২০২১ সালের ২১ এপ্রিল দক্ষিণ ইসরায়েলের ডিমোনা শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে একটি তীব্র বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই অঞ্চলটি জুড়ে বিকট শব্দে সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে ওঠে। না, এটি কোনো যুদ্ধের সূচনা ছিল না। বিস্ফোরণে কেউ নিহত হয়েছে বা কোনো স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এরকম খবরও পাওয়া যায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আকস্মিকভাবে কোনো শত্রুরাষ্ট্র ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালালে ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনী যতটা চমকে যেত, এই বিস্ফোরণের ফলে তার চেয়ে কম চমকায়নি। কারণ বিস্ফোরণটি হয়েছে দিমোনা শহর থেকে ১৩ কি.মি. দূরে নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত ‘শিমন পেরেজ নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার’ থেকে মাত্র ৩০ কি.মি. (২০ মাইল) দূরে। ধারণা করা হয়, এই ‘পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র’টিই ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক কর্মসূচির প্রাণকেন্দ্র!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসরায়েল ১৯৬০–এর দশকের প্রথমদিকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করে এবং বর্তমানে ইসরায়েলের ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়াড’ (nuclear triad) রয়েছে, অর্থাৎ ইসরায়েল যথাক্রমে পারমাণবিক সাবমেরিন, আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও কৌশলগত বোমারু বিমান ব্যবহার করে জল, স্থল ও আকাশ থেকে শত্রুপক্ষের ওপর পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করতে সক্ষম। কিন্তু অন্যান্য পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র যেভাবে তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা প্রচার করেছে, ইসরায়েল সেটা করেনি। তারা এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ‘ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতার নীতি’ (policy of deliberate ambiguity) অনুসরণ করে, অর্থাৎ তাদের কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, এই বিষয়টি তারা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করে না।
কিন্তু ইসরায়েলের কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত গবেষণাকেন্দ্রটি যে প্রকৃতপক্ষে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের কেন্দ্র, এই বিষয়টি বর্তমানে ‘উন্মুক্ত রহস্য’ (open secret) হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য নেগেভ পারমাণবিক কেন্দ্রকে ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, এই অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের কাছাকাছি বড় ধরনের একটি বিস্ফোরণ যে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশারদদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রাথমিক পর্যায়ে ইসরায়েলিরা ধারণা করেছিল, এই ঘটনার সঙ্গে ইরান জড়িত। ১৯৮০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ইরান ও ইসরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত। ইরানি পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে ইসরায়েল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন এবং ২০১১ সালে ইসরায়েলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়ায় ইরানি সামরিক উপস্থিতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়াকে ইসরায়েল নিজেদের জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য এখন পর্যন্ত ইসরায়েলিরা সিরিয়ায় ইরানি ও ইরান–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর শত শত আক্রমণ পরিচালনা করেছে।
এই মাসেও ইরানি–ইসরায়েলি প্রক্সি যুদ্ধ পুরোদমে চলমান রয়েছে। ৬ এপ্রিল লোহিত সাগরে ইরিত্রিয়ার উপকূলের কাছে একটি লিম্পেট মাইনের আঘাতে ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী কোর’-এর নৌবাহিনীর জাহাজ ‘এমভি সাভিজ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এই আক্রমণের জন্য ইসরায়েল দায়ী বলে ধারণা করা হয়। ১১ এপ্রিল ইরানের ‘নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে’ একটি বিস্ফোরণের ফলে কেন্দ্রটির বৈদ্যুতিক গ্রিড ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ইসরায়েলি প্রচারমাধ্যম একে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’–এর কাজ বলে দাবি করে। ১৩ এপ্রিল ইমারাতের উপকূলের কাছে একটি ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে ইসরায়েলি জাহাজ ‘এমভি হিপেরিয়ন রে’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ জন্য ইরান দায়ী বলে ধারণা করা হয়। ১৫ এপ্রিল ইসরায়েলি বিমান বাহিনী গাজা ভূখণ্ডে ইরান–সমর্থিত সংগঠন হামাসের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালায়।
