ছোটবেলায় মা খালারা বলতেন, “বেশি চিনি খেও না, পেটে কৃমি হবে।” কৃমি জিনিসটা শুনতেও যেমন কানে লাগে, ঠিক তেমনি তার চেহারা এবং কাজ। ছেলে থেকে বুড়ো সকলেরই এতে ভীষণ ভয়, তাই পেট থেকে কৃমি তাড়ানোর জন্য নিয়ম করে কৃমির ঔষধ খেতে হয়। কৃমির ঔষধ ঠিকমতো না খেলে আবার তাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। পেটে কৃমি হয় তা সকলেই জানেন, কিন্তু চোখেও যে ঘুরে বেড়াতে পারে আস্ত একটা কৃমি, তা কি আপনারা জানেন? যদি না জেনে থাকেন, তবে চলুন জেনে নেয়া যাক।
লোয়া লোয়া একধরনের আফ্রিকান পরজীবী, যা আফ্রিকান আই ওয়ার্ম হিসেবে অধিক পরিচিত। আফ্রিকার প্রায় ১ কোটি মানুষ এই কৃমির সংক্রমণের শিকার এবং ২ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ আসন্ন সংক্রমণের তালিকায় রয়েছে। বিশেষত ঘন বর্ষণের এলাকা, যেমন মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকায় এর প্রকোপ সর্বাধিক। শুধু তা-ই নয়, এসব এলাকায় বেশ লম্বা সময় নিয়ে ভ্রমণরত পর্যটকদের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ সংক্রমণের সম্ভাব্যতা রয়েছে।
লোয়া লোয়া কৃমির সংক্রমণকে বলা হয় লোয়াসিস। ক্রিসপস গোত্রের ডিয়ার ফ্লাই ও ম্যাংগো ফ্লাই- এই দু’ধরনের মাছি এই কৃমির বাহক। এই দুই মাছির কামড়ে কৃমি মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। মানবদেহে এরা খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে থাকে এবং এরা এত পরিমাণে নতুন কৃমির জন্ম দেয় যে দেহের সেসব স্থানে অনেক সময় ফুলে যায় বা ফুসকুড়ির মতো দেখা দেয়। এই নব্য জন্ম নেয়া বাচ্চা কৃমিগুলোকে মাইক্রোফিলারি বলা হয়। কিছু কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতি মিলিলিটার রক্তে প্রায় ২০০,০০০-৩০০,০০০ এর মতো মাইক্রোফিলারি পাওয়া যায়।
প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিতে পরিণত হতে একেকটি মাইক্রোফিলারির প্রায় ১-৪ বছর লেগে যায়। নুডলসের মতো দেখতে এই লোয়া লোয়া কৃমির জীবনকাল সর্বোচ্চ ১৭ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী কৃমির দৈর্ঘ্য ৫০-৭০ মি.মি. হয়ে থাকে এবং পুরুষ কৃমি অপেক্ষাকৃত খাটো হয়ে থাকে। এদের দৈর্ঘ্য ৫০-৭০ মি.মি.। মানুষের শরীরের সাব-কিউটেনিয়াস টিস্যুতে এরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়, এমনকি চোখের সাব-কনজাংকটিভা ও স্ক্লেরাতেও এদের দেখা যায়।
১৭৭০ সালে সর্বপ্রথম এই কৃমির সংক্রমণ সম্পর্কে জানা যায়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে একটি জাহাজে করে কিছু ক্রীতদাস আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং এই জাহাজে কর্মরত একজন ফরাসী সার্জন সর্বপ্রথম এই সংক্রমণটি সনাক্ত করেন।
সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় তা মানবদেহে কোনো লক্ষণের সৃষ্টি করে না। যখন কৃমি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় কনজাংকটিভায় চলে আসে, তখন নানারকম লক্ষণ দেখা দেয়। এমতাবস্থায় প্রধানত দুটি লক্ষণ দেখা যায়।
- ক্যালাবার সোয়েলিং: যখন প্রাপ্তবয়স্ক কৃমি চোখের কনজাংকটিভায় চলে আসে, তখন চোখ ফুলে যায় এবং চোখে বেশ পিচুটি জমে যায়।
- চোখে জ্বালাপোড়া: আইবলের উপর কৃমিটি ঘুরে বেড়াতে থাকে, যা প্রদাহ সৃষ্টি করে।
লোয়া লোয়া কৃমির সংক্রমণের একটি ঘটনা বলা যাক। কঙ্গোর অধিবাসী সালামবঙ্গো পেশায় একজন শিকারী। হরিণ শিকার করে তিনি তার জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠে তিনি ঘন বন জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। হঠাৎ তিনি কিছুদিন যাবৎ আধো আলোতে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন এবং প্রখর সূর্যালোকে চোখে তীব্র ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেন। সারা শরীরে চুলকানির মতো দেখা দেয় এবং তার কাছে মনে হতে থাকে যে চোখের ভেতরে কিছু একটা কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা তার জন্য কষ্টকর ও ভীতিপ্রদ ছিল। কাগজের লেখা কিছুক্ষণ পড়লে তার চোখ দিয়ে রীতিমতো পানি গড়িয়ে পড়তো। তিনি বলেন,
“আমি অনেককে জিজ্ঞেস করতাম, “দেখ তো, আমার চোখে বোধহয় কিছু একটা পড়েছে।” জবাবে প্রত্যেকেই বলত, “কৃমির মতো কী যেন একটা দেখা যাচ্ছে তোমার চোখে।”
