ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় ও বিতর্কিত চরিত্র সৌরভ গাঙ্গুলী। সাধারণ দর্শক-সমর্থক থেকে শুরু করে সতীর্থ কিংবা পূর্বসূরী, বোদ্ধা, বিশ্লেষকদের ভালোবাসা ও ঘৃণার যুগপৎ সম্মিলন এতটা প্রকটভাবে তার সমসাময়িক আর কারো ভাগ্যে জোটেনি।
এই সাক্ষাৎকারটি সৌরভ দেন ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে, অস্ট্রেলিয়ার আইকনিক মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ১০০তম টেস্ট খেলতে নামার আগে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই সাক্ষাৎকারটির বিশেষ মূল্য রয়েছে।
তবে আরেকটি বিষয় এই সাক্ষাৎকারের গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি তিনি দিয়েছেন ক্রিকইনফোর তৎকালীন সহযোগী সম্পাদক আনন্দ বসুকে, যিনি সৌরভের বিরুদ্ধে সমানে লেখালেখি করেছেন, টিভিতে কথা বলেছেন। শেষ দেখে ফেলেছেন এই বঙ্গসন্তানের ক্যারিয়ারেরও। কিন্তু স্মরণীয় মাইলফলক স্পর্শের আগে সৌরভ সেই আনন্দেরই মুখোমুখি হয়েছেন মন খুলে কথা বলতে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আনন্দের নার্ভাসনেস স্পষ্টতই ফুটে উঠেছে আলাপচারিতায়। কিন্তু নিপাট ভদ্রলোক সৌরভ ব্যক্তিগত আবেগকে মনের কোণে বিন্দুমাত্র ঠাঁই না দিয়ে, শতভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দিয়েছেন প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর।
৮ জুলাই, ২০২২, সৌরভ গাঙ্গুলীর ৫০তম জন্মদিনে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য থাকছে ‘দাদা’র এই স্মরণীয় সাক্ষাৎকারটির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ।
১০০ টেস্ট কি আপনার জন্য খুবই অর্থবহ একটি ব্যাপার? আপনি তো ইতোমধ্যেই শচীন (টেন্ডুলকার), রাহুল (দ্রাবিড়) আর অনিলকে (কুম্বলে) এই মাইলফলক ছুঁতে দেখেছেন।
হ্যাঁ, এটি আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার। যেকোনো ক্রিকেটারের জন্যই এটি একটি বিশাল মাইলফলক। তাছাড়া ভারতীয় ক্রিকেটে খুব বেশি খেলোয়াড়ের তো এই অর্জন নেই। সুনীল গাভাস্কার, দিলিপ ভেংসরকার, কপিল দেব… তারপর বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে অনিল, শচীন, রাহুল। তাই এই ক্লাবে যোগ দিতে পারলে ভালো লাগবে অনেক।
বর্তমান যে ক্রিকেটারদের নাম আপনি উল্লেখ করলেন, তাদের চেয়ে তো আপনার জার্নি অনেক বেশি কঠিন ছিল। এই জার্নিকে কি আপনি সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে তুলনা করবেন? বাংলার একজন ক্রিকেটারের ১০০ টেস্ট খেলা…
একটি রাজ্য হিসেবে আমরা খুব একটা বড় ক্রিকেটারের জন্ম দিতে পারিনি। কিন্তু আমি আশা করব ভবিষ্যতে যেন এর শুরু হয়। বোম্বে (মুম্বাই), কর্ণাটক, দিল্লির মতো জায়গা থেকে একের পর এক ক্রিকেটার উঠে আসছে। ক্রিকেটকে ভালোবাসে এমন একটি রাজ্য হিসেবে আমাদের জন্যও জরুরি এমন সব ক্রিকেটার তৈরি করতে থাকা, যারা নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেবে, ভারতের হয়ে খেলবে।
