ এর ওষুধ চুরি করা উচিত/উচিত নয়।
![](https://assets.roar.media/assets/uEuAwGnEwDJ3WO72_IMG_20190630_205128.jpg)
বিকল্পসমূহ:
১.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে, কেননা ওষুধটির প্রকৃত মূল্য মাত্র ১০০ ডলার, যা তার দিতে চাওয়া অর্থের অনেক অনেক কম, তাই তিনি কোনো চুরি করছেন না।
অথবা,
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কেননা এতে তাকে কারাগারে যেতে হতে পারে।
২.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে, কেননা নিজের স্ত্রীকে সুস্থ হতে দেখলে তিনি যে পরিমাণ অানন্দ অনুভব করবেন, তা ওষুধ চুরি করে কারাগারে গিয়ে ভোগ করা যন্ত্রণার চাইতে অনেক অনেক বেশি।
অথবা,
ওষুধ প্রস্তুতকারকের বাড়ি থেকে ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কেননা কারাগারে গেলে তাকে যে পরিমাণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে তা নিজের স্ত্রীর মৃত্যুতে পাওয়া শোকের চাইতে অনেক অনেক বেশি।
![](https://assets.roar.media/assets/IffiRA0x9lQcmpZf_IMG_20190630_205051.jpg)
৩.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে, কেননা স্বামী হিসেবে নিজের স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তার কর্তব্য।
অথবা,
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কেননা তিনি ইতোমধ্যেই বৈধ সকল উপায়ে নিজের স্ত্রীর রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করে দেখেছেন, অাইন ভঙ্গ করা তার পক্ষে কোনোভাবেই উচিত হবে না।
৪.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কারণ চুরি করা অাইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার অাইন মেনে চলা উচিত।
অথবা,
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে এবং সেইসাথে অাদালতের সিদ্ধান্ত মেনে সাজা ভোগ করাও, কারণ একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তিনি অাইনের দায় এড়াতে পারেন না।
৫.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে, কেননা প্রতিটি মানুষেরই এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, যা সকল অাইন-কানুন এবং নিয়মের উর্ধ্বে এক পরম সত্য।
অথবা,
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কারণ ওষুধ প্রস্তুতকারকের অধিকার রয়েছে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করার, অার হেইনজের স্ত্রী অসুস্থ বলে তার ওষুধ চুরি করাকে কোনোভাবেই বৈধতা দেয়া যায় না।
![](https://assets.roar.media/assets/SBC2RqRTBTpXiraK_IMG_20190630_205814.jpg)
৬.
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে, কারণ সবার ওপরে মানুষ সত্য। তাই একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য অন্যের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করা দোষের কিছু নয়।
অথবা,
ওষুধটি চুরি করা হেইনজের জন্য উচিত হবে না, কারণ ওষুধটি অারো অন্য রোগীদের প্রয়োজন হতে পারে, যাদের জীবন হেইনজের স্ত্রীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
অভিমত বিশ্লেষণ
ধরা যাক, অাপনি অাপনার বিকল্প বেছে নিয়েছেন। এবার বিশ্লেষণে যাওয়া যাক।
প্রথম বিকল্প: শাস্তি ও অানুগত্য (Obedience and Punishment Orientation)
যদি অাপনি প্রথম বিকল্প বেছে নেন, তার মানে অাপনি নৈতিক উন্নয়নের প্রথম স্তরে অবস্থান করছেন। এর অর্থ কোনো ঘটনার নৈতিক দিক বিবেচনা করতে গেলে শাস্তির ব্যাপারটিই অাপনার কাছে মুখ্য হয়ে দাড়ায়। হেইনজের চুরি করাকে অাপনার কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে হচ্ছে, তার মানে সেটি করা অনুচিত। অাবার চুরিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে মনে না হলে, অাপনি সেটি বেঁছে নিতে কসুর করবেন না।
দ্বিতীয় বিকল্প: অাত্মস্বার্থ (Individualism and Exchange)
