খেলতে গিয়ে এখানে সেখানে কেটে যাওয়া, র্যাশ, ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি সব বাচ্চাদেরই যেন ছেলেবেলার একটি অংশ। আর বাচ্চাদের এসব সমস্যা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মা বাবাদের চিন্তার শেষ নেই! সচরাচর যে সমস্যাগুলো হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঠাণ্ডা, কাশি, গলা ব্যাথা যা কিছুটা সচেতন হলেই সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যায়। এছাড়াও খেলাধুলা করতে গিয়ে হালকা কেটে ছিঁড়ে গেলে এবং এর থেকে র্যাশ বা অ্যালার্জি হলেও সেটা তেমন কোনো চিন্তার বিষয় নয়। তবে বাচ্চাদের শরীর খারাপ বেশি দিন ধরে থাকলে তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং সতর্ক থাকা জরুরি। এছাড়াও কিছু কিছু লক্ষণ বা উপসর্গ আছে যেগুলো দেখা মাত্রই বসে না থেকে সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। আজ সেই লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে।
মাত্রাতিরিক্ত জ্বর
যদি একটি বাচ্চার জ্বর হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে। বাচ্চার বয়স যদি ৬ মাস বা তার উপরে হয়, তাহলে জ্বর ১০১ ডিগ্রীর বেশি হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মাত্রাতিরিক্ত জ্বর বলতে বোঝায় ১০৪ ডিগ্রী জ্বর। অবস্থায় প্রথম দিন অপেক্ষা করে পরের দিন অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। আর যদি খাওয়াদাওয়া ঠিক মতো করে থাকে, তবে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ফোনে পরামর্শ নেয়ার সুযোগ থাকলে সেটাও করতে পারেন।
শরীরের এমন অবস্থায় বাচ্চাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রামের প্রয়োজন। যদি বাচ্চার বেশি জ্বর এবং শরীর খারাপ যেমন- অতিরিক্ত দুর্বল লাগার কারণে স্বাভাবিকভাবে নড়তে চড়তেও সমস্যা হচ্ছে তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যদি আপনার বাচ্চার বয়স ২ বছর বা তার বেশি হয় এবং টানা ৪ দিন বা তার বেশি সময় ধরে ১০৪ ডিগ্রী বা এর চেয়ে বেশি জ্বর হয় তখন চিকিৎসকের কাছে অবশ্যই যেতে হবে। আর শিশুর বয়স যদি ২ বছরের কম হয়, তাহলে জ্বর অপেক্ষাকৃত কম (১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইট) হলেও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অনবরত মাথাব্যথা
শিশুদের মাথাব্যথার বিষয়টি অনেক সময় তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। ফলে ওরা যথাযথভাবে ব্যথা বা যন্ত্রণাটি কতটুকু বা ঠিক কতক্ষণ ধরে হচ্ছে তা প্রকাশ করতে পারে না। অল্প ব্যথা থাকলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিলে বা ঘুমালেই স্বাভাবিকভাবে মাথাব্যথা চলে যাওয়ার কথা। তবে এর পরও যদি মাথাব্যথা না সারে, টানা ব্যথা হতেই থাকে এবং বাচ্চা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করে, খেলাধুলায় অনিচ্ছা প্রকাশ করে এবং বিছানা থেকে উঠতে না পারে তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়াও মাথাব্যথার কারণে যদি স্নায়বিক কোনো সমস্যা, যেমন- চোখ খুলতে কষ্ট হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, বমিভাব, মাথাব্যথার সাথে জ্বরও হয় এবং হাঁটতে কষ্ট হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তলপেটে ব্যথা
শিশুদের প্রায়ই এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, অনেক সময় খাবার খাওয়ার আগে হাত ধুতে ভুলে যাওয়া, অতিরিক্ত পরিমাণে ফাস্ট ফুড খাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এমনটি হতে পারে। তবে অধিক সময়ের জন্য এই ব্যথা স্থায়ী হলে এবং ব্যথার মাত্রা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। ব্যথা যদি নাভির দিক থেকে শুরু হয়ে ডানদিকের তলপেটের দিকে এসে অতিরিক্ত হয় তাহলে এটি বুঝে নিতে হবে যে এটি অ্যাপেন্ডিক্স (আন্ত্রিক রোগবিশেষ) এর ব্যথা।
অ্যাপেন্ডিক্সের লক্ষণগুলো-
- ডানদিকে তলপেটের নিচের দিকে ব্যাথা
- বমি
- ডায়রিয়া
- হাত দিয়ে পেট পরীক্ষা করার সময় নরম অনুভূত হওয়া।
আপনার বাচ্চার যদি তলপেটে ব্যথা সহ উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়, তাহলে অনতিবিলম্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
উচ্চ শব্দেও কোনো প্রতিক্রিয়া বা সাড়া না দেওয়া