চলুন আপনার ক্যারিয়ারকে কয়েকটা ভাগে বিভক্ত করা যাক। প্রথমেই ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালের সময়টা, যখন আপনি মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই বাদ পড়ে যান। তারপর ১৯৯৬ সাল, যখন আপনার টেস্ট অভিষেক হয়, এবং ২০০০ সাল অবধি আপনি একটানা খেলতে থাকেন। ২০০০ সালে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকে ২০০৫ পর্যন্ত আরেকটা পিরিয়ড। এবং সর্বশেষ ২০০৫ থেকে এখন পর্যন্ত। গাঙ্গুলীর এই এতগুলো যুগ সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
১৯৯২ সালে তো আমি একদমই ছোট ছিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় গেলাম, কিন্তু ক্রিকেট খেলার সুযোগ বলতে গেলে পেলামই না। স্রেফ একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেই বাদ পড়লাম। এরপর চার বছর আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলি। যেহেতু তখন বয়স কম, দলের বাইরে থাকা আমাকে খুব একটা পোড়ায়নি। ১৯৯৬ সালে আমি ফিরে এলাম, এবং অবশ্যই টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা চমৎকার ছিল। আমি টানা খেলতে থাকলাম। ২০০০ সালে আমি ক্যাপটেন হলাম, এবং ২০০৫ পর্যন্ত ওই পদে থাকলাম। এটি ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুবই সফল একটি সময়, তাই আমার জন্যও সন্তোষজনক মেয়াদ। ২০০৫ সালে আমি আবার বাদ পড়লাম। (আমি) খুশি আবারো দলে ফিরতে পেরে, এবং ফেরার পর থেকে পারফর্ম করে যাওয়ায়।
আপনার কি মনে হয় অধিনায়কত্ব একটু আগেভাগেই চলে এসেছিল আপনার দোরগোড়ায়?
হ্যাঁ, যখন অধিনায়ক হলাম, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার অভিজ্ঞতা মাত্র পাঁচ বছরের। শচীন সেই অস্ট্রেলিয়া সিরিজের (১৯৯৯-২০০০) পর আর দলকে নেতৃত্ব দিতে চাইছিল না। আমি ওই সময় ছিলাম সহ-অধিনায়ক। যেহেতু দুই ফরম্যাটেই আমার জায়গা পাকা ছিল, তাই ওই দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে বেছে নেওয়া হলো। কিন্তু যদি ভারত দলের হয়ে কয় বছর খেলেছি সেটা চিন্তা করেন, তাহলে আমার অধিনায়কত্ব পাওয়াটা একটু তাড়াহুড়া করেই হয়ে গেছে।
একটি কঠিন সময়ে আপনি দলের দায়িত্ব নেন। ভারতীয় ক্রিকেট তখন ম্যাচ-পাতানোর ডামাডোলে অস্থির। টিভিতে এসে আপনি দাবি করেন যে আপনার দলের সবাই নির্দোষ, এবং ভবিষ্যতেও তারা নিষ্কলুষই থাকবে। অমন একটা পরিস্থিতিতে দলের দায়িত্ব নেওয়া কি কঠিন ছিল না?
হ্যাঁ, তা তো ছিলই। ওই সময়টায় আমি আসলে খুবই বিস্মিত, হতভম্ব ছিলাম। আমি তো জানতামই না তলে তলে এসব কিছু ঘটছে। অবশ্য ওই কারণেই আমরা বেশ কিছু তরুণ খেলোয়াড় পেয়ে যাই। যুবরাজ (সিং), জহির (খান) ২০০০ সালে দৃশ্যপটে আসে। আমার দলে তখন মাত্র চারজন সিনিয়র ছিল; আমি, শচিন, রাহুল আর অনিল। এর বাইরে নতুনদের নিয়ে দল সাজাতে হচ্ছিল। একদিনের ম্যাচে (বীরেন্দর) শেহবাগ, হরভজন (সিং), আশিষ নেহরার মতো ক্রিকেটাররা বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছিল। এখন আমরা সুফল ভোগ করছি ওই চ্যালেঞ্জিং সময়টার। তখন দলে আসা খেলোয়াড়রা একেকজন এখন ম্যাচ-উইনার হয়ে উঠেছে।
আপনি তো ওই সময়ে তরুণ ক্রিকেটারদের দলে আসা নিয়ে বললেন। কিন্তু ব্যাটিংয়েও আপনারা তখন ভালো করছিলেন; ফলাফল আপনাদের পক্ষে আসছিল। বিশ্বের সেরা দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারত ঘরের মাঠে ম্যাচ জেতে, আবার অ্যাওয়ে ম্যাচেও ড্র করে। ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সেটি কি স্বর্ণযুগ ছিল?
হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা ৫০ বছর বাদে পাকিস্তানের মাঠে পাকিস্তানকে হারাই, এবং বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যাই। আমরা ওই সময়ে দুটো মিনি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলি। শচীন, রাহুল, (ভিভিএস) লক্ষ্মণ, শেহবাগ সবাই তাদের সেরা ব্যাটিং ফর্মে ছিল। এই বিষয়টি সম্ভবত দলকে সাহায্য করেছে।
আপনার নেতৃত্ব এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষত তরুণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে আপনি যা করেছেন। আসলে আপনি তাদের জন্য কী এমন করেছেন যা অন্যদের চেয়ে আলাদা?
আমি তাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছি। একজন অধিনায়ক হিসেবে আমার নির্দিষ্ট কিছু আইডিয়া ছিল, যেটি এখন আমি কুম্বলের মধ্যেও দেখতে পাই। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতাম যে প্রত্যেক ক্রিকেটারেরই কিছু ফেয়ার চান্স পাওয়া প্রয়োজন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম খেলোয়াড়দের উপর থেকে চাপ সরিয়ে নেব এবং তাদেরকে স্বাধীনভাবে খেলতে দেব। নিজেদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে এই ব্যাপারটি সত্যিই অনেক সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে আমার ছিল রাহুল, শচীন, অনিল ও লক্ষ্মণ, যারা নিজেরাই অসাধারণ ক্রিকেট খেলছিল।
আপনি দলের জন্য যা করেছেন, তার সঙ্গে ব্যক্তি আপনার প্রচুর ফারাক। আপনি নিজে একজন নম্র-ভদ্র, ঠান্ডা মাথার মানুষ, অথচ আপনার দলটি ছিল কাঠিন্যে ভরপুর, যেকোনো সময়ে লড়াইয়ে প্রস্তুত।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমরা তখনই ভালো খেলি যখন আগ্রাসী থাকি। যখনই আমরা খানিকটা গা-ছাড়া ভাব দেখাতাম, পুরোপুরি ভিন্ন একটি দলে পরিণত হতাম। আমাদের তাই দল হিসেবে তেতে ওঠার দরকার পড়ত, এবং এভাবেই ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমরা ফল পাই। তারা আসল এখানে… স্টিভ ওয়াহ এখানে (ভারতে) বাদে অন্য সবখানেই জিতেছে। সে দলের উপর চাপ প্রয়োগ করছিল। এদিকে আমরা ছিলাম একটি তরুণ দল, তাই তারা খুব ভালো করেই জানত দু’দলের মধ্যে তারাই সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে। আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠাই ছিল আমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে ভালো খেলার একমাত্র পথ।
ভারতীয় ক্রিকেটে একসময় অন্যতম আলোচিত বিষয় ছিল আঞ্চলিক পক্ষপাত। কিন্তু আপনার মেয়াদকাল থেকে অনেকাংশেই বিষয়টির ইতি ঘটেছে।
সত্যি বলতে কী, অধিনায়ক হওয়ার আগেও যখন আমি ক্রিকেট খেলতাম, এসব কিছু তেমন একটা লক্ষ করিনি। হয়তো বয়স কম ছিল বলেই বুঝতে পারতাম না। যখন আমি অধিনায়ক হলাম, আমার উপর পুরো দায়িত্ব চাপল ভারতের জন্য সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ ১৫ জনকে বেছে নেওয়ার। আমি সেটিই করতে চাইতাম, এবং আমার উপর কোনো জায়গা থেকেই চাপ ছিল না নির্দিষ্ট কাউকে দলে নেওয়ার বা দল থেকে বাদ দেওয়ার। আমি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি যখন অধিনায়কত্ব করব, সেরা দলকেই খেলতে হবে।
সেই সময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটেছিল : ভারতের প্রথম বিদেশি কোচ নিয়োগ। জন রাইটের সঙ্গে আপনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু এখন যদি চিন্তা করি, বিশেষত পরবর্তীতে ঘটা অন্যান্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, জন রাইটের সঙ্গে আপনার তো বেশ স্বাস্থ্যকর একটি কাজের সম্পর্কই ছিল। তাই না?
