আকাশে ওড়ার চেষ্টা মানুষের জন্য নতুন কিছু নয়। কল্পনার ইকারাসের মোমের তৈরি ডানায় আকাশে ভাসা থেকে রাইট ভাতৃদ্বয়ের সত্যিকারের আকাশে ওড়ার মাঝে কেটে গিয়েছিল অনেক বছর। অথচ আকাশে উড়তে শেখার মাত্র কয়েক দশকের মাঝেই মানুষ পৌঁছে গিয়েছে মহাকাশে। মানুষের তৈরি মহাকাশযান আমাদের সৌরজগৎ ছেড়েও চলে গিয়েছে। কিন্তু মানুষের মহাকাশযাত্রার পথ মোটেও কোনো সহজ পথ ছিল না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাঁধা ছাড়াও প্রযুক্তিগত বাঁধার কারণে মহাকাশ যাত্রার অনেক পরিকল্পনাই সফলতার মুখ দেখেনি। এর বাইরেও ঘটে গেছে বেশ কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া কলম্বিয়া স্পেস শাটল দুর্ঘটনা সেরকমই একটি উদাহরণ। চলুন জেনে নেয়া যাক মহাকাশ যাত্রার ইতিহাসের অন্যতম বড় এই দুর্ঘটনার খুঁটিনাটি তথ্য।
শুরুর আগে
নাসার অরবিটাল ফ্লিটের প্রথম শাটল ছিল কলম্বিয়া। ১৯৮১ সালে প্রথমবারের মতো মহাকাশ যাত্রা করা কলম্বিয়ার নামকরণ হয়েছিল ১৭৯৬ সালে কলম্বিয়া নামের একটি জাহাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। সেই জাহাজটি কলম্বিয়া নদীর আশপাশের এলাকা আবিষ্কারের কাজ করেছিল। অ্যাপোলো-১১ মিশনের কমান্ড মডিউলের নামও ছিল কলম্বিয়া। স্পেস শাটল কলম্বিয়ার নামকরণের পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল সেই কমান্ড মডিউলটিও। ১৯৮১ সালের পর ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোট ২৭ বার মহাকাশে গিয়েছিল কলম্বিয়া। প্রতিবারই সফলতার সাথে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল। কিন্তু ২৮তম যাত্রাতেই আকাশে বিধ্বস্ত হয়ে মহাকাশ যাত্রার ইতি টানতে হয় কলম্বিয়াকে।
ধ্বংসের দিকে যাত্রা
২০০৩ সালে ১৬ জানুয়ারি ৭ জন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী নিয়ে ১৬ দিনের যাত্রা শুরু করে কলম্বিয়া। দলনেতা ছিলেন আমেরিকান বিমানবাহিনীর কর্নেল ও যন্ত্রপ্রকৌশলী রিক হাসবেন্ড। তার সাহায্যকারী হিসেবে ছিলেন ৫ জন আমেরিকান ও একজন ইসরায়েলি। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভূত কল্পনা চাওলাই কোনো সামরিক বাহিনীর নিয়মিত সদস্য ছিলেন না। বাকিরা সবাই বিমানবাহিনী কিংবা নৌবাহিনীর সদস্য ছিলেন।
তবে যাত্রা শুরুর আগে থেকেই যেন অশুভ কিছুর ইঙ্গিত ছিল কলম্বিয়ার শেষ যাত্রার দিকে। ১১ জানুয়ারি যাত্রা শুরুর কথা থাকলেও ১৮ বার বাতিল হয় যাত্রা। সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে শেষপর্যন্ত ১৬ জানুয়ারি মহাকাশে যাত্রা করে কলম্বিয়া। কিন্তু যাত্রা শুরুর মাত্র ৮২ সেকেন্ড পরেই স্যুটকেসের আকারের একটি রিফ্যাক্টরি ফোম খসে পড়ে আঘাত করে কলম্বিয়ার বাম পাখায়। যে মুহূর্তে ফোমটি আঘাত করে সে মুহূর্তে কলম্বিয়ার গতি ছিল বাতাসের গতির থেকেও প্রায় আড়াই গুণ বেশি, উচ্চতা ছিল ভূমি থেকে প্রায় বিশ কিলোমিটার উপরে।
তবে কলম্বিয়ার ফোম খুলে পড়ার ঘটনা সেবারই প্রথম ছিল না। এর আগেও বেশ কয়েকবার ফোম খুলে যাবার ঘটনা ঘটায় মিশনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেননি সেদিনের ঘটনায়। তবে পরের দিন উচ্চ রেজ্যুলেশনের ভিডিওতে দেখা যায় ফোমটির পাখায় আঘাত করা। ভিডিও থেকে আশঙ্কা করা হয় কলম্বিয়ার বাম পাখার তাপরোধক অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে ভিডিওতে পরিষ্কার বোঝা যায় নি পাখার ঠিক কোন অংশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
