একটি রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে রূপরেখা অনুসরণ করে, সেটাই হচ্ছে সেই রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি। সাধারণত পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে কূটনীতি। একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সাথে এটির সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে, সেই প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে কূটনীতি।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি দেশের কূটনীতিক সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিনিধি। বর্তমানে কূটনীতিকদের সুরক্ষা এবং অন্যান্য সুবিধা ১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। এটি ১৯৬৪ সালের ২৪ এপ্রিল কার্যকর হয়েছে।
এই কনভেনশনের তৃতীয় অনুচ্ছেদে দূতাবাসগুলোর ৫টি কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি রয়েছে, যেগুলো হলো:
১. স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করা;
২. আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখার মধ্যে থেকে স্বাগতিক রাষ্ট্রে নিজের রাষ্ট্র এবং নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করা;
৩. স্বাগতিক রাষ্ট্রের সরকারের সাথে আলোচনা করা;
৪. আইনের আওতার মধ্যে থেকে স্বাগতিক রাষ্ট্রের সার্বিক অবস্থা এবং উন্নয়ন পর্যালোচনা করে নিজ দেশে তা অবহিত করা;
৫. স্বাগতিক রাষ্ট্রের সাথে নিজ দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করা এবং অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে কাজ করা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য ‘মিম’ একটি অতিপরিচিত বিষয়। সাধারণভাবে, মিম (meme) বলতে এমন কোনো ছবি বা ভিডিও বোঝানো হয়, যেটির উপরে কোনোকিছু লেখা থাকে এবং এটি একটি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতিনিধিত্বকারী অর্থ বহন করে। এগুলো তৈরি করা হয় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া বা ‘ভাইরাল’ (viral) করার উদ্দেশ্যে এবং যেগুলো প্রায়শই হাস্যরসাত্মক হয়ে থাকে।
এই লেখাটিতে বেশ কিছু মিমের মাধ্যমে কূটনীতিকদের সুরক্ষা এবং অন্যান্য সুবিধার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশন–এর ২৭ নং অনুচ্ছেদে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডে কূটনীতিকদের যোগাযোগের অনুমতি এবং সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। একটি কূটনৈতিক মিশনে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্রের নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সেগুলো একধরনের বিশেষ ব্যাগে বহন করা হয়।এটি ‘ডিপ্লোমেটিক ব্যাগ’ নামে পরিচিত। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এই ধরনের ব্যাগ দৃশ্যমান বাহ্যিক চিহ্ন দ্বারা শনাক্ত করা হয় এবং এটি সব ধরনের নিরাপত্তা তল্লাশি থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে।
উক্ত কনভেনশনের ৩১ নং অনুচ্ছেদে ‘কূটনৈতিক দায়মুক্তি’ প্রদান করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩১(১) অনুযায়ী, একজন কূটনীতিক স্বাগতিক রাষ্ট্রের ফৌজদারি, দেওয়ানি এবং প্রশাসনিক এখতিয়ারের বাইরে থাকেন। অর্থাৎ, একজন কূটনীতিকের বিরুদ্ধে স্বাগতিক রাষ্ট্র কোনো ধরনের ফৌজদারি, দেওয়ানি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। স্বাগতিক রাষ্ট্রের কোনোরকম হস্তক্ষেপ ছাড়া কূটনীতিকদের তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতে মূলত এই সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
অন্যদিকে, অনুচ্ছেদ ৩১(৪) অনুযায়ী, একজন কূটনীতিক যদি স্বাগতিক রাষ্ট্রের নিকট থেকে ‘কূটনৈতিক দায়মুক্তি’ পায়, এই দায়মুক্তি তাকে নিজ দেশে জবাবদিহিতা প্রদান করতে বাধা দিবে না। অর্থাৎ, নিজ দেশ চাইলে সেই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি, দেওয়ানি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
এই কনভেনশনের ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘কূটনৈতিক দায়মুক্তি’র অধিকার পরিত্যাগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। একটি স্বাগতিক রাষ্ট্র চাইলে এই অধিকার পরিত্যাগের জন্য সেই কূটনীতিকের নিজ দেশের নিকট অনুরোধ করতে পারে। যদি এই অনুরোধ গৃহীত হয়, তাহলে স্বাগতিক রাষ্ট্র সেই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি, দেওয়ানি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। যদি একজন কূটনীতিক দায়িত্ব পালনকালে দাপ্তরিক কর্মকাণ্ডের বাইরে কোনো গুরুতর অপরাধের অভিযুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে তার নিজ দেশ দায়মুক্তির অধিকার পরিত্যাগ করে থাকে।
উক্ত কনভেনশনের নবম অনুচ্ছেদে ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ (persona non grata) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। এটি একটি ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ অবাঞ্চিত বা অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। একটি স্বাগতিক রাষ্ট্র সেখানে দায়িত্বরত একজন কূটনীতিককে তার কর্মকাণ্ডের জন্য অবাঞ্চিত ঘোষণা করতে পারে এবং এজন্য সেই স্বাগতিক রাষ্ট্র কোনো প্রকার ব্যাখ্যা প্রদান করতে বাধ্য নয়। এমন পরিস্থিতিতে সেই কূটনীতিককে নিজ দেশে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বর্তমানে বৈশ্বিক বাস্তবতায় বিভিন্ন দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপ্তি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। সেই সাথে ১৯৬১ সালে প্রণীত কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক ভিয়েনা কনভেনশনের গুরুত্বও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, অথচ কোনো মিম চোখে পড়েনি, এরকম ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একজন নারী একটি বিড়ালের দিকে নির্দেশ করে চেঁচামেচি করছেন, কিংবা খেলার মাঠে একজন টাক মাথাবিশিষ্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমর্থক দর্শক হতাশ হয়ে কোমরে দুই হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন– এই সংক্রান্ত বেশ কিছু মিম বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। কাঠখোট্টা আন্তর্জাতিক আইনে বিদ্যমান কূটনীতিকদের অধিকার, সুরক্ষা ও দায়মুক্তি আর একটু সহজভাবে প্রকাশের জন্য মিমের চেয়ে ভালো বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না।