আমরা একসাথে খুবই ভালোভাবে কাজ করতাম। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপারটি ছিল। মতের পার্থক্য তো থাকবেই। তিনি হয়তো আমাকে কোনো একটি ব্যাপারে তার মতামত জানাতেন, আমিও তারপর চেষ্টা করতাম আমার দিক থেকে বিষয়টি উপস্থাপনের। দিনশেষে, আমার সবসময়ই মনে হয়, অধিনায়কের কথাই অগ্রগণ্য। কারণ মাঠে বসে তো আমাকেই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হতো।
জন মানুষ হিসেবে চমৎকার ছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার কৃতিত্ব তার। তিনিই সবাইকে অনুধাবন করিয়েছেন যে বিদেশের মাটিতে জেতা গুরুত্বপূর্ণ, এবং ঘরের মাঠে জেতাই সব নয়। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হরভজন যেভাবে বল করেছিল, তার পেছনেও ভূমিকা ছিল এই মানুষটিরই।
আপনার মেয়াদের শেষ দিকে মনে হচ্ছিল এই সবকিছুই আপনার উপর বিষম বোঝা হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন আপনার নিজে ব্যাটিং ফর্মই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। এই মূল্যায়নের সঙ্গে কি আপনি একমত?
একজন অধিনায়ক হিসেবে আপনি যদি ভালো পারফর্ম না করেন, তা সে যে দেশেই হোক না কেন, এবং বিশেষত আমাদের এই উপমহাদেশে, আপনার উপর পাহাড়সম চাপ পড়বে। হয়তো এটি নিছকই একটি কাকতাল যে আমার অধিনায়কত্বের শেষ ভাগে আমি ব্যাট হাতে ভালো করতে পারিনি। কিন্তু আমার নেতৃত্বের পুরোটা সময়জুড়ে আমি ক্যাপটেন্সি আর ব্যাটিংকে আলাদা রাখতে চেষ্টা করেছি। আমি যখন ব্যাট করতে নামতাম, একবারও মনে করতাম না যে আমি ক্যাপটেন। এমনকি যখন আমি ব্যাট হাতে স্কোর করতে পারতাম না, আমি জানতাম মাঠে বসে আমাকে অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে যেন দল জিততে পারে। পরের দিকে এটি স্রেফ কাকতালীয় ব্যাপার যে আমি এমন একটা সময়ে অধিনায়কত্ব হারালাম যখন আমার ব্যাটিং ফর্মও ভালো ছিল না।
রাইট পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন, তিনি সম্ভবত একটু বেশি সময়ই থেকে ফেলেছেন। আরো আগেই তার ভারতীয় ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়া উচিত ছিল। আপনিও কি নিজের অধিনায়কত্বের ব্যাপারে একই ধরনের কথা বলবেন?
না, আমার তা মনে হয় না। জন পাকিস্তান সিরিজের (২০০৩-০৪ সালে) পর চলে যেতে চান। কিন্তু সেখানে ক্রিকেটের চেয়েও বড় কারণ ছিল তার কিছু পারিবারিক সমস্যা। তার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা ছিল, এবং তিনি চার থেকে পাঁচ বছর নিউজিল্যান্ডের বাইরে ছিলেন। আমরা বিভিন্ন সফর থেকে ফিরে যে যার বাড়িতে চলে যেতাম, কিন্তু তিনি নিজের বাড়িতে নয়, ফিরতেন ভারতেই। এদিক থেকে চিন্তা করলেও ব্যাপারটা তার জন্য অনেক কঠিন ছিল।
আপনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দলের বাইরে ছিলেন। তারপর আবার আপনি ২০০৫ সালে বাদ পড়লেন। এই দুটো সময়কে আপনি কীভাবে তুলনা করবেন?
