১৯৭৩ সালের নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রথম আসরের শিরোপা হাতে ওঠে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক রিচেল হিহো ফ্লিন্টের। প্রথম নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ মাঠে গড়াতে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ছয় হাঁকান এবং তার নেতৃত্বে কখনও ম্যাচ হারেনি ইংল্যান্ড। ২৩টি ওডিআইতে ৫৮.৪৫ ব্যাটিং গড়ে ৬৪৩ রান করেন তিনি। এছাড়া ২২ টেস্টে তিনটি শতকের সাহায্যে ১,৫৯৪ রান করেন ফ্লিন্ট। নারী ক্রিকেটের সফলতার অগ্রদূত ফ্লিন্টের সম্মানার্থে আইসিসি বর্ষসেরা নারী ক্রিকেটারের পুরষ্কার তার নামানুসারে দেওয়া হয়। উদ্বোধনী পুরষ্কারটি জেতেন অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার এলিস পেরি।
নিউজিল্যান্ডের এমি স্যাটার্থওয়েট ও ভারতের হারমানপ্রিত কৌরকে টপকে পেরি বর্ষসেরা ক্রিকেটারের এ পুরষ্কার জেতেন। এই অলরাউন্ডার পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত সময়ে ১৯টি ওডিআইতে ৯০৫ রান করার পাশাপাশি মিডিয়াম পেস বল করে ২২ উইকেট শিকার করেছেন। এছাড়াও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দিবারাত্রির একমাত্র অ্যাশেজ টেস্ট ম্যাচে ৩৭৪ বলে ২৭টি চার এবং একটি ছয়ের মারে ২১৩* রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি তিন উইকেট শিকার করেন। যার দরুন তিনি অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। নারী টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এলিস পেরির ২১৩* রানের ইনিংসটি তৃতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। প্রায় ১৩ বছর পর কোনো নারী ক্রিকেটার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিশতক হাঁকালেন তিনি।
১
১৯৯০ সালের ৩ নভেম্বর। সিডনির শহরতলী ওয়াহরঙ্গায় মার্ক এবং ক্যাথির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এলিস আলেকজান্দ্রা পেরি। পেরির শৈশবকাল কেটেছিল সিডনি থেকে ট্রেনের মাধ্যমে ৩০ মিনিটের দূরত্বের পিম্বলে। ক্রীড়া অনুরাগীদের জন্য আদর্শ জায়গা পিম্বল। এখানে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট স্কুল আছে। খেলার মাঠ, টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল- সবকিছুর দেখা মিলবে পিম্বলে। এলিস পেরি পিম্বল প্রাইভেট স্কুলে পড়াকালে সেখানকার খেলাধুলা, অ্যাথলেটিক্স দল, ক্রিকেট দল এবং পলিটিক্যাল কার্টুনের অধিনায়ক ছিলেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নারী ক্রিকেটার হিসেবে অস্ট্রেলিয়া দলে অভিষেক ঘটে এলিস পেরির। তার রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে তখনও অভিষেক ঘটেনি। এর তিন মাস আগেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। অভিষেক ওডিআইতে ব্যাট হাতে নয় নাম্বারে নেমে ১৯ রান করার পাশাপাশি দুই উইকেট শিকার করেন তিনি।
২
২০০৭-০৮ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে নারী জাতীয় ক্রিকেট লীগে অভিষেক ঘটে এলিস পেরির। মৌসুমে নিজের প্রথম ম্যাচে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৯ রান খরচায় দুই উইকেট শিকার করেন পেরি। তার প্রথম উইকেটটি ছিলো সেসময়কার নারী ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ক্যারেন রল্টনের। এলিস পেরির খেলা প্রথম মৌসুমেই তার দল নিউ সাউথ ওয়েলস চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি ৭টি ম্যাচ খেলে ১৩.২০ ব্যাটিং গড়ে ৬৬ রানের পাশাপাশি ৯ উইকেট শিকার করেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ব্যাটে-বলে দলের জয়ে সহায়তা করার দরুন খুব শীঘ্রই টেস্ট দলে ডাক পান এলিস পেরি। ২০০৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট ম্যাচ খেলেন তিনি। অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংসে মোট ২৭ রান এবং তিন উইকেট শিকার করেন।
২০০৮-১৭ সাল পর্যন্ত সাতটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন পেরি, যার সবকটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম চার টেস্টে আশানুরূপ পারফরমেন্স করতে না পারলেও শেষ তিন টেস্টে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছেন। ২০১৪ সালের পার্থ টেস্টে ১০২ রান করার পাশাপাশি ৮ উইকেট শিকার করেন। ২০১৫ সালে ক্যান্টারবেরি টেস্টে ৯ উইকেট শিকার করেন এবং সর্বশেষ সিডনি টেস্টে ২১৩* রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন। নারী ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার সাতটি টেস্টে ৬১.৭১ ব্যাটিং গড়ে ৪৩২ রান এবং ১৭.৩৩ বোলিং গড়ে ৩০ উইকেট শিকার করেন।
৩
২০১০ সালে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসরের ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয় প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা অস্ট্রেলিয়া। প্রথমে ব্যাট করে আট উইকেটে ১০৬ রান সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। সেসময় এলিস পেরি বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। তার ব্যাটিং পজিশন ছিলো লোয়ার অর্ডারে। আট উইকেটের পতন ঘটলেও পেরি ব্যাটিং করার সুযোগ পাননি। তবে বল হাতে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতান তিনি।