এটি বেছে নেয়ার মানে অাপনি নৈতিক উন্নয়নের দ্বিতীয় স্তরে রয়েছেন। এর মানে অাপনি নৈতিকতাকে বিচার করেন নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। ওষুধটি চুরি করলে স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবে, হেইনজের মানসিক প্রশান্তি ফিরে অাসবে। অাবার একইসাথে হেইনজকে কারাগারে যেতে হবে, যন্ত্রণা অনুভব করতে হবে। অর্থাৎ হেইনজ কাজটি থেকে লাভবান হচ্ছে না ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সেটিই এই বিকল্পের মূলকথা।
![](https://assets.roar.media/assets/bF8bQhoDOgbOH52I_IMG_20190630_205033.jpg)
তৃতীয় বিকল্প: অান্তঃব্যক্তিক প্রত্যাশা (Interpersonal expectation)
এটি মূলত নৈতিক উন্নয়নের তৃতীয় স্তরেরই প্রতিফলন, যা পারস্পরিক প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করে। কেননা চুরি করার বা না করার ওপর হেইনজ ও তার স্ত্রীর অান্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ওঠা-নামা করছে, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে অাপনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন।
চতুর্থ বিকল্প: অাইনি কর্তৃত্ব এবং স্থিতিশীলতা (Maintaining the Social Order)
এ বিকল্প বেছে নেয়ার মানে হলো নৈতিকতা বিবেচনার সময় অাইন ও সামাজিক শৃঙ্খলাকে প্রাধান্য দেয়া। একটি ব্যক্তির চুরি করা বা না করার সাথে সমাজের স্থিতিশীলতা যে পরমভাবে জড়িত, সেটি অাপনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন এবং এর ফলে যে প্রভাব পড়ে, সেটিকেও গুরুত্ব দেন।
হেইনজ চুরি করলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে, এটি ভেবে অাপনি চুরির বিপক্ষে মত দেন। অাবার চুরির পরে শাস্তি ভোগ করার শর্তারোপ করলে অাপনি মত পরিবর্তন করেন, কারণ অাপনার কাছে তখন সেটি তূলনামূলকভাবে কম অনৈতিক মনে হয়।
![](https://assets.roar.media/assets/Dy60caJ0BH2P28fW_IMG_20190630_205835.jpg)
পঞ্চম বিকল্প: সামাজিক মূল্যবোধ ও অধিকার (Social Contract and Individual Rights)
অাপনি যদি এই বিকল্প মোতাবেক সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে অাপনি পঞ্চম স্তরে অবস্থান করছেন। হেইনজের স্ত্রীর বেঁচে থাকার অধিকারকে অাপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, তাই অাপনি চুরি করার বিকল্প বেছে নেন। অাবার ওষুধ প্রস্তুতকারকের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে গেলে চুরি করাকে অাপনার কাছে অনৈতিক বলে মনে হয়।
ষষ্ঠ বিকল্প: সার্বজনীন নৈতিক বিধান (Universal Moral Principles)
এই বিকল্পটি বেছে নেয়ার অর্থ, অাপনি শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবেন না, সার্বজনীন মানবাধিকার নিয়েও চিন্তা করেন। অাইন-কানুনগুলো সামাজিক রীতিনীতি ছাড়া অার কিছুই নয়, এবং এদের একটি সুনির্দিষ্ট ক্রম রয়েছে। একটি অাইন ভাঙা একজন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাছে কিছুই না, এটুকু আপনার বিশ্বাস।
এটি এমন এক শাশ্বত বিধান, যা সমাজ, অাইন, রাষ্ট্র সবকিছুরই উর্ধ্বে। এই চিন্তাধারা অাপনাকে চুরি করার বিকল্প বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে। অপরদিকে অন্য রোগীদের জীবনও অাপনার কাছে সম-গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় চুরি করা অাপনার কাছে অনৈতিক বলে মনে হয়।
***
হেইনজের এই সমস্যাটি যে শুধু অামাদের নৈতিক-চেতনা এবং বিবেককেই পরীক্ষা করে, তা নয়। এটি অামাদের মানসিক পরিপক্বতার অন্যতম নির্দেশক। একজন ব্যক্তি তার অবধারণগত উন্নয়নের কোন ধাপে অবস্থান করছেন, তার সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, তিনি হেইনজের সমস্যার সমাধানে কোন বিকল্পটি বেছে নিচ্ছেন, সেটি থেকে। এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়াটি হয়তো ত্রুটিমুক্ত নয়, তবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ বিচারে এর অনবদ্য ভূমিকা স্বীকার না করে পারা যায় না।