গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে পুরো বিশ্বই একটা উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রুশ গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে কেবল ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের ভাষ্য তথা পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ সম্প্রতি সার্বিয়ার গণমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ববর্তী বিভিন্ন ঘটনার আলোকপাত করেছেন যা যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম সাধারণত নীরবতা পালন করে থাকে। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি বাংলায় তুলে ধরা হলো।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট, অবরোধ আরোপ, এবং রাশিয়ার পাল্টা পদক্ষেপগুলো নিয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সাথে আমরা আলোচনা করছি। একটা ঐতিহাসিক কঠিন সময়ের মধ্যে আপনার ব্যস্ত কর্মসূচির মাঝেও আমাদের প্রজাতন্ত্রের টেলিভিশন ও রেডিও কোম্পানিকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বের করে নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ল্যাভরভ: আমি মনে করি এরকম সময়গুলোতে প্রকৃতপক্ষে কী হচ্ছে তা নিয়ে আরো বেশি বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিৎ এবং তা প্রচার করা উচিৎ; বিশেষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে যখন মিথ্যার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা যে আমাদের দর্শকরা মুদ্রার উল্টো পিঠের ঘটনাগুলো জানতে পারছেন না, তাদের মাঝে ইউরোপের দর্শকরাও আছেন। তারপরও এটা একটা সুযোগ করে দিয়েছে তাদের জানানোর। আমরা রুশ-ইউক্রেনীয় সংকট দিয়েই শুরু করি। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এই ঘটনা বিশ্বের শীর্ষ খবর। কিন্তু কোন ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে এটা এতদূর গড়ালো, তা নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে। রাশিয়া কেন ঠিক ওই মুহূর্তে বিশেষ সামরিক অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো?
ল্যাভরভ: আপনি প্রশ্নের শুরুতে যেটা বললেন, ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্বের মুদ্রা উল্টো পিঠের ঘটনাও জানাটা গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিয়া (যেখানে শীঘ্রিই সফর করব) অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে তাদের সেরাটা দিচ্ছে। তারা ইউরোপের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা সংস্থা ওএসসিই এর প্রতি তাদের অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়ন করছে, যার মাঝে ওএসসিই অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সকল নাগরিকের তথ্য অধিকারের নিশ্চয়তাও রক্ষা করছে কোনোপ্রকার ব্যতিক্রম ছাড়া। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অঙ্গীকারগুলো পূরণ করছে না। আমি আপনাকে যা বলতে যাচ্ছি তা পশ্চিমা দেশসমূহ, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গণমাধ্যমে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তারা রুশ গণমাধ্যমের ওপর ক্রমাগত অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। রুশ টিভি চ্যানেল আর সংবাদ সংস্থাগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
আপনি বললেন, ২৪ ফেব্রুয়ারির আগে কী ঘটছিল তা নিয়ে খুব কম লোকই জানে। এই সমস্যা আমরা মাত্র যা আলাপ করলাম তার কারণেই হচ্ছে। এতগুলো বছর ধরে পরিস্থিতি যখন খুবই উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, পশ্চিমা বিশ্ব এটা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। অন্যদিকে উত্তেজনা তখন ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