এমতাবস্থায় স্বভাবতই ইসরায়েলিরা প্রাথমিকভাবে নেগেভ পারমাণবিক কেন্দ্রের নিকটে সংঘটিত এই বিস্ফোরণকে ইরানিদের দ্বারা পরিচালিত অন্তর্ঘাত হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় যে, এই বিস্ফোরণটি ঘটেছে ঐ অঞ্চলে একটি সিরীয় বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পতিত হওয়ার ফলে। ঐ অঞ্চলে অবস্থিত আশালিম নামক একটি ইহুদি বসতি ও আশেপাশের কয়েকটি বেদুইন গ্রাম থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটির কিছু টুকরো পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত টুকরোগুলো বিশ্লেষণের পর ইসরায়েলি বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এগুলো সোভিয়েত–নির্মিত ‘এস–২০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের অংশ, মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র পরিভাষায় যেটিকে ‘এসএ–৫’ নামে অভিহিত করা হয়।
এস–২০০ সোভিয়েত আমলে নির্মিত একটি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, যেটি শত্রুপক্ষের বিভিন্ন ধরনের বিমান ধ্বংস করার কাজে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬০–এর দশকে তদানীন্তন ‘কেবি–১’ (বর্তমান ‘আলমাজ–আন্তেই’) ডিজাইন ব্যুরো কর্তৃক নকশাকৃত এই ক্ষেপণাস্ত্রটি ১৯৮০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সিরিয়ার কাছে রপ্তানি করেছিল। সিরীয় গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে সিরীয় এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলোর অবস্থা তেমন ভালো ছিল না, এবং গৃহযুদ্ধ চলাকালে এই পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। অবশ্য ২০১৫ সালে সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর রুশরা সিরিয়ার এস–২০০ সিস্টেমগুলোর সংস্কার সাধন করে এবং সেগুলোকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলার চেষ্টা করে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ১৯৬০–এর দশকে তৈরি একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে যতই আধুনিকায়ন করা হোক না কেন, সেটি বর্তমান যুগের যুদ্ধবিমানের মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়। তদুপরি, সিরিয়ায় কোনো ‘অঙ্গীভূত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (Integrated Air Defense System, ‘IADS’) নেই, এবং সিরীয় এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলোর ক্রুরাও তেমন দক্ষ নয়। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসরায়েল শত শতবার সিরিয়ার অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালালেও সিরীয় এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলো তাদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর সিরীয়রা এলোপাথাড়ি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে, এবং বলাই বাহুল্য, তাদের প্রায় কোনোটিই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয় না।
যেমন: সিরীয়রা কেবল ২০২০ সালেই ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের দিকে প্রায় ৯০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, কিন্তু একটি বিমানও ভূপাতিত করতে পারেনি। ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, এই হারে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা খুবই বিরল এবং বর্তমান বিশ্বের অন্য কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে এই হারে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় না। অবশ্য ২০১৮ সালে সিরীয়দের নিক্ষিপ্ত এস–২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একটি ‘এফ–১৬’ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়, যেটি গৃহযুদ্ধ চলাকালে সিরীয় এয়ার ডিফেন্সের একমাত্র উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই ঘটনার পর থেকে ইসরায়েলিরা সিরিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য এফ–৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
স্বভাবতই সিরীয় এয়ার ডিফেন্সের দুর্বলতা এবং এস–২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষেপণাস্ত্রটি কীভাবে ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হলো, এটি নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে যায়। পরবর্তীতে অবশ্য প্রকৃত ঘটনাবলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২১ এপ্রিল ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের আশেপাশে অবস্থিত কয়েকটি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালায়। সিরীয় সরকারের ভাষ্যমতে, আক্রমণ চলাকালে সিরীয় এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলো আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। তারা ইসরায়েলি বিমানগুলো থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর অধিকাংশ মাঝপথে ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হয়, কিন্তু কিছু ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুগুলোয় আঘাত হানতে সক্ষম হয়। এর ফলে চারজন সিরীয় সৈন্য আহত হয় এবং কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিরীয়দের নিক্ষিপ্ত এস–২০০ ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি ক্ষেপণাস্ত্র কোনো ইসরায়েলি বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাত করতে পারেনি, কিন্তু দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলি আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং নেগেভ পারমাণবিক কেন্দ্রের ৩০ কি.