Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লোজ-আপ: ডকু ফিকশনে শিল্পানুরাগ ও স্বাধীনতার বয়ান

আক্রোশের ভয়ে শিল্পকে ভেক ধরতে হয়।

আদালতে সিনেমার প্রধান চরিত্র হোসেইন সাবজিয়ানের করা এ উক্তি সিনেমার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণরুপে তুলে ধরে। ক্লোজ-আপের গল্প আবর্তিত হয়েছে একজন শিল্পপ্রেমীকে ঘিরে। কিন্তু শিল্পের প্রতি তার অনুরাগের বিষয়টি সে সরাসরি প্রকাশ করতে পারে না, পাছে অন্যরা ক্রোধান্বিত হয় এই ভয়ে। রূপকের মাধ্যমে এখানে ইরানের সিনেমায় সৃজনী স্বাধীনতার উপর যে দমন নীতির খড়গ নেমে আসে প্রত্যহ, তা-ও উপস্থাপিত হয়েছে। সিনেমার কাজ কেবল যাপিত জীবনের ক্লেশ দূর করে মানুষকে কোনো অলীক জগতে নিয়ে যাওয়া নয়। বরং বেশিরভাগ গ্রেট সিনেমা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজ-কাল-দেশের রুঢ় বাস্তবতা। কিন্তু উপরমহলের শৌর্যবীর্য যখন কথায় কথায় অপমানিত বোধ করে, তখন শিল্প ধারণ করতে হয় ছদ্মবেশ। আশ্রয় নিতে হয় চাতুরীর। আব্বাস কিয়ারোস্তমির নিজের ভাষায়, সিনেমা হচ্ছে যুথবদ্ধ কিছু মিথ্যা, যেগুলো বলা হয় বৃহত্তর কোনো সত্য তুলে ধরতে।

ইরানী সিনেমার প্রবাদপুরুষ আব্বাস কিয়ারোস্তমি; Image Credit : tehrantimes.com

 

১৯৮৯ সালের শরৎকাল, ইরানী ম্যাগাজিন শরুশে ছাপা হয় বিরল এক অপরাধের খবর। হোসেন সাবজিয়ান নামে এক দরিদ্র ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার অপরাধ উত্তর তেহরানের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সাথে প্রখ্যাত পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ পরিচয়ে জালিয়াতি। ঐ আহানখা পরিবার থেকে কিছু অর্থ গ্রহণ করলেও, অর্থই তার অপরাধের মূল প্রেরণা বলে মনে হয় না। তার আর আহানখা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মূল যোগসূত্র ছিল সিনেমার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। তাদের কাছে নিজেকে মাখমালবাফ বলে পরিচয় দিয়ে প্রাথমিকভাবে পার পেয়ে গেলে, সাবজিয়ানের মাথায় এ পারফর্মেন্সকে চালিয়ে যাওয়ার ভূত সওয়ার হয়। এ সময় সে তাদের তার পরবর্তী সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং ঐসব চরিত্রের জন্য রিহার্সাল করায়। মূল পরিচালক ইতালিতে একটি চলচ্চিত্র উৎসবে পুরষ্কার পেয়েছেন বলে সংবাদ প্রচারিত হয় ইরানী মিডিয়ায়। কিন্তু আহানখাদের ‘মাখমালবাফ’ এ ব্যাপারে কোনো তথ্যই জানতেন না, যা তাদের আগের সন্দেহকে বিশ্বাসে রুপান্তরিত করে এবং তারা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে। শরুশের রিপোর্টার হাসান ফারাজমান্দ নিজে উপস্থিত থেকে সাবজিয়ানের গ্রেফতার প্রত্যক্ষ করেন এবং পুলিশ স্টেশনে তার বিশদ সাক্ষাৎকার নেন। এটা ছাপা হলে দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সকলেই কথা বলতে শুরু করে অদ্ভুতুড়ে এই ঘটনা নিয়ে। 

এ সময় পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তমি ব্যস্ত ছিলেন অন্য একটি কাজে। ম্যাগাজিনে জালিয়াতির খবরটি পড়ে তিনি সেই কাজ রেখে এ ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা ভাবেন। তিনি যখন সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনও আহানখা আর সাবজিয়ানের মামলা প্রক্রিয়াধীন ছিল, অপরাধীর ভবিতব্যে কী আছে তা-ও নির্ধারিত হয়নি। ১০০ মিনিটের সিনেমায় বাস্তবের ঘটনার কুশীলবদের অভিনয় করতে রাজি করান তিনি। কিয়ারোস্তমিসহ সকলেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন নিজের পূর্বে কৃতকর্মের পুনঃমঞ্চায়নে। মাখমালবাফের নিজের এ ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর ইচ্ছা ছিল। তিনি নিজেই ঘটনার মূল কেন্দ্রবিন্দু, তার হাতে এ প্রজেক্টের বস্তুনিষ্ঠতার দিকটি ব্যাহত হতে পারে। এ কথা বলে কিয়ারোস্তমি তাকে নিবৃত্ত করেন। 