সবচেয়ে নিকটবর্তী সময়ের কথাও যদি বলি, সবকিছুর সূত্রপাত হয় অন্ততপক্ষে ২০১৪ সালে। ফ্রান্স, জার্মানি এবং পোল্যান্ড, ইউক্রেনের তখনকার প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকভিচের সাথে চুক্তিতে এসে নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন সকালেই ইয়ানুকভিচের বিরোধীপক্ষ নব্য নাৎসি বাহিনী আর চরমপন্থীরা কিয়েভের ক্ষমতা দখল করে। জার্মানি, ফ্রান্স, এবং পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের অথর্বতা প্রদর্শন করল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিশ্রুত চুক্তিকে সম্মান দেখানোর জন্য যেখানে তাদের উচিৎ ছিল বিরোধী পক্ষকে চাপ দেওয়া, সেখানে তাদের অক্ষমতাকে পরবর্তীতে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য তারা দাবি করে, এটা ছিল ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ’। তৎক্ষণাৎ পরিষ্কার হয়ে যায় এটা কতটা ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়া ছিল। অভ্যুত্থানের পরদিন উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করা এই লোকেরা (যাদের মাঝে পশ্চিমা দেশগুলো কর্তৃক উগ্রবাদী সংগঠন হিসাবে কালো তালিকাভুক্ত সংগঠনও ছিল) ঘোষণা দেয়, তারা রুশভাষীদের তাদের ভাষা ব্যবহারের অধিকার কেড়ে নেবে এবং ক্রাইমিয়া থেকে রুশদের বের করে দেবে। তারা অস্ত্রধারীদের ক্রাইমিয়াতে পাঠায় সুপ্রিম কাউন্সিলে (স্থানীয় সংসদ) তাণ্ডবলীলা চালানোর জন্য। তখন থেকেই সব শুরু।
পশ্চিমা বিশ্ব এটা নিয়ে নীরব ছিল। বর্তমান পরিস্থিতির পেছনের ঘটনাগুলো কীভাবে গড়ে উঠছিল তা নিয়ে সাধারণ পাঠক, দর্শক বা শ্রোতারা অবগত ছিলেন না। এটা ২০১৪ সালের ২ মে পর্যন্ত চলতে থাকে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা নব্য নাৎসিরা এই দিন ওডেসায় ৫০ জন মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। ২০১৪ সালের ২ জুন, ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী তাদের যুদ্ধবিমান থেকে লুহানস্কের কেন্দ্রে এবং পূর্ব ইউক্রেনের অন্যান্য জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বোমা ফেলতে থাকে, গতকাল যার আরেকটি বর্ষপূর্তি গেল। এই অঞ্চলের নাগরিকদের একমাত্র অপরাধ ছিল, তারা সংবিধান বিরোধী অভ্যুত্থান গ্রহণ করতে চায়নি, এবং পুরোপুরি রুশবিদ্বেষী চরমপন্থী নব্য নাৎসিদের শাসন মেনে নিতে চায়নি, যারা তৃতীয় রাইখের ঐতিহ্যগুলো পুনর্জীবিত করছিল, ও হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দালালদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল।
সবাই এসব ঘটনা সম্পর্কে অবগত; অন্তত ইউক্রেন, রাশিয়া, ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ক্ষেত্রে এটা বলা যায়। পশ্চিমা বিশ্ব এই বাস্তবতা উপেক্ষা করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৫ সালে যখন ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইউক্রেনের অংশগ্রহণে মিনস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, তখন একটা সুযোগ ছিল ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা অক্ষুণ্ণ রাখার। তারা যদি চুক্তিটা বাস্তবায়ন করত, দনবাসকে প্রতিরক্ষার প্রয়োজনই পড়ত না।
মিনস্ক চুক্তিতে শর্ত আরোপ করা হয়েছিল যে, দনবাস অঞ্চলের একটা বিশেষ মর্যাদা থাকা প্রয়োজন। এতে সাধারণ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। প্রথমত, স্থানীয় রুশ ভাষায় কথা বলার অধিকার থাকতে হবে; দ্বিতীয়ত, আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা স্থানীয় পুলিশ বাহিনী থাকবে; তৃতীয়ত, কখন আইনজীবী ও বিচারপতিদের নিয়োগ দেওয়া হবে, তা জানাতে হবে এবং রুশ ফেডারেশনের সাথে বিশেষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখতে হবে।
