
২০১৭ সালের শেষ দিন।
নিউ ইয়ার্স ইভ পালনের এক অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করছেন এক তরুণী। মধ্যরাতে একজনের সাথে গল্প করতে করতে হঠাৎ করেই দুর্বল অনুভব করলেন তিনি। এরপর কয়েক ঘণ্টা কী হয়েছিল কিছুই মনে নেই তার।

নিউ ইয়ার্স ইভে’র পার্টিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তরুণী; Image Source: timeout.com
তরুণীর সংবিৎ যখন ফিরল, তখন বাজে ভোর চারটে। নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন রাস্তার এক বেঞ্চে, আরেক বান্ধবীর পাশে। বাসায় ফিরে সেই তরুণী ঘুমিয়ে পড়েন, সেই ঘুম ভাঙে বিকালে। তবে দুর্বলতা কাটল না তার। এই সমস্যা থেকে যায় টানা আট দিন। প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়তে থাকেন তিনি, জেগেও ক্লান্ত অনুভব করতেন।
আট দিন পর বিকালে একেবারে আচমকাই তরুণী সতেজ বোধ করতে থাকেন, ঘুম ঘুম ভাবটাও অনেক কমে যায়। স্বাভাবিকভাবে সব কাজ করতে সক্ষম হন তিনি। তবে এই সমস্যা তাকে একেবারে ছেড়ে যায়নি। আরো পাঁচবার তিনি আক্রান্ত হন, চিকিৎসকের পরামর্শও নেন।
অনেক বিশেষজ্ঞই তরুণীকে পরীক্ষা করেন। অবশেষে একজন স্নায়ুরোগের চিকিৎসক সন্দেহ করলেন ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম (Kleine-Levin syndrome ) নামে দুর্লভ এক রোগ হয়েছে তার। সেই অনুষ্ঠানের প্রায় পঁচিশ মাস পরে অবশেষে এই রোগ নিশ্চিত হয়। এর মধ্যে চিকিৎসার জন্য স্লিপ সেন্টারেও পাঠানো হয় তাকে, যেখানে তার ঘুমের ধরন আর অন্যান্য বিষয় পরীক্ষা করা হয়।
ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম
অত্যন্ত দুর্লভ এক রোগ ক্লেইন-লেইভ সিনড্রোম। এই রোগে আক্রান্তরা দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে কাটান। দিনে প্রায় ২০ ঘন্টাই বিছানায় কাটতে পারে তাদের। পাশাপাশি অত্যধিক ক্ষুধা, স্বাভাবিক ব্যবহারে পরিবর্তন ইত্যাদিও দেখা যায় তাদের মাঝে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের হাতেগোণা কিছু রোগী পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি চিকিৎসক ডি বুশ্যানে সর্বপ্রথম ২৪ বছরের এক তরুণীর কথা বর্ণনা করেছেন যিনি কিনা মাঝে মাঝে প্রায় ২০-২২ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটাতেন। ডি বুশ্যানে উল্লেখ করেন- এই দীর্ঘ ঘুমের বিপত্তি একদিন থেকে শুরু করে আট দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল, এবং এরকম অন্তত চারবার ঘটে।
তবে বিষয়টা তখনো গবেষকদের দৃষ্টি সেভাবে কাড়তে পারেনি। ১৯২৫ সালে উইল ক্লেইন নামে এক স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এরকম পাঁচজন রোগী খুঁজে পান। ফ্রাঙ্কফুর্টের অধ্যাপক ক্লেইস্টের ক্লিনিক থেকে এদের শনাক্ত করেন তিনি। এরা সকলে মাঝে মাঝেই অতিরিক্ত লম্বা সময় ঘুমিয়ে কাটাতো, যা স্বাভাবিক কোনো কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না।
ক্লেইনের চার বছর পর নিউ ইয়র্কের সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাক্স লেভিনও ঘুমের সমস্যার রোগী নিয়ে কাজ শুরু করেন। এরকম কিছু রোগীর কথা ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেন তিনি, যেখানে ক্লেইনের একজনসহ পাঁচজন রোগীর ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ঘুম এবং ক্ষুধার যৌথ লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে স্নায়ুরোগ বিশারদ ক্রিচলি আর হফম্যান ক্লেইন আর লেভিনের গবেষণাকে আরো বিশদ আকারে করার প্রয়াস নেন। তাদের নামানুসারে এই রোগের নাম ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম প্রস্তাব করেন তারাই।
যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ক্রিচলি ক্লেইন লেভিনের বলা রোগী বাদেও আরো পনেরজন খুঁজে পান। নিজে শনাক্ত করেন ১১ জনকে। তার রোগীদের অনেকেই ছিল ব্রিটিশ মেরিন সেনা, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই করেছিল। এরপর হফম্যানের সাথে মিলে এদের পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। ফলাফল প্রকাশিত হয় ‘The Syndrome of Periodic Somnolence and Morbid Hunger’ এক প্রবন্ধে।
ক্রিচলি আর হফম্যান দুই তরুণের কথা লিপিবদ্ধ করেন, যাদের ক্ষেত্রে ঘুম আর খাওয়ার সমস্যা দেখা দিত সপ্তাহখানেকের জন্য। এরপর সব ঠিকঠাক, মাসখানেক পর আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়- সমস্যা শুরুর কয়েকমাস আগে তারা কোনো সংক্রমণে ভুগেছিলেন। তবে অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই তেমন কিছু দেখা যায়নি।
ক্রিচলি আর হফম্যানের পথ ধরে পরবর্তী দশকগুলোতে ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম নিয়ে অনেক গবেষক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সালে স্লিপ ডিজঅর্ডারসের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই রোগকে, এর কিছু চিহ্নও নির্দিষ্ট করেন গবেষকেরা।