কাঠগড়ায় অভিযুক্ত সাবজিয়ান; Image Credit : www.sabzian.be

 

নিজের ১০ম চলচ্চিত্রে পরিচালক সরাসরি সোশ্যাল কমেন্ট্রি, শিল্পের স্বাধীনতা বা সেন্সরশিপ নিয়ে কিছু বলেননি। তবে এসকল বিষয় প্রতিবিম্বিত হয় সাবজিয়ানের কথাবার্তা, বিশ্বাস এবং আচার-আচরণে। মাখমালবাফের দ্য সাইক্লিস্ট (১৯৮৭) নিয়ে তার মুগ্ধতার কোনো পরিসমাপ্তি নেই। ব্যাপারটা নেশার দিকেই চলে গেছে বলা যায়। তার মতে, পরিচালক এখানে জীবনের ক্লিষ্টতার যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, সেটি তার জীবনের সাথে খাপে খাপ মিলে যায়। এই চলচ্চিত্র আর শিল্প মাধ্যম হিসেবে সিনেমা তাকে এতটাই আন্দোলিত করেছে যে, নিজেকে মাখমালবাফ বলে মিথ্যা পরিচয় দিতে তার ভেতর কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না। আমাদের সকলের জীবনেই তো কোনো না কোনো আদর্শ থাকে, যারা আমাদের অনুপ্রেরণা যোগান প্রতিনিয়ত। সাবজিয়ানের জন্য মাখমালবাফও সেরকমই একজন। আর বেকারত্ব, দারিদ্র্যের প্রবল কষাঘাতে পীড়িত জীবনে- নিজেকে প্রিয় পরিচালকের দ্বিতীয় সত্তা মনে করার বিভ্রম টিকিয়ে রাখে তার ভেতরের শিল্পের সমঝদারকে। 

এতক্ষণে তো এটি প্রতীয়মান হয় যে, ক্লোজ-আপের কেন্দ্রীয় চরিত্র মিথ্যা বলে, চাতুরীর আশ্রয় নেয়। কিন্তু সে কি খারাপ মানুষ? অবশ্যই না। তার একমাত্র ভালোবাসা, ভালো লাগার বিষয় হলো শিল্প। শিল্পই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং তার জন্য মিথ্যা বলতেও সে পিছপা হয় না। আহানখা পরিবারের সাথে মাখমালবাফ রূপে ছলনা করার সময় সে প্রতিনিয়ত নিজের বলা মিথ্যাকে প্রগাঢ় রুপ দিতে চেয়ে। এভাবে সে পেয়েছে নিজের আসল সত্তার খোঁজ। শিল্প-সাহিত্য তার রক্তের সাথে মিশে গেছে। কিন্তু তার সামাজিক অবস্থানের কারণে কেউ তার প্রতি মনোযোগ দেয় না। প্রখ্যাত ডিরেক্টরের ছদ্মবেশ ধারণ করে সে পায় মানুষের মনোযোগ, যা এমনিতে সে পেত না। তখন তার মুখ থেকে যেসব কথা নিঃসৃত হয়, সেগুলো মাখমালবাফের নয়। বরং শিল্প সমঝদার সাবজিয়ানের নিজের। এভাবে সমাজে তেলা মাথায় তেল দেওয়ার সংস্কৃতির এবং শ্রেণিবৈষম্যের দিকে আঙুল তুলেছেন কিয়ারোস্তমি। সাবজিয়ানের অপরাধ কেবল নিজের ভালোবাসা রক্ষার জন্য প্রভাবশালী, জনপ্রিয় একজন মানুষের বেশ ধারণ করা। 

অভিযোগকারী আহানখা পরিবারের দুই সদস্য; Image Credit : expresselevatortohell.com

 

