খাবার আমরা সবাই খাই। কিন্তু কেউ সেই খাবার কাঁচা অবস্থাতেই বেশি পছন্দ করেন, আর কেউ পছন্দ করেন রান্না করা অবস্থায়। অনেকে বলে থাকেন, খাবার রান্না করলে এর অনেক পুষ্টি উপাদান চলে যায়। অন্যদিকে ‘মুখরোচক’ বলে একটা শব্দ আছে তা-ই জানেন না প্রতিপক্ষরা, এমনটাই ভেবে থাকেন রান্না করা খাবারের দিকে বেশি ঝুঁকে থাকা মানুষগুলো। এখন প্রশ্ন হলো- খাবার রান্না করে খাওয়াটা আমাদের জন্য ভালো, নাকি কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া উচিত? এমন অনেক দেশের কথা এবং তাদের খাবারের কথা আমরা এখানে উল্লেখ করতে পারি যাদের খাবার না থাকে কাঁচা, না থাকে পুরোপুরি রান্না করা খাবার বলতে আমরা যেটা বুঝি তেমনটা। আধসেদ্ধ এই খাবারগুলোও কি আমাদের জন্য ভালো, নাকি নয়? আজ চলুন খাবার ও রান্না করা খাবার সম্পর্কে থাকা এই বিতর্কের সত্যাসত্য খানিকটা বোঝার চেষ্টা করি।
স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কোনটি?
প্রশ্ন যেহেতু স্বাদ নিয়ে নয়, সেক্ষেত্রে বলা যায় যে, স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে কাঁচা খাবারই বেশি এগিয়ে থাকবে এই আলোচনায়। রান্না করার সময় খাবারের বেশ কিছু পুষ্টিগুণ চলে যায়। এছারা খাবার রান্না করার প্রক্রিয়াতেও খাবারের ভেতর থেকে কাটাকুটি এবং ধোয়ার মাধ্যমে অনেক পুষ্টি বেরিয়ে যায়। তবে রান্না করলে যেমন খাবারের মধ্যে থেকে কিছু ভিটামিন চলে যায়, ঠিক তেমনি রান্না করা খাবারের মধ্যেও কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মানুষ কাঁচা খাবার কী করে খাবে? শত শত বছর ধরে রান্না করা খাবারের উপরে নির্ভরশীল মানুষের পক্ষে রান্না করা খাবার ছাড়া কি সম্ভব? এক্ষেত্রে আপনি বেছে নিতে পারেন র’ ফুড ডায়েট কিংবা রান্না না করা খাবারের খাদ্যাভ্যাস।
কাঁচা খাবারের খাদ্যাভ্যাস বা র’ ফুড ডায়েট কী?
র’ ফুড ডায়েট বলতে মূলত খাবারের মধ্যে খাবার অন্তত ৭০ শতাংশ কাঁচা রাখাকেই বোঝায়। কাঁচা খাবার বলতে একেবারে কাঁচা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়া, রান্না না করা খাবারকেই বোঝায়। শাকসবজি, বাদাম, শস্য, ফল ইত্যাদিকেই বিশেষ করে র’ ফুড ডায়েটের মধ্যে ফেলা হয়। র’ ফুড ডায়েট বলতে অনেকে ভাবেন পুরোপুরিভাবে উদ্ভিজ্জ খাবারের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়াকে। কিন্তু ব্যাপারটি কিন্তু একদম তা নয়। খানিকটা দুধ, মাছ এবং মাংস এই ধরনের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে আপনিও খেতে পারেন। অনেকে ভেবে থাকেন, রান্না করা খাবারের মাধ্যমে অনেক এনজাইম চলে যায়। অনেকে আবার রান্না করা খাবারকে বিষাক্ত বলেও ভাবেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, কাঁচা খাবার খাওয়ার কি কেবলই সুবিধা আছে? কোনো অসুবিধা কি নেই? আছে। আর সবকিছুর মতো রান্না না করা খাবারেও আছে সমস্যা। প্রথমত, রান্না না করা খাবার খাওয়াটা আমাদের পক্ষে বেশ কষ্টকর। অনেকেই এই ডায়েট শুরু করলেও শেষ করতে পারেন না। অনেকের শরীর ব্যাপারটি নিতে পারে না। আর অন্যদিক থেকে বলতে গেলে, কাঁচা খাবারে এমন অনেক জীবাণু থাকে, যেগুলো দূর করা সম্ভব একমাত্র রান্নার মাধ্যমে। এই যেমন- মাংস রান্না করাটা বেশ দরকারি একটি ব্যাপার। উপরোক্ত কারণগুলোর জন্যেই র’ ফুড ডায়েট করাটা সমস্যার ব্যাপার হয়ে পড়ে।
রান্না করা খাবারের নেতিবাচক দিক
যেহেতু রান্না করা খাবার নিয়ে অনেকের সমস্যা তৈরী হয় বা হচ্ছে, অনেকেই এর বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তার মানে নিশ্চয়ই রান্না করা খাবারে কিছু নেতিবাচক ব্যাপার আছে। কিন্তু কী সেগুলো? চলুন দেখে নিই।
এনজাইম চলে যায়
