কোরিয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিকট ভবিষ্যতে না হলেও একটা সময়ে গিয়ে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া একত্রিত হয়ে যেতে বাধ্য হবে। অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র নিয়ে সবার মাঝেই ইতিবাচক মনোভাব দেখা যায়। কোরীয়রা বিশ্বাস করেন, এতে কোরিয়া উপদ্বীপে আবার শান্তি ফিরে আসবে। দীর্ঘমেয়াদে হয়তো এমনটাই হবে। কিন্তু একত্রিত হওয়ার পর পরই যে প্রজন্ম দেশ পরিচালনা করবে, তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হবে না। অন্তত কয়েক দশক ধরে চলবে তাদের এই কষ্টকর যাত্রা। তাদের জন্য এই পরিবর্তনটা হবে নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। সামাজিকভাবেও বিভিন্ন ভাঙ্গন দেখা যাবে।
দুই কোরিয়া এক হবে এটা নিশ্চিতভাবে বললেও ঠিক কবে এক হতে পারে, সেই সময়টা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। এই কারণে একত্রীকরণ নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন। এটা হঠাৎ করে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। এই একত্রীকরণ প্রক্রিয়াটা হওয়ার কারণ হবে উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের কারণে শাসকদের পতন হওয়ায়। উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞরা এমনটাই ভেবে থাকেন। আর এই সংকটটা হয়তো এতটাই আকস্মিকভাবে হতে পারে যে, বিভিন্ন দেশের নেতারা এটা সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম থেকেই প্রথম জানতে পারবেন। কারণ এমনও হতে পারে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ও কূটনীতিকদের অনুমান অনুযায়ী সময়ের অনেক আগেই এটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই একত্রীকরণ পরবর্তী সময়ে দুই কোরিয়ার জনগণকেই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে কোরিয়া উপদ্বীপ নিয়ে চীনের অস্বস্তি থাকলেও এখানে মূলত দুই কোরিয়ার জনগণের সংকটগুলোই প্রাধান্য দেওয়া হবে।
প্রক্রিয়া হবে অনেক ব্যয়বহুল
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য সম্পন্ন দুটি সমাজকে এর আগে কখনো একত্রিত হতে দেখেনি দেখেনি বিশ্ব। দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপি যেখানে ১.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, সেখানে উত্তর কোরিয়ার মাত্র ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি উত্তর কোরিয়ার তুলনায় ৬০ গুণ বড়! আমরা নিকট অতীতে দুই জার্মানির একত্রীকরণের কথা চিন্তা করতে পারি। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে এতটা পার্থক্য ছিল না, যেটা দুই কোরিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায়। ষাটের দশকের শেষ ভাগ থেকে প্রায় প্রতিটি পূর্ব জার্মান পরিবারই পশ্চিম জার্মানির টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখতে পারত। দুই জার্মানির আত্মীয়দের মধ্যে যাতায়াত কিংবা চিঠি চালাচালি করাও নিয়মিত ব্যাপার ছিল।
কিন্তু দুই কোরিয়ার মধ্যে বিষয়টি সেরকম নয়। বেশিরভাগ উত্তর কোরীয় নাগরিকের দক্ষিণ কোরিয়ার জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। একজন সাধারণ উত্তর কোরীয় নাগরিকের দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে জানার উপায় কেবল দুটি- চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা মিষ্টি প্রেমের মেলোড্রামা সিরিয়াল, আর দেশটির ভয়াবহতা আর অন্ধকার দিক সম্পর্কে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা।
গত দুই দশক ধরে সম্ভাব্য অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনে কেমন অর্থ ব্যয় হতে পারে, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে এগুলো অনেকাংশে অনুমানমূলক। কারণ একে তো কবে এই একত্রীকরণ হতে পারে, তার নিশ্চয়তা নেই। তার ওপর উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়াও দুষ্কর। তাছাড়া এর সাথে জার্মানির একত্রীকরণকে তুলনা করে ধারণা করাও কার্যকর কিছু হবে না।
একত্রীকরণ কতটা ব্যয়বহুল হবে, তা নির্ভর করে এখানে ‘খরচ’ এর সংজ্ঞাটা কেমন হবে। এটা কি উত্তর কোরিয়ার জনগণের মাথাপিছু আয় সামসময়িক দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের মাথাপিছু আয়ের সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার খরচের কথা চিন্তা করে হবে, নাকি এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেখানে উত্তর কোরিয়ার জনগণদের মাথাপিছু আয় তুলনামূলক কম হলেও একটা সম্মানজনক অবস্থায় থাকবে? ধরা যাক, সেটা দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণদের তুলনায় অর্ধেক হবে। নাকি উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি দ্রুত উন্নতি করতে কেমন খরচ হবে, সেটা বিবেচনা করা হবে?