কোর্টরুম ট্রায়ালের দৃশ্যাবলীতে বাস্তবের ফুটেজও ব্যবহৃত হয়েছে। ক্যামেরা ছিল দুটি। একটি ৩২ মিলিমিটারের ল্যান্ডস্কেপ ক্যামেরা, যেটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের মুখে ফোকাস করেছে, অন্যটি ১৬ মিলিমিটারের। এর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কেবল সাবজিয়ানের ওপর। মামলা চলাকালীন তর্ক-বিতর্ককে শিল্প এবং শিল্পপ্রেমী বিষয়ক অর্থপূর্ণ, গভীর একটি সংলাপ বলা চলে। অভিযুক্তের বাস্তবে করা যুক্তিতর্কের ওপর ভিত্তি করে এ অংশের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন পরিচালক। বিচারকসহ উপস্থিত সকলকেই আমরা সাবজিয়ানের ব্যথায় সমব্যথী হতে দেখি। এ ঘটনায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন বোধহয় কিয়ারোস্তামি আর ইরানী সিনেমা।

নিজের দেশে সমালোচিত হলেও ক্লোজ-আপই বহির্বিশ্বের কাছে তাদের সিনেমার কথা জানান দেয়। কিয়ারোস্তমি, মাখমালবাফসহ সেদেশের সমকালীন অন্য পরিচালকেরা পরিণত হন সিনেফাইলদের আগ্রহের বিষয়ে। কোনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরষ্কার বগলদাবা করা প্রথম ইরানী সিনেমা হওয়ার কৃতিত্বও ক্লোজ-আপের। মুক্তির পাঁচ বছর পর ১৯৯৫ সালে এটি নিয়ে নির্মিত হয় একটি ডকুমেন্টারি। ‘ক্লোজ-আপ লং শট’ নামক এ ডকুমেন্টারিতে সাবজিয়ান কথা বলেন সিনেমার প্রতি তার ভালোবাসা, নিজের আইডল মাখমালবাফ এবং কিয়ারোস্তমির সাথে কাজের পর তার জীবনে আসা পরিবর্তন নিয়ে। ফারাজমান্দ যে ঘটনাকে দেখেছিলেন জনপ্রিয়তা এবং অর্থপ্রাপ্তির উপায় হিসেবে, সেখানে পরিচালক খুঁজে নিয়েছেন মানবসত্তার মর্মন্তুদ গল্প। 

মামলার যুক্তিতর্ককে আরো আকর্ষণীয় এবং হৃদয়গ্রাহী  করতে পরিচালক নিজেই সাবজিয়ানের প্রশ্নকর্তারূপে আবির্ভূত হন, যা বাস্তবতা এবং কল্পনার সীমারেখাকে অস্পষ্ট করে দেয়। তিনি সাবজিয়ানের কাছে জানতে চান, “আপনি কি একজন অভিনেতা নাকি পরিচালক?” এবং “এত ভালো অভিনেতা হওয়ার পরও আপনি কেন একজন পরিচালকের ছদ্মবেশ নিলেন?

সাবজিয়ানের দিক থেকে জবাব আসে, “পরিচালকের চরিত্রে অভিনয়টাও তো আমার অভিনয় দক্ষতার প্রমাণ।” 

এসব প্রশ্ন আর উত্তরের মাঝেই আসলে লুকিয়ে আছে ক্লোজ-আপের গূঢ় সৌন্দর্য, যেটি শিল্প-সিনেমা এবং এগুলোর প্রতি একজন মানুষের ভালোবাসা বিষয়ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। 

নকল আর আসল মাখমালবাফের মোটর সাইকেল রাইড; Image Credit : birdmenmagazine.com

 

সাবজিয়ানের সাথে আসল মাখমালবাফের দেখা হওয়ার দৃশ্য সিনে-ইতিহাসের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলোর একটি। মাখমালবাফ যেভাবে তাকে গ্রহণ করেন, সেটিও দর্শক মনে রাখবে অনেকদিন। এ দৃশ্যসমূহ ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। এ সিকোয়েন্সে ফুলের ব্যবহারের একটি বিষয় রয়েছে, যেটি শুরুতে কানাগলিতে ফুল নাড়াচাড়ার বিষয়ের সমাপ্তি টানে অসাধারণভাবে। মাখমালবাফ আর সাবজিয়ানের মোটরসাইকেল রাইডও দর্শকের মনে প্রগাঢ় ছাপ রাখে। দিনশেষে, ক্লোজ-আপ এক প্রেমিকের গল্প, যে শিল্প আর সিনেমার প্রেমে এতটাই মশগুল ছিল যে, নিজেই পরিণত হয় একটি সিনেমার মূল বিষয়বস্তুতে।

Related Articles