জুলাই, ১৯৮৮। তাপমাত্রার রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্ম পার করছিল যুক্তরাষ্ট্র। বছরের একটা বড় সময় কম তাপমাত্রায় কাটানো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের কাছে গ্রীষ্ম আসে উৎসবের বার্তা নিয়ে। সে বছর, উষ্ণ বায়ুপ্রবাহের সাথে প্রকৃতির কোমলতাকে ছাড়িয়ে তৈরি হয় রুক্ষতা, প্রকাশ পায় গ্রীষ্মের রূদ্ররূপ। যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যুতের ব্যবহার রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়, উষ্ণ গ্রীষ্মে বাড়ে পর্যটন, রাস্তায় বাড়ে গাড়ির সংখ্যা, হাইওয়েগুলোতে তৈরি হয় গাড়ির উপচে পড়া ভীড়।
একই সময়ে একটি ভিন্ন ধরনের রেকর্ড হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড পরিমাণ সহিংসতার ঘটনা ঘটে, অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায় খুন আর ধর্ষণের ঘটনা, বেড়ে যায় অস্ত্রসহ ডাকাতির ঘটনাও। দেশটিতে সেবছর প্রায় দেড় মিলিয়ন অপরাধের ঘটনা নথিভুক্ত হয়, অন্যান্য গ্রীষ্মের চেয়ে যা ১০% শতাংশ বেশি।
এই তথ্য হাতে আসার পর গ্রীষ্মে মানুষের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হলো। দেখা গেল, শীতকালের তুলনায় গ্রীষ্মকালে মানুষ ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকার সময় অধিকহারে হর্ন বাজায়, দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সাথে খারাপ ব্যবহারের ঘটনাও তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটে গ্রীষ্মেই। এই সময়ে রাস্তায় মানুষ অপরিচিত মানুষদের কম সাহায্য করে, বেড়ে যায় রাস্তায় মানুষের অসংলগ্ন আচরণ।
কাছাকাছি সময়ে, ১৯৯২ সালে যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির সময় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। যুক্তরাজ্য আর ওয়েলসের কয়েক বছরের অপরাধের রেকর্ড নিয়ে তারা প্রমাণ করেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে মানুষের অপরাধপ্রবণতার একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। শীতকালের চেয়ে মানুষ গ্রীষ্মকালে সহিংস অপরাধে জড়ায় বেশি,আবার শীতের মধ্যেই কোনো সপ্তাহে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অপরাধের সংখ্যা।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের অপরাধসংক্রান্ত রেকর্ড নিয়ে একটি গবেষণা হয়, যা নিয়ে পরবর্তীতে ব্রিটেনের মূলধারার অনেক সংবাদমাধ্যমেই রিপোর্ট হয়। গবেষণাটি মানুষের দ্বারা সংগঠিত বিভিন্ন সহিংসতার প্যাটার্ন নিয়ে বিশ্লেষণের পর দাবি করছে, যখন যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন ১৪% বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটায় মানুষ, তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকার সময়ের তুলনায়। একই সময়ে বাড়ে এক নাগরিকের মাধ্যমে অন্য নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের ঘটনা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়রানি বাড়ে ১৬ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া রাজ্যে বিভিন্ন ঋতুতে মানুষের অপরাধপ্রবণতা নিয়ে গবেষণা চালান ইউনিভার্সটি অব ড্রেক্সেলের গবেষকরা। তাদের গবেষণাতেও উঠে এসেছে একই সমীকরণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রায় সকল ধরনের অপরাধের হারই বৃদ্ধি পায়। গবেষণাটি বলছে, গ্রীষ্মকালে মানুষ কম আরামদায়ক অনুভব করে, মানুষের শরীর বেশি শক্তি খরচ করে, মানুষের ঘুমের সময়ও কমে যায়। এই প্রক্রিয়াগুলোর ফলে মানুষের মধ্যে দ্রুত সংঘাতে জড়িয়ে পড়বার প্রবণতা দেখা যায়।