সব ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এসব গবেষণার ফলাফলও তাই বিভিন্ন অঙ্কের এসেছে। তবে একটা বিষয়ে সবাইই একমত, অবিভক্ত কোরিয়া গঠন করা অনেক ব্যয়বহুল হবে। গবেষণাগুলোর ফলাফল থেকে অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনে খরচ ধরা হয়েছে ০.২ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই খরচটা দক্ষিণ কোরিয়ার পকেট থেকেই দিতে হবে। সর্বনিম্ন খরচটিও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ।
এতে আদৌ কতটা উপকার হবে, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। দুই কোরিয়ার অর্থনীতির বিশাল পার্থক্য আংশিকভাবে বিমোচন করতেই অন্তত তিন দশকের বেশি সময় লেগে যাবে। এতে হয়তো সামরিক বাহিনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বাজেটের পরিমাণ কমাতে হবে। সর্বোপরি এতে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণের সমর্থন থাকাও জরুরি। কারণ অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনের খরচটা তাদের দেওয়া কর থেকেই নেওয়া হবে। এ কারণেই তরুণ প্রজন্মের দক্ষিণ কোরীয় নাগরিকদের কাছে অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনের ধারণাটি জনপ্রিয় নয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার নিয়ন্ত্রিত কোরিয়া ইন্সটিটিউশন ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের এক জরিপে দেখা যায় ২০-২৯ বছর বয়সী দক্ষিণ কোরীয়দের ৭২.১ শতাংশই অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে আগ্রহী নন। দক্ষিণ কোরিয়ায় চাকরির বাজারের সংকট আর ব্যয়বহুল জীবন ব্যবস্থার কারণে তারা উত্তর কোরিয়াকে টেনে আনা এক প্রকার বোঝা হিসাবেই মনে করেন। বয়স্কদের মাঝে এখনো একত্রীকরণের ধারণা জনপ্রিয় থাকলেও সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ কোরীয়দের মাঝে দিন দিন এর জনপ্রিয়তা কমছে।
সামাজিক সংকট
অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্র গঠনের পর বেশ কিছু সামাজিক সমস্যা দেখা যেতে পারে, যার হয়তো গ্রহণযোগ্য কোনো সমাধানও দেওয়া সম্ভব হবে না। কিছু সংকট নিয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া সম্ভব হলেও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেও অনেক সমস্যা দেখা যেতে পারে। আমরা যদি পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনগুলো খেয়াল করি, দেখা যাবে সেখানে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী নাগরিকরা। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন স্কুলশিক্ষক, প্রকৌশলী, শিল্প কারখানার দক্ষ কর্মজীবী ও সেবিকারা। তারা আশির দশকের শেষের দিকে মস্কো, প্রাগ আর বুদাপেস্টের রাস্তায় নেমে এসেছিলেন গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দাবি নিয়ে।
উত্তর কোরিয়ায় যদি শাসকদের পতনের জন্য এমন কোনো আন্দোলন হয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। উত্তর কোরিয়ার আন্দোলনেও হয়তো মধ্যবিত্তরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করবেন। তবে একত্রীকরণ হয়ে যাওয়ার পর উত্তর কোরিয়ার মধ্যবিত্তরা ‘মধ্যবিত্ত’ মর্যাদাটাই হারিয়ে ফেলবেন। তার মানে এই নয় যে উত্তর কোরিয়ার চিকিৎসকরা কিংবা সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকরা একত্রীকরণ পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের হারিয়ে ফেলবেন। একত্রীকরণ হওয়ার পর তাদের আয়ও বাড়বে। কিন্তু একই সাথে তারা দেখতে পাবেন তাদের দক্ষতাগুলো তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