১৯৯০ সালে রোগ শনাক্তকরণের প্রাথমিক কিছু ক্রাইটেরিয়াসহ একে স্লিপ ডিজঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়; Image Source: semanticscholar.org
রোগতত্ত্ব
চিকিৎসা সাহিত্যে এই পর্যন্ত ৫০০টি ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে এটাও মনে রাখতে হবে- এই রোগে শনাক্তকরণ খুব সহজ নয়, ফলে অনেক রোগীই কিন্তু জানেন না তারা এই রোগে আক্রান্ত। সাধারণত কিশোর বয়সে রোগের উপদ্রব দেখা দেয়, যা ছেলেদের মধ্যে বেশি।
কী হয় এই রোগে?
যদিও ঠিক কী কারণে রোগের সূচনা তা অজানা, তবে অনেক ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কোনো ধরনের সংক্রমণের ইতিহাস থাকতে পারে। রোগের প্রকোপ দেখা যায় বিচ্ছিন্নভাবে, মাঝের বিরতিতে রোগী সম্পূর্ণ লক্ষণমুক্ত এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করেন।
ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের রোগী একবারে ১৮-২০ ঘন্টাই ঘুমিয়ে কাটান। যখন রোগের প্রকোপ দেখা দেয়, তখন কেবল খাওয়া আর প্রাকৃতিক কার্য সারা ব্যতীত অন্য কোনো কারণে ঘুম থেকে ওঠেন না তারা।

অতিরিক্ত ঘুম রোগের একটি উপসর্গ; Image Source: cosmopolitanme.com
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাদের কি ডেকে তোলা সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব, তবে তাতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। কারণ, জোর করে তোলা হলে তাদের মধ্যে অস্থিরতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, অবসাদ, কনফিউশন ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে কথা জড়িয়ে যেতে পারে।
আরেকটি উপসর্গ থাকে অতিরিক্ত ক্ষুধার, যা ঘুমের পাশাপাশি দেখা দেয়। রোগীরা অন্যান্য সময়ের থেকে অস্বাভাবিক বেশি পরিমাণে খেতে শুরু করেন। মিষ্টি খাবার পছন্দ করলেও খুব একটা বাছবিচার এসময় করেন না তারা।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে হুঁশ থাকে না রোগীর © stock.adobe.com
তৃতীয় আরেকটি সমস্যা হয় যৌন প্রবৃত্তিতে। অন্যান্য সময় স্বাভাবিক মানুষটি অতিরিক্ত জৈবিক চাহিদা প্রদর্শন করতে শুরু করেন। তাদের কথাবার্তা আর আচার-আচরণেও স্বাভাবিক যে সংযম সেটা উবে যায়।
মনে রাখতে হবে, সব রোগীর মধ্যে তিনটি উপসর্গ থাকার সম্ভাবনা খুব কম। অধিকাংশ সময় এক-দুটি লক্ষণ থাকতে পারে। পাশাপাশি উগ্র আচার-ব্যবহার প্রদর্শন করে রোগী। ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের রোগীরা শরীরের পাশাপাশি মানসিক অবসাদে ভোগে। ফলে অনেকটা একাকী থাকতে পছন্দ করে তারা। এজন্য অনেক সময় তাদের মানসিক রোগী বলে ভুল হতে পারে। একটা বড় ব্যাপার হলো সারাক্ষণ উপসর্গগুলো থাকে না। বছরে ২-১২ বার হতে পারে, প্রতিবার এক থেকে তিন সপ্তাহ থাকতে পারে সমস্যা। এরপর আবার সব ঠিক।
কেন হয়?
আরো অনেক রোগের মতো ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমের কারণ জানতে বিজ্ঞানীরা এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরো অনেক কিছুর পাশাপাশি জিনগত বৈশিষ্ট্য, পারিবারিক রোগের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তথ্যপ্রমাণ জড়ো করেছেন তারা। অনেক গবেষক মনে করেন, মস্তিষ্কের বিশেষ অংশে গঠনগত সমস্যা রোগের কারণ হতে পারে। কেউ কেউ আবার একে অটোইমিউন জাতীয় ব্যধি মনে করছেন, যেখানে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধব্যবস্থা আমাদের সুস্থ কোষগুলোর বিরুদ্ধেই কাজ করতে থাকে।

মানব মস্তিষ্কের গঠনগত সমস্যা থেকে রোগের উৎপত্তি হতে পারে বলে অনেক গবেষক মত দিয়েছেন; Image Source: popularmechanics.com
চিকিৎসা
অনেক সময় দেখা যায়- বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনা-আপনিই ঠিক হয়ে যায় সবকিছু। তবে বাকিদের ক্ষেত্রে বিরতি দিয়ে এই বিপত্তি চলতে থাকে। যেহেতু নির্দিষ্ট কারণ আবিষ্কৃত নয় এখনও, তাই চিকিৎসা করা হয় উপসর্গভেদে। এজন্য বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠন করতে হয় মেডিকেল বোর্ড। রোগীর পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হয় পুরো প্রক্রিয়াতে।

চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করার প্রয়োজন হতে পারে; Image Source: nam.edu
ওষুধ দিয়ে খুব একটা উপকার পাওয়া যায়না ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোমে, বরং জীবনযাপন প্রণালীতে কিছু পরিবর্তন আনার ওপর জোর দেয়া হয়। যখন রোগের প্রকোপ চলতে থাকে তখন রোগীকে সম্পূর্ণ ভাবে ঘরে বসে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। ক্লেইন-লেভিন সিনড্রোম যদিও জীবননাশের কারণ নয়, তবে নানাভাবে রোগীর জন্য বিব্রতকর হতে পারে তা। কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।