১৮৭৯ সাল। স্যান ডি সাওতোলা ঘুরতে বেরিয়েছেন ছোট্ট মেয়ে মারিয়াকে নিয়ে। কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়? আচ্ছা কেমন হয় যদি মেয়েরও সময় কাটে আর নিজের পছন্দের কাজটাও হয়ে যায়? সাওতোলা ছিলেন শখের প্রত্নতাত্ত্বিক। অগত্যা তার বর্তমানের শখের গুহাটিকেই অবসর কাটানোর জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন। গুহাটিতে কিছুদিন হল খননকাজ শুরু করেছেন। হাড়গোড়সহ প্রাচীন যুগের অনেক কিছু খুঁজে পেয়ে গুহাটি সম্পর্কে আগ্রহ আরও বেড়েছে। এই গুহার সন্ধান পাওয়া আবার আরেক গল্প। ১৮৬৭ সালের এক দিনে মোদেস্তো কুবিলাস পোষা কুকুরকে নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ করে কোথায় যেন ছুটে গেল কুকুর। কুকুরটিকে পাওয়া গেল ঝোপঝাড়ের পেছনে প্রায় লুকিয়ে থাকা এক গুহার ভেতরে। কুবিলাসের পরিচয় ছিল সাওতোলার সাথে। সাওতোলা আরো সাত বছর পর ১৮৭৫ সালে গুহাটিকে দেখতে গেলেন। ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়া পাথরে ঢেকে ছিল গুহার মুখ। খনন শুরু করলেন ১৮৭৯ সালে। আজও নিবিষ্ট মনে কাজ করছিলেন। মেয়ে মারিয়াও খেলছিল নিজের মতো। সাওতোলার চমক ভাঙলো মেয়ের চিৎকারে। ‘মিরা পাপা! বুয়েইস পিনতাদোস!’( দেখ বাবা! ষাঁড়ের ছবি!) মেয়ের আঙুল নির্দেশ করছিল ছাদের দিকে। বিস্ময়ে বিমূঢ় সাওতোলা কোনোরকমে উচ্চারণ করলেন– “নো সন বুয়েইস, সন বিসন্তেস” (ষাঁড় নয়, বাইসন!) আর তিনি খুব ভালোমতোই জানতেন ইতিহাসে স্পেনে কখনো বাইসন বাস করেনি। এই ছবি একমাত্র প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর যুগ ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়। এভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিল অন্যতম সুন্দর গুহাচিত্রের গুহা আলতামিরা।
উনিশ শতক এমন একটি শতাব্দী যখন ইউরোপীয়রা নিজেদের পূর্বপুরুষ ঠিক কবে থেকে উন্নতির পথ ধরেছিল, কবেই বা তারা এসেছিল ইউরোপে, আর আদৌ তারা বুদ্ধিমান ছিল নাকি এসব তর্কে মশগুল ছিল। কারো কারো ধারণা ছিল এই সভ্যতা একেবারেই নতুন। আলতামিরার আবিষ্কার বিতর্কের পালে নতুন হাওয়া দিল। এই অদ্ভুত সুন্দর ধাঁচের শিল্পচেতনা সম্পন্ন প্রস্তর মানব কিছুতেই হেলাফেলার নয়। আবার তার শিল্পচেতনাই হয়ে দাঁড়ালো তার অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিতর্কের সুযোগ। সাওতোলা যেহেতু নিজে প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন, তার ধারণা ছিল এসব চিত্র প্রস্তরযুগের। ১৮৮০ সালে ইউরোপজুড়ে গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হতে থাকায় বুকে বল পেলেন তিনি। সব বর্ণনা লিখে ফেললেন খাতায়। নিজ খরচে বই বের করলেন। কিন্তু কপালটাই খারাপ ছিল তার। ইউরোপে তখন আবিষ্কৃত