কসোভোর ঘটনাগুলো মনে করুন। ২০১৩ সালে, এমনকি ইউক্রেনের সাথে মিনস্ক চুক্তি হওয়ার আগে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দেয় বেলগ্রেড (সার্বিয়ার রাজধানী) ও প্রিস্টিনাকে (কসোভোর রাজধানী) চুক্তিতে এনে আরেকটা সফলতা অর্জন করেছে। এতে কসোভোতে একটা সার্ব সম্প্রদায়ের মিউনিসিপালটি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়। চুক্তির অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো ছিল মাতৃভাষা ব্যবহারের অধিকার, স্থানীয় সরকারের স্বায়ত্তশাসন, এবং সার্বিয়ার সাথে বিশেষ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন রক্ষা করা। আসলে এটা ছিল মিনস্ক চুক্তির মতোই। উভয়ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু তারা নিজেদের অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে প্রিস্টিনা (সার্বিয়ার ক্ষেত্রে) ও কিয়েভকে (দনবাসের ক্ষেত্রে) সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয় ক্ষেত্রেই নিজেদের অপ্রতুলতা, অবাধ্যতা ও অনিচ্ছার বিষয়টি প্রমাণ করেছে।
এর চেয়েও ‘আগ্রহ জাগানিয়া’ বিষয় হচ্ছে মিনস্ক চুক্তি জাতিসংঘের সাথেও জড়িত ছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই চুক্তির অনুমোদন দেয়। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন একে দুই পয়সারও দাম দেয়নি। একই কথা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারা গোপনে কিয়েভ রেজিমকে তাদের রুশবিদ্বেষী কার্যক্রমে উৎসাহ দিয়ে আসছিল। তারা বছরের পর বছর ধরে মিনস্ক চুক্তির প্রতি গড়িমসি প্রদর্শন করে আসছিল। অন্ততপক্ষে দনবাসে (যেহেতু চুক্তিতে এই অঞ্চলের কথা উল্লেখ ছিল) রুশ ভাষা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পরিবর্তে তারা সেখানে রুশ শিক্ষাব্যবস্থা, রুশ গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিষিদ্ধ করে। উল্টো সেখানে আইনগতভাবে তারা নব্য নাৎসি মতবাদ ও চর্চা উৎসাহ দিতে থাকে। এর মাঝে নাৎসি ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠা করা এবং হিটলারের জার্মানিকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা বিভিন্ন প্রতীকের ব্যবহারও ছিল। ইউরোপ এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে ছিল।
এসব ঘটনা আমাদের ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মনে করিয়ে দেয়- শুরুর দিকে হিটলারের প্রতি ইউরোপের মনোভাব কেমন ছিল এবং কী পরিমাণ ইউরোপীয় দেশসমূহ তাদের সামরিক সদস্যদের তৃতীয় রাইখের সেনাবাহিনীতে পাঠায়, যার মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করা বাহিনীও ছিল।
এগুলোর সবকিছুই অনেকদিন ধরে ঘটে আসছিল। বছরের পর বছর ধরে আমরা কিয়েভ রেজিমকে মিনস্ক চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়ে আসছিলাম, তাদের ন্যাটোর সম্প্রসারণ নীতির ফলাফল হবে ভয়াবহ। প্রথমত, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিশ্রুতি দেয় ন্যাটোর সম্প্রসারণ করবে না। কিন্তু দেখা যায় তারা আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলে আসছিল। তখন থেকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের পাঁচটি ঢেউ দেখা যায়। বর্তমানে ষষ্ঠ ধাপের সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমরা তাদেরকে অনেক আগেই সতর্ক করি, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে টেনে নিয়ে যাওয়া রুশ ফেডারেশনের জন্য সরাসরি হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা হবে। তারা ইউরোপে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ চুক্তি বিষয়ে আমাদের খসড়া প্রত্যাখ্যান