কৌতূহলের সীমানা ছুঁয়ে দেখতে একদিন মানুষ নেমে পড়েছিল বিশ্বের পথে। কেউ কেউ আবিষ্কার করেছিল মহাদেশ, নতুন জাতি, হাজার বছরের পুরোনো কোনো গল্প কিংবা অদ্ভুতূড়ে কোনো প্রাণী। আর কেউ কেউ নিজের অভিযান ও আবিষ্কারের গল্পে মিশিয়েছিল কল্পকথার নানা উপাদান। এরকম কিছু মিথ্যা আবিষ্কার সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো এখানে।
১. সোনার শহর
আমেরিকার প্রথমদিকের আবিষ্কারকদের অনেকেই এসেছিলেন স্পেন থেকে। একদম শুরুর দিকের আবিষ্কারকদের একজন ছিলেন হার্নান কর্টেস। তিনি অ্যাজটেক (মেক্সিকো)-এ গিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের খুন করার মাধ্যমে তাদের ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফেরেন। দিকে দিকে গুজব রটে গেল হার্নান খুঁজে পেয়েছেন পুরোপুরি সোনার তৈরি এক শহর। তার মানে নতুন খুঁজে পাওয়া এই মহাদেশের কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে এমন অদ্ভুত এক শহর! এসব গল্প শুনে স্পেনের রাজা আরো বেশি করে আবিষ্কারকদের আমেরিকার দিকে পাঠাতে লাগলেন। কিন্তু তারা সেখানে খুঁজে পেল দরিদ্র আদিবাসীদের গ্রাম। বাস্তবতা বুঝতে পেরে আবিষ্কারকরা একসময় হতাশ হয়ে দেশে ফিরে আসে। তারপরেও এল ডোরাডো বা হারানো শহরের গল্পগুলো মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়নি। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বলেছেন এল ডোরাডো কখনোই কোনো শহরের নাম ছিল না, বরং এটি একটি প্রথার নাম, যেখানে নতুন রাজা সিংহাসনে ওঠার সময় সারা গায়ে স্বর্ণের গুড়া মেখে স্বর্ণের অর্ঘ্য দিতেন।
২. দক্ষিণ আমেরিকার দৈত্য
সর্বপ্রথম নৌ-পথে বিশ্বভ্রমণ করা ফার্দিনান্দ ম্যাজেলান বলেছিলেন, তিনি এমন এক জাতিকে দেখেছেন যারা উচ্চতায় সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক লম্বা। স্থানটি ছিল বর্তমান আর্জেন্টিনা। জাতিগতভাবে অনেকেই একটু বেশি লম্বা হয়ে থাকে, কিন্তু ফার্দিনান্দের নাবিকেরা বলেছিল তাদের দেখা লোকেরা লম্বায় ছিল ৩ মিটার বা দশ ফুটের মতো! এরপর অন্যান্য আবিষ্কারকেরাও দাবি করতে লাগলো তারাও এমন দৈত্য দেখতে পেয়েছেন।বাইবেলে বলা ছিল এমন এক দৈত্যাকার জাতির কথা, ফলে নিজেদের বিশ্বভ্রমণকে সত্য প্রমাণ করতে আবিষ্কারকেরা প্রায়ই নিজেদের গল্পে এসবের মিশেল আনতেন। মানুষ এসব বিশ্বাসও করে নিতো সহজে! গল্পটির মাঝে হয়তো আংশিত সত্যতা থাকতে পারে। তারা হয়তো দীর্ঘকায় এক জাতির দেখা পেয়েছিলেনও, কিন্তু তারা ইচ্ছেমতো সেসব জাতির উচ্চতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
৩. অনন্তযৌবনের ফোয়ারা
