১৪৯২ সালে রিকনকুইস্টা বাহিনীর হাতে গ্রানাডার পতনের পর, ইউরোপীয় মুসলমানদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। মুসলিমদের ৭০০ বছরের শাসন প্রথা ভেঙে সেখানে জন্ম নেয় নতুন এক শক্তির। খ্রিস্টানরা স্পেনের শাসনভার দখল করে নেয়। মুসলিমরা মান-ইজ্জতের ভয়ে, দলে দলে আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলে চলে যেতে শুরু করে। সাইয়্যিদার পরিবারও সবার সঙ্গে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়। তাদের আশ্রয় হয় মরক্কোর একটি শহর তাঞ্জিয়ারে। একসময় পার্শ্ববর্তী তিতওয়ানের প্রশাসকের সঙ্গে বিয়ে হয় সাইয়্যিদার।
পরবর্তী সময়ে তার স্বামীর মৃত্যু হলে, তিনি তিতওয়ানের রানী হিসেবে আবির্ভূত হন। ক্ষমতায় আসার পরই সাইয়্যিদা মাতৃভূমির দিকে নজর দেন। একসময় যে খ্রিস্টানরা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেটার প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ এসেছে তার সামনে। তাই দ্বিতীয়বার না ভেবেই, ভূমধ্যসাগরের বুকে তরী ভাসালেন নিজের সেরা নৌ-কমান্ডারদের নিয়ে। রাতারাতি ইউরোপ জুড়ে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ‘এক নারী জলদস্যু’ তাদের জাহাজগুলো লুট করে নিচ্ছে! একসময় সাইয়্যিদার পরিচয় ঘটে, ইউরোপিয়ানদের ত্রাস বারবারোসা ভাতৃদ্বয়ের সঙ্গে। তাদের একের পর এক নৌ অভিযানে, ইউরোপিয়ানদের বাণিজ্যিক পথগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
ঘর ছেড়ে বহু দূরে
সাইয়্যিদা আল-হুররা স্পেনের তৎকালীন রাজধানী গ্রানাডায়, ১৪৮৫ থেকে ১৪৯০ এর ভেতর যেকোনো সময় জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম ‘লাল্লা আয়েশা বিনতে আলি ইবনে রশিদ আল-আলমি।’ তার বাবার নাম আলি ইবনে রশিদ এবং মায়ের নাম লাল্লা জোহরা ফার্নান্দেজ। সাইয়্যিদার বাবা ছিলেন গ্রানাডার একজন প্রভাবশালী গোত্রপতি। আর মা ধর্মান্তরিত মুসলিম। ১৪৯২ সালে স্পেনের রাজ্য অ্যারাগনের রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও ক্যাস্টিলের রানী ইসাবেলার সম্মিলিত আক্রমণে গ্রানাডার পতন ঘটে।
স্পেন থেকে মুসলিমদের বিতাড়িত করতে শুরু করেন তারা। বিতাড়িত হয়ে সাইয়্যিদার পরিবার তাঞ্জিয়ারের উপকূলবর্তী শহর শেফশাউনে চলে আসে। এই এলাকাটি পূর্বে আলি ইবনে রশিদের নৌঘাঁটি ছিল। গ্রানাডা থেকে চলে আসা মানুষদের আশ্রয় দিতে তিনি শহরটির সংস্কার করেন। এভাবেই শেফশাউন মানুষের কোলাহলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এখানে আসার পর সাইয়্যিদার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারের মেয়ে হিসেবে তিনি ধর্মতত্ত্ব, ভাষা, গণিত এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করেন। তার শিক্ষক ছিলেন খ্যাতিমান ধর্মীয় পণ্ডিত এবং স্থপতি আবদুল্লাহ আল-গাজনওয়ানি।
১৫০১ সালে সাইয়্যিদার বিয়ে হয় তৎকালীন তিতওয়ান প্রদেশের শাসক আবুল হাসান আল-মান্দারির সঙ্গে। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর। মান্দারি নিজেও গ্রানাডা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নিজ যোগ্যতাবলে তিতওয়ানের শাসক হিসেবে নিয়োগ পান। শেফশাউনের মতো তিতওয়ানও মুসলিমদের একটি দুর্গ ছিল। ১৪০০ সালের দিকে খ্রিস্টান রাজ্য ক্যাসটাইল তিতওয়ানের দুর্গগুলো ধ্বংস করে দেয়। কারণ, খ্রিস্টানদের বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে এই দুর্গ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হত। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর শহরটি আবার তৈরি করা হয়। ফলে, একসময় এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে শুরু করে।
