কয়েক বছর আগে ভারতে বসবাসরত একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে বিতর্ক ওঠে। বিশেষত যখন স্থানীয় কয়েকজন মানুষ তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করেন। এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকায়। কিন্তু খুব কম ভারতীয় তাদের সম্পর্কে জানেন। জনসংখ্যায় তারা কমপক্ষে ২০,০০০। কোনো কোনো পরিসংখ্যানে এই সংখ্যা প্রায় ৭০,০০০ পর্যন্ত দেখা যায়। জনগোষ্ঠীটির নাম ‘সিদ্দি’। তারা নিজেদের আফ্রিকার বানতু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করে।
প্রায় বিচ্ছিন্ন এই জনগোষ্ঠীটি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে বেশ কয়েকটি গ্রামে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। এছাড়াও ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও হায়দ্রাবাদ শহরের কিছু কিছু স্থানে তাদের বসবাস রয়েছে (ভারতের বাইরে পাকিস্তানে তাদের একটি বড় জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে)।
বানতু জনগোষ্ঠীর এই সদস্যরা ৭ম শতকে আরব বণিকদের দাস হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন। আরবদের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে পর্তুগিজ ও ব্রিটিশ শাসকরাও বানতুদের দাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে ভারতে নিয়ে আসে। দাস ছাড়াও স্বাধীনভাবে অনেক বানতু বিভিন্ন সময় ভারতে আসেন। পেশায় তারা ব্যবসায়ী ও সৈনিক ছিলেন।
তবে পর্তুগিজদের আগমন ঘটলে বানতুদের স্বাধীনভাবে ভারত আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮-১৯ শতকের মধ্যে যখন দাসপ্রথা রহিত হতে থাকে, তখন আফ্রিকা থেকে আসা এসব বানতু সদস্য বিপদে পড়ে যান। তারা দলে দলে জঙ্গলে পালাতে থাকেন। যারা জঙ্গলে পালাতে পারেননি, তাদের ধরে ধরে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়।
এসব আফ্রিকান দাসরা মূলত ‘হাবশি’ নামে পরিচিত ছিল। তারা আবিসিনিয়া বা বর্তমান ইথিওপিয়া অঞ্চলে বসবাস করতেন। হাবশি কিংবা বানতু না হয়ে তারা ‘সিদ্দি’ নাম ধারণ করার পেছনে ইতিহাসে দুটি কারণ পাওয়া যায়।
প্রথমত, যখন উমাইয়া খেলাফতের সেনাপতি হিসেবে মোহাম্মদ বিন কাসিম ভারত বিজয় করেন, তখন তিনি আফ্রিকার একটি সৈন্যবাহিনী সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সেসব আফ্রিকান সৈন্য ছিল বানতু জনগোষ্ঠীর সদস্য। মোহাম্মদ বিন কাসিম ভারত বিজয় করলে তারা রাজকীয় মর্যাদা লাভ করেন। এ সময় তাদেরকে ‘সাইয়্যেদ’ উপাধি প্রদান করা হয়। আরবিতে সাইয়্যেদ শব্দের অর্থ ‘সম্মানিত’। এই সাইয়্যেদ শব্দ বিবর্তিত হয়ে ‘সাইয়িদ’ ও পরে ‘সিদ্দি’ নামে এসে উপনীত হয়। সেসব সৈন্য ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে বিভিন্ন সময় দাস হিসেবে আসা বানতুরাও তাদের সাথে মিশে যান এবং একটি বড় জনগোষ্ঠীতে পরিণত হন।
আরেকটি ব্যাখা হলো, সিদ্দিরা দাস হিসেবে প্রথম যে আরব বণিকের সাথে জাহাজে চড়ে ভারতে এসেছিলেন, সেই আরব বণিকের নামের সাথে সাইয়্যেদ শব্দটি যুক্ত ছিল। মুনিবের নামানুসারে তারা নিজেদের নাম সাইয়্যেদ রাখে। পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে তাদের নাম সিদ্দি হয়। সময়ের পরিবর্তনে সিদ্দিদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো আফ্রিকান চিহ্ন বিরাজমান নেই। পোশাক-পরিচ্ছেদে তারা আর দশজন ভারতীয় নাগরিকদের মতোই। তবে তাদের চেহারায় এখনো কিছুটা আফ্রিকান পূর্বপুরুষদের ছাপ মেলে। সিদ্দিদের আবাসস্থল ভ্রমণ শেসে বিবিসির সাংবাদিক নীলিমা ভালঙ্গি বলেন,