বাকি গুহাগুলোর ছবির শিল্প দক্ষতা আলতামিরার ধারেকাছে দিয়েও যায় না। প্রথমে কাঠকয়লার কালি দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়েছে পুরো ছবি। তারপর হেমাটাইট আকরিক দিয়ে রঙ করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গার রঙ চেঁছে উঠিয়ে ফেলে ঔজ্জ্বল্য ইচ্ছাকৃতভাবে কমানো, আবার কিছু কিছু স্থান হাইলাইট করা। সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুক চলচ্চিত্রের মনমোহন বাবুর কথা মনে আছে? চলচ্চিত্রে তিনি টুকিটাকি আঁকাআঁকি করতেন। আলতামিরার গুহাচিত্র দেখে তিনি ঠিক করেছিলেন জীবনে আর যা-ই হন, চিত্রশিল্পী হবেন না। কারণ প্রস্তর যুগের মানুষেরা যে শিল্পের নিদর্শন রেখে গেছে, সেই সীমানাকে ছোঁয়ার যোগ্যতা তার কখনো হবে বলে তিনি মনেই করেন না। এই অংকনশৈলী যে প্রস্তর যুগের কারোর, তা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না বিশ্ব। তাই সাওতোলাকে শুনতে হল ‘ভন্ড’ অপবাদ। বিশেষজ্ঞরাও পাতার পর পাতা লিখে গেলেন তার বিরুদ্ধে। ফরাসী গবেষক গ্যাব্রিয়েল ডি মর্টিলেট ও এমিল কার্টেইলহ্যাক ১৮৮০ সালে লিসবনের ‘প্রাগৈতিহাসিক কংগ্রেস’ এ এই আবিষ্কারের তীব্রনিন্দা করেন। এ কারণে অধিকাংশ মানুষই সাওতোলাকে বানোয়াট ভাবছিলেন। এই গবেষকরাই আবার ১৯০২ সালে নিজেদের ভুল স্বীকার করে নেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেচারা সাওতোলা মারা গেছেন, দেখে যেতে পারেননি নিজের আবিষ্কারের প্রতিষ্ঠাটুকু।
আলতামিরার গুহাতে
উত্তর স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়াতে আন্তিয়ানা দেল মার গ্রামের অদূরেই এই গুহাটি। ২৭০ মিটারের এই গুহাকে মোটামুটি তিনটি চেম্বার বা কক্ষে ভাগ করা যায়। প্রথমটি ‘পলিক্রোম বা ফ্রেসকোর চেম্বার’, ‘দ্বিতীয়টি বেসিন বা গর্ত চেম্বার’ শেষটিকে বলে ‘ঘোড়ার লেজ’। এককালে এই গুহার প্রবেশদ্বার ছিল ২০ মিটার আর উচ্চতা ৬ মিটার। বিশাল এই প্রবেশপথ প্রস্তরমানবকে নিয়ে যেত সূর্যের আলোয় আলোকিত বড় একটা হলের দিকে। হয়তো তারা থাকতো সেখানে। প্রবেশদ্বারের পরেই হলঘরটি হল প্রধান গ্যালারি। বেশিরভাগ ছবিই এখানে। গুহার ছাদটা এখানে এত নিচু বলেই হয়ত শিল্পীরা এঁকেছিলেন দেয়াল জুড়ে। শত শত ছবির মধ্যে বাইসন, হরিণ, বন্য শূকর প্রধান। আরো আছে অর্ধ মানবের ছবি।
শেষের দিকে সরু ঘোড়ার লেজে আছে দুর্বোধ্য জ্যামিতিক অঙ্কন। এখানে আঁকা আছে মূলত তিন ধরনের ছবি। চারকোল আর রঙ দিয়ে আঁকা জন্তুর ছবি, জ্যামিতিক অঙ্কন আর কিছু খোদাই। কিছু কারণে আলতামিরার অঙ্কনগুলো বিশেষত্ব পেয়েছে সেগুলো হল, একটি ছবিতে এতগুলো রঙের ব্যবহার এই যুগের মানুষের জন্য অভাবনীয়। লোমের পুরুত্ব, রঙের ঔজ্জ্বল্যের উপর নির্ভর করে রঙের আস্তরণে পার্থক্য এনে জীবন্ত করা হয়েছে প্রাণীগুলোকে। আর ঐ যুগে প্রাকৃতিক ক্যানভাসের এত চমৎকার ব্যবহার খুব কম গুহাতেই দেখা গেছে। অবাক হতে হয়, কিছু ছবি আঁকা হয়েছে স্প্রে ব্যবহার করে। যে সে স্প্রে নয়, জীবজন্তুর হাড়ের ভেতর রঙ দিয়ে অন্য দিকে মুখ লাগিয়ে ফু দিয়ে স্প্রে তৈরি করা হত। মস, চুল, লোম অথবা আস্ত রঙ হাতে ধরে আঁকা ছবিও কিছু আছে।