করে, যেটা আমরা ২০০৯ সালে পুনরায় প্রস্তাব করি। ২০২১ সালে তারা আমাদের আরেকটা খসড়া চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, যেটা আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো উভয় পক্ষের কাছে আলাদাভাবে উপস্থাপন করেছিলাম। আমাদের রঢ়ভাবে জানানো হয়, ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং এতে ইউক্রেনের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়ে আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই, এবং আমরা যেন এটা নিয়ে নাক না গলাই।
একইসাথে তারা ইউক্রেনে স্রোতের মতো অস্ত্র প্রবেশ করাতে থাকল (এতে কোনো সন্দেহ নেই)। সেখানে শত শত সিআইএ ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা কাজ করছিল। আমি মনে করি, ইউক্রেনে তারা দশ বছর ধরে কাজ করছে এবং ইউক্রেনীয় সংস্থাগুলোর দাপ্তরিক ভবনগুলোতে তাদের বিশাল একটা প্রভাব আছে। বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে, এই এজেন্টরাই ইউক্রেনের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের সকল যুক্তিসঙ্গত আপসের প্রস্তাবনা খারিজ করে দিতে থাকে। এতে আমাদের এখানে প্রচলিত সবচেয়ে বাজে ভয়টাই ন্যায্য হয়ে যায়, যেখানে রুশ ফেডারেশনকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ইউক্রেনকে একটা আক্রমণের পাদভূমিতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এ কারনেই দুই প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্কের একটা বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এবং তারা ইউক্রেনের অংশই থাকার কথা ছিল। ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী ও ‘ন্যাশনাল ব্যাটালিয়ন্স’ উভয় প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাতে থাকে। বিগত বছরগুলোতে তারা যখন মিনস্ক চুক্তিকে অন্তর্ঘাত করে আসছিল, তখন সেখানে ১৪,০০০ বেসামরিক নাগরিক মারা যায় তাদের কামানের গোলার আঘাতে। তারা শহরগুলোতে এবং বেসামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে আসছিল, যার মাঝে স্কুল, হাসপাতাল, এবং কিন্ডারগার্টেনও ছিল।
২৪ ফেব্রুয়ারির আগে এখানে কী ঘটছিল তা ইউরোপ উপলব্ধি করতে পারেনি। এ কারণে তাদের নিয়ে করুণা হয়। এটা শুধু একটা দিকেই নির্দেশ করে; পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে মন্তব্য করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তারা তাদের জনগণ ও ভোটারদের এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে রাখতে চেয়েছিলেন।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্র ও ‘সম্মিলিত পশ্চিমা বিশ্ব’কে ‘মিথ্যার সাম্রাজ্য’ বলে অভিহিত করেন। এই সাম্রাজ্যের অনেক আগেই উত্থান হয়। তারা গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুকে ফিল্টার করে থাকে। তারা ওএসসিই’র প্রতি মুক্ত ও অবাধ তথ্য প্রবাহের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে আসছে। পশ্চিমা বিশ্ব কয়েক যুগ আগে থেকেই সত্যকে চাপা দিয়ে আসছে।
আমাদের দর্শকরা দনবাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত। আমাদের একজন বিশেষ প্রতিনিধি সেখানে কাজ করছেন, যিনি আমাদের দর্শকদের ঘটনাস্থল থেকে প্রতিদিনই সংবাদ পরিবেশন করে আসছেন; বিশেষ করে মারিউপোলের তীব্র যুদ্ধের সময়ে এবং আজভস্টাল স্টিল কারখানার ঘটনার সময়টায়। রাশিয়াকে বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য দোষারোপ করা হয়, কিন্তু পশ্চিমারা ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করা বন্ধ করেনি। তাহলে সংঘাতটা কি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে, নাকি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অন্য কেউ লড়ছে?
