যখন দুই পক্ষের লড়াই বা ঝগড়া হয়, তখন কিছু মানুষকে দেখা যায় তা থেকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করতে। তারা কোনো এক পক্ষকে সাহায্য করে বা উসকিয়ে দিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজের স্বার্থ বজায় রাখার চেষ্টা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে আমেরিকা ও রাশিয়ার অবস্থান।
আরব দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব অনেক দিন থেকে চলে আসছে। এই দ্বন্দ্ব মূলত ধর্মীয় হলেও বিভিন্ন সময় ভৌগোলিক, রাজনৈতিক সহ আরো নানা কারণে যুদ্ধের সৃষ্টি হয়েছে। আজকে আমরা আলোচনা করব চতুর্থ আরব ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে, যা ইওম কিপুর যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এই যুদ্ধের মূল পটভূমি ছিল ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলো ইসরায়েল কর্তৃক যেসকল ভূমি হারিয়েছিল, সেগুলোর ফিরে পাওয়া। এজন্য ১৯৭৩ সালে অক্টোবর মাসে মিশর ও সিরিয়া একত্রে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইওম কিপুর হচ্ছে ধর্মীয় দিক থেকে ইহুদিদের জন্য একটি বিশেষ দিন। ইওম কিপুরের সময় হঠাৎ এই আক্রমণের জন্য ইসরায়েল মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সপ্তাহ ধরে চলা এই যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ব্যবহৃত হয়। যার ফলে অসংখ্য মানুষ নির্মমভাবে হতাহত হয়।
একটা সময় মনে হয়ে যে, এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে থেকে ছড়িয়ে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে হতে পারে যারা দুই পক্ষকে সাহায্য করেছিল। এই যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি সাক্ষরে বাধ্য করে, যার ফলে ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।
১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মিশর ও সিরিয়ায় উল্লেখযোগ্য সামরিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ শুরু করতে থাকে। সেনাবাহিনী ইসরায়েলের সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসে, তবে এই কার্যক্রমগুলো সীমান্তে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত অনুশীলন হিসেবে ভাবা হয়।
ইসরায়েলের হাই কমান্ডের কাছে বিষয়টি সন্দেহজনক বলে মনে হয়। এজন্য তারা মিশর ও সিরিয়ার সীমান্তের নিকটে অবস্থিত সামরিক ইউনিট দ্বিগুণ করার জন্য আদেশ দেয়। ইওম কিপুরের আগের সপ্তাহে ইসরায়েলের সন্দেহ আরো তীব্র হয় যখন গোয়েন্দারা খবর দেয় যে, সোভিয়েত পরিবারগুলো মিসর ও সিরিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। উভয় দেশই তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে একবদ্ধ ছিল। এদিকে মিত্র বেসামরিক নাগরিকদের চলে যাওয়া অগ্রিম বার্তা জানান দিচ্ছিল যে, দেশগুলো যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলছে।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর ইয়ম কিপুরের দিন ভোরে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, যুদ্ধ আসন্ন। ভোর হওয়ার আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বৈঠক করেন এবং সকাল দশটায় দেশের সেনাবাহিনীকে একত্রিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। গোয়েন্দা সূত্র আরও ইঙ্গিত করে, ইসরায়েলে আক্রমণ সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হবে। তবে মিশর ও সিরিয়া উভয়ই দুপুর ২টায় ইসরায়েল আক্রমণ শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্য হঠাৎ করে এক বিশাল যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
মিশর প্রথমে সুয়েজ খালে হামলা করে। মিশরীয় সেনারা খালটি পেরিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে যারা ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে সিনাই উপদ্বীপটি দখল করেছিল।
ইহুদী ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দিন ইওম কিপুরের সময় আক্রমণ শুরু করা মিশরীয় ও সিরিয়ানদের কৌশল বলে মনে হলেও ইসরায়েলীয়দের পক্ষে এটি সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয়, যেহেতু এই দিনটি মূলত রাষ্ট্রীয় বন্ধ ছিল। যখন রিজার্ভ মিলিটারি ইউনিটগুলোকে ডিউটির জন্য জরুরী রিপোর্ট করা হয়, তখন তাদের বেশিরভাগই বাড়িতে বা উপাসনালয়ে ছিল। এজন্য তারাও দ্রুত রিপোর্ট করতে পেরেছিল। আর এই কারণে যুদ্ধের জন্য একত্রিত হওয়ার মূল্যবান সময়গুলো বাঁচানো সম্ভব হয়।
সিরিয়া থেকে আক্রমণ শুরু হয় গোলান মালভূমিতে। এটি ইসরায়েল ও সিরিয়ার সীমান্তের একটি মালভূমি, যা ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী দখল করেছিল। সিরিয়ার সেনাবাহিনী ইসরায়েলের সামনের স্থাপনাগুলোতে বিমান হামলা এবং তীব্র বোমা হামলা দিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে।
শত শত ট্যাংক নিয়ে তিনটি সিরিয়ান পদাতিক বাহিনী আক্রমণ চালায়। ইসরায়েলি কমান্ডাররা সিরিয়ার প্রাথমিক আক্রমণের আকস্মিকতা কাটিয়ে কাছাকাছি অবস্থিত আর্মার্ড ইউনিটগুলোকে যুদ্ধে প্রেরণ করে।
গোলান মালভূমির অগ্রভাগের দক্ষিণ অংশে সিরিয়ার ইউনিটগুলো ভেঙে যায়। ৭ই অক্টোবর, সম্মুখ বরাবর তীব্র লড়াই হয়। ফলে উভয় পক্ষই বিপুল হতাহতের শিকার হয়।