পাখার তাপরোধকের মূল কাজ থাকে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময়। বাইরে থেকে কোনো বস্তু পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করলে বাতাসের বিভিন্ন কণার সাথে ঘর্ষণে উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। এতে উচ্চ তাপের সৃষ্টি হয় যাতে মহাকাশযানের মূল ধাতব অংশ গলে যেতে পারে। কিন্তু তাপরোধক পদার্থ সেই তাপমাত্রা শোষণ করে মহাকাশযানকে রক্ষা করে। ফলে তাপরোধক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় নড়েচড়ে বসে নাসা কর্তৃপক্ষ।
নাসার ব্যবস্থাপনা ও প্রকৌশল দপ্তর নিজেদের ভেতর বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতার কারণে তারা বিপদের আশঙ্কা করেনি খুব বেশি। সম্ভাব্য বিপদের ব্যাপারে বেশ কিছু সিমুলেশনও চালায় তারা। কিন্তু পরিপূর্ণ তথ্য না থাকায় সেগুলো থেকেও বিপদের কোনো সম্ভাবনার কথা জানা যায়নি। তবে বিপদের কথা আশঙ্কা করে আমেরিকার নিরাপত্তা বিভাগ তাদের গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের সাহায্যে কলম্বিয়ার ছবি তোলার প্রস্তাব দেয় নাসাকে। কিন্তু নাসা তাদের প্রস্তাব নাকচ করে নিজেদের সিন্ধান্তেই অটল থাকে।
শুরুতে মহাকাশচারীদের ফোমের পাখায় আঘাত করার ঘটনা জানানো না হলেও পরবর্তীতে তাদের জানানো হয়। তবে নাসার মিশন ব্যবস্থাপকদের মতো তারাও বিপদের আশঙ্কা করেননি। কারণ তারাও আগে এরকম ঘটনার কথা শুনেছেন। ফলে ১৬ দিনের মিশন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ীই স্বাভাবিকভাবেই চালান মহাকাশচারীরা। কিন্তু অস্বাভাবিকতা শুরু হয় ১ ফেব্রুয়ারি, যেদিন কলম্বিয়ার পৃথিবীতে ফিরে আসার কথা ছিল।
১ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার পূর্ব উপকূলের সময় সকাল ৮টা ৪৪ মিনিটে কলম্বিয়া পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। প্রথম পাঁচ মিনিট স্বাভাবিকভাবেই নামতে থাকে পৃথিবীর দিকে। এরপর কলম্বিয়া প্রবেশ করে সর্বোচ্চ তাপ তৈরি হতে পারে এমন এলাকায়। এ এলাকাটি পার করাই ছিল সবচেয়ে বিপদজ্জনক। স্বাভাবিকভাবেই এ সময় অনেক বেশি তাপ উৎপন্ন হয়, যা সর্বোচ্চ ১,৬৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠতে পারে। ঠিক তিন মিনিট পর থেকে শুরু হয় অস্বাভাবিকতা। ভূমিতে থাকা পর্যবেক্ষকরা হঠাৎ কলম্বিয়ার লেজের দিক অতিরিক্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থেকে। কয়েক সেকেন্ড পরেই নাসায় অবস্থান করা মিশন পরিচালকরা কলম্বিয়ার বাম পাখার সেন্সরে গন্ডগোল খেয়াল করেন। এ সময় প্রথমবারের মতো সবাই সবচেয়ে খারাপ খবরের আশঙ্কা শুরু করেন। ৮টা ৫৯ মিনিট পর্যন্ত মিশন কন্ট্রোল থেকে কলম্বিয়ার সাথে যোগাযোগ থাকলেও হঠাৎ করে সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ধারণা করা হয়, এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই টেক্সাসের আকাশে বিধ্বস্ত হয় কলম্বিয়া।
কলম্বিয়ার ফিরে আসার সময় ও পথ আগে থেকেই জানা থাকায় স্থানীয় মিডিয়া ও জনগণের অনেকেই সাক্ষী হয়েছিলেন কলম্বিয়ার শেষ মুহূর্তগুলোর। পরিষ্কারভাবে দেখা না গেলেও টিভি ফুটেজে কলম্বিয়ার টুকরো টুকরো হয়ে পড়ার দৃশ্য ধরা পড়ে। ধারণা করা হয় ধ্বংস হবার শেষ পর্যন্ত মহাকাশচারীরা চেষ্টা করেছিলেন বাঁচার। কিন্তু মূল কেবিন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ায় কেবিনের চাপ কমে যেতে থাকে। আর এতেই অজ্ঞান হয়ে মারা যান মহাকাশচারীদের সবাই।
দুর্ঘটনার কারণ