ল্যাভেরভ: ইউক্রেন একটা দর কষাকষির হাতিয়ার; যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের সমন্বয়ের অ্যাংলো-স্যাক্সন জোট একে নিপুণভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনেকদিন ধরেই নিজেদের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছে; তারা এখন কেবল সেই জোটের একান্ত বাধ্যগত সংগঠনে পরিণত হয়েছে। তারা ইউক্রেনীয়দের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, রাশিয়াকে ‘যুদ্ধের ময়দানে’ পরাজিত করে আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য (অথবা, তারা যেটাকে এখন বলছে রাশিয়ার ‘শক্তি ক্ষয়’ করার জন্য)। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কূটনীতিক জোসেপ বোরেল, বরিস জনসন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদরা একটা বুলিই আওড়ে যাচ্ছেন- রাশিয়া আর পুতিনকে যুদ্ধের ময়দানে অবশ্যই পরাজিত হতে হবে।
তাদের এ ধরনের কথাবার্তার বাস্তবায়ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা তার প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এটা। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে আসতে বাধা দিচ্ছে। দুই মাস আগে, ইউক্রেন বিষয়টা নিষ্পত্তি করতে একপ্রকার চুক্তির প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছিল। আমরা এই প্রস্তাবনাকে একটা ভিত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এর একদিন পর, পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে এই চুক্তি নিয়ে আর আগাতে নিষেধ করল। তারা আরো কঠোর অবস্থান নিলো, এবং রুশ সেনারা বুচা শহর ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার তিন দিন পর তারা সেই অঞ্চলে একটা নাটক মঞ্চস্থ করল। জীবন সেখানে স্বাভাবিকভাবেই চলছিল; সেখানকার মেয়র গাড়িতে করে বুচার রাস্তায় ঘুরছিলেন। মৃতদেহগুলো সেখানে পাওয়া গেল তিন দিন পর। এখন পর্যন্ত বুচায় মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের নাম জানানো হয়নি; পশ্চিমা টেলিভিশন চ্যানেল বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। এই লোকদের মৃত্যু কীসের আঘাত থেকে হয়েছে, সেটা নিয়েও কেউ কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। এতে আবারও দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা বিশ্ব কাউকেই প্রকৃত তথ্য জানাতে আগ্রহী নয়। একটা উসকানি মঞ্চস্থ করা এবং একে ঘিরে হৈচৈ সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে যখনই কেউ প্রকৃত তথ্য বের করে আনার চেষ্টা করে, তখনই তারা একে আলোচনার বাইরে নিয়ে যায়, এবং আরেকটি মিথ্যা নিয়ে আসে।
আপনারা দেখতে পারছেন ইউক্রেনে ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এখন আমেরিকানরা তাদেরকে মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম দিচ্ছে। ব্রিটিশরাও যেন ঠিক মুহূর্তেই তাদের অনুসরণ করেছে। স্পষ্টতই তারা ওয়াশিংটন থেকে অনুমতির অপেক্ষায় ছিল এবং তাদের এমএলআরএস ইউক্রেনীয়দের কাছে সরবরাহ করছে। এটা একটা ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। তারা একইসাথে বলছে, “তারা (ইউক্রেনীয়রা) রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে; ইউক্রেনীয়রা মারা যাচ্ছে- তারা মরুক, আমরা কেবল তাদের অস্ত্র দিচ্ছি।” শেষ পর্যন্ত এতে ইউক্রেনীয়দের আরো বেশি প্রাণহানি ঘটবে।
মারিউপোল ও আজভস্টালের মতো অভিযান কার্যক্রমগুলো ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নির্দেশনা দিয়েছিলেন আজভস্টালে যেন নির্বিচারে আক্রমণ না করা হয়। কড়া অবরোধের মুখে আজভ ব্যাটালিয়নের গুণ্ডারা আত্মসমর্পণ করে। তারা এখন জবানবন্দি দিচ্ছে। আমি মনে করি, ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের দৈনন্দিন জীবনে এই নব্য নাৎসি মতবাদ ও চর্চা কীভাবে প্রয়োগ করা হয়, সেসবের ব্যাপারে তারা অনেক চমকপ্রদ তথ্য দেবে, যার মাঝে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অধীনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে।
হাঙ্গেরি রাশিয়ার জ্বালানি কেনা চলমান রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাঙ্গেরি ছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের বাকি দেশগুলো রাশিয়াকে দুর্বল করার জন্য ষষ্ঠ ধাপের অবরোধ আরোপ করেছে। ইউরোপের প্রত্যেকেই এর অর্থনৈতিক ফলাফল নিয়ে শঙ্কিত। এই অবরোধগুলোর রাশিয়ার ওপর কেমন প্রভাব ফেলছে?