২০১৮ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বছরগুলোর একটি, যুক্তরাজ্যের ইতিহাসেও উষ্ণতম বছরগুলোর একটি ছিল সেই বছর। সেই বছরে, যুক্তরাজ্যের সামগ্রিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, পুলিশের কাছে জরুরি সাহায্যের জন্য আবেদন করেন রেকর্ডসংখ্যক মানুষ। জরুরি সেবার নাম্বার ৯৯৯-এ মোট কলের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৪০ শতাংশের বেশি।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সহিংস অপরাধ বৃদ্ধির ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মেক্সিকোও। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সেখানে বেড়ে যায় খুন, ধর্ষণ আর ডাকাতির ঘটনা, বাড়ে দলবদ্ধ অপরাধের সংখ্যাও। একই চিত্র দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও। সেখানকার অপরাধের তথ্যের উপর পরিচালিত গবেষণা দেখাচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকাতে প্রতি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে খুনের ঘটনা বাড়ে ১.৫ শতাংশ। প্রায় একই রকম দেখা যায় ইউরোপের দেশ গ্রিসেও। ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা থাকাকালে যে পরিমাণ হত্যার ঘটনা ঘটে দেশটিতে, তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে গেলে হত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ৩০ শতাংশের বেশি।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে বাড়ে সহিংস আন্দোলনের সম্ভাবনা
তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আন্দোলনে নেমে পড়ারও একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। গত ৩৬ বছরে সংঘটিতে সাত হাজারের বেশি রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। মানুষের রাজনৈতিক দাবিতে যেকোনো সময়ই আন্দোলনই জড়াতে পারে। কিন্তু অধিক তাপমাত্রায় মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টির প্রকাশ বৃদ্ধি পায় এবং আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। আবার তুলনামূলকভাবে অধিক তাপমাত্রায় যেসব আন্দোলন হয়, সেই আন্দোলনগুলোকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা বেশি ঘটে, বাড়ে সহিংসতার সর্বোচ্চ মাত্রায় যাওয়ার সম্ভাবনাও।
২০২০ সালের আগস্টে উষ্ণতম একটি গ্রীষ্ম পার করে নেদারল্যান্ড। তাদের দেশে তাপমাত্রা রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে রেকর্ড পরিমাণ উষ্ণ সপ্তাহ পার করে এই মাসেই। উষ্ণতম সপ্তাহটি পার করার পরের সপ্তাহেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে সেখানে, আগুন লাগানোর ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ২৭ জন মানুষ।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় আত্মহত্যার ক্ষেত্রেও। বারটি দেশের প্রায় চৌদ্দ লাখ আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে মানুষের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা, বাড়ে আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনাও। তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে গেলে মানুষের মধ্যে আত্মঘাতী হবার চিন্তা বেশি আসে, ব্যাপকভাবে বাড়ে আত্মহত্যার ঘটনা।
তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ফুটবল ম্যাচে ফাউলের সংখ্যা সমানুপাতিকভাবে বাড়ে, বাড়ে খেলোয়াড়দের কার্ড দেখানোর সংখ্যা। এর সাথে বেড়ে যায় প্যানাল্টির সংখ্যাও। তুলনামূলক অধিক তাপমাত্রায় সাংবাদিকেরা বিভিন্ন ইস্যুতে নেতিকবাচক প্রতিবেদন করেন বেশি, বাড়ে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের গতিও।
কেন বাড়ে সহিংসতার প্রবণতা?
এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পরিচালিত প্রায় সবগুলো গবেষণাই বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে মানুষের সহিংস হওয়ার প্রবণতার সম্পর্ক আছে, সম্পর্ক আছে মানুষের অপরাধপ্রবণতার সাথেও। সবগুলো দেশেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে অপরাধের সংখ্যা, বাড়ে সহিংসতার ঘটনাও। অনেকগুলো জৈবিক এবং পারিপার্শ্বিক কারণ এই সহিংসতার প্রবণতা বৃদ্ধিতে প্রভাব রাখে।
প্রথমত, মানুষের যাপিত জীবনের যত আনন্দ-বেদনা, উচ্ছ্বাস কিংবা পছন্দের পরিবর্তন, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সেরোটোনিন। শরীরের অভ্যন্তরে এই রাসায়নিক পদার্থ আমাদের কোনো জিনিসের ব্যাপারে ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করে, আবার তৈরি করে নেতিবাচক অনুভূতিও। তাপমাত্রার সাথে শরীরে সেরোটোনিন নিঃসরণের একটি ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক রয়েছে। এই ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক মানুষকে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করে, যেকোনপ ইস্যুতে আগ্রাসনের দিকে ঠেলে দেয়। ফলে, তাপমাত্রার বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ে সহিংস ঘটনা ঘটার প্রবণতা।
দ্বিতীয়ত, শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন হচ্ছে টেস্টোস্টেরন। এই হরমোন মানুষের লিঙ্গীয় পরিচয় প্রকাশ করে, সেই অনুযায়ী আচরণে উদ্বুদ্ধ করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে মানুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন নিঃসরণের হার বৃদ্ধি পায়, যা শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, তৈরি করে আগ্রাসী মনোভাব। এই কারণেই, গ্রীষ্মকালে সহিংস ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, গৃহস্থালী সহিংসতার ঘটনাও বেড়ে যায় ১২ শতাংশ পর্যন্ত।
তৃতীয়ত, মানুষের সমাজবদ্ধ জীবনের অধিকাংশ উৎসবই হয় উষ্ণ সময়ে। অধিকাংশ দেশেই গ্রীষ্মকালে কৃষিজ ফসল ঘরে তোলে মানুষ, সারাবছর ধরে উৎপাদিত পণ্যগুলোতে এ সময় আসে আধিক ফলন। ফসলকে কেন্দ্র করে বাড়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, অর্থনীতির পাশাপাশি নতুন উদ্দীপনা আসে মানুষের জীবনেও। ফলে গ্রীষ্মকালেই সাধারণভাবে অধিকাংশ সামাজিক উৎসব হয়, শীতপ্রধান দেশগুলোতে গ্রীষ্মকালে মানুষ অধিক হারে বনভোজনে যায়, মানুষ বিভিন্ন কাজে প্রদর্শন করে অধিক সক্রিয়তা। এই প্রক্রিয়াগুলোতে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বেশি হয়, তৈরি হয় স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বগুলো থেকেও তৈরি হয় সংঘাত।
চতুর্থত, সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষে মানুষে মতপার্থক্য হয়েছে, সভ্যতা এগিয়েছে এই মতপার্থক্যের ধারণাকে সঙ্গে করেই। স্বার্থ কিংবা আদর্শগত দ্বন্দ্ব সমাধানে মানুষ সাধারণভাবে তিনটি পথ অনুসরণ করে। মতভিন্নতা সমাধানে আলোচনায় বসে, আলোচনায় স্বার্থের দ্বন্দ্বের সমাধান না হলে সাধারণত সংঘাত তৈরি করে সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে চায়। সাধারণভাবে, যেসব অঞ্চলের মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অধিক শিক্ষিত, সেসব অঞ্চলের মানুষ মতভিন্নতা সমাধানে আলোচনার পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতা দেখায়। উল্টো প্রক্রিয়া দেখা যায় কম শিক্ষিত সমাজগুলোতেও। আবার, শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে সাধারণভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বেশি হয়, উষ্ণ অঞ্চলগুলোর তুলনায়। এর কারণ, অধিক তাপমাত্রায় মানুষের মস্তিষ্ক কম আউটপুট দেয়, প্রভাবিত হয় কগনেশাল ফাংশন। এর ফলেও, সংঘাতে জড়ায় মানুষ।
সংঘাতময় আগামী
শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। ২০২০ সালের আগপর্যন্ত এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছিল গড়ে ১.২ শতাংশ। বর্তমান সময়েও বিপুল বিনিয়োগ চলছে অবকাঠামোগত খাতগুলোতে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প। শক্তির চাহিদা পূরণে তৈরি হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। নির্বিচারে চলছে বন কাটা, জ্বলছে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজনও। ফলাফল হিসেবে বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, ত্বরান্বিত হবে জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত বাড়বে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা। সেই সাথে বাড়বে মানুষে মানুষে সংঘাত, বাড়বে মানুষের অপরাধপ্রবণতা।