জয়ের জন্য শেষ বলে নিউজিল্যান্ডের দরকার পাঁচ রান। সুপার ওভারের জন্য চার রান। ব্যাটিং প্রান্তে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক শোফি ডিভাইন।
এলিস পেরির করা শেষ বলে সোজা ব্যাট চালান ডিভাইন। ক্যামেরাম্যান বল খুঁজছিলেন বাউন্ডারিতে। কিন্তু পেরি অসাধারণ দক্ষতার সাথে তার ডান পায়ের সাহায্যে বল রুখে দিলে অস্ট্রেলিয়া তিন রানের জয় পায়। এলিস পেরি চার ওভারে ১৮ রান খরচায় তিন উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরষ্কার জেতেন। অস্ট্রেলিয়া নারী ক্রিকেট দল ২০১২ এবং ২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপাও ঘরে তোলে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেটে জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। এতে করে হ্যাটট্রিক শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া। ফাইনালে এলিস পেরি বল হাতে ১৩ রানে দুই উইকেট শিকারের পর ৩১* রানের ইনিংস খেলেন। ২০১৩ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া। এলিস পেরি চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গোড়ালির ইনজুরি নিয়ে খেলেন এলিস পেরি।
নয় নাম্বারে ব্যাট করতে নেমে ২২ বলে অপরাজিত ২৫* রান এবং বল হাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টপ অর্ডারের প্রথম তিন উইকেট তুলে নেন মাত্র ১৯ রান খরচায়। ২০১৫ সালের অ্যাশেজে তার দুর্দান্ত নৈপুণ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজ জেতে অস্ট্রেলিয়া। বোলিং এবং ব্যাটিং দুই বিভাগেই দুই দলের সেরা পারফর্মার ছিলেন পেরি। সাত ম্যাচে ২৬৪ রান এবং ১৬ উইকেট শিকার করে সিরিজ সেরার পুরষ্কার জিতেছিলেন তিনি।
৪
ক্যারিয়ারের শুরুতে এলিস পেরি মূলত বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। তার ব্যাটিং পজিশন ছিলো শেষের দিকে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৭, ৮, ৯ এবং ১০ নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করতেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয় ব্যাটসম্যান এলিস পেরির ভেলকি। ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত ২৩টি ওডিআইতে ১৭টি অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৭টি অর্ধশতক হাঁকাতে সবচেয়ে কম ইনিংস খেলেছেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের সুবাদে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ‘উইজডেনস লিডিং ওমেন ক্রিকেটারের’ পুরষ্কার জেতেন পেরি।
পেরি এখন পর্যন্ত ৯৪টি ওডিআইতে ৫০.২৭ ব্যাটিং গড়ে ২,৪১৩ রান করেছেন এবং ১২৬ উইকেট শিকার করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতে লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করলেও বর্তমানে টপ অর্ডারে ব্যাট করেন পেরি। তিন নাম্বার ব্যাটিং পজিশনে আট ইনিংসে ৫২.১২ ব্যাটিং গড়ে ৪১৭ রান করেন। চারে ২৩ ইনিংসে ৮২.৭৮ ব্যাটিং গড়ে ১,১৫৯ রান এবং পাঁচে ছয় ইনিংস ব্যাট করে ১৭০.৫০ ব্যাটিং গড়ে করেছেন ৩৪১ রান। তিনি বর্তমানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন উইমেনস বিগ ব্যাশ সিডনি সিক্সার্সের হয়ে। আসরের প্রথম ম্যাচেই মেলবোর্ন স্টার্সের বিপক্ষে ৪৯ বলে অপরাজিত ৯১* রানের ইনিংস খেলেছেন। এখন পর্যন্ত পাঁচ ম্যাচে ৭৪.৬৬ ব্যাটিং গড়ে আসরের সর্বোচ্চ ২২৪ রান করেছেন।
৫
এলিস পেরি ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলেও সমান দক্ষ। ফুটবলে ডিফেন্ডার হিসাবে খেলেন তিনি। ২০০৭ সালের ৪ আগস্ট মাত্র ১৬ বছর ৯ মাস বয়সে হংকংয়ের বিপক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলেন পেরি। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই গোল করেন তিনি। আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারে তিনটি গোল করেছেন তিনি। হংকংয়ের পর ২০০৮ সালের ৩১ মে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে এবং ২০১১ সালের ৯ জুলাই সুইডেনের বিপক্ষে গোল করেন তিনি। এলিস পেরি প্রথম অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ এবং ফুটবল বিশ্বকাপ খেলেন। ফুটবল এবং ক্রিকেট দুটো খেলাতেই সমান পারদর্শী হওয়ার কারণে বেশ কয়েকবার মধুর সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো পেরিকে। ২০১০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং এএফসি উইমেনস এশিয়া কাপ একই সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। দুই দলের মূল একাদশে পেরির সুযোগ পাওয়া নিশ্চিত ছিল। শেষপর্যন্ত তিনি ক্রিকেটকেই বেছে নেন।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি আবারও এমনই এক সমস্যায় পড়েন পেরি। ফুটবলে উইমেন লীগের সেমিফাইনাল তার দল সিডনি ফুটবল খেলা এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের টি-টোয়েন্টির ফাইনাল খেলার সময়সূচী একই দিনে পড়ে। এবার তিনি ফুটবলকে বেছে নেন। বর্তমানে এলিস পেরি ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটে বেশি মনোযোগী, যেটা তার সাম্প্রতিক ব্যাটিং পারফরমেন্স দেখেই বোঝা যায়। যেসব মেয়ের খেলাধুলা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের বড় আইডল এখন এলিস পেরি।
ফিচার ইমেজ- Redbull.com