ল্যাভরভ: আমরা আমাদের পশ্চিমা সহকর্মীদের কূটনৈতিক দক্ষতা ও নির্ভরযোগ্যতার ওপর ২০১৪ সালের পর থেকেই আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। তখন আমাদের ওপর ক্রাইমিয়া সম্পর্কিত অবরোধ করা হলো। ক্রাইমিয়ার জনগণদের অভিব্যক্তি প্রকাশে নিশ্চয়তা নিয়ে কাজ করার পাল্টা জবাব ছিল এটা। এটা মনে রাখা প্রয়োজন, কসোভোর ক্ষেত্রে কোনো গণভোট হয়নি, কিন্তু ক্রাইমিয়াতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। একাধিক বিদেশি পর্যবেক্ষক এসে দেখে গেছেন। যদিও তারা রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করছিলেন না, তারা ছিলেন সম্মানীত বেসামরিক নাগরিকদের অংশ। এই সৎ লোকেরা নিজেদের চোখে পুরো ঘটনা দেখতে চেয়েছিলেন। ক্রাইমিয়ার জনগণের অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা চাওয়া এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করা নব্য নাৎসি শাসকগোষ্ঠীর আনুগত্য স্বীকার না করার শাস্তি হিসাবে তাদের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়।
তখন থেকে আমরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করছি এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদারদের সাথে আমরা যোগাযোগ রেখে আসছি। আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তার কারণে কৃষিতে ভালো অবস্থানে আসতে পেরেছি। আমরা এর অনেক বছর আগে থেকেই বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করে আসছিলাম।
ইউরোপে জীবনযাত্রার মান কমছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। নতুন গরিব সম্প্রদায় এখন সেখানকার জীবনের বাস্তবতা। মানুষ বহু সমস্যায় জর্জরিত, তার মাঝে রয়েছে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি। অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার আর ইউরো খরচ করা হচ্ছে ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়ার জন্য। জার্মানি বলেছে, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির এই কঠিন সময়ে জার্মান জনগণদের সহায়তা করা তাদের মূল কাজ নয়। বরং, এর চেয়ে দেশটির সামরিক খাতে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ রাখাই গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে তারা ইউরোপের নেতৃস্থানীয় সামরিক শক্তি হতে চায়। ইউরোপের অনেক লোকই একে পুরোপুরি নিরীহ চোখে দেখছেন না।
ষষ্ঠ পর্যায়ের অবরোধটি দেওয়া হয়েছে মূলত সামুদ্রিক তেল আর পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর। তেলের ওপর রাজনীতি চলে না এবং এর একটা চাহিদা আছে। তেলের বাজার রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা কোনো প্রকার বাতিকের ওপর চলে না। আমাদের বিকল্প বাজারব্যবস্থা আছে, যা আমাদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করছি। পশ্চিমাদের নীতিনির্ধারণীর কারণে তেলের বর্তমান দাম যেখানে দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের বাজেটের আয়ে কোনো প্রভাবই ফেলছে না। বরং, এই বছর তেল ও গ্যাস রপ্তানির আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
আমরা এই সকল ঘটনা থেকে একটা শিক্ষাই পেয়েছি, তা হলো- এই লোকদের ওপর আর কখনো নির্ভর করা যাবে না। এর মানে এই নয় যে, আমরা তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবো। তারা যখন এখনকার পাগলামি বন্ধ করবে, তখন আমরা দেখব তারা আমাদের কাছে কী বলতে আসে। এখন থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত, আমাদের দেশের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র কিংবা আমাদের জনগণের জীবন, কোনো পরিস্থিতিতেই পশ্চিমা বিনিয়োগ বা প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে দেবো না।