উত্তর কোরীয়দের সাধারণত তাত্ত্বিক জ্ঞান ভালো থাকলেও ব্যাবহারিক জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা প্রবল। একজন মধ্যম মানের উত্তর কোরীয় প্রকৌশলী হয়তো তার দক্ষিণ কোরীয় সমকক্ষের তুলনায় ভালো ক্যালকুলাস হিসাব করতে পারেন। কিন্তু তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান সাধারণত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। উত্তর কোরিয়ার কোনো প্রকৌশলীর যদি কখনো নিউক্লিয়ার বা মিসাইল ডিজাইন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে তার হয়তো আধুনিক কম্পিউটার নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাই নেই। তিনি হয়তো ইংরেজিতেও দক্ষ না, রেফারেন্স বই নিয়েও হয়তো তার কোনো ধারণা নেই। উত্তর কোরিয়ার একজন গড়পড়তা প্রকৌশলীর পুরো চাকরিজীবন কেটে যায় ষাটের দশকের মরিচা ধরা যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে করতে। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানির একজন নিয়োগকর্তার কাছে এ ধরনের প্রকৌশলীর কোনো গুরুত্ব নেই।
নব্বই দশকে উত্তর কোরিয়ার দুর্ভিক্ষের সময়টাতে সেখানে যারা কাজ করেছেন, সবাই চিকিৎসকদের নিঃস্বার্থভাবে দক্ষতার সাথে কাজ করাকে প্রশংসা করে থাকেন। তারা ১৯৩০ এর দশকের যন্ত্রপাতি দিয়ে হৃৎপিণ্ডের জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু একত্রীকরণ পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থায় উত্তর কোরিয়ার চিকিৎসকরা দেখতে পাবেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নব্বই শতাংশ ওষুধ আর চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই।
স্কুল ও কলেজ শিক্ষকরাও অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবেন। জ্যামিতি বা জৈব রসায়নের মতো তত্ত্বীয় আর অরাজনৈতিক বিষয়ের শিক্ষকরা নিজেদের হয়তো মানিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু যারা মানবিক শিক্ষা শাখার শিক্ষকতা করছেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন হবে? উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস বিভাগের একজন গড়পড়তা শিক্ষক এমন সব ঘটনা নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছেন, যেগুলো আসলে ঘটেনি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৯ সালের ১ মার্চের বিদ্রোহে কিম পরিবারের নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকার কথা, কিংবা পেকদু পর্বতের ঢালে এক গোপন ক্যাম্পে কিম জং ইলের শৈশব কাটানোর কথা, যার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কোরিয়ার প্রকৃত ইতিহাস নিয়েও তাদের জ্ঞান অনেক সীমাবদ্ধ। ঐতিহ্যবাহী কোরীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা যা জানেন, তা মূলত ‘একটা সামন্ততান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি।’
এর সমাধান হিসাবে হয়তো তাদের পুনরায় শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা নিয়ে কথা উঠতে পারে। কিন্তু এটা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন হবে। পুনঃশিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ব্যয়বহুল হবে এবং এর জন্য অনেক সময়েরও প্রয়োজন হবে। কিছু সংখ্যক মেধাবী হয়তো দ্রুত নিজেদের অভিযোজিত করে ফেলতে পারবেন। কিন্তু বেশিরভাগ উত্তর কোরীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এটা সম্ভব হবে না। এটা ঠিক উত্তর কোরিয়ার সময়কার তুলনায় তাদের জীবনযাপনের মান