বিয়ের পর সাইয়্যিদাকে যথেষ্ট সম্মান করতেন তার স্বামী। স্বামীর সংস্পর্শে এসে তাই সাইয়্যিদা নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পান। রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারগুলো সহজেই শিখে নেন তিনি। স্ত্রীর গুণে মুগ্ধ হয়ে মান্দারি অল্প সময়ের মাঝে, সাইয়্যিদাকে তিতওয়ানের রানী হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৫১৫ সালে স্বামী আল-মান্দারি মৃত্যুবরণ করেন।
ফলে রাজ্যে নতুন প্রশাসক নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এই দায়িত্ব পালন করার মতো যোগ্য কেউ না থাকায়, রাজ্যের শাসনভার সাইয়্যিদা নিজের হাতে নিয়ে নেন। সদ্য স্বামী হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠা সাইয়্যিদার সামনে এটা নিজেকে মেলে ধরার দারুণ একটা সুযোগ ছিল। সেই সুযোগটাই তিনি গ্রহণ করলেন।
এক নারী নৌ সেনাপতির উত্থান
শাসনভার গ্রহণ করার পর তার নতুন পদবি দেওয়া হয়। ‘সাইয়্যিদা আল-হুররা’, যার অর্থ সার্বভৌম স্বাধীন রানী। কিংবা ‘হাকিমিত তিতওয়ান’ নামেও পরিচিতি পান তিনি। সেই সময় মুসলিম রাজ্যগুলোতে শাসক হিসেবে নারীদের সচরাচর দেখা যেত না। কিন্তু সেদিক থেকে সাইয়্যিদা ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি নিজে যোগ্য ছিলেন এই পদের জন্য। তাছাড়া আভিজাত্যের রক্তও বইছিল তার শরীরে। সব মিলিয়ে তার ক্ষমতায় আরোহণ, সে অঞ্চলের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
শাসক হিসেবে ক্ষমতা লাভের পর, সাইয়্যিদা নিজের পুরনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে শুরু করেন। স্পেন থেকে তাদের বিতাড়িত করার দুঃসহ স্মৃতি এতদিন তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণ করার মতো সুযোগ কখনো আসেনি তার সামনে। তবে প্রথাগত যুদ্ধে খ্রিস্টানদের পরাজিত করা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। কিন্তু, ইউরোপিয়ানদের বাণিজ্যিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া সহজতর ছিল।
তাই শত্রুবধের সুযোগ আসতেই উঠেপড়ে লাগলেন তিনি। নিজের সেরা নৌ কমান্ডারদের ডেকে পাঠালেন। তাদের সমন্বয়ে শক্তিশালী একটি নৌবাহিনী গঠন করলেন। সমুদ্রে লড়াই করার জন্য তৈরি করা হলো বিশালাকার সব জাহাজ। তারপর, সেই সময়ের ভূমধ্যসাগরে খ্রিস্টানদের ত্রাস বারবারোসা সহোদরদের কাছে শুভেচ্ছাদূত পাঠালেন।
বারবারোসা ভাতৃদ্বয় অটোমান সুলতানের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা পেতেন। তাদের কাজ ছিল ভূমধ্যসাগরে খ্রিস্টানদের বাণিজ্যিক পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া। কারণ পথগুলো ব্যবহার করে, স্পেনীয় এবং পর্তুগিজরা মধ্যপ্রাচ্য আর ভারতবর্ষে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার করেছিল। এই পথগুলো বন্ধ করতে পারলে খ্রিস্টানদের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