ফোয়ারার জলে ডুব দিয়েই অশীতিপর বৃদ্ধ হয়ে গেলেন টগবগে তরুণ- এমন গল্প পাওয়া যায় রূপকথাতেই। কিন্তু অনেক আবিষ্কারক দাবি করেছিলেন সত্যিই আছে এমন ঝর্ণা, যার পানিতে গোসল করলে যৌবন ফিরে পায় মানুষ। এমনকি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও বিশ্বাস করতেন তিনি আরোগ্য দেয়া নদী আবিষ্কার করেছেন। জোয়ান পন্স ডি লিওন এর ফোয়ারার খোঁজ সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর ছিল। তিনি ক্যারিবিয় দ্বীপ বিমিনিতে এমন ফোয়ারার সন্ধান পান। কিন্তু জোয়ান পরে ফোয়ারার চেয়ে স্বর্ণের উপর বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। সোনা, ফোয়ারা কোনোটাই না পেয়ে উত্তরের দিকে গিয়ে ফ্লোরিডা আবিষ্কার করেন। বিমিনিতে পর্যটকদের আকর্ষণ একটি স্থানের নাম এখনো ‘ফাউন্টেন অব ইয়ুথ‘। তবে সেটি একটি সাধারণ খনিজ পানির ঝর্ণা।
৪. জলপরী অথবা মৎস্যকন্যা
ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে বিখ্যাত বনে গেলেও তার ভ্রমণকালের অনেক গল্প কিন্তু বিতর্কিত। ১৪৯২ সালে তিনি সাগরের পানিতে জলপরী দেখার দাবী করেন। জন স্মিথ নামের আরেকজনও একই দাবি করেন। তাদের দুজনের মতেই জলপরী তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর নয়। তারা দেখতে অনেকটা সমুদ্র-গাভীর মতো। এছাড়াও অনেক নাবিক অনেক সময়ে সমুদ্রে জলকন্যা দেখেছেন বলে দাবী করেছেন। গ্রিক ও রোমান উপকথায় মৎস্যমানবের উপস্থিতির কারণে মানুষ সহজেই জলপরী দেখার গল্পগুলো বিশ্বাস করতে থাকে। স্কটিশ আর ওয়েলশরা বিশ্বাস করতো সাগর থেকে জলপরীরা উঠে এসে পুরুষদের বিয়ে করে। মধ্যযুগে সত্যিকারের সামুদ্রিক প্রাণীদের সাথে জলপরীরাও নথিভুক্ত হয়েছিল।
৫. মিটলা, কুকুর নাকি বিড়াল
আমাজন বনকে মানচিত্রে আবদ্ধ করার জন্য পার্সি ফসেট আমাজনের আর সব প্রাণীদের তালিকায় যোগ করলেন তার আনকোরা আবিষ্কার মিটলাকে। এর বৈশিষ্ট্য কিছুটা কুকুরের মতো আর কিছুটা বিড়ালের মতো। ফসেটের বলা অনেকগুলো প্রাণী সত্য হিসেবে থাকলেও, কোনো ছবি বা প্রমাণ না থাকায় মিটলাকে আজ পর্যন্ত কল্পনা বলেই ধরে নেয়া হয়। ফসেটের পর অনেকেই মিটলাকে দেখেছেন বলে দাবি করেন। কিছু বর্ণনায় মিটলা হলো ছোট কানের খর্বাকৃতির কুকুরবিশেষ, আবার কারো মতে মিটলা এক বড়সড় বিড়াল।
৬. কার্টিয়ারের ধোঁকা
রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের নির্দেশে ফরাসী জ্যাকুইস কার্টিয়ার কানাডা গেলেন। উদ্দেশ্য কানাডা থেকে এশিয়া যাওয়ার সোজা পথ বের করা। কার্টিয়ার কানাডা থেকে ফেরার পর তার দেয়া রিপোর্টে রাজা এতই খুশি হলেন যে সেটেলার সহ আরো অনেক আবিষ্কারকদের পাঠিয়ে দিলেন নতুন এই বিশ্বে অর্থাৎ এশিয়াতে উপনিবেশ গড়তে। কিন্তু উপনিবেশকারীরা গিয়ে দেখলো কার্টিয়ারের বলা হীরা-জহরতের গল্প একেবারেই বানোয়াট। তাছাড়া স্থানীয়রাও উপনিবেশকারীদের সম্পর্কে বৈরী ধারণা পোষণ করতো। দ্রুতই এই স্থান ত্যাগ করে ফিরে যায় উপনিবেশকারীরা। ফ্রান্সিস এসব জানার পর কার্টিয়ারকে আর কোনো ভ্রমণে পাঠাননি।
৭. মাদাগাস্কারের মানুষখেকো গাছ!
নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড পত্রিকার প্রতিবেদক এডমুন্ড স্পেনসার একবার একটি গল্প লিখেন। গল্পটি ছিল একটু অন্য ধাঁচের। গল্পে প্রতিবেদক এক আবিষ্কারকের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, যিনি মাদাগাস্কার ঘুরে এসেছে। সেখানে নাকি তিনি দেখেছেন দানবীয় এক গাছ খেয়ে ফেলেছে এক তরুণীকে। গল্পটি এমনভাবে লেখা ছিল যে সত্য বলে ভ্রম হয়। যদিও এটি ছিল নেহাতই লেখকের কল্পনা। এই গল্প অনেকগুলো পত্রিকায় ছাপা হলো। অনেক মানুষ একে সত্য প্রতিবেদন বলে ধরে নিল। সত্য বলে ধরে নেয়া লোকদের মাঝে ছিলেন দুজন অভিযাত্রী চেজ সালমন অসবর্ন ও মট হার্স্ট। এই গাছের সন্ধান করতে করতে তারা মাদাগাস্কার পৌঁছে গেলেন। স্থানীয়রাও উৎসাহ দিতে লাগল এই গাছ সত্যিই আছে বলে। বলাই বাহুল্য, তাদের এই অভিযান সফল হয়নি।
৮. আরিজোনাতে প্রাচীন মিশরীয়রা
১৯০৯ সালে জি ই কিনকেইড গ্রান্ড ক্যানিয়ন সফর করেন। তিনি দাবি করেন, এমন একটি স্থান তিনি খুঁজে পেয়েছেন যেখানে চারদিকে ছড়িয়ে আছে নানারকম হস্তশিল্প, পোশাক, বাসনকোসন আর অস্ত্র। তার বর্ণনানুসারে এসব জিনিসের একটিও আরিজোনার অধিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসের সাথে মেলে না। এগুলো বরং মিশরীয় বা এশীয়দের সাথে মিলে। তার এই আবিষ্কারের গল্পে সাড়া পড়ে যায় চারদিকে। তাহলে কি মধ্যপ্রাচ্য বা এশীয়রা হাজার বছর আগে পদচিহ্ন রেখেছিল আমেরিকাতে? কিন্তু কিনকেইড যাওয়ার আগেই জন ওয়েসলি পাওয়েল ও তার দল খুব ভালোভাবে গ্রান্ড ক্যানিয়ন চষে ফেলেছিলেন। তাদের অভিযানে এমন কোনোকিছু পাননি তারা।
৯. ক্রোকার ল্যান্ড
আর্কটিক খুঁজে পাওয়া অভিযাত্রীদের একজন ছিলেন রবার্ট প্যারি। অন্য অভিযাত্রীদের সাথে তার আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় অমিল হলো তিনি ভিন্ন একটি মহাদেশ খুঁজে পাওয়ার দাবী করছিলেন। তার দাবী অনুযায়ী এলস্মেয়ার দ্বীপের কাছে তিনি একটি বিশাল ভূখণ্ড পান। তার অভিযানের অর্থদাতা জর্জ ক্রোকারের নামে এর নাম রেখেছিলেন ক্রোকার ল্যান্ড। যেহেতু তিনি উত্তর মেরু আবিষ্কারকদের মাঝে একজন ছিলেন, তাই তার কথা ফেলবার মতো ছিল না। কিন্তু মানুষ যখন আকাশে নিয়ে উড়তে শিখলো তখন এমন কোনো ভূখণ্ডের সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউ কেউ বলেন প্যারি ভুল দেখেছিলেন। আবার কেউ বলে থাকেন, নিজের বিফলতাকে ঢাকতে মিথ্যা আবিষ্কারের গল্প বলেছেন।
১০. এন্টার্কটিকার পিরামিড
সম্প্রতি একদল ভ্রমণকারী কিছু ছবি দেখিয়ে দাবি করেছেন এন্টার্কটিকাতে তারা পিরামিড আবিষ্কার করেছেন। অনেকেই ছবিগুলোকে বানোয়াট বললেও স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি এই পিরামিড আকৃতির বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করে। কিন্তু গবেষকদের দাবি এগুলো পিরামিড নয় বরং বরফে ঢাকা পুরাতন পাহাড়। একদল বলছে এই আকৃতির পাহাড় থাকা অসম্ভব। একজন গবেষক ব্যাখ্যা করেছেন বরফ ধ্বসের কারণে ধীরে ধীরে পাহাড়গুলো মসৃণ পিরামিডীয় আকার নিতে পারে।
ফিচার ছবি- The Epoch Times