নাটকীয়ভাবে উন্নত হবে। তারা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারবেন, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন, প্রতিদিন মাছ-মাংস খেতে পারবেন, সূর্যাস্ত উপভোগ করার সময় পাবেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরীয়রা এগুলো আগে থেকেই ভোগ করে আসছেন। তখন উত্তর কোরীয় মধ্যবিত্তরা দেখতে পাবেন অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে তাদের জীবনযাপনের মান নিম্ন শ্রেণির। বেশিরভাগের কাছে এটা অপমানজনক মনে হবে।
কিন্তু শুধু অভিজাত শ্রেণি বা তুলনামূলক অবস্থাসম্পন্নদের কথা চিন্তা করলেই হবে না। সাধারণ উত্তর কোরীয় নাগরিকদের কাছেও অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা হতাশাজনক হবে। তারা হয়তো কোরিয়া একত্রীকরণ দেখতে চাইবেন, এমনকি এর জন্য হয়তো লড়াইও করবেন। তারা মনে করবেন দ্রুতই তারা দক্ষিণ কোরীয়দের জীবনযাত্রার মানের কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে যাবেন। কিন্তু বিষয়টা মোটেও এমন হবে না। একত্রীকরণের পর তারা ব্যক্তি স্বাধীনতা উপভোগ করবেন। প্রিয় গান শুনতে পারবেন, যেখানে তাদের নেতাদের স্তুতি গাথা থাকবে না। কিন্তু খুব দ্রুতই তারা দক্ষিণ কোরীয়দের জীবনযাপনের সাথে নিজেদের তুলনা করা শুরু করবেন। সেখানে তাদের সাথে নিজেদের বিশাল পার্থক্য দেখে হতাশ হবেন।
খুব দ্রুতই তারা উপলব্ধি করবেন, তারা আসলে নিম্ন পারিশ্রমিকের অদক্ষ শ্রমনির্ভর কাজ ছাড়া কোনো কাজের জন্য যোগ্য নন। কিছু সংখ্যক হয়তো নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবেন। কিন্তু বেশিরভাগ উত্তর কোরীয়দের বাকি জীবন কাটাতে হবে মেঝে পরিষ্কার করে আর শ্রমিকের কাজ করে। তারা এটাকে তাদের প্রতি বৈষম্য হিসেবে দেখবেন। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করা শরণার্থীদের লক্ষ করলে বৈষম্যের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তথাকথিত এই বৈষম্যটা হবে উত্তর কোরীয়দের আধুনিক কর্ম ব্যবস্থা সম্পর্কে দক্ষতা বা পরিচিতি না থাকা। কিছু দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়তো এই অদক্ষ কিন্তু শৃঙ্খলিত সস্তা শ্রমিকদের সাদরে গ্রহণ করে নেবে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই এ ব্যাপারে একমত যে দক্ষিণ কোরিয়ার বর্তমান অর্থনীতির জন্য অদক্ষ শ্রমিকদের খুব একটা প্রয়োজন নেই।
অনেক উত্তর কোরীয় নাগরিকই তখন স্থান পরিবর্তন করে দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নত শহরগুলোতে চলে যাবে। শ্রমিকদের অভিবাসনের কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার অদক্ষ শ্রমিকরা চাকরি হারাতে পারে। দক্ষিণ কোরীয় গাড়ি চালকদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ কমে যেতে পারে। সাবেক দুই রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে আস্থা আর বিশ্বাসহীনতাও প্রকট আকারে দেখা যাবে। অনেকেই জড়িয়ে পড়বে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এতে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার যেসব অঞ্চলে দিনের আলো বা রাতের অন্ধকারে তুলনামূলক নিরাপদ পরিবেশ বজায় আছে, সেগুলো হয়তো আর এরকম নাও থাকতে পারে। উত্তর কোরীয় নারীদের অনেকেই পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
ভূমি সংক্রান্ত সংকট
উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে আসতে থাকা বিপুল সংখ্যক অভিবাসীদের কারণে হয়তো সামাজিক কিছু সংকট তৈরি হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সংকট তৈরি করবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে উত্তর কোরিয়ার দিকে যাওয়া তুলনামূলক কম সংখ্যক অভিবাসীরা। কোরিয়া বিশেষজ্ঞ ও জন্মসূত্রে পূর্ব জার্মান রুদিগার ফ্রাঙ্ক কোরিয়া উপদ্বীপের একত্রীকরণ প্রসঙ্গে বলেন,
যদি কখনো দুই কোরিয়া এক হয়ে যায়, তাহলে উত্তর কোরীয়দের কাছ থেকে দক্ষিণ কোরীয়দের রক্ষা করা আবশ্যক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে উত্তর কোরীয়দেরকে দক্ষিণ কোরীয়দের কাছ থেকে রক্ষা করা, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবসায়ীদের হাত থেকে।
প্রকৃতপক্ষে উত্তর কোরিয়ার ভূখণ্ড নিয়ে ব্যাপক আকারে সংকট দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে, যার মাঝে আছে ১৯৪৬ সালের ভূমি সংস্কার আইন। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার এই আইন কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি। চীনের জমিদারদের জমি সরকার যখন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়, তাদেরকে হয় হত্যা করে আদায় করে নেওয়া হয়, কিংবা জমিদাররা চুপচাপ সেগুলো মেনে নেন। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার জমিদাররা সেক্ষেত্রে ভাগ্যবান ছিলেন। তারা ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যান। কিন্তু তাদের হারানো জমির কথা ভুলে যাননি। উত্তর কোরিয়ায় থাকা ভূখণ্ডগুলোর তাত্ত্বিকভাবে বৈধ মালিকরা বর্তমানে হয়তো সিউলের কোনো এক জায়গায় বসবাস করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক পরিবারই এই মালিকানাগুলো দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মে সংরক্ষণ করে রেখেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে তাদের জমির দামও বেড়েছে। দক্ষিণ সিউল অঞ্চলের জমির দাম ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে কয়েক হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে (মূদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করে)। দক্ষিণ কোরীয়রা সম্ভাব্য শিল্প কারখানার কেন্দ্রের কথা চিন্তা করে উত্তর কোরিয়ার ভূমি দখল করতে এগিয়ে আসবে। ১৯৪৬ সালের সময় যাদের জমির মালিকানা ছিল, তারা উত্তর কোরিয়ার কৃষকদের তুলনায় অনেক ধনী ও ক্ষমতাধর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই তারা যদি জোর করে ভূমি দখল করতে চায়, তাদেরই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রতারণা ও জালিয়াতিমূলক কর্মকাণ্ড
একত্রীকরণ পরবর্তী কোরিয়ার আবাসন প্রকল্পে শুধু অনেক আগেই গত হয়ে যাওয়া জমিদারদের বংশধররা এসে ঝামেলা করবে না। উত্তর কোরিয়ার আবাসন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা দীর্ঘমেয়াদে বিপুল পরিমাণ লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বর্তমানে উত্তর কোরিয়ায় ছায়া আবাসন প্রকল্প চলমান থাকলেও বেশিরভাগ উত্তর কোরীয়দের আবাসন নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। যদি দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা সৌভাগ্যবান হন, তাহলে তারা উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের সাথে ছলনা করে তাদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো খুবই স্বল্প মূল্যে কিনে নিতে পারেন। শহুরে উত্তর কোরীয়রা যে দ্রতই নিজেদের প্রতারিত মনে করবেন, এতে কোনো সন্দেহ থাকে না। একত্রীকরণ নিয়ে তারা তখন আর খুব একটা উদ্যমী মনোভাব দেখাবেন না।
