গৃহিনী আনোয়ারা বেগমের (ছদ্মনাম) বয়স আটত্রিশ। বাস করেন ঢাকার নারিন্দায়। এক সকালে নাস্তা তৈরি করতে গিয়ে বটিতে আঙ্গুল কেটে ফেললেন। ভাবলেন, ক্ষতস্থানে পট্টি বেঁধে দিলেই দু-চার দিনের মধ্যেই ঘা শুকিয়ে যাবে। কিন্তু দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ঘা যখন শুকালো না, তখন উদ্বিগ্ন আনোয়ারা হাজির হলেন চিকিৎসকের দোরগোড়ায়।
সবকিছু খুলে বলার পর চিকিৎসক অন্যান্য সমস্যার কথা জানতে চাইলে আনোয়ারা জানান, তার ইদানিং খুব ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে, সেই সাথে মাথাব্যথা আর উচ্চ রক্তচাপ তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তিনি হুটহাট মন-মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন।
সব শুনে চিকিৎসক তাকে ব্লাড টেস্ট ও সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট নিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। চিকিৎসকের কথা মতো পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে দেখা করলে তিনি জানান, আনোয়ারার একটি হরমোনাল ব্যধি হয়েছে, যার নাম কুশিং ডিজিজ।
কুশিং ডিজিজ কী?
কুশিং ডিজিজ কী, সেটা জানার পূর্বে আমাদের জানতে হবে কর্টিসল সম্পর্ক। এটি গ্লুকোকর্টিকয়েড শ্রেণীভুক্ত একটি স্ট্রেস হরমোন। অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত এই হরমোনের প্রধান কাজ স্ট্রেস লেভেল নিয়ন্ত্রণ করা। এ হরমোন দিনে সর্বোচ্চ এবং রাতে সর্বনিম্ন নিংসৃত হয়ে ঘুম চক্র ও রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণেও ভূমিকা রাখে।
উল্লেখ্য, পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত ACTH হরমোন মানবদেহে কর্টিসল নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার জন্ম নিলে ACTH এর নিঃসরণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে। ফলে এই অতিরিক্ত ACTH অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে কর্টিসল নিঃসরণ করতে উদ্দীপ্ত করে। তখনই ব্যক্তি কুশিং ডিজিজে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধরা হয়।
অনেকেই সুপরিচিত কুশিং সিনড্রোমের সাথে কুশিং ডিজিজকে গুলিয়ে ফেলতে ফেলেন। উপসর্গগুলোয় সাদৃশ্য থাকলেও রোগ দুটোর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, কুশিং সিনড্রোম যেকোনো কর্টিসল তারতম্যের জন্য হতে পারে। অন্যদিকে কুশিং ডিজিজের একমাত্র কারণ হলো পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমারের সৃষ্টি।
কারণ
যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, কেবল একটি কারণই কুশিং ডিজিজকে কুশিং সিনড্রোম থেকে আলাদা করেছে। তা হলো পিটুইটারি গ্রন্থিতে অবস্থিত টিউমার। রোগটির কারণ বিশ্লেষণের পূর্বে পিটুইটারি গ্রন্থি কী, সে ব্যাপারে বলে নেয়া উচিত।
পিটুইটারি গ্রন্থিটি দেখতে অনেকটা শিমের বিচির মতো। এই গ্রন্থিটি মস্তিষ্কের অন্যান্য গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে একে সকল হরমোনাল গ্রন্থির রাজা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
সাধারণ পিটুইটারি গ্রন্থির বৃদ্ধি খুবই ধীর। কিন্তু জিনগত অস্বাভাবিকতার কারণে এই বৃ্দ্ধি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে। তখন জন্ম নেয় টিউমার, যার নাম পিটুইটারি অ্যাডেনোমা। সাধারণত টিউমারের আকার ১ সেন্টিমিটারের কম হলে তাকে মাইক্রো অ্যাডেনোমা এবং ১ সেন্টিমিটারের বেশি হলে তাকে ম্যাক্রো অ্যাডেনোমা বলে ডাকা হয়। এই অ্যাডেনোমাগুলোই ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কুশিং ডিজিজের জন্য দায়ী বলে বিবেচনা করা হয়।
