
‘ভূস্বর্গ’ কথাটা আমরা অনেক সময় অনেক জায়গায় ব্যবহার করি। সাধারণত অত্যন্ত সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশের মুখোমুখি হলে এই শব্দ আমাদের মনে আসে। এর অর্থ হতে পারে পৃথিবীর এমন এক স্থান, যেটি আমাদের কল্পনার স্বর্গের মতোই সুন্দর; আরেকভাবে বলা যেতে পারে, ভূস্বর্গ হলো পৃথিবীর বুকে যে স্থান আমাদের স্বর্গের কথা মনে করিয়ে দেয়, আমাদের মনে স্বর্গীয় অনুভূতির জন্ম দেয়; যেখানে কোনো দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক, জরা-মৃত্যু নেই। আছে অপার, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি আর আনন্দ।
যুগে যুগে পৃথিবীর দুর্দশাপীড়িত মানুষ এরকম অনুপম শান্তিময় স্বর্গরাজ্যের কথা, অমরত্বের কথা কল্পনা করে আসছে। সুপ্রাচীন সুমেরীয় মহাকাব্য গিলগামেশ থেকে শুরু করে আজকের উত্তরাধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত সবখানে এই চিন্তাধারার ছাপ পাওয়া যায়। আজকে আমরা সেরকম একটি রাজ্যের কথা জানব, যা পৃথিবীর মাঝে অবস্থান করেও পরিচিত পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, আধুনিক সভ্যতার কাছে ভীষণভাবে অজ্ঞাত।

১৯৩৩ সালে ইংরেজ ঔপন্যাসিক জেমস হিলটন এর উপন্যাস ‘লস্ট হরাইজন’ প্রকাশিত হয়। এ বইটির গল্প অনুসারে কয়েকজন মানুষ একটি প্লেন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে আফগানিস্তান-পাকিস্তান এর উত্তর-পূর্বে ও তিব্বতের উত্তর পশ্চিম অঞ্চলের একটি দুর্গম ভ্যালি বা উপত্যকায় এসে পৌঁছায়, যেখানে বসবাসকারী মানুষেরা সকলে অস্বাভাবিক দীর্ঘ জীবনের অধিকারী, যেখানে রয়েছে স্বর্ণখনির মতো মূল্যবান সম্পদের ভান্ডার, বিশাল একটি লাইব্রেরিতে সঞ্চিত রয়েছে পৃথিবীর সকল যুগের সকল বিষয়ের আহরিত জ্ঞান। সেখানে বসবাসকারী মানুষের মাঝে নেই কোনো দুঃখ-কষ্ট, রোগ-বালাই, শোক-তাপ, হিংসা-বিদ্বেষ। সকলে সুশৃঙ্খলভাবে একটি বৌদ্ধ মঠের প্রণীত নিয়ম-কানুন মেনে জীবন পরিচালিত করে, যার নাম শাংগ্রি-লা।
এই শাংগ্রি-লা পৃথিবীর মানুষের কাছে অদৃশ্য, শুধুমাত্র তারাই এর অবস্থান জানতে পারে যাদেরকে এখানকার অধিবাসীরা নিজ উদ্যোগে এখানে নিয়ে আসে। এটি এমন একটি পর্বতের কোলে অবস্থিত, যেটিকে লেখক বর্ণনা করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর উঁচু পর্বত হিসেবে, যার নাম মাউন্ট কারাকাল। চারদিকের সুউচ্চ পর্বতমালা এই ছোট্ট উপত্যকাকে বাকি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