দুই ভাই এর মধ্যে অরুচ, স্পেন থেকে বিতাড়িত মুসলিমদের নিরাপদে আফ্রিকান দেশগুলোতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে সাইয়্যিদার পরিবারও ছিল। সে সূত্র ধরে তিনি বারবারোসা ভাইদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। তারাও সানন্দে রাজি হলেন এই প্রস্তাবে। চুক্তি অনুসারে, বারবারোসা ভাতৃদ্বয় ভূমধ্যসাগরের পূর্ব দিকে অভিযান পরিচালনা করবে। আর সাইয়্যিদার নৌবহর পশ্চিমের দখল নেবে।
সমুদ্রে অভিযান শুরুর অল্প সময়ের মাঝে, ইউরোপিয়ানদের ভেতর সাড়া ফেলে দেয় তার বাহিনী। এই নৌবাহিনীর মূলমন্ত্র ছিল, খ্রিস্টান বাণিজ্যিক জাহাজগুলোতে অতর্কিত হামলা চালানো। তারপর নিরাপদে সেখান থেকে প্রস্থান করা। এই বাহিনীর সঙ্গে অসম এক লড়াই চলতে থাকে ইউরোপিয়ানদের। পুরো ইউরোপজুড়ে মানুষের মুখে-মুখে প্রচার হতে থাকে,
“এক নারী জলদস্যু ভূমধ্যসাগরে লুটপাট চালাচ্ছে।”
অনেক ইউরোপিয়ান শাসকই সাইয়্যিদার মৃতদেহ তাদের জাহাজের মাস্তুলে বেঁধে রাখার স্বপ্ন দেখতেন। তবে সেটা কেবলই কল্পনা! কারণ, সাইয়্যিদা কখনও নিজে সমুদ্রে অভিযানে বের হননি। সেটার প্রয়োজনও ছিল না তার। একে তো তিনি ছিলেন তিতওয়ানের এক ধনী শাসক। ফলে অর্থ-সম্পদের প্রতি তার অতিরিক্ত কোনো মোহ ছিল না। খ্রিস্টানদের জাহাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি নিজ শহরকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
অন্যদিকে, তখন তিতওয়ানের নিজস্ব কোনো নৌবাহিনীও ছিল না। এই প্রতিশোধ মিশনের বদৌলতে তাদের নৌবাহিনীও গঠন হয়ে গেলো। পূর্বদিকে বারবারোসা ভাতৃদ্বয় আর পশ্চিমে সাইয়্যিদার নৌবাহিনীর নিয়মিত আক্রমণে, ইউরোপীয়দের বাণিজ্যিক যোগাযোগ একেবারে ভেঙে পড়ে।
ক্ষমতার চূড়া থেকে আকস্মিক পতন
ইউরোপ কিংবা আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে সাইয়্যিদা আল-হুররার শক্ত প্রভাব বলয় তৈরি হয়েছিল। যা দেখে উত্তর মরক্কো’র শাসক আহমদ আল-ওয়াত্তাসি সাইয়্যিদাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠান। মূলত এই প্রস্তাব যতটা না আনুষ্ঠানিক, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ছিল। শক্তিশালী দুই রাজ্যের এই বন্ধনের প্রয়োজনীয়তা সাইয়্যিদাও বুঝতে পারছিলেন। ফলে তিনি ওয়াত্তাসির প্রস্তাবে রাজি হন। তাদের বিয়ের দুই বছর পর ১৫৪২ সালে, নিজের জামাতার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিতওয়ানের রাজত্ব হারান এই নারী শাসক।
মূলত এ ষড়যন্ত্র ছিল ইউরোপিয়ানদের। তারা সামরিক দিক থেকে ব্যর্থ হয়ে, আফ্রিকা জুড়ে কূটনৈতিক জাল বিছিয়ে দেয়। যে ফাঁদে পা দিয়ে আফ্রিকার অনেক রাজ্যে অশান্তি আর ভাঙন তৈরি হয়। সেটা ভিন্ন এক গল্প।
ক্ষমতা হারানোর পর সাইয়্যিদাকে শেফশাউনে নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ২০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটান। এ অবস্থাতেই ১৫৬১ সালে শেফশাউনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার মৃত্যুর পরও বেশ কিছু সময় ধরে, ভূমধ্যসাগরে তার নৌবাহিনীর প্রভাব বজায় ছিল। অবশেষে পর্তুগীজরা এই নৌবাহিনীকে ধ্বংস করে দেয়। সাইয়্যিদা আল-হুররার ক্ষমতা হারানো, কিংবা মৃত্যুর পরও তিনি মরক্কোর মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাননি। বরং নিজ রাজ্যের মানুষদের প্রতি তার ভালোবাসাই, তাকে জায়গা করে দিয়েছে সকলের মনে। এভাবেই এত শতাব্দী পর এসেও সাইয়্যিদা আল-হুররা মরক্কোর আকাশে জ্বলজ্বলে এক সন্ধ্যাতারা হয়ে আছেন।