এই দুটো ছিল একদমই আলাদা বিষয়। ১৯৯২ সালে আমি বাচ্চা একটা ছেলে ছিলাম, ১৮ বা ১৯ বছর বয়স আমার। তাই দল থেকে বাদ পড়ায় আমার কিছু যায়-আসেনি। আমি বাংলার হয়ে খেলেই খুশি ছিলাম, শুধু ফার্স্ট-ক্লাস ক্রিকেটই খেলছিলাম। ওই বয়সে তো কেউ কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করে না। কিন্তু ২০০৫ সালে যখন আমি আবার দল থেকে জায়গা হারালাম, তখন প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। আমার বয়স তখন ৩২; যেকোনো কারণেই হোক, আমি অধিনায়কত্ব হারিয়েছি; চারদিকে আমাকে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। দল থেকে জায়গা হারানোর জন্য এটি খুব একটা সুখকর সময় নয়। তাই এই দুটো পরিস্থিতিকে আমি পুরোপুরি আলাদা বলব।
দ্বিতীয়বার বাদ পড়ার পরও আপনি কীভাবে ক্রিকেটে লেগে থাকলেন? ওই সময়ে কী করছিলেন?
আমি তখন আমার খেলার উপর কাজ করি, এবং নিজের জন্যও প্রচুর সময় পেয়ে যাই। যখন আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, হোটেল, এয়ারপোর্ট, রোজকার স্কেজিউল থেকে দূরে ছিলাম, তখন এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ক্লান্তি দূর হতে থাকে… আমি সিস্টেম থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসি, কিন্তু আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম আমার পক্ষে খেলায় ফেরা সম্ভব। সামনে তখন অনেকগুলো কঠিন সফর ছিল, তাই আমি জানতাম দলে অন্তর্ভুক্ত খেলোয়াড়রা যদি ভালো করতে না পারে, তাহলে একপর্যায়ে আমার পালাও আসবে। তবে এগুলো তো শুধুই বিশ্বাস আর আশা। বাস্তবতা ভিন্নও হতে পারত। শেষমেশ যা হয়েছে, তাকেই তো নিয়তি বলে।
বাইরে থেকে দেখে যদ্দূর মনে হয়, ক্রিজে আপনি এখন আগের চেয়েও বেশি ধীর-স্থির, শান্ত। কামব্যাকের পর এটি কি আপনার মধ্যে একটি পরিবর্তন?
এগুলো আসলে আরো অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে, আনন্দ। যখন আপনি ভালো খেলেন, অনেক ব্যাপারই দেখে ভালো লাগে। আবার যখন আপনি ভালো খেলেন না, আপনি অনেক কিছুই চেষ্টা করেন, কিন্তু সেসব চেষ্টা কাজে আসে না। খেলা জিনিসটাই এমন। তবে অবশ্যই, এখন আমার নিজেকে দেওয়ার মতো প্রচুর সময় আছে হাতে। ভারতে অধিনায়কত্বের ভার বহনটা তো সহজ নয়। যখন কেউ অধিনায়ক থাকে, তাকে গোটা দলকে সামলাতে হয়, আবার নিজের খেলা, মিডিয়া, সিলেকশন, ট্যুর- এই সমস্ত কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে হয়। কাজটা সহজ নয়। এখন আমি নিজেকে অনেক সময় দিতে পারি, নিজের উন্নতির জায়গাগুলো নিয়ে কাজ করতে পারি। আমি এখন ভাবতে পারি যে দলকে সাহায্য করার জন্য আমার কী করা প্রয়োজন, এবং এই ব্যাপারটিই আমাকে মানসিকভাবে সতেজ রাখে।
তাহলে আপনি কি একমত যে মনকে নির্ভার রাখা এবং অন্যান্য মানসিক সমস্যার সমাধান করা ব্যাটিংয়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ?