সমাজতন্ত্র পরবর্তী যুগে পূর্ব ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অঞ্চলগুলোতে আরেকটি সমস্যা দেখা যায়। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা ছিল অজ্ঞ কিংবা সাধাসিধে ধরনের। তাই তারা সহজেই দ্রুত ধনী হওয়ার প্রতারণার ফাঁদে পা দিত। পঞ্জি পিরামিড স্কিম ছিল তখন খুবই নিয়মিত ঘটনা। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ায় এমএমএম নামে একটি কোম্পানি পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে প্রায় ৫০ লক্ষ সাবেক সোভিয়েত নাগরিকের সঞ্চয়ের অর্থ হাতিয়ে নেয়।
এমএমএমের কারণে কিছুটা রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা যায়, কিন্তু এটা সমাজতন্ত্র পরবর্তী আলবেনিয়ার তুলনায় কিছুই ছিল না। আলবেনিয়ায় পঞ্জি স্কিমগুলো ৩০ লক্ষ জনগণের দেশটির এক-চতুর্থাংশ থেকে প্রায় অর্ধেক জনগণের কাছ থেকে ১.২ থেকে ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়, যা ছিল দেশটির বার্ষিক জিডিপির অর্ধেক। ১৯৯৭ সালে ব্যবসায় ধ্বস নামলে এই সংকট গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়, যাতে ৫০০ থেকে ১,৫০০ মানুষ মারা যায়। রোমানিয়াতেও এমন পঞ্জি স্কিমের ঘটনা ঘটে, তবে তা সহিংসতায় রূপ নেয়নি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে উত্তর কোরীয়রাও অবিভক্ত কোরিয়া রাষ্ট্রে এমন প্রতারণার সম্মুখীন হতে পারে। তারা তাদের অবস্থান অনুযায়ী চতুর হলেও আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করলে এখনো অনেক পিছিয়েই আছে। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াতে থাকা উত্তর কোরীয় ডিফেক্টরদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। এখানে উত্তর কোরিয়ার শরণার্থীদের প্রতি পাঁচ জনে এক জন প্রতারণার শিকার হন, যা পুরো দেশের নাগরিকদের গড় হিসাবের চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি। অবিভক্ত কোরিয়ায় তাই উত্তর কোরীয়রা সহজেই বহির্বিশ্ব থেকে আসা লোকদের প্রতারণার শিকার হবে, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা লোকদের দ্বারা। এটা তাদের একত্রীকরণ নিয়ে সুখকর অভিজ্ঞতা দেবে না।
সামরিক বাহিনীর পরিণতি
একত্রীকরণ পরবর্তী কোরিয়ায় সামাজিক পরিবর্তন উত্তর কোরিয়ার সবার জন্যই কঠিন অভিজ্ঞতা হবে এটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। তবে তাদের সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। উত্তর কোরিয়ার সেনবাহিনীতে প্রায় ১১ থেকে ১২ লক্ষ সদস্য আছে। বেশিরভাগ সদস্যই কেবল সৈনিক। তারা মূলত অবৈতনিক শ্রমিক, যাদের কিছু প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীতে তিন থেকে চার লক্ষ পেশাদার যোদ্ধাও আছেন, যারা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পুরোটা সময় নিম্ন প্রযুক্তির হত্যাকাণ্ডের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন। তারা হচ্ছেন স্পেশাল ফোর্স, পিয়ংইয়ং ডিফেন্স কমান্ড আর অন্যান্য এলিট স্কোয়াডের সদস্য।
একত্রীকরণ পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থার প্রতি তারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কারণ সারা জীবন সেনা সদস্য হিসাবে পার করে আসা সৈনিকদের বেসামরিক নাগরিকদের মতো সীমিত দক্ষতাগুলোও নেই। তারা তখন জুচে আদর্শ আর কিম পরিবারের কিংবদন্তিগুলোর মিথ্যা গল্প আর অসারতাগুলো দেখতে পাবেন। হঠাৎ করে এই সমাজ ব্যবস্থার পতন ঘটতে দেখা হয়তো তাদের জন্যও একটা ধাক্কা হয়ে আসতে পারে। তাদের কেউ কেউ হয়তো দারোয়ানের মতো নিম্ন আয়ের চাকরিতে ঢুকবেন। তবে বেশিরভাগই অপরাধ জগতের আকর্ষণীয় পথ বেছে নেবেন।