গভীর আগ্রহ নিয়ে উত্তরা কানাদা জেলার জনশূন্য বন-জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা দিয়ে আমরা চলতে থাকলাম। এই এলাকা হর্নবিল পাখি ও চিতাবাঘের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। ধুলাবালি ও খানাখন্দের ধাক্কায় বার বার সজাগ হয়ে উঠছিলাম। অবশেষে আমরা একটি সবুজ কৃষিভূমিতে গিয়ে পৌঁছলাম। গ্রামটির নাম গাদগেরা। কর্ণাটকের এই গ্রামে বসবাস করে সিদ্দি আদিবাসীদের একটি বড় অংশ।
গ্রামে প্রবেশের পর আমরা দেখতে পেলাম, সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো আফ্রিকান চিহ্ন বর্তমান নেই। সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে আমরা সবকিছু অবলোকন করতে থাকলাম। আমাদের সাথে একজন সিদ্দি গাইড ছিলেন। তিনি পার্শ্ববর্তী কনকানি গ্রামের বাসিন্দা। আমরা দেখলাম, অনেকেই স্থানীয় ভাষায় কথা বলছেন। নারীরা রঙিন শাড়ী পরেন। অধিকাংশ পুরুষ কৃষিকাজ করেন। তাদের মধ্যে ভারতের আর দশটি গ্রামের বাসিন্দাদের থেকে তেমন কোনো পার্থক্য দেখতে পেলাম না। তবে আমরা তাদের কোঁকড়ানো চুল ও চেহারার গঠন পর্যবেক্ষণ করতেও ভুলিনি, যা তাদেরকে দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য অধিবাসীদের থেকে কিছুটা আলাদা করে রাখে, যা হয়তো তাদের আফ্রিকান পরিচয়ের বাহক।
চেহারায় কিছুটা ভিন্নতার ছাপ থাকলেও সিদ্দিরা খুব সুন্দরভাবে ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাষার সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছেন। তারা বর্তমানে ভারতের নাগরিক। তবুও কখনো কখনো ভারত তাদের জন্য অত্যন্ত ভয়ের জায়গা হয়ে ওঠে। যেমন- ২৭ বছর বয়সী জহির উদ্দিন মুহাম্মদ নামের এক সিদ্দি যুবক বলেন,
আমার চেহারার গঠন আলাদা বলে অনেকেই আমার চেহারার দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকান। তারা আমাকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। যদিও আমি তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করার চেষ্টা করি। আমি সবসময় হিন্দিতে কথা বলি এবং তাদের সাথে মজা করি। কিন্তু যখন আমি কোনো প্রতিবেশী শিশুকে বিস্কুট উপহার দিতে চাই, তখন তারা তা গ্রহণ করে না।
সিদ্দিদের বর্তমান বা অতীত যা-ই হোক না কেন, মোঘল আমলে তারা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় ছিল। এ সময় তাদের আবাসভূমিতে বেশ কিছু মোঘল স্থাপত্যও নির্মাণ করা হয়েছিল। বিশেষত ১৫৭৩ সালে নির্মিত ‘সিদি সাইয়্যেদ মসজিদ‘ আমাদের সেই সংবাদই জানান দেয়। যেমনটি বলছিলেন নীলিমা ভালঙ্গি,
আমি এখানে আসার বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকেই সিদ্দিদের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করছিলাম, তখন আমি একটি মসজিদের কথা শুনতে পাই। আমি এই মসজিদের উন্নত নকশা, সূক্ষ্ম অলঙ্কার, পাথরের নয়নাভিরাম দৃশ্যে আমি চমৎকৃত হয়ে গেছি। ১৫৭৩ সালে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। আমি জানতে পেরেছি, আবিসিনিয়ার এক সিদ্দি সাইয়্যেদ এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। আমি মসজিদের সেই সুখস্মৃতি এখনো ভুলতে পারিনি, মনের মধ্যে গেঁথে আছে।
মোঘল আমলে সিদ্দিরা রাজনৈতিকভাবেও বেশ মর্যাদায় আসীন হন। তাদের জন্য ১৫ শতকে মুম্বাই শহরের নিকটে একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। দুর্গে সিদ্দিরা নিজেদের পতাকা বহন করতেন।