দুর্ঘটনার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার সাথে সাথে মিশন পরিচালনা কক্ষের সকল দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। যান্ত্রিক ত্রুটি ছাড়াও ভূমিতে থাকা ক্রুদের ভুলের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তাই পুরো কক্ষটি একটি ক্রাইম সিন হিসেবে গণ্য হত। কান্নায় ভেঙে পড়া গ্রাউন্ড ক্রুদের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করারও ছিল না সেসময়। তবে পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায় পুরো ব্যাপারটিতে তাদের কোনো দোষ ছিল না। অল্প কথায় বলতে গেলে, দুর্ঘটনার কারণ ছিল ফোমের পাখায় আঘাত করা আর তার ফলে সৃষ্ট ক্ষত। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি আসলে এতটা সহজও ছিল না। নাসার একটি দল ভিডিও বিশ্লেষণ করে কলম্বিয়ার উড্ডয়নের মতো একটি বাস্তব সিমুলেশন তৈরি করেন। সেখানে দেখা যায় ফোমের আঘাতে প্রায় ১৬ ইঞ্চি ক্ষতের সৃষ্টি করে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় উচ্চ তাপমাত্রায় এত বড় ক্ষত নিয়ে কলম্বিয়ার টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
কিন্তু পুরো ব্যাপারটির শেষ এখানেই নয়। কারণ ভিডিও দেখার পরেও নাসার হাতে ছিল ১৫ দিন সময়। এ সময় তারা পূর্বাভিজ্ঞতার উপরেই বেশি জোর দিয়ে বিপদের সব সম্ভাবনা বাদ দিয়ে রেখেছিল। তাদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিরাপত্তা বিভাগের গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের সাহায্য না নেয়া। এতে হয়তো কলম্বিয়াকে রক্ষা করার সুযোগ থাকতো। কলম্বিয়াকে আরো কিছুদিন মহাকাশে রেখে ক্রুরা পাখার ক্ষতিগ্রস্থ স্থানটি মেরামত করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারার কারণে নাসার ব্যবস্থাপনা কমিটিকে কঠোর সমালোচনার শিকার হতে হয় এ দুর্ঘটনার জন্য। বহিষ্কার হওয়া ছাড়াও শাস্তি পান পুরো মিশনের পরিচালনায় থাকা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
প্রকৌশলগত দিক দিয়ে বলতে গেলে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের পর বাম পাখার ক্ষতিগ্রস্থ স্থানে তাপের কারণে চাপ (থার্মাল স্ট্রেস) বেড়ে যাচ্ছিল। এর ফলে অতিরিক্ত চাপে ধীর ধীরে বাম পাখার সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ফলে একসময় পাখার তাপ ও চাপ ধারণ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় এবং পুরো পাখাসহ মহাকাশযানটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
কলম্বিয়ার এ দুর্ঘটনাটি ছিল আমেরিকার মহাকাশ গবেষণার পথে একটি বড় ব্যর্থতা। পরবর্তী দুই বছরের জন্য আমেরিকা তাদের সব মহাকাশ কার্যক্রম বন্ধ রাখে। ফলে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে রসদ পাঠানো ও অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য আমেরিকাকে পুরোপুরি রাশিয়ার উপর নির্ভর করে থাকতে হয়। নাসা তাদের স্পেস শাটল কার্যক্রমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুরোপুরি পরিবর্তন করে যেন পরবর্তীতে এরকম দুর্ঘটনা না ঘটে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় মহাকাশচারীদের নিরাপত্তায়, যেন দুর্ঘটনা ঘটলেও তাদের জীবিত উদ্ধার করা যায়। তবে তাতে খুব বেশি লাভ হয়নি, কেননা ২০১১ সালে নাসা তাদের স্পেস শাটল কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। আর এর পেছনে মূল কারণ ছিল ২০০৩ সালে কলম্বিয়ার দুর্ঘটনা। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনে স্মরণ করা হয় কলম্বিয়ার সাত মহাকাশচারীদের, যারা হয়তো শেষ মুহূর্তের আগে জানতেনও না কী অপেক্ষা করছে পরের মুহূর্তগুলোতে।
ফুটনোটঃ
১. Final Report on Columbia Space Disaster, NASA. August 2003
২. M. Mahmud, A. Acharjee, A. Mahmud (2013) STUDY OF THREE CATASTROPHIC INCIDENTS
ফিচার ইমেজ- Nasa.gov