কম-বেশি অনেকেই হয়তো ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’-এর নাম শুনেছেন। এটা একধরনের মানসিক সমস্যা। এই অবস্থায় একজন ব্যক্তির নিজের উপর নিজেই কোনো ধরনের বিশ্বাস রাখতে পারে না। সবসময় একটি সন্দেহ বা অনিশ্চয়তা কাজ করে যে কাজটা তাকে দিয়ে আসলেই হবে নাকি। আত্মবিশ্বাসের অতিরিক্ত অভাবের পরিণতিই হলো এই ‘ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’। আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি তো কম-বেশি সবারই থাকে, তাই এই মানসিক সমস্যাটি সকলকে বোঝাতে বেশি একটা বেগ পেতে হয় না। সবাই রোগীর পরিস্থিতি কম করে হলেও বুঝতে পারে। তবে পরিস্থিতি যদি হয় এর উল্টো তাহলে সকলে ব্যাপারটা একইভাবে দেখে না। বিশেষ করে আমাদের দেশে অন্যান্য মানসিক সমস্যার মতো এই ধরনের মানসিক রোগের বিষয়কেও অগ্রাহ্য করা হয়।
মনে করেন, এমন একজন মানুষের সাথে আপনার পরিচয় হলো যার মধ্যে এতটাই আত্মবিশ্বাস আছে যে, সে কারো পরোয়াই করে না। একটি কাজ করতে পারবে কি না কিংবা নিজের যোগ্যতা কতটুকু আছে এসব বিষয় নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই নেই। তার নিজের উপর সম্পূর্ণ ভরসা আছে যে, সে যা করবে তা ঠিকই করবে। পরবর্তীতে কোনো কাজ ভুল করে ফেলার পরও সেই ব্যক্তি নিজের দোষ মেনে নিতে নারাজ। এমন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসীকে আপনি কীভাবে দেখবেন? অনেকে হয়তো এরকম কোনো মানুষকে অহংকারী হিসেবে বিবেচিত করে তার সাথে আর মিশতে চাইবেন না। তবে এমনও হতে পারে যে, এই ধরনের অভিমানী ব্যক্তি আসলে কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে নিজেই অতিরিক্ত পছন্দ করার মানসিক বিষয়টি চিকিৎসাক্ষেত্রে ‘সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত।
একজন ব্যক্তি সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছেন কি না তা বোঝা একটু কঠিন। কারণ যে কেউ সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের যেকোনো একটি লক্ষণ প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু এজন্য তাকে এই কমপ্লেক্সের ভুক্তভোগী বলা যাবে না। সব লক্ষণের কম-বেশি উপস্থিতিই এই কমপ্লেক্স যে আছে তা নিশ্চিত করতে পারবে।
সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের লক্ষণ
১) অহংকার: একজন ব্যক্তি এই মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত থাকলে অন্যদেরকে নিজের তুলনায় কম যোগ্য মনে করে। তার মধ্যে অতিরিক্ত অহংকারের বিষয়টি কাজ করে।
২) সহানুভূতির অভাব: যাদের মধ্যে নিজেকে শ্রেয় ভাবার মানসিকতা থাকে তারা অন্যদের দুঃখে শরীক হতে পারে না। অন্যদের কষ্ট বা বিপদের কথা শুনেও তাদের মধ্যে কোনো অনুভূতিই কাজ করে না।
৩) অন্যের মতামতকে পাত্তা না দেওয়া: সুপিরিয়র ব্যক্তি সব বিষয়ে (এ সম্পর্কে ধারণা থাকুক বা না থাকুক) তাদের ‘অনাবশ্যক’ মতামত দেন। নিজেদের কথার সঠিক কোনো যুক্তি আছে কি না তা খতিয়ে দেখার চেষ্টাই করেন না। অন্যরা কী বলছে বা অন্যদের মতামত কী তা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই এই কমপ্লেক্সে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে।
৪) অস্থিরতা: সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত হলে ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে সবসময় অস্থির ও অধৈর্য থাকার বিষয়গুলো কাজ করে। প্রতি মুহূর্তে তাদের মস্তিষ্কে কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যায়, যার ফলে তারা তাদের প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশে অক্ষম হয়।
ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স কি কোনোভাবে সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের জন্য দায়ী?
