১
প্রথম পর্বে আলোচনা করা হয়েছিল একজন খেলোয়াড় নিজে পারফর্ম না করেও আড়ালে থেকে কীভাবে অন্য সবাইকে দিয়ে পারফর্ম করিয়ে দলকে সফলতা এনে দেন এবং নিজেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা জিতে নেন। আজকের আলোচনাটি হবে দুই ধাপে।
প্রথম ধাপে আলোচনা করা হবে বিখ্যাত খেলোয়াড়রা নিজে পারফর্ম করে কীভাবে দলকে সফলতা এনে দিয়েছিলেন এবং নিজেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটি জিতে নিয়েছিলেন তা নিয়ে। ১৯৭০ এর পেলে, ১৯৮২ এর পাওলো রসি কিংবা ১৯৮৬ সালের ম্যারাডোনা এই ঘরানার উদাহরণ। আজ আলোচনা করা হবে ১৯৮৬ সালের ম্যারাডোনাকে নিয়ে।
২
১৯৩০ সাল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত বিশ্বকাপ হয়েছে ২০টি। এই ২০টি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন ২০ জন। ধারণা করা হয়, এই ২০ পারফর্মেন্সের মাঝে তুলনা করলে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাবে ১৯৮৬ সালের ম্যারাডোনার পারফর্মেন্সই। কী করেছিলেন তিনি, সেটাই এক ঝলক দেখা যাক।
এর আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন ইতালি থাকার পরেও আর্জেন্টিনার জন্য সেবারের গ্রুপটা খুব বেশি কঠিন ছিল না, অন্তত পরের পর্বে যাওয়ার জন্য। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ৩-১ গোলে জেতা ম্যাচে ম্যারাডোনা কোনো গোল পাননি, তবে অ্যাসিস্ট তিনটিই তার। দ্বিতীয় ম্যাচ ইতালির বিপক্ষে, ৬ মিনিটেই ইতালি গোল দেওয়ায় আর্জেন্টিনা পিছিয়ে পড়ে। তবে ৩৪তম মিনিটে গোল করে ম্যারাডোনাই দলকে ড্র করাতে সাহায্য করেন। ৩য় ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জেতা ম্যাচে ১টি অ্যাসিস্ট করেন তিনি।
দ্বিতীয় পর্বে উরুগুয়ের মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। ১-০ গোলে জেতা এই ম্যাচটি টুর্নামেন্টের একমাত্র ম্যাচ যেখানে ম্যারাডোনার কোনো গোল কিংবা অ্যাসিস্ট নেই। তবে ম্যাচে ম্যারাডোনার একটি ফ্রি-কিক ক্রসবারে লেগে ফেরত আসে আর আরেকটি গোল ভুলবশত বাতিল করে দেওয়া হয়। কোয়ার্টার আর সেমি দুটোই ছিল ম্যারাডোনাময়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনা ছিলেন অবিশ্বাস্য। বেলজিয়ামের বিপক্ষেও ২টি গোল করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ফাইনালে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচে উইনিং গোলে অ্যাসিস্ট করেন ম্যারাডোনা।
এখন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আর্জেন্টিনার সেবারের ১৪টি গোলের মাঝে ১০টি গোলেই ম্যারাডোনার প্রত্যক্ষ অবদান ছিল এবং প্রতিটি ম্যাচেই তিনি উজ্বল ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, টুর্নামেন্টে আর্জেন্টিনার জন্য কঠিন ম্যাচের র্যাঙ্কিং করতে বললে প্রথমে গ্রুপে ইতালি, কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড আর ফাইনালে জার্মানির কথাই উঠে আসবে। ইতালির বিপক্ষে গোল করে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচান ম্যারাডোনা আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার দেওয়া ২ গোলেই ২-১ এ ম্যাচটি জিতে নেয় আর্জেন্টিনা।
সত্যি বলতে কী, সেই বিশ্বকাপে আসলে সেরার তালিকায় ম্যারাডোনার কোনো প্রতিযোগীই ছিলেন না।
৩