মি. দূরের একটি স্থানে পৌঁছে। সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি যখন নিক্ষিপ্ত হয়, তখন ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেমগুলো সেটি চিহ্নিত করে এবং ক্ষেপণাস্ত্রটির গতিপথ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। তেল আভিভে অবস্থিত ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর ভূগর্ভস্থ অপারেশন্স সদর দপ্তর থেকে সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ধ্বংস করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ইসরায়েলি ক্ষেপনাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেমগুলো সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্রটিকে ধ্বংস করতে পারেনি এবং এটি নেগেভের আকাশে বিস্ফোরিত হয়। ক্ষেপণাস্ত্রটির টুকরো আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে পড়ে। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেমগুলোর এই শোচনীয় ব্যর্থতা ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনীকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
উল্লেখ্য, ইসরায়েলের একটি বহুস্তরবিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী ব্যবস্থা রয়েছে এবং এগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে ইসরায়েলিরা এতদিন পর্যন্ত পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের অত্যাধুনিক ও বিবিধ ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেমগুলো আকাশপথে পরিচালিত সব ধরনের আক্রমণ থেকে ইসরায়েলি জনসাধারণ এবং সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করতে সক্ষম। বাস্তবিকই ইসরায়েলিদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে একটি।
ইসরায়েলিদের বহুস্তরবিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ধাপে রয়েছে ‘অ্যারো’ (Arrow) দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেম। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ (আইএআই) এবং মার্কিন বহুজাতিক কর্পোরেশন ‘বোয়িং’ কর্তৃক যৌথভাবে নির্মিত এই সিস্টেমটি শত্রুপক্ষের দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। ‘অ্যারো–১’ ও ‘অ্যারো–২’ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের অভ্যন্তরে এবং ‘অ্যারো–৩’ বায়ুমণ্ডলের বাইরে শত্রুপক্ষের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে ‘ডেভিডস স্লিং’ (David’s Sling) মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেম। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস’ এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানি ‘রেথিয়ন’ কর্তৃক যৌথভাবে নির্মিত এই সিস্টেমটি শত্রুপক্ষের বিমান, ড্রোন এবং মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে সক্ষম। অত্যাধুনিক রাডার ও ইলেক্ট্রো–অপটিক সেন্সরবিশিষ্ট এই সিস্টেমটি লক্ষ্যবস্তুতে সঠিকভাবে আঘাত হানার ক্ষমতার জন্য প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে।
ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তৃতীয় ধাপে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’ (Iron Dome) স্বল্পপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেম। ‘ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এবং ‘রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস’ কর্তৃক যৌথভাবে নির্মিত এই সিস্টেমটি শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত স্বল্পপাল্লার রকেট ও কামানের গোলা ধ্বংস করতে সক্ষম। এই সিস্টেমটি ব্যবহার করে ইসরায়েলিরা নিয়মিত হামাস কর্তৃক ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত রকেটগুলো ধ্বংস করে থাকে।
তিন স্তরবিশিষ্ট এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির পেছনে ইসরায়েল শত শত কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে এবং এক্ষেত্রে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভ করেছে। নেগেভের ওপরে বিস্ফোরিত হওয়া সিরীয় এস–২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েলিরা সম্ভবত অ্যারো বা ডেভিডস স্লিং সিস্টেম ব্যবহার করেছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতাই ইসরায়েলিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। অবশ্য সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্রটি বিস্ফোরণের ফলে ইসরায়েলে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি কিংবা তাদের কোনো স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাহলে ইসরায়েলিরা কেন এই ব্যাপারটি নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হচ্ছে?