কৃমির কথা শোনার পর থেকেই তিনি এমন কাউকে খুঁজে ফিরছিলেন, যে কিনা সুঁচের সাহায্যে তার চোখ থেকে ওই অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসটিকে বের করে ফেলবে।
দুর্ভাগ্যবশত, কঙ্গোর ঘন জঙ্গলে অবস্থিত এবং সকল সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত এই গ্রামটিতে এমন কেউ ছিল না, যে তাকে এই দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। দিন দিন বাড়তে থাকা কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় বেশ কিছু ঔষধ প্রয়োগ করেন, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না। এরপর তিনি জঙ্গল থেকে বিভিন্ন তেতো গাছের পাতা সংগ্রহ করে, তার থেকে রস নিংড়িয়ে চোখে লাগাতে থাকেন। এতে করে তার চোখের ব্যথাটা ক্ষণিকের জন্য বন্ধ হলেও পরক্ষণেই তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
আফ্রিকার মতো অনুন্নত দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা। তাই এদেশের অধিকাংশ মানুষ এমন রোগে আক্রান্ত হলেও তাদের জন্য নেই কোনো চিকিৎসার সুযোগ। তাদের অপেক্ষা করতে হয় কৃমিটির প্রাকৃতিক মৃত্যুর। নিদারুণ কষ্ট সহ্য করা ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের কোনো উপায় থাকে না।
পক্ষান্তরে, আমেরিকায় কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে অপারেশন অথবা ব্লাড ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে কৃমি অপসারণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও রয়েছে পথ্যের সুবিধা।
- লোয়াসিসের চিকিৎসায় ডিইসি (ডাই ইথাইল কার্বামাজিন) ব্যবহার করা হয়, যা প্রাপ্তবয়স্ক ও বাচ্চা কৃমি উভয়ের বিরুদ্ধেই সক্রিয়। ৮ থেকে ১০ মি.গ্রা. করে প্রতিদিন ডিইসি সেবনের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে এবং ঔষধ সেবনের মেয়াদকাল ২১ দিন। তবে এই ঔষধের কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যাদের শরীরে বাচ্চা কৃমির সংখ্যা কম, তাদের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তবে যাদের শরীরে এর সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের ক্ষেত্রে নানা রকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তাই ডিইসি দিয়ে চিকিৎসা শুরুর পূর্বে চিকিৎসকের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
- প্রতিদিন দুবার করে মোট ২০০ গ্রাম অ্যালবেনডাজল সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন অনেক চিকিৎসক। ঔষধ সেবনের মেয়াদকাল ২১ দিন এবং এই ঔষধ সেবনে মাইক্রোফিলারির সংখ্যা অনেকটা কমে যায়।
- ইভারমেকটিন মাইক্রোফিলারির বিরুদ্ধে বেশ ভালো কাজ করে, তবে প্রাপ্তবয়স্ক কৃমির বিরুদ্ধে এর কার্যক্ষমতা নেই।
- লোয়া লোয়া কৃমির আক্রমণের হাত থেকে দ্রুত চিকিৎসা প্রদানের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি।
আফ্রিকার এই অঞ্চলে যারা ভ্রমণকারী আসেন, তাদের প্রতিষেধক হিসেবে একবার ৩০০ গ্রাম ডিইসি সেবনের জন্য বলা হয়ে থাকে।
আফ্রিকার এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে এই রোগের প্রকোপ হেতু সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো মাথাব্যথা নেই। চিকিৎসক, গবেষক বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কিঞ্চিৎ উদ্যোগ হয়ত আক্রান্ত মানুষগুলোর জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারে।
একদল ফরাসী গবেষক লোয়া লোয়া কৃমি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ২০০১ সালে তারা প্রায় ৩,৬০০ জন আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং এর প্রায় ১৫ বছর পরে ২০১৬ সালে তারা পুনরায় তথ্য যাচাই করলে এই সংক্রমণ সম্পর্কে আরো কিছু নতুন তথ্য জানা যায়। দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে সুস্থ ব্যক্তিদের তুলনায় আক্রান্ত ব্যক্তির বেশিরভাগই মারা গেছেন। এছাড়াও লোয়া লোয়া কৃমির আক্রমণে অনেক সময় সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়।
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সুদৃষ্টি এবং প্রচেষ্টার ফলে এই রোগ নিয়ে গবেষণাকে প্রশমিত ও ত্বরান্বিত করতে পারে। সচেতনতা ও সঠিক সময়ে সঠিক ঔষধের ব্যবহার হয়ত এই কৃমির সক্রমণকে অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে।
ফিচার ইমেজ: theywillkillyou.com