এখন গত পর্বের জিদান আর এই পর্বের ম্যারাডোনার মাঝে তুলনা করলে কে বেশি এগিয়ে থাকবেন? পরিস্থিতি বলে, জিদান বাদে ফ্রান্স কোয়ার্টার ফাইনালই পার করতে পারতো না, আবার ম্যারাডোনার পারফর্মেন্সও এমন ছিল যে, তাকে ছাড়াও আর্জেন্টিনা খুব বেশি দূরে যেতে পারতো বলে মনে হয় না।
তবুও ‘একজন ভাঙ্গা দলকে টেনে অনেক দূর নিয়ে গেছে আর আরেকজন মোটামুটি ভালো দলকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছে’ এমন দুটি পারফর্মেন্স যদি একই টুর্নামেন্টে ঘটে, তাহলে কে পাবে সেরার পুরস্কার? সেটা দেখার জন্য আমাদেরকে যেতে হবে দ্বিতীয় ধাপে।
৪
এমন যদি হয় যে, একই টুর্নামেন্টে একজন খুব ভালো দলের হয়ে ভালো খেলে প্রায় প্রতিটা ম্যাচে অবদান রেখে দলকে চ্যাম্পিয়ন করালো আর আরেকজন ডুবতে থাকা দলকে নিয়ে রানার্স আপ হলো, তাহলে কার পারফর্মেন্স এগিয়ে থাকবে? এই বিষয়ের সবচেয়ে জুতসই উদাহরণ হচ্ছে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপের সেরার লড়াইয়ে অন্যতম উল্লেখযোগ্য সবচেয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছিল ১৯৯৪ বিশ্বকাপে। গোল্ডেন বল পেয়েছিলেন রোমারিও, সিলভার ব্যাজিও আর ব্রোঞ্জ স্টইচকভ।
রোমারিও গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচের তিনটিতেই গোল করেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে অ্যাসিস্ট করেন। কোয়ার্টারে ৩-২ গোলে জেতা ম্যাচে ১টি গোল করেন। সেমিতে ১-০ গোলে জেতা ম্যাচে গোল করেন। গোলশূন্য ফাইনাল ম্যাচে টাইব্রেকারে গোল করেন তিনি।
অন্যদিকে ব্যাজিও এবং ইতালির ১৯৯৪ বিশ্বকাপের পারফর্মেন্সটা একটু লক্ষ্য করুন।
- গ্রুপ পর্ব: আয়ারল্যান্ডের সাথে ১-০ গোলে হার দিয়ে শুরু। নরওয়েকে ১-০ গোলে হারানো ম্যাচে কোনো গোল পাননি। এরপর মেক্সিকোর সাথে ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচেও কোনো গোল পাননি। মাত্র ৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে উঠে ইতালি।
- দ্বিতীয় পর্ব: নাইজেরিয়ার সাথে ২৫ মিনিটে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়ে ইতালি। ৮৮ মিনিটে ব্যাজিওর করা গোলে সমতা ফিরে পাওয়ার পর ১০২ মিনিটে জয় সূচক গোলটাও তার পা থেকেই আসে।
- কোয়ার্টার ফাইনাল: স্পেনের সাথে ১-১ গোল থাকা অবস্থায় ৮৮ মিনিটে গোল করে ব্যাজিও ম্যাচটাকে জিতিয়ে দেন।
- সেমি ফাইনাল: বুলগেরিয়ার সাথে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে দুটি গোলই ব্যাজিও করেন।
- ফাইনাল: ফাইনালে ব্রাজিলের সাথে টাইব্রেকারে হেরে যায় ইতালি।
ফাইনাল ইতালি জিতলে সম্ভবত সেরার পুরস্কার ব্যাজিওই হয়তো পেতেন। দলীয় ব্যর্থতার সাথে সাথে নিজেও পেনাল্টি মিস করে ব্যর্থতার ষোলো কলা পূর্ণ করেন তিনি।
আর রোমারিও-ব্যাজিও যদি এরকম খেলতে না পারতেন তাহলে সেরা হয়েও যেতে পারতেন স্টইচকভ। তার পারফর্মেন্সটা একটু লক্ষ্য করুন।
তবে পারফর্মেন্স জানার আগে বুলগেরিয়ার বিশ্বকাপ ইতিহাসটিও একটু জানা প্রয়োজন। ১৯৩০-৫৮ সাল পর্যন্ত তারা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। ১৯৬২-৭৪ পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে বাদ পড়ে তারা। ১৯৭৮ আর ১৯৮২ সালে আবার কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়। ‘৮৬-তে কোয়ালিফাই করে দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত যায়। ‘৯০-তে আবারও কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়।