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে। যেকোনো কাজের ক্ষেত্রেই মন নির্ভার রাখা জরুরি। আপনি যত অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করবেন, আপনার কাজ তত কঠিন হয়ে পড়বে।
দলে ফেরার পর থেকে কোন ইনিংসটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করেছে? বেছে নেওয়ার জন্য তো আপনার হাতে বেশ কয়েকটি অপশনই রয়েছে।
আসলে, জোহানেসবার্গে প্রথম নকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি ছিল আমার কামব্যাক ম্যাচ, উইকেটটা ছিল যথেষ্ট কঠিন, এবং সেবারই আমরা দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম কোনো টেস্ট ম্যাচ জিতলাম। তাছাড়া নটিংহ্যামে আমার নকটা, যেখানে শচীনের সঙ্গে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জুটি গড়লাম, সেটাও অনেক সন্তোষজনক ছিল। তাছাড়া ভারতও ম্যাচটি জেতে। ইডেন গার্ডেনসের হান্ড্রেড, যেটি ঘরের মাঠে আমার প্রথম শতক, সেটিও অনেক সন্তুষ্টি দিয়েছে। ৬১ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আমার প্রথম ডাবল-হান্ড্রেডটিও ভালো ছিল।
ফিটনেসের ব্যাপারে আপনার তেমন একটা সুখ্যাতি নেই, তারপরও আপনি লম্বা একটি ক্যারিয়ার পেয়েছেন। এই দীর্ঘস্থায়িত্বের পেছনে রহস্য কী?
আমি আমার ফিটনেস নিয়ে কাজ করি। আমি হয়তো মোহাম্মদ কাইফ বা অন্যান্য তরুণ ক্রিকেটারদের মতো ফিট নই। যখন আমরা ক্রিকেট খেলা আরম্ভ করি, তখন ফিটনেসের সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পরিবর্তন এসেছে। আমার, রাহুলের মতো মানুষরাও ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছে। আমরা মাঠে সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন না হতে পারি, কিন্তু আমরাও কার্ডিও ও ওজন নিয়ে কাজ করি, যা ব্যাটিংয়ের সময়ে সত্যিই কাজে দেয়।
আপনার ব্যাটিংয়ের টেকনিক শচীন বা রাহুলের মতো কমপ্যাক্ট নয়। আপনার কি ব্যাটিং নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে?
না, আমার টেকনিক অতটা কমপ্যাক্ট নয়। ওই দুজনের মতো কমপ্যাক্ট কখনোই ছিল না আমার টেকনিক। কিন্তু আমার অন্য কিছু অস্ত্র আছে। আমার টাইমিং। ভালো বলগুলোকেও আমি মেরে সীমানাছাড়া করতে পারি, যে ক্ষমতা হয়তো অন্যদের মধ্যে নেই। আমাকে আসলে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের খেলায় মানিয়ে নিতে হয়েছে।
আমি বুঝতে পেরেছি আমার শক্তিমত্তার জায়গা কোনগুলো, এবং কোনগুলো আমার শক্তিমত্তার জায়গা নয়। এগুলো চিন্তাভাবনা করেই আমি খেলেছি। ঈশ্বরের কৃপায় আমার মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভা আছে অফ সাইডে খেলার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেটি আমাকে সাহায্য করেছে, কেননা এই অফ সাইডের চ্যানেলেই বোলাররা বল করতে পছন্দ করে এবং ব্যাটসম্যানকে আউট করতে চায়। সব খেলোয়াড়ই তো ভিন্ন, কিন্তু প্রত্যেকের উচিত রান বের করার নিজস্ব উপায় খুঁজে বের করা। আমি আমার নিজের রাস্তাটা বের করেছি।
আপনি ভারতকে নেতৃত্বদানের কিছু ঝক্কির কথা বলেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন অংশ কোনটি ছিল?
ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হলো টাইম ম্যানেজমেন্ট। আপনাকে মোটা চামড়ার হতে হবে। আপনার চারপাশে কী ঘটছে না-ঘটছে সেসব নিয়ে আপনাকে মাথা ঘামালে চলবে না। রোজ সকালে আপনাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে কিংবা রাতে ঘুমাতে যেতে হবে কেবল একটি চিন্তাকেই সঙ্গী করে, “আজকে আমি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সেরা হবে এমন কিছু করব বা করেছি।” আপনার কাজ নিয়ে হরেক রকমের মন্তব্য থাকবে। হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখছে, অনেকে তো এই খেলাকেই পুঁজি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। তাই সমালোচনা থাকবেই। আপনি যদি সব সমালোচনাকেই কানে তুলতে চান, তাহলে আপনাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে। আপনাকে তাই শিখতে হবে, কীভাবে নিজেকে এসব থেকে সরিয়ে এনে খেলার জন্য ভালো হয় এমন কিছুতে মনোনিবেশ করা যায়।
রাহুল দ্রাবিড় বলেছেন, ফ্যান ও মিডিয়ার প্রতিক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্গতি থাকে না। আপনি কি এ ব্যাপারে একমত?