ঠিকমতো শুনতে না পাওয়ার সমস্যাটি বাচ্চারা প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ওদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, ওদের শ্রবণশক্তিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে কিনা। যদি দেখেন যে, আপনার সন্তান কোনো শব্দ শোনার পরও কোনো রকম প্রতিক্রিয়া বা সাড়া দিচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন। শিশুর শ্রবণশক্তি ব্যাঘাতের সমস্যা প্রতিরোধে আপনি নিজেও কিছুটা করতে পারেন। সেন্টার অব ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) মতে, শব্দ দূষণের কারণে ৬ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় ১২.৫ শতাংশ শিশুর শ্রবণশক্তিজনিত সমস্যা হয়ে থাকে।
সমস্যাটি কমিয়ে আনতে টিভি দেখার সময়, ভিডিও গেম খেলার সময় ও গান শোনার সময় যেন ওরা উচ্চ মাত্রায় ভলিউম না দিয়ে শোনে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। বিশেষ করে, বাচ্চাদের কানে হেডফোন দেওয়া থেকে একেবারেই বিরত রাখুন। আর যদি হেডফোন একান্তই ব্যবহার করে থাকে, তবে কানের ওপর দেয়া যে হেডফোনগুলো থাকে সেগুলো ব্যবহার করতে দিন। কানের ভেতর দেয়ার চাইতে কানের উপরে থাকা হেডফোনগুলো শব্দ থেকে কানকে অপেক্ষাকৃত অধিক সুরক্ষিত রাখে। এছাড়াও নয়েজ-ক্যান্সেলিং জাতীয় হেডফোনগুলোর এয়ার কুশনে মেমরি ফোম থাকে। তাই এগুলো কানে ভালোভাবে এঁটে থাকে যা পারিপার্শ্বিক শব্দ কমাতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত পিপাসা
সারাদিন খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করার পর শিশুদের পানির তৃষ্ণা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। আদতে, এই বিষয়টি ইতিবাচক লক্ষণ যে আপনার শিশুর শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে হাইড্রেটেড থাকছে। কিন্তু কোনো রকম কর্মকাণ্ড ছাড়াই বা একদমই কম খেলাধুলা ও কাজ করার পরও যদি আপনার বাচ্চার অতিরিক্ত পানির তৃষ্ণা লাগে তাহলে তা চিন্তার বিষয় বটে! যদি আপনার বাচ্চার ভীষণ পিপাসা থাকে এবং অধিক পরিমাণে পানি খাওয়ার পরও সেই তৃষ্ণা মিটতে না চায় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অনবরত অধিক মাত্রায় তৃষ্ণা টাইপ-১ ডায়াবেটিসের উপসর্গ হতে পারে। বিশেষ করে অধিক পরিমাণে তৃষ্ণার সাথে সাথে যদি ক্ষুধা ও মূত্রত্যাগের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ওজন কমতে থাকে, অবসাদ অনুভব হয়; তাহলে টাইপ-১ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখুন যে, আপনার সন্তানের টাইপ-১ ডায়াবেটিস আছে কিনা।
মূত্রত্যাগের পরিমাণ কমে যাওয়া ও অবসাদ
ব্যক্তিভেদে সুস্থ অবস্থায় মূত্রত্যাগের পরিমাণ একেক জনের একেক রকম হয়ে থাকে। প্রতি ৫ থেকে ১০ মিনিটে মূত্র বিসর্জনের চাপ আসতে পারে। তবে তার খাওয়াদাওয়া, কাজ, পানি খাওয়া এবং উপর্যুপরি সার্বিকভাবে শরীরের কার্যক্রমের উপরও এই বিষয়টি নির্ভর করে। একইভাবে, একেক শিশুর এনার্জি লেভেল একেক রকম হয়ে থাকে। তাই খেলাধুলা, কাজ ও পড়াশোনা করার পর কিছুটা ক্লান্তি চলে আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু টানা কয়েকদিন ধরে যদি আপনার শিশু ক্লান্তি অনুভব করে অথবা স্বাভাবিক সময়ের মতো একদমই শক্তি না পায়, তাহলে সে বিষয়ে আপনাকে সচেতন হতে হবে।
মূত্রত্যাগের পরিমাণ কম হওয়ার ক্ষেত্রেও একইভাবে সচেতন হতে হবে। পরপর দু’দিন যদি স্বাভাবিক সময়ের চাইতে মূত্রত্যাগের পরিমাণ কমে যেতে থাকে তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মূত্রত্যাগের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং অবসাদের সাথে যদি ত্বক ও ঠোঁট শুষ্ক হয়ে যায়, মাথা ঘোরায়, অত্যধিক বমি ও ডায়রিয়া হয় তাহলে সেটি ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ। ডিহাইড্রেশন হলো শরীর থেকে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ পানি বেরিয়ে যাওয়া এবং এর কারণে শারীরিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটা। তাই এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এছাড়াও সারা শরীরে র্যাশ বা অ্যালার্জি হওয়া, বদহজম ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যাও বেশিদিন স্থায়ী ও গুরুতর হলে দেরি না করে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ফিচার ইমেজ: Working Moms Against Guilt