চিত্রের বয়স বিচার
গুহাচিত্রগুলোকে নিয়ে প্রথম গবেষণা করেছিলেন ফরাসি প্রস্তরযুগ বিশেষজ্ঞরা। কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে চিত্রগুলোকে পরীক্ষা করে তারা জানিয়েছিলেন এগুলোর বয়স কমসে কম ১৪-১৭ হাজার বছর। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কিছুই বলতে পারেননি তখন। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম থোরিয়াম পদ্ধতিতে পরীক্ষা করার পর যে তথ্য উঠে এলো, তাতে সবার চক্ষু চড়কগাছ। কোনো কোনো ছবির বয়স ৩৬,০০০ বছর পর্যন্ত! ধারণা করা হয়, প্রাচীন প্রস্তর যুগের নিয়ান্ডারথাল মানবেরা করেছিল এই অপূর্ব শিল্পের সৃষ্টি। গুহার এই চিত্রগুলোর উদ্দেশ্য নিছক শিল্প ছিল বলে মনে হয় না। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আটপেয়ে একটি শূকর আর সংকর একটি মানুষ বাদে সবই শিকারের পশু। মাংসাশী কোনো জীব বা উদ্ভিদের ছবি নেই। গবেষকরা এ কারণে ধারণা করেন, ছবি আঁকিয়েদের বিশ্বাস ছিল পশুর ছবি আঁকলে তারা আরো বেশি পশু শিকার করতে পারবে। অথবা প্রস্তর মানবের ধর্মবিশ্বাস হয়তো জড়িত ছিল এই গুহার সাথে।
খোলা বন্ধ আলতামিরা
৩৫,০০০ বছর আগে আঁকা আদিম মানুষের অসাধারণ চিত্রকলা দেখবার সাধ আপনার হতেই পারে। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, ফ্রান্স বা মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টও কিন্তু এখানে ঢোকার সুযোগ পাননি! ১৯৭৯ সালে অনেক গবেষণার পর বন্ধ করা হয় আলতামিরা। প্রতিদিন ৩,০০০ মানুষের চাপে নষ্টই হতে পারতো এই গুহা! ২০০২ সালে দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ করবার আগে এর পর্যটক সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। কয়েকশো গজ দূরেই তৈরি হয় আলতামিরার রেপ্লিকা।
কিন্তু নকল আলতামিরা দেখতে আগ্রহ পাচ্ছিল না মানুষ। ক্যান্টাব্রিয়ার আয়ও কমছিল দিনে দিনে। শেষে পর্যটক সংখ্যা সীমিত রেখে ২০১৪ সালে আবার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এর দুয়ার। এখন শুধুমাত্র বিজ্ঞানী, বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ আর লটারির জোরে ঢুকতে পারেন কিছু সৌভাগ্যবান দর্শক। সৌভাগ্যবান কেন বলছি? প্রস্তরযুগের এই সিস্টিন চ্যাপেল ঘুরে এসে মুগ্ধ পিকাসো বলেছিলেন- “আলতামিরার পর, শুধু অবক্ষয়ই হয়েছে!”
ফিচার ইমেজ সূত্র: Rotten-Tomatoes