সেই বুলগেরিয়াকে নিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে খুব বেশি আশা কারো থাকার কথা ছিল না। তার উপর তারা পড়েছিল সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার গ্রুপে। প্রথম ম্যাচে সুপার ঈগল নাইজেরিয়ার কাছে ২-০ গোলে হেরে যাওয়ার পর গ্রুপ পর্বই তাদের সীমানা মনে হচ্ছিল। কিন্তু গ্রীসকে ৪-০ গোলে হারিয়ে আশাটা বাঁচিয়ে রাখে তারা। ম্যাচে ২টি গোল করেন স্টইচকভ। শেষ ম্যাচে ম্যারাডোনাকে হারিয়ে মনোবল ভাঙ্গা আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারায় বুলগেরিয়া। এই ম্যাচেও স্টইচকভ ১ গোল করেন।
দ্বিতীয় পর্বে মেক্সিকোকে হারায় তারা টাইব্রেকারে। নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে ড্র হওয়া সেই ম্যাচেও দলের পক্ষে ১টি গোল করেন স্টইচকভ। কোয়ার্টারে তারা মুখোমুখি হয় আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির। ম্যাচের প্রথম গোলটি করেন জার্মানির ম্যাথিউস। কিন্তু সবাইকে অবাক করে ৭৫ আর ৭৮ মিনিটে ২ গোল করে জিতে যায় বুলগেরিয়া। প্রথম গোলটি করেন স্টইচকভ। সেমিতেও স্টইচকভ ১টি গোল করেন, তবে ব্যাজিও ম্যাজিকের কাছে হেরে যান।
‘৯৮ বিশ্বকাপেও স্টইচকভ খেলেন এবং দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যান। তবে এবার গ্রুপ থেকেই বিদায় নেয় বুলগেরিয়া। স্টইচকভ যাবার পর এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে আর কোয়ালিফাই করতে পারেনি বুলগেরিয়া। কোন দলকে কোন পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন তিনি, একবার ভাবুন তাহলে। তবে তার চেয়েও ভালো পারফর্মার থাকায় অনেক তার নাম সেভাবে জানে না।
মজার বিষয় হলো, সেই বিশ্বকাপের অল স্টার দলে ৭ ম্যাচে ৫ গোল করা ব্যাজিও, ৭ ম্যাচে ৫ গোল করা রোমারিও আর ৭ ম্যাচে ৬ গোল করা স্টইচকভ- তিনজনেই সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র ৩ ম্যাচে ৬ গোল করা রাশিয়ার সালেঙ্কো সুযোগ পাননি সেখানে। কারণ তার এই পারফর্মেন্সের পরেও যে রাশিয়া গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল!
৫
আগের পর্বের আর আজকের বিশ্লেষণ থেকে সেরা নির্বাচনের একটি সূত্র বের করার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেরা নির্বাচনে যে বিষয়গুলো দেখা হয়, তার মাঝে কয়েকটি পয়েন্ট আজকে উল্লেখ করা হচ্ছে:
- প্রথমে চেষ্টা করা হয় চ্যম্পিয়ন দল থেকে কাউকে সেরার জন্য নির্বাচিত করা যায় কিনা।
- যদি চ্যাম্পিয়ন দলের স্ট্র্যাটেজি ইতালি কিংবা জার্মানির মতো দলগত হয় আর দলে যদি সেরকম একক পারফর্ম করা কেউ না থাকে, তাহলে চেষ্টা করা হয় এমন কাউকে দিতে যে কিনা দল চূড়ান্ত সফলতা না পেলেও এমন সফলতা পেয়েছে যা কিনা মানুষ স্বাভবিকভাবে আশা করেনি।
- টুর্নামেন্টের সেরার ক্ষেত্রে খেলোয়াড়টিকে অন্তত সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছুতেই হবে।
- শিরোপা না জিতেও সেরা হওয়া যাবে যদি শিরোপা জেতা দলে সেরকম কোনো একক পারফর্মার না থাকে অথবা নিজের পারফর্মেন্সটা এমন থাকে যা কিনা বিশ্বাস যোগায় যে, তিনি শুধুমাত্র দলের ব্যর্থতার জন্যই চূড়ান্ত সফলতা পাননি।
বি.দ্র: পরের পর্বে এই সূত্র অনুযায়ী ক্লাবের কিছু পারফর্মেন্স বিশ্লেষণ করা হবে এবং এই সংক্রান্ত আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে। আমাদের আলোচনা নিয়ে আপনাদের মতামত কিংবা প্রশ্ন জানাবেন কমেন্টে।