ইসরায়েলিরা সিরিয়ার অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে সাহসী লড়াই করে এবং ট্যাঙ্ক যুদ্ধ শুরু হয়। ৮ই অক্টোবর, এবং পরের দিন ইসরায়েলি এবং সিরিয়ার ট্যাঙ্কগুলো একটি ভারী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৭৩ সালের ১০ই অক্টোবর, ইসরায়েলিরা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধবিরতি লাইনে সিরিয়াকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
১১ ই অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলিরা পাল্টা আক্রমণ চালায়। দেশটির নেতাদের মধ্যে কিছু আলোচনার পরে, পুরনো যুদ্ধবিরতি লাইন পেরিয়ে সিরিয়ায় আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসরায়েলিরা সিরিয়ার সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সময় একটি ইরাকি ট্যাঙ্ক-বাহিনী ঘটনাস্থলে আসে, সিরিয়ার পাশাপাশি লড়াইয়ের জন্য। একজন ইসরায়েলি কমান্ডার ইরাকিদের সমতলভূমি পেরিয়ে যেতে দেখে আক্রমণের জন্য তাদের প্ররোচিত করে। পরে ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক দ্বারা ইরাকিরা হামলার শিকার হয় এবং প্রায় ৮০টি ট্যাঙ্ক হারিয়ে আক্রমণ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
ইসরায়েলি এবং সিরিয়ার ইউনিটগুলোর মধ্যে তীব্র ট্যাঙ্ক যুদ্ধও হয়। ইসরায়েল কিছু উচ্চ পাহাড় দখল নিয়ে সিরিয়ার মধ্যে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং সিরিয়ানরা প্রাথমিক আক্রমণের সময় যে হার্মোন পাহাড় দখল করে, তা আবার উদ্ধার করে। গোলানের যুদ্ধ শেষ অবধি ইস্রায়েলের শক্ত অবস্থান ধারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। উভয় দেশ ১৯৭৩ সালের ২২ শে অক্টোবর জাতিসংঘের দ্বারা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়।
মিশরীয় সেনা থেকে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ ৬ই অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে শুরু হয়। সিনাইয়ে ইসরায়েলি অবস্থানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা দিয়ে আক্রমণ শুরু হয়। ইসরায়েলিরা মিশর থেকে যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বালু দিয়ে বিশাল প্রাচীর তৈরি করেছিল এবং মিশরীয়রাও একটি অভিনব কৌশল ব্যবহার করে। তারা জল-কামানকে গাড়ীতে লাগায় এবং বালির দেয়াল গর্ত করতে ব্যবহার করে, যার ফলে ট্যাঙ্কগুলো সামনে এগিয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রাপ্ত ব্রিজিং সরঞ্জামগুলো মিশরীয়দের সুয়েজ খাল পেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
ইসরায়েলি বিমান বাহিনী মিশরীয় বাহিনীকে আক্রমণ করার সময় মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হয়। ইসরায়েলি পাইলটদের মিসাইল এড়ানোর জন্য কম উচ্চতায় উড়তে হয়েছিল, যা তাদের মিশরের বিমান প্রতিরোধী আক্রমণের পরিসরে ফেলে। ফলে ইসরায়েলি পাইলটদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
ইসরায়েলিরা মিশরীয়দের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এক সময় দেখে মনে হচ্ছিল যে, ইসরায়েলিরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে এবং মিশরীয় আক্রমণ ধরে রাখতে সক্ষম হবে না। পরিস্থিতি এমন হলে আমেরিকার সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিকসন ইসরায়েলে সাহায্য প্রেরণে উদ্বুদ্ধ হয়। নিকসনের প্রধান বৈদেশিক নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলী অনুসরণ করেন এবং নিক্সনের নির্দেশে আমেরিকা থেকে ইসরায়েলে এক বিশাল বিমান বাহিনী যায়।
যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে আগ্রাসনের সম্মুখভাগে লড়াই অব্যাহত থাকে। ইসরায়েলিরা মিশরীয়দের কাছ থেকে একটি বড় হামলার প্রত্যাশা করেছিল, যা ১৪ই অক্টোবর একটি বিশাল আক্রমণ হিসাবে রূপ নেয়। ইসরায়েলিদের ভারী ট্যাঙ্ক আর আমেরিকার বিমান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মিশরীয়রা তেমন অগ্রগতি করতে না পেরে প্রায় ২০০ ট্যাঙ্ক হারায়।
১৯৭৩ সালের ১৫ ই অক্টোবর ইসরায়েলিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং দক্ষিণে সুয়েজ খাল পেরিয়ে উত্তর দিকে যুদ্ধ করে। এরপরের লড়াইয়ে মিশরীয় তৃতীয় সেনাবাহিনীকে অন্যান্য মিশরীয় বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের ঘিরে রাখা হয়।
জাতিসংঘ যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছিল, যা অবশেষে ১৯৭৩ সালের ২২ শে অক্টোবর কার্যকর হয়।
ইওম কিপুর যুদ্ধের একটি সম্ভাব্য বিপদজ্জনক দিক ছিল, দ্বন্দ্বটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা। ইসরায়েলিরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জোটবদ্ধ ছিল, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশর এবং সিরিয়া উভয়কেই সমর্থন করেছিল।
যুদ্ধের পরে বিপুল হতাহতের কারণে ইসরায়েল হতাশাগ্রস্ত হয় এবং তাদের অগ্রিম প্রস্তুতির অভাব সম্পর্কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
যদিও মিশর মূলত পরাজিত হয়েছিল, তবে যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্যগুলো রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতের মর্যাদাকে বাড়িয়ে তোলে। কয়েক বছরের মধ্যে আনোয়ার সাদাত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েল সফর করেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্যাম্প ডেভিডে ইসরায়েলি নেতৃবৃন্দ এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের সাথে বৈঠক করেন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য।