অনেক সময় সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির অদ্ভুত ব্যবহারের পেছনে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সই মূলত দায়ী থাকতে পারে। ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছেন এমন একজন ব্যক্তি নিজেকে বাকিদের তুলনায় অযোগ্য মনে করেন। আর সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগছে এমন কেউ নিজেকে অন্যদের তুলনায় শ্রেয় বা উত্তম মনে করেন। নিজেকে ইনফিরিয়র ভেবে নেওয়া মানুষটির মধ্যে সবসময়ই অনিশ্চয়তা ও দ্বিধা কাজ করে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি নিজেকেই সুপিরিয়রের উপাধি দিয়েছেন, তার মধ্যে দেখা যায় প্রয়োজনের অধিক আত্মবিশ্বাস।
অবশ্যই একজন মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার। তবে অতিরিক্ত কিছুই ভালো নয়। তা যত কল্যাণকরই হোক না কেন। মাঝে মাঝে দেখা যায়, ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের ভুক্তভোগী নিজের দুঃখ-কষ্ট এবং নিরাপত্তাহীনতা লুকানোর তাগিদেই ‘সুপিরিয়র’ হওয়ার মুখোশ ধারণ করতে পারেন। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে এই রোগের পেছনেও ব্যক্তিবিশেষের বিষণ্ণতা বা কোনো বিষয়ে তীব্র শোকই দায়ী।
প্রতিরোধ
অভ্যাস বা আচরণ পরিবর্তন করা সহজ নয়। আর কোনো ব্যক্তির যখন নিজের সম্পর্কে খুব বেশি ইতিবাচক ধারণা থাকে বা যার আত্মবিশ্বাসের পরিমাণ অস্বাভাবিক তার পক্ষে নিজের ভুল দেখা অনেক কঠিন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও তারা তাদের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করবেন না। এভাবে ‘সুপিরিয়র’ সেজে ঘুরলে সে বন্ধুত্ব এবং পারিবারিক সম্পর্ক হারাতে পারে। সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত ব্যক্তি এটাও কখনো স্বীকার করবেন না যে, নিজেদের অসঙ্গত ব্যবহারের জন্যই তারা সবার বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক হারাচ্ছেন। ব্যাপারটা আসলে একইসাথে হাস্যকর ও বেশ দুঃখজনক বটে। সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রণ করার কয়েকটি উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো:
১) নিজের প্রশংসা শুনে অতিরিক্ত খুশি না হওয়া
পৃথিবীতে এমন খুব কম মানুষই আছেন যারা নিজেদের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন না। তবে সবার উচিত নিজের দক্ষতা ও বুদ্ধি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিছু মানুষ সবসময়ই অন্যদের প্রয়োজনের অধিক প্রশংসা করে। এসব নকল কথাবার্তায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লে তা ব্যক্তিবিশেষকে নিজের কর্মদক্ষতা বাড়াতে নিরুৎসাহিত করবে। কেননা, তার মনে হবে “আমি তো সব পারি। আমি অনেক ভালো জানি। আর কষ্ট করার দরকার নেই”।
অতিরিক্ত প্রশংসা পাওয়া শুরু করলে প্রশংসাকারীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার পূর্বের সাধারণ কথোপকথনে ফিরে যাওয়াই শ্রেয়। এতে করে নিজের আত্মবিশ্বাসও নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সামনের মানুষটির সংক্ষিপ্ত পথ ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার ইচ্ছাও চাপা পড়ে যায়।
২) অন্যের মতামত শোনার মতো ধৈর্যশক্তি রাখা
নিজেকে ‘সুপিরিয়র’ বা ‘শ্রেষ্ঠ’ ভেবে নেওয়া ব্যক্তি যে সবসময়ই কম জানে বা কোনো কাজ করতে কম পারদর্শী হয় ব্যাপারটা কিন্তু সেরকমও নয়। তবে অন্যদের সাথে কাজ করতে হলে তাদের মতামত শোনার মতো ধৈর্য থাকতে হয়। একটি সমাজে বাস করতে হলে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করলে হয় এবং সর্বদাই পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে হয়। নাহলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশে টিকে থাকা অনেক কঠিন।
এভাবে কোনো অফিসে কাজ করতে হলেও অন্যদের অভিমতকে গুরুত্ব দেওয়ার একটা বিষয় কাজ করে। হয়তো বা ‘সুপিরিয়র’ ব্যক্তির কাছে সমস্যা সমাধানের উত্তম উপায় রয়েছে। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, বাকিদের বক্তব্য শোনার পর আরো ভালো কোনো সমাধান বের হলো।
৩) না বুঝে নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়া
এই কমপ্লেক্সে ভুগছে এমন ব্যক্তিরা নিজেদের মতামত ছাড়া অন্য কারো মতামতকে গুরুত্ব দিতে চায় না। তারা ভুলে যায় যে এটা শুধু তাদের ‘মতামত’। সবারই নিজস্ব কিছু অভিমত থাকে। একজন ব্যক্তি একটি বিষয়কে যেভাবে বিবেচনা করে অন্য কোনো ব্যক্তি ঠিক সেভাবে না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া উভয়পক্ষের চিন্তাভাবনা ঠিক হওয়া সত্ত্বেও মতভেদ থাকতেই পারে। সেজন্য না বুঝে নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেওয়া উচিত না। ভিন্ন মত শোনার মতো মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। অন্যের দৃষ্টিকোণকে হেয় করা এবং তা নিয়ে পরচর্চা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
৪) প্রয়োজনে সাহায্য চাওয়া
সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স অনেক সময় বংশগত কোনো কারণেও হতে পারে। অথবা স্কুল-কলেজ, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা চাকরি ক্ষেত্রের পরিবেশের কারণেও হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় যে, এই কমপ্লেক্সে ভুগছে এমন ব্যক্তির পক্ষে ইচ্ছা থাকলেও নিজের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। ‘সুপিরিয়র’ ভাবসাব থাকলেও কিছুক্ষণ পর আবার ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের ভুক্তভোগী হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মনের মধ্যে সংশয় কাজ করে। সঠিক কোনটা কিংবা ভুল কোনটা তা বোঝার মতো বুদ্ধিও লোপ পায়। এরকম অবস্থায় আপন কেউ পথনির্দেশনা দিলে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের কোনো ভুক্তভোগীকে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সের ভুক্তভোগীর মতোই যথেষ্ট সময় দিয়ে ধৈর্য সহকারে বোঝাতে হবে। তার সমস্যাগুলো ধরিয়ে দিতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সহায়তা প্রয়োজন হলে তা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।