উপসর্গ
কুশিং ডিজিজের প্রধান উপসর্গের মধ্যে রয়েছে:
- কাধ এবং ঘাড়ে অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির সৃষ্টি হওয়া, যাকে বাফেলো হাম্পও বলা হয়।
- ঘন ঘন মন-মেজাজের পরিবর্তন হওয়া।
- মেদ বেড়ে যাওয়া।
- ঘা শুকাতে সময় নেয়া।
- সহজেই ত্বক ছিলে যাওয়া।
- ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া।
- মাথাব্যথা।
- বিষণ্নতা ও উদ্বেগ।
- স্মৃতিভ্রম।
- অস্থিক্ষয়।
- পেশিতে দুর্বলতা।
- উচ্চ রক্তচাপ।
- ঘন ঘন তেষ্টা পাওয়া ও মূত্রত্যাগের ইচ্ছা জাগা।
রোগনির্ণয়
মূত্র পরীক্ষা: দিনের বিভিন্ন সময়ের মূত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কর্টিসল লেভেল নির্ণয় করে কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়।
কর্টিসল ব্লাড টেস্ট: রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেও কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়। তবে এই পরীক্ষায় কেবল রক্ত নেয়ার সময়কার কর্টিসলের মাত্রা প্রকাশ পায়।
কর্টিসল স্যালিভা টেস্ট: স্যালিভা বা লালা পরীক্ষার মাধ্যমেও কুশিং ডিজিজ শনাক্ত করা যায়।
সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই: কম্পিউটেড টমোগ্রাফি বা ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিংয়ের মাধ্যমে টিউমারের অবস্থান নির্ণয় করে রোগটি শনাক্ত করা সম্ভব।
কর্টিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোন টেস্ট: এ পরীক্ষায় ব্যক্তির শরীরে CRH প্রবিষ্ট করে দেখা হয় কর্টিসল নিঃসৃত হচ্ছে কি না। যদি কর্টিসল নিঃসৃত হয় তবে ধরে নেয়া হয় ব্যক্তির কুশিং ডিজিজ আছে।
পেট্রোসাল সাইনাস স্যাম্পল: এ পরীক্ষায় প্রথমে সাইনাস ক্যাভিটির মাধ্যমে পিটুইটারি থেকে আগত রক্ত এবং এরপর গাইড ক্যাথেটারের মাধ্যমে পিটুইটারি থেকে সরাসরি সংগৃহীত রক্তের মধ্যে তুলনা করা হয়। সাইনাস ক্যাভিটির মাধ্যমে আগত রক্তে কর্টিসলের মাত্রা বেশি পাওয়া গেলে তা মস্তিষ্কে অ্যাডেনোমার উপস্থিতি নিশ্চিত করে।
চিকিৎসা
পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণ
কুশিং ডিজিজ নিরাময়ে সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করা গেছে পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণের মাধ্যমে। কুশিং ডিজিজের টিউমারটি যদি পিটুইটারি গ্রন্থির ভেতরেই আবদ্ধ থাকে, এবং তা মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশ ছড়িয়ে না পড়ে, সেক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে গ্রন্থিটিকে অক্ষত টিউমারটি অপসারণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে পুনরায় টিউমার হবার সম্ভাবনা প্রায় ৮৫ শতাংশ হ্রাস পায়।
অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণ
কিছু রোগীর ক্ষেত্রে টিউমার পিটুইটারি গ্রন্থিতে আবদ্ধ না থেকে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। সেসব ক্ষেত্রে পিটুইটারি গ্রন্থি অপসারণ করে খুব একটা ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না। এসব ক্ষেত্রে কর্টিসল হরমোন ক্ষরণকারী অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণের মাধ্যমে ইতিবাচক ফলাফল লক্ষ্য করা যায়।
তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কর্টিসল মানবদেহের জন্য অত্যাবশকীয় একটি হরমোন। তাই অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি অপসারণের পর রোগীকে সারাজীবন কর্টিসল জাতীয় সিন্থেটিক হরমোনের উপর নির্ভর হয়ে থাকতে হয়।
রেডিওসার্জারি
