প্রকৃতির বিপুল ঐশ্বর্যে ভরপুর আমাদের এই বসুন্ধরা। প্রকৃতির তৈরি এই সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয় না। প্রকৃতির তেমনই এক কীর্তি লুরে ক্যাভার্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক গুহার একটি এই লুরে ক্যাভার্ন। রহস্যে ভরা লুরে ক্যাভার্নে রয়েছে অসংখ্য গুহা। প্রত্যেকটি গুহায় তৈরি হয়েছে প্রকৃতির অসংখ্য নিদর্শন। গুহাগুলো সমতল থেকে প্রায় দেড়শো ফুট উঁচুতে অবস্থিত। প্রকৃতির এক অত্যাশ্চর্য সৃষ্টির মহড়া চলছে যেন এখানকার প্রত্যেকটি গুহায়। গুহার এই নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম পর্যটকদের মনে তাই প্রতিনিয়ত বিস্ময় জাগায়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বছর যেন মূর্ত হয়ে তাদের চোখের সামনে উপস্থিত হয়।
লুরে ক্যাভার্নের ভৌগোলিক অবস্থান
লুরে ক্যাভার্নকে প্রধানত লুরে কেভ হিসেবেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের লুরে শহরের পশ্চিমে সেনানদোহা ভ্যালিতে এই গুহা অবস্থিত। ১৮৭৮ সালে বিশাল আকারের এই গুহাটি আবিষ্কৃত হয়। পরে তা বাণিজ্যিকভাবে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি এই লুরে ক্যাভার্ন।
এই রহস্যময় গুহার দৈর্ঘ্য ২.৪ কি.মি.। এটি ঘুরে দেখতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা। গুহার ভেতরে রয়েছে অসম্ভব সুন্দর সব নিদর্শন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে যুক্ত হয়েছে মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জা। ভার্জিনিয়া স্টেটের ব্লু বিজ শ্রেণীর সিনানডোয়া নদীর উপত্যকায় লুরের গুহাগুলো অবস্থিত। রকি, সিয়েরা নেভাডা, আল্পস, আন্দিজ ও হিমালয় পর্বতশ্রেণী থেকেও ব্লু বিজ পর্বতশ্রেণী অনেক প্রাচীন এই লুরে ক্যাভার্ন। অনন্তকাল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে প্রকৃতি গুহাগুলোর এই অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।
যেভাবে আবিষ্কৃত হলো লুরে ক্যাভার্ন
লুরে ক্যাভার্ন আবিষ্কারের করেন এন্ড্রু ক্যাম্পবেল, তার ১৩ বছর বয়সী ভাতিজা কুইন্ট আর সঙ্গে ছিল তাদের পরিচিত এক ফটোগ্রাফার বেনটন স্টেবিনস। তারা তিনজনই এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। সেনানদোহা ভ্যালির বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চুনাপাথরের উপস্থিতি তাদেরকে আকৃষ্ট করে। ১৮৭৮ সালে ১৩ আগস্ট গুহার কাছাকাছি এক ছোটখাট গর্ত থেতে ঠান্ডা বাতাস বের হয়ে আসছে দেখে গুহার ভেতরে কী আছে, তা দেখার জন্য এই তিনজন উৎসুক হয়ে পড়েন। শুরু হয়ে যায় এই তিনজনের পাহাড়ের গুহা রহস্য অভিযান।
ভুগর্ভস্থ গুহাটি দেখার জন্য ওই গর্ত লক্ষ্য করে তারা কয়েকজনের সহায়তায় খনন শুরু করে দেন। চার ঘণ্টা ধরে গর্ত খোঁড়ার পর তারা একটা সুরঙ্গের খোঁজ পান