২০২১ সালের ১৯ জুলাই ‘বেন অ্যান্ড জেরি’স’ কোম্পানির নীতি ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় ইসরায়েল এর দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আইসক্রিম বিক্রি না করার ঘোষণা দেয়। বেন অ্যান্ড জেরি’স মূলত আইসক্রিম ও বিভিন্ন ধরনের পানীয় উৎপাদন করে থাকে। ১৯৭৮ সালের ৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টের বার্লিংটনে কোম্পানির যাত্রা শুরু।
দুই বাল্যবন্ধু বেন কোহান ও জেরি গ্রিনফিল্ড কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠা করেন। ভোক্তাদের সুস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বেন অ্যান্ড জেরি’স ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষা এবং জাতিগত সমতা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০০ সালের এপ্রিলে বেন কোহান ও জেরি গ্রিনফিল্ড অ্যাংলো-ডাচ বহুজাতিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের নিকট শর্তসাপেক্ষে বেন অ্যান্ড জেরি’স বিক্রি করে দেন।
ইউনিলিভারের নিকট বিক্রি হলেও বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর সবসময়ই স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রগতিশীল মূল্যবোধ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার নীতি অব্যহত রাখার সুযোগ ছিল। বর্তমানে ম্যাথিউ ম্যাকার্থি এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২৮ জুলাই ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বেন কোহান ও জেরি গ্রিনফিল্ড দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে কোম্পানির আইসক্রিম বিক্রি না করার সিদ্ধান্তের সাথে নিজেদের একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
২০০৫ সালের ৯ জুলাই ফিলিস্তিনের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের আহবানে ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনি ভূমি দখলদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের প্রতিবাদে বর্জন, বিভক্তিকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনের সূচনা হয়, যেটি সংক্ষেপে BDS (Boycott, Divestment and Sanctions) নামে পরিচিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসানে বর্জন আন্দোলনে বৈশ্বিক সমর্থনের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এই আন্দোলন শুরু। ১৯৮০-র দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় কোকা-কোলা, পেপসি-কো, রিবক এবং ফোর্ডের মতো কয়েকটি প্রভাবশালী কোম্পানি দেশটির সাথে সব ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
কিন্তু এই বর্জন, বিভক্তিকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন ইসরায়েলের অর্থনীতি এবং কূটনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারেনি। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র ঘোষণার পূর্ব থেকেই ইসরায়েল বিভিন্ন পর্যায়ে বর্জনের মুখোমুখি হয়ে এসেছিল। সেজন্য দেশটি উচ্চ মানসম্পন্ন বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে সচেষ্ট হয়, যেন অংশীদাররা সহজেই অন্য দেশ থেকে পণ্য প্রতিস্থাপন করতে না পারে। এর মাধ্যমে দেশটি সবসময়ই বর্জন আন্দোলনের প্রভাব হ্রাস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েল বিভিন্ন দেশে লবিং বা তদবির অব্যহত রেখেছে। এর মাধ্যমে তারা ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট পণ্য বর্জন বন্ধে বিভিন্ন দেশের আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে জার্মান পার্লামেন্ট বর্জন, বিভক্তিকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনের কর্মকাণ্ডকে ‘অ্যান্টি-সেমেটিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ‘অ্যান্টি-সেমেটিজম’ বলতে সাধারণত ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা, বৈরিতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ বোঝানো হয়ে থাকে। একে বর্ণবাদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিসের সরকার ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট পণ্যের বর্জন রোধের জন্য পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ৩৫টি অঙ্গরাজ্যে ইসরায়েলের পণ্য বর্জন, বিভক্তিকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন, নির্বাহী আদেশ অথবা রেজুলেশন পাস করা হয়েছে। এসব বিধানের মাধ্যমে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট পণ্য বর্জন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের ব্যবসায়িক অংশীদার হতে বাধা প্রদান করা হয়েছে। ২০০৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো শহরে প্রতিষ্ঠিত এয়ারবিএনবি হচ্ছে একটি বৈশ্বিক ডিজিটাল প্লাটফর্ম, যেটি ব্যবহারকারীদের বাসা ভাড়া খুঁজে পেতে সহায়তা করে থাকে। ২০১৮ সালে এয়ারবিএনবি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলি বসতি ভাড়া দেওয়ার জন্য অন্তর্ভুক্ত তালিকা অপসারণ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ইসরায়েল আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্লাটফর্মটি তালিকা অপসারণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে আইসক্রিম বিক্রয় না করার ব্যাপারে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর এই সিদ্ধান্তকে ‘অ্যান্টি-সেমেটিক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এদিকে বর্জন, বিভক্তিকরণ এবং নিষেধাজ্ঞা আন্দোলনে সংশ্লিষ্টরা স্বাভাবিকভাবেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিড একে ‘অ্যান্টি-সেমেটিজমের নিকট লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এছাড়াও, ইসরায়েলের প্রায় সকল মতাদর্শের রাজনীতিবিদ এই ইস্যুতে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের নিকট এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছে। দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর আইসক্রিম বিক্রয় না করার ঘোষণার পর সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেকোনো বর্জন পদক্ষেপের ঘটনাকে ‘অন্যায্য’ হিসেবে অবহিত করেছেন। ফ্লোরিডা এবং টেক্সাস অঙ্গরাজ্য সরকার ইতোমধ্যে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
এমনকি ইসরায়েল এই ইস্যুতে ইউনিলিভারের পদক্ষেপ দাবি করেছে। ইউনিলিভারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালান জোপ ইসরায়েলে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও আইসক্রিম বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্তকে বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর নিজস্ব সিদ্ধান্ত হিসেবে অবহিত করে কোম্পানির বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তাই ইসরায়েল ভূখণ্ডে দুই ইহুদি ধর্মাবলম্বীর প্রতিষ্ঠিত বেন অ্যান্ড জেরি’স-এর আইসক্রিম বিক্রি বন্ধের এই সিদ্ধান্ত প্রতিহতকরণে দেশটির পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে, সেটা সময়ই নির্ধারণ করতে পারবে।