Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টুরেট সিন্ড্রোম: যে রোগে দেহের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না ব্যক্তির

কেমন হতো যদি আপনার শরীর আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নড়াচড়া করা শুরু করে? অথবা আপনার অজান্তেই আপনি কথা বলা গোঙ্গানো শুরু করে দেন? আমাদের মাঝে অনেকেরই এমন একটি স্নায়বিক সমস্যা রয়েছে, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় টুরেট সিন্ড্রোম। আমাদের যখন হেঁচকি ওঠে তখন আমাদের ইচ্ছা সত্ত্বেও সেটি আমরা আটকাতে পারি না। আমাদের চাওয়া সত্ত্বেও আমাদের শরীর হেঁচকি বন্ধ করতে পারে না।

আমাদের এই লেখাটি টুরেট সিন্ড্রোম নিয়ে। 

টুরেট সিন্ড্রোম কী?

টুরেট সিন্ড্রোম হলো একধরনের স্নায়ুতান্ত্রিক সমস্যা। এর নামকরণ করা হয়েছে ফরাসি নিউরোলজিস্ট জিল ডে লা টুরেট এর নামানুসারে। এটি একধরনের টিক ডিসঅর্ডার। টিক হলো আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার দেহের কোনো মাংসপেশির আন্দোলন। টিক দুই ধরনের রয়েছে।

  • মোটর টিক (এটি শরীরের নড়াচড়ার সাথে সম্পর্কিত, যেমন- চোখের পলক ফেলা, কাঁধের ঝাঁকুনি)
  • ভোকাল টিক (এক্ষেত্রে ব্যক্তি মুখ দিয়ে আওয়াজ করেন, গলা পরিষ্কার করতে থাকেন )
    নিউরোলজিস্ট জিল ডে লা টুরেট; Image source: Wikimedia Commons

টিক সাধারণ হতে পারে, আবার জটিলও হতে পারে। জটিল টিকের ক্ষেত্রে একাধিক ধরনের টিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। টুরেট সিন্ড্রোম একধরনের জটিল টিক ডিসঅর্ডার। এটি একজন ব্যক্তির শিশুকালে হতে পারে, আবার বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও হতে পারে। সাধারণত বাচ্চাকালে একজন টুরেটে আক্রান্ত হলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে লক্ষণ হ্রাস পেতে থাকে, আবার কখনও কখনও লক্ষণ না কমার বদলে আরও বাড়তে থাকে। আর জটিলতা শুরু হয় তখনই।

কেন হয় টুরেট সিন্ড্রোম?

টুরেট সিন্ড্রোম খুব একটা বিরল কিছু নয়। ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের প্রতি ১০০ জনে একজনের টিক সিন্ড্রোম থাকে, আর ৫-১৭ বছর বয়সীদের প্রতি ১৬০ জনের ১ জনের টুরেট সিন্ড্রোম পাওয়া যায়। এই সিন্ড্রোমের কারণ এখনও বিজ্ঞানীদের কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা অনুযায়ী, মস্তিষ্কের কিছু অঞ্চলের অস্বাভাবিকতা (যেমন- ব্যাসাল গ্যাংগলিয়া, সম্মুখ খণ্ড বা লোব এবং কর্টেক্স) এসব অঞ্চলের মধ্যে সংযোগকারী সার্কিটের অস্বাভাবিকতা এবং বেশ কিছু নিউরোট্রান্সমিটার (যেমন- ডোপামিন, সেরোটোনিন, নরএপিনেফ্রিন) এসবের অস্বাভাবিকতার সাথে এই সিন্ড্রোমের সম্পর্ক রয়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, বেশ কিছু জেনেটিক কারণও এর জন্য দায়ী। পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা বেশ কিছু কারণকে টুরেট সিন্ড্রোমের রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো-

  • টুরেট সিন্ড্রোমের জন্য দায়ী জিনটি একটি ডমিন্যান্ট বা প্রকট জিন। তাই কোনো ব্যক্তি এতে আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে ৫০% সম্ভাবনা থাকে তার সন্তানদের মাঝে সেটি সঞ্চারিত হওয়ার।
  • লক্ষণ প্রকাশের দিক থেকে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা ৩ থেকে ৪ গুন বেশি সেনসিটিভ বা ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
  • ডোপামিনের অস্বাভাবিক ভাঙন টুরেট সিন্ড্রোমকে প্রভাবিত করে।  

বিজ্ঞানীদের মতে এটি একটি জটিল রোগ, যেটি অনেকগুলো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এখানে পরিবেশের একটি বড় প্রভাব রয়েছে। গর্ভাবস্থায় ধূমপান, জন্মের সময় অস্বাভাবিক কম ওজন এবং কিছু ইনফেকশনের প্রভাব কীভাবে এর পেছনে দায়ী সেটি নিয়েও এখন গবেষণা চলছে।

কী হয় টুরেট সিন্ড্রোমে? 