সিদ্দিদের এমন সব উজ্জ্বল ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও সারা ভারতে বর্তমানে তারাই বেশ নিষ্পেষিত। অনেকে ভারতের ইতিহাস থেকে তাদের নাম মুছে দিতে চান। অনেকে তাদের ‘ছিটকে পড়া জনগোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান। রাজনীতিবিদ থেকে ইতিহাসবিদ, সবার মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যা একটি বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরির অন্তরায়।
সিদ্দিদের বেশিরভাগ সদস্য কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের সাথে জড়িত। তাদের স্থায়ী কাজের সুযোগ-সুবিধা নেই। দারিদ্র্যের কারণে তারা পড়ালেখাতেও পিছিয়ে পড়েছে। কাজের মধ্যে একটু বিরতি পেলে সেই সময় তাদের খেলাধুলায় মেতে উঠতে দেখা যায়।খেলাধুলায়ও তারা বৈষম্যের শিকার।
১৯৮০ সালে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী মার্গারেট আলভা এখানে একটি ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন করেন। তখন সবার মধ্যে একটি আশার সঞ্চার হয়েছিল। সিদ্দিদের মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। কথা ছিল, প্রতিবছর এ ধরনের একটি আয়োজন এখানে করা হবে। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা বেশিদিন রক্ষিত হয়নি। সিদ্দিরা এখন তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন। তবে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের ভাগ্যোন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। নীলিমা ভালঙ্গি জানান-
যখন আমরা সেখানে ছিলাম, তখন আমরা বেশ কিছু যুবক ও যুবতীকে ফুটবল খেলতে দেখি। তাদের সাথে একজন কোচও ছিলেন। খেলাধুলা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করে সিদ্দি তরুণ সমাজকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘অসকার ফাউন্ডেশন’ এবং ‘স্কিলশেয়ার’ নামের আন্তর্জাতিক সংগঠন। খেলা চলাকালীন খুব লম্বা এক ব্যক্তি হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কাছে আসলেন। যে স্বল্প কয়েকজন সিদ্দি দারিদ্রতার গণ্ডি অতিক্রম করতে পেরেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার নাম জুজি জ্যাকাই হরনোডকার। তিনি খুব ধীরগতিতে এবং বিনয়ের সাথে আমাদের জানালেন, তার এই ক্ষিপ্র গতি আর সুঠাম দেহই ভারতীয় ক্রীড়া সংস্থার ৪০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল। ক্রীড়া সংস্থার বিশেষ সেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটি পরে অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিদ্দি জনগোষ্ঠীর লোকজনকে অনেকটা মাঝপথে বসিয়ে রেখে ১৯৯৩ সালে সেই আয়োজনটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন নিরুপায় হয়ে জুজি একটি সরকারি চাকরি খুঁজে নেন।
বর্তমানে জুজি ১৪ জনের একটি ছোট অ্যাথলেট দল নিয়ে কাজ করছেন। দলের সবাই সিদ্দি। জুজির আশা, ২০২৪ সালের অলিম্পিকে তাদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। তিনি সেই অনুসারে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তার এই আশা পূর্ণ হলে প্রায় তিন দশক পূর্বের অতৃপ্তি ভুলতে পারবেন তিনি। একটি মেডেল সিদ্দিদের মাঝে আবার পুনর্জাগরণ নিয়ে আসতে পারে এমনটিই তার বিশ্বাস। জুজির এই স্বপ্ন পূরণ হোক আমাদেরও সেই প্রত্যাশা।
ফিচার ইমেজ- Neelima Vallangi