এর কারণ হচ্ছে ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত সামর্থ্য। ইরানের কাছে বিপুল সংখ্যক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে এবং তারা নিখুঁতভাবে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ও আত্মঘাতী ড্রোন নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের দুটি তেলক্ষেত্রে ড্রোন হামলা চালিয়ে দেশটির তেল উৎপাদন ক্ষমতা সাময়িকভাবে অর্ধেকে নামিয়ে আনার মধ্য দিয়ে ইরানিরা ড্রোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে (যদিও ইরান এই আক্রমণে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে)। তদুপরি, ইরানি প্রক্সি লেবানিজ সংগঠন ‘হিজবুল্লাহ’র কাছে লক্ষাধিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশারদদের চিন্তার কারণ হচ্ছে, তাদের এত অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেখানে ১৯৬০–এর দশকে তৈরি একটি ক্ষেপনাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারছে না, সেক্ষেত্রে ইরান বা হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে তাদের নিক্ষিপ্ত হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে ধ্বংস করবে? ইসরায়েল যেহেতু আয়তনে খুবই ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্র, সেহেতু সম্ভাব্য যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করতে না পারলে তাদের জান-মালের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হবে।
এমতাবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্রটি বিস্ফোরিত হওয়ার পরপরই ইসরায়েলিরা নেগেভ পরমাণু কেন্দ্রের আশেপাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। একই সঙ্গে তারা সিরিয়ার যে এয়ার ডিফেন্স ঘাঁটি থেকে উক্ত ক্ষেপণাস্ত্রটি নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সেটিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের অংশ হিসেবে তারা দামেস্ক থেকে ৪০ কি.মি. উত্তর–পূর্বে অবস্থিত দুমায়রা শহরে অবস্থিত এয়ার ডিফেন্স ঘাঁটি এবং আশেপাশের আরো কয়েকটি এয়ার ডিফেন্স ব্যাটারির ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। ব্রিটেনভিত্তিক সিরীয় যুদ্ধ পর্যবেক্ষক ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’–এর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, উক্ত ইসরায়েলি আক্রমণের ফলে সিরীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা নিহত হন।
অবশ্য ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের মতে, সিরিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলি পরমাণু কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালিয়েছে, এমনটি প্রতীয়মান হয় না। ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক উজি রুবিনের মতে, এস–২০০ একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং এটি ইসরায়েলের গভীরে আঘাত হানতে সক্ষম, কিন্তু এটি একটি পরমাণু কেন্দ্রের মতো বড় লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য উপযুক্ত নয়। সিরিয়া যদি নেগেভ পরমাণু কেন্দ্র আক্রমণ করতেই চাইত, সেক্ষেত্রে তারা ‘স্কাড’ বা অনুরূপ বড় আকারের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করত। উল্লেখ্য, এই আক্রমণটি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, এমন দাবি সিরিয়া বা ইরানও এখন পর্যন্ত করেনি।
কিন্তু ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি সশস্ত্রবাহিনী ভবিষ্যতে যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী এই ঘটনাটির তদন্ত করতে শুরু করেছে। ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তাদের মতে, এই ব্যর্থতার কারণ ছিল ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সমলয়নের (synchronization) অভাব। অর্থাৎ, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে সমন্বিত নয়। এজন্য শত্রুপক্ষের নিক্ষিপ্ত কোনো ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত হওয়ার পর সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য কোন রাডার ব্যবহৃত হবে, ক্ষেপণাস্ত্রটি ধ্বংস করা হবে কিনা বা করলে কোথায় করা হবে, পুরো সিস্টেম জুড়ে সতর্কতা ঘোষণা করা হবে কিনা– এসব বিষয় নিয়ে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় এবং এর ফলে এই ধরনের ব্যর্থতা দেখা দেয়।
এমতাবস্থায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর চিন্তাভাবনা করছে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল আমিকাম নরকিনের মতে, এই ঘটনাটি যে কয়েক বছর পরে না ঘটে এখন ঘটেছে, একেই ইসরায়েলের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই ঘটনার পর ইসরায়েলের সব অঞ্চলে অবস্থিত সর্বস্তরের ক্ষেপণাস্ত্র–বিধ্বংসী সিস্টেমগুলোকে একটি একক কমান্ড ও নার্ভ সেন্টারের আওতাধীনে নিয়ে আসা হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে তেল আভিভে অবস্থিত ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর অপারেশন্স কেন্দ্রের একটি স্ক্রিনেই বিভিন্ন দিক থেকে আগত সকল শত্রুভাবাপন্ন বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
সামগ্রিকভাবে, ইসরায়েলের পরমাণু কেন্দ্রের নিকটে সিরীয় ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনাটি ইসরায়েলি নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি ভঙ্গুর দিককে স্পষ্ট করে তুলেছে। এর মধ্য দিয়ে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিধর সামরিক শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের যে ভাবমূর্তি ছিল, সেটি আংশিকভাবে হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এমতাবস্থায় ইসরায়েলিরা তাদের এই দুর্বলতাকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে কিনা কিংবা ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে কিনা, সেটিই এখন দেখার বিষয়।