ধারণা করা হয়, সভ্য পৃথিবীতে একদিন এক মহাযুদ্ধ হবে। এই যুদ্ধে মানবসভ্যতার সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। আর সেদিন মানব সভ্যতার শেষ নিদর্শন হিসেবে শাংগ্রি-লা পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবে। সমগ্র পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের উত্তাপ শাংগ্রি-লাকে স্পর্শ করবে না। এটিই হবে পৃথিবীর মানুষের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল।
১৯৩৩ সালে এই উপন্যাস প্রকাশের পর পরই পাঠকদের কাছে ব্যাপক সমাদর ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আশঙ্কার মাঝে এই উপন্যাসে বর্ণিত পৃথিবীর বুকে এরকম স্বর্গরুপ স্থানের উপস্থিতির ধারণা সমগ্র ইউরোপের পাঠককূলের মাঝে বিপুল সাড়া জাগায়। এখন প্রশ্ন হলো, ঔপন্যাসিক জেমস হিলটন কি শুধুমাত্র নিজের কল্পনার জায়গা থেকে এমন কাহিনী বর্ণনা করেছেন? নাকি বাস্তবে কিছুটা হলেও তার এই কল্পনার ভিত্তি রয়েছে? আমরা এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
তিব্বতে এরকম রহস্যময়, পৃথিবীর দৃষ্টির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একটি রাজ্যের উপস্থিতির ধারণাটি আজকের নয়। সম্রাট আকবর তার ধর্মদর্শন দীন ই এলাহী প্রতিষ্ঠার জন্য মতামত নেওয়ার লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা ধর্মের ধর্মশিক্ষায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করতেন। এদের মাঝে হিন্দু, যোগী, সন্ন্যাসী যেমন ছিলেন, তেমনি খ্রিস্টান যাজকেরাও ছিলেন। এরকমই একজন যাজক সেখানে একটি নিবন্ধের সন্ধান পান, যার সাথে একটি মানচিত্র যুক্ত ছিল। মানচিত্রটি ছিল হিমালয়ের উত্তরের কোনো এলাকার, যাতে শুধুমাত্র মানস সরোবর ছাড়া আর কোনো কিছুই চিহ্নিত ছিল না। নিবন্ধতে দাবি করা হয়, মানচিত্রের ঐ স্থানে খ্রিস্টানরা বসবাস করে। পরবর্তীতে আরেকজন পর্তুগিজ মিশনারি, যার নাম আন্তোনিও আন্দ্রাদে, মানচিত্রে বর্ণিত স্থানের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। তিনি যোগী ও তীর্থযাত্রীদের সাথে বহু কষ্টে হিমালয় পাড়ি দিয়ে অবশেষে এক অসম্ভব সুন্দর ও ধনী রাজ্যের সন্ধান লাভ করেন, কিন্তু সেখানে কোনো খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীর বসবাস ছিল না।
মহাযান বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের কাছে কালাচক্র তন্ত্র একটি পরিচিত নাম। এই মতবাদে একটি রাজ্যের বর্ণনা পাওয়া যায় যেটি শাম্বালা নামে পরিচিত। এই রাজ্য হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত একটি উপত্যকা। এর চারপাশে সুউচ্চ পর্বতমালা এমনভাবে একে বেষ্টন করে রেখেছে যেন উপর থেকে দেখলে এ রাজ্যকে একটি পদ্মফুলের মতো দেখায়।

সমগ্র শাম্বালা উপত্যকা একটি অনিন্দ্যসুন্দর শ্বেতশুভ্র পর্বতের ছায়ায় অবস্থান করে। এই রাজ্যের রাজা স্বয়ং শাক্যমুনি বুদ্ধের কাছ থেকে মহাযান শিক্ষা লাভ করেন। এখানকার মানুষ যুদ্ধ বিগ্রহের সাথে পরিচিত নয়। এখানে কোন রোগ-শোক, মহামারী, অস্থিরতা, দুঃখ-দুর্দশা, হিংসার অস্তিত্ব নেই। এ রাজ্যের মানুষ পরম শান্তিতে মহান বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শণ অনুযায়ী জীবনধারণ করে। সমগ্র পৃথিবীজুড়ে যখন বস্তুবাদী দর্শণ আধ্যাত্মিকতাকে অপসারণ করবে, পৃথিবী যখন স্বেচ্ছাচারিতা ও সন্ত্রাসে পরিপূর্ণ হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে, তখন লোকচক্ষুর অন্তরালে কুয়াশায় ঢেকে থাকা শাম্বালা রাজ্যের উপর থেকে কুয়াশার চাদর অপসারিত হবে; পৃথিবীবাসীর কাছে এ রাজ্য দৃশ্যমান হবে। এখান থেকেই শুরু হবে পরবর্তী শান্তিপূর্ণ পৃথিবী প্রতিষ্ঠার প্রয়াস।
কাজেই দেখা যায়, শাংগ্রি-লা নগরীর কাহিনী তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এই ধরনের নগরের উপস্থিতির ধারণাটি অনেক পুরাতন। এই কিছুদিন আগেও তিব্বত ছিল পৃথিবীর মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নিষিদ্ধ এক দেশ; যে দেশের বহু স্থানে পরিচিত পৃথিবীর কোনো মানুষের পা পর্যন্ত পড়েনি। প্রাকৃতিক দুর্গমতা আর বৈরী পরিবেশের কারণে যে দেশের অনেক কিছুই ছিল আমাদের অজানা। তাই হয়তো আমরা প্রশ্ন করি, শাংগ্রি-লা কি সত্যিই আছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ জানি না। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, হানাহানি ও অশান্তির এ পৃথিবীতে শাংগ্রি-লা নগরের ভাবনা আমাদের ভবিষ্যতের এক শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে শেখায়। তাই প্রশ্নটি বরং আমাদের এভাবে করা উচিত, ‘শাংগ্রি-লা কি নেই?’