রান্না করা খাবারের ক্ষেত্রে রান্নার সময় খাবারের এনজাইম চলে যায়। সাধারণত, এনজাইম আমাদের শরীরে খাবারকে ভাঙতে সাহায্য করে। আপনি যে খাবারগুলো খাচ্ছেন প্রতিদিন, সেগুলোতেও এনজাইম থাকে। এই এনজাইম হজমে সাহায্য করে। এনজাইম সাধারণত উষ্ণতা পেলে একটু একটু করে কমে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ১১৭ ডিগ্রী ফারেনহাইটে এনজাইম একেবারের মতো চলে যায় খাবার থেকে। আর এই ব্যাপারটিকেই রান্না না করে খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছেন এর সমর্থকেরা। অন্যদিকে, রান্না করা খাবার খাওয়ার ব্যাপারেও কম মানুষ কথা বলেননি। তাদের যুক্তিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাদের মতে, আমাদের শরীর যথেষ্ট পরিমাণ এনজাইম উৎপাদন করে। ফলে হজমের জন্য সেটিই ব্যবহার করা যায়। বাড়তি এনজাইমের কী দরকার! এই বাড়তি এনজাইম মূলত গাছেদের জন্যে বলে মনে করেন তারা। দুই পক্ষের কথাতেই যুক্তি রয়েছে। তবে এর মধ্যে কোনটি আপনি বেছে নেবেন, তা বলাটা কিন্তু মুশকিল।
ভিটামিন নষ্ট হয়
কথাটি সত্যি যে, কাঁচা খাবারের চাইতে রান্না করা খাবারে ভিটামিনের পরিমাণ কমে যায়। আর এর মূল কারণ হল ভিটামিনের প্রকৃতি। রান্না করার সময় কিছু ভিটামিন এমনিতেই উষ্ণতার ফলে চলে যায়। ভিটামিন ‘বি’ এবং ভিটামিন ‘সি’ এর মতো ভিটামিন জলে দ্রবণীয়। ফলে, রান্না করলে এই ভিটামিনগুলোও নষ্ট হয়ে পড়ে। শুধু তা-ই নয়, শাকসবজি পানিতে সেদ্ধ করা হলে এতে করে খাবারের ৫০-৬০ শতাংশ ভিটামিন উড়ে যায়। ভিটামিন ‘এ’ এর মতো ভিটামিনগুলো রান্না করার ফলে প্রভাবিত হলেও পুরোপুরি লুপ্ত হয় না। অন্যদিকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত হয় এক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ডি’, ‘কে’, ‘ই’ এর মতো ভিটামিনগুলো। সেদ্ধ করার চাইতে সবচাইতে বেশি কার্যকরী উপায় হলো ভাজা কিংবা অল্প আঁচে ঢাকনাসহ সেদ্ধ করা। এতে করে খাবারের পুষ্টি খাবারের ভেতরেই বজায় থাকবে। এছাড়াও চেষ্টা করা উচিত যতটা সম্ভব কম সময় খাবার জ্বাল দেওয়া। কারণ যতক্ষণ সেটি চুলায় থাকবে, ততক্ষণ এবং তত বেশি পুষ্টি উপাদান খাবার থেকে বেরিয়ে যাবে।
অন্যদিকে রান্না করা খাবারেরও আছে বেশ কিছু ভালো দিক। সেগুলো হলো-
এতে করে খাবার খেতে বেশ সহজ এবং হজম করাটাও সহজ হয়। অন্যদিকে কাঁচা খাবার, রান্না না করা খাবার এনজাইমপূর্ণ থাকলেও সেটা হজম করার জন্য আমাদের শরীরের বেশি পরিমাণ শ্রম দিতে হয়। কিছু খাবারে রান্না করার পর পুষ্টির পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া সাথে খাবার চিবোনো সহজসাধ্য হওয়া এবং খাবারের গন্ধ আর স্বাদ বৃদ্ধি পাওয়ার ব্যাপার তো আছেই। খাবার রান্না করে খেলে খাবারের অনেক জীবাণু নষ্ট হয়ে যায়। ফলের মতো খাবারগুলো গ্রহণ করলে জীবাণু সংক্রমণের সমস্যা বেশি থাকে না। কিন্তু টমেটো, লেটুস পাতা আর পালং শাকের মতো খাবারগুলোতে থেকে যায় জীবাণু, যেটা আমাদের শরীরকে বাজেভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
দুধ এবং মাংসের ক্ষেত্রেও গরম করে জীবাণু নষ্ট করে ফেলাটাই সমীচীন। খাবার রান্না করলে অনেক সময় এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যেমন- বিটা ক্যারোটিন এবং ল্যুটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক গবেষণায় দেখা যায় যে, টমেটো রান্না করায় এর ভিটামিন ‘সি’ এর পরিমাণ কমে গেলেও লাইকোপেন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর রান্না করে খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যকর নাকি নয়, এটা অনেকটা কোন খাবার রান্না করা হচ্ছে তার উপরেও নির্ভর করে। ব্রোকলি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ কিংবা রসুনের মতো খাবারগুলো কাঁচা অবস্থাতেই খাওয়া ভালো। অন্যদিকে, মাশরুম, টমেটো, পালং শাক, গাজর, আলু, মাংস, মাছ, দুধ ইত্যাদি খাবারগুলো রান্না করেই খাওয়া স্বাস্থ্যকর। তাহলে কী ভাবছেন? রান্না করা নাকি রান্না না করা খাবার- কোনটি বেছে নেবেন আপনার খাবার টেবিলে?
ফিচার ইমেজ: IFLScience