এ প্রক্রিয়ায় এমআরআই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে টিউমারটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে সেখানে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিক্ষেপ হয়। এই চিকিৎসা অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী এবং মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থির ওপর এর তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ে বলে জানা গেছে।
পিটুইটারি ডিরেক্টেড ড্রাগস
কুশিং ডিজিজের জন্য দায়ী টিউমার যে শুধু অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে কর্টিসল নিঃসরণে উদ্দীপ্ত করে তা-ই নয়, এটি নিজেও প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ করে। পিটুইটারি ডিরেক্টেড ড্রাগগুলো গ্রন্থিতে অবস্থিত টিউমারটিকে আক্রমণ করে এবং প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ কমিয়ে দেয়।
এই ওষুধগুলোর মধ্যে bromocriptine, cabergoline এবং pasireotide উল্লেখযোগ্য। এদের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেমন: আঙ্গুলে অসাড়ভাব, নাক থেকে পানি পড়া, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া প্রভৃতি।
অ্যাড্রেনাল ডিরেক্টেড ড্রাগস
এই ওষুধগুলো কর্টিসলের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। তবে পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমারের ওপর সরাসরি কোনো প্রভাব ফেলতে না পারায় দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় এদের খুব একটা ব্যবহার করা হয় না।
অ্যাড্রেনাল ডিরেক্টেড ড্রাগের মধ্যে রয়েছে ketoconazole এবং metyrapone। এগুলো সেবনে মাথা ঘোরানো, অজ্ঞান হওয়া, বমি বমি ভাব, ঘন ঘন মূত্রত্যাগের মতো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
গ্লুকোকর্টিকয়েড রিসেপ্টর ডিরেক্টেড ড্রাগস
এই ওষুধগুলো কর্টিসল সংযোগকারী গ্লুকোকর্টিকয়েড রিসেপ্টরের ওপর ক্রিয়া করে। ফলে CRH এবং ACTH এর নিংসরণ হ্রাস পায়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করে বিশেষ ফল পাওয়া গেছে।
করণীয়
শল্যচিকিৎসা ও ওষুধ সেবনের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়ম মেনে চললে কুশিং ডিজিজে আক্রান্ত একজন রোগী অন্যান্য সুস্থ মানুষের মতোই প্রাত্যহিক জীবনযাপন করতে পারেন। এগুলো হলো:
- স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাদ্য, যেমন- বাদাম, অ্যাভেকাডো, নারিকেল, সামুদ্রিক মাছ কর্টিসল নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তাই এগুলো বেশি বেশি খেতে হবে।
- কুশিং ডিজিজের কারণে বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। এগুলো মধ্যে সমতা আনতে চাই উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য। সবুজ শাকসবজি এবং লো-ফ্যাট মাংস এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- শিম, সবুজ শাকসবজি, ব্রকলী, ফুলকপি, দই, ছোট মাছ অস্থির দৃঢ়তা বাড়ায়। তাই এসব খাদ্য বেশি বেশি করে গ্রহণ করতে হবে।
- হালকা কসরত, যেমন- হাঁটাহাঁটি, ইয়োগা, সাইকেল চালানো কুশিং ডিজিজের উপসর্গগুলো প্রকোপ কমাতে সহায়তা করে।
- ভিটামিন ডি অস্থির দৃঢ়তা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। যদিও সূর্যের আলো ভিটামিন ডি এর অন্যতম প্রধান উৎস, তবুও কারো কারো দেহে এই উপাদানগুলোর অভাব থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য উৎস থেকে উপাদানগুলো গ্রহণ করতে হবে।
- চিকিৎসা চলাকালে অ্যালকোহল, নিকোটিন এবং অন্যান্য নেশাদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।
- নিয়মিত বিশ্রাম নিতে হবে।