এসব বিষয় সামলানোর নিজস্ব পদ্ধতি ছিল আমার। জ্যামকে [দ্রাবিড়ের ডাকনাম] এ কথা আমি আগে বলেওছি। গণমাধ্যম বা জনগণ কীভাবে রিয়্যাক্ট করল, তা নিয়ে আপনার ভাবলে চলবে না। তারা যেভাবে খুশি রিয়্যাক্ট করতে পারে। তারা কী বলল সেটির প্রতি আপনি অধিনায়ক হিসেবে কেমন রিয়্যাক্ট করলেন, তা-ই হলো গুরুত্বপূর্ণ। এই সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে জানতে হবে আপনাকে।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া যাক: আমি বছরের পর বছর ধরে আপনার সমালোচনা করেছি, আমার লেখায় এবং টেলিভিশনে। আমাকে অনেকেই গাঙ্গুলীবিরোধী হিসেবে দেখে। তারপরও আপনি আমার সঙ্গে বসে কথা বলছেন কেন?
না, না, না। আমি কখনো এভাবে ভাবিনি। আমি কখনোই সমালোচনা নিয়ে চিন্তিত নউ। আমি যদি ভালো না খেলি, আমি তো আশা করতে পারি না যে আপনি লিখবেন আমি ভালো খেলেছি। একমাত্র দেখার বিষয় হলো, সমালোচনা যেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে না যায়। আনন্দ, আমি একজন খুবই ফ্রি পারসন। আমি এসব ব্যাপার নিয়ে কষ্ট পাই না, মনে রাগ পুষে রাখি না। অধিনায়ক থাকাকালীন আমি মাঠে এমনকি আমার সতীর্থ খেলোয়াড়দের উপরও রেগে যেতাম অনেক সময়, কিন্তু পরে মাঠের বাইরে আমি নিজের তাদের ঢাল হয়ে দাঁড়াতাম। সমালোচনা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। মাঝে মাঝে এগুলো বরং আমাকে সাহায্যই করে।
এত বিপুল প্রতিভা ও সংস্থান সত্ত্বেও ভারত বিশ্ব ক্রিকেটের একটি পরাশক্তি হয়ে উঠতে পারছে না কেন?
আমার তো মনে হয় আমরা আগের চেয়ে অনেক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছি। দেশের মাটিতে আমরা সব সময়ই ভালো খেলেছি। কিন্তু গত পাঁচ-সাত বছরে আমাদের বিদেশের পারফরম্যান্সেও পরিবর্তন এসেছে। সম্ভবত আপনাদের ওয়েবসাইটেই আমি পড়ছিলাম, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত বিদেশে গিয়ে অস্ট্রেলিয়া বাদে অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে। এটি তো বেশ ভালো লক্ষণ। কিন্তু আমাদের আরো কিছু মানসম্মত খেলোয়াড় প্রয়োজন। ৩৪-৩৫ বছর বয়সী আমাদের কিছু খেলোয়াড় ছিল- টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়, আমি, লক্ষ্মণ, অনিল, যারা ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য অসাধারণ ছিল। এখন আমাদের আরো কিছু ধারাবাহিক প্রতিভার আগমন প্রয়োজন। সত্যি বলতে কী, আমি যুবরাজ বা শেহবাগ বাদে ব্যাটিংয়ে আহামরি কাউকে দেখিনি। এবং বোলিংয়ে হরভজন, (এস) শ্রীশান্থ ও আরপি (সিং)। জহির দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, তাই তাকে আমি এ তালিকায় রাখছি না। আমাদের আরো কিছু কোয়ালিটি প্লেয়ার দরকার, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে।
আপনি যদি ভারতীয় ক্রিকেটের কোনো একটি দিক পরিবর্তন করতে পারতেন, সেটি কী হতো?
আমি চেষ্টা করতাম খেলোয়াড়দের উপর থেকে যথাসম্ভব চাপ সরিয়ে নেওয়ার। তাদেরকে নিজেদের মতো করে, স্বাধীনভাবে খেলতে দিন না!