টুরেট সিন্ড্রোমের প্রধান লক্ষণ হলো টিক, অর্থাৎ শরীরের মাংসপেশির ছান্দিক স্পন্দনের ব্যতিক্রম ঘটা। লক্ষণগুলো সাধারণত ৫-১০ বছর বয়সে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। প্রথমদিকের লক্ষণগুলো সাধারণত মোটর টিক, অর্থাৎ শরীরের কোনো পেশীর অস্বাভাবিক স্পন্দন, প্রধানত মাথা এবং ঘাড়ের দিকের পেশিগুলোর ক্ষেত্রে এরূপ হয়ে থাকে। পেশীর অস্বাভাবিক স্পন্দন সাধারণত ব্যক্তির উত্তেজনা, মানসিক চাপের সাথে বেড়ে যায়। আবার সেই অস্বাভাবিক স্পন্দন কমে যায় যখন ব্যক্তি শান্ত এবং কোনো কাজে মনোযোগী হন। পাশাপাশি কিছু ভোকাল টিকও দেখা যায়। মোটর টিকের মধ্যে সাধারণ ক্ষেত্রে ঘন ঘন চোখের পলক ফেলা, চোখের অন্য ধরনের নড়াচড়া, মুখ ভেংচান, কাঁধ ঝাঁকনো, মাথা ঝাঁকানো দেখা যায়। জটিল ক্ষেত্রে অনেকগুলো সাধারণ টিকের কম্বিনেশন, লাফান, শরীর বাঁকান এসব দেখা যায়। সাধারণ ভোকাল টিকের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ঘন ঘন গলা পরিষ্কার করতে থাকেন, পাশাপাশি নাক ঝাড়া, আওয়াজ করতে থাকা সহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা যায়। জটিল ক্ষেত্রে কখনো কখনো ব্যক্তি নিয়ন্ত্রনহীনভাবে বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন।

টুরেট সিন্ড্রোমের লক্ষণসমূহ; Image source: Movement Disorders – UF Health

টুরেট সিন্ড্রোমের সব থেকে জটিল ক্ষেত্রে ব্যক্তির পেশীর স্পন্দন এতটাই নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে যায় যে, ব্যক্তি নিজেই নিজেকে আঘাত করতে থাকেন, হতে পারে সেটা মুখে বা শরীরের অন্য কোথাও। ভোকাল টিকের ক্ষেত্রে ব্যক্তি জটিল পর্যায়ে গেলে দুটো পরিণতির সম্মুখীন হতে পারেন- Coprolalia: এক্ষেত্রে ব্যক্তি সামাজিকভাবে অযোগ্য কথা বলতে থাকেন, এবং Ecolalia: এক্ষেত্রে ব্যক্তি অন্যের কথার পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। তবে Coprolalia খুবই বিরল, সাধারণত টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের ১০-১৫ শতাংশের  ক্ষেত্রেই কেবল এটি দেখা যায়।

শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা

সাধারণত কোনো ব্যক্তির যদি একাধারে কমপক্ষে এক বছর মোটর ও ভোকাল টিক থাকে তাহলে ডাক্তার তাকে টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত বলে ধরে নেন। টুরেটের পাশাপাশি অন্য স্নায়ুতাত্ত্বিক অথবা মানসিক সমস্যাও ডাক্তারকে এটি শনাক্তে সাহায্য করে। টুরেটের জন্য কোনো রক্ত, ল্যাব অথবা কোনো ইমেজিং পরীক্ষা নেই। তবে খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ইইজি এসব পরীক্ষা করা হয়ে থাকে টুরেট শনাক্তের জন্য।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টুরেটে আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সুস্থ হয়ে যান, অনেকের ক্ষেত্রেই আবার বয়স বাড়ার সাথে সাথে লক্ষণগুলো চলে যেতে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো অতটা প্রকট না হওয়ায় ঔষধের প্রয়োজন পড়ে না। তবে যাদের ক্ষেত্রে টিকের উপস্থিতি স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটায় তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। সাধারণত Neuroleptic drugs অর্থাৎ যেসব ঔষধ মনোরোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়, এসকল ঔষধের ব্যবহার টিক দমনের ক্ষেত্রে কার্যকরী বলে দেখা গেছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবার ক্ষেত্রে এই ঔষধ কার্যকরী হয় না, বরং অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়।

টুরেট আক্রান্ত অস্ট্রেলিয়ান তরুণী; Image Source: Biyanca Sae

টিকের প্রভাব কমানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে কিছু আচরণগত চিকিৎসাও প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, যেমন- সচেতনতার প্রশিক্ষণ, আচরণগত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। মোটকথা, আচরণের নিয়ন্ত্রণ আনার পেছনে এসব পদ্ধতি কাজ করে। সম্প্রতি ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন নামক অস্ত্রোপচার পদ্ধতিও টুরেটের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে, যদিও এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, তবে অনেকেই এর ফলে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। যারা খুব জটিল টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে এটি একটি সমাধান হয়ে আসতে পারে। ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক তরুণীর জটিল টুরেটের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক জেফ মাটোভিকেরও সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছিল।

শেষকথা

অনেকেই হয়তো আমাদের আশেপাশে টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মানুষদের দেখি, কিন্তু খুব একটা নজর দেই না। টুরেটে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেক সময় সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন হতে হয়। যদিও যোগ্যতার দিক থেকে তারাও একজন সাধারণ মানুষ থেকে কোনো অংশে কম নন।

যদিও এখন পর্যন্ত কোনো সফল চিকিৎসা চালু হয়নি, তবে আমরা আশা করতে পারি একদিন হয়তো প্রত্যেক টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগীই সুস্থ হয়ে উঠবেন। তাই আমাদের উচিত টুরেট সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এবং এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া।

This article is about Tourette Syndrome. It is a neurological disorder. The symptoms, causes and treatments are mentioned in the article.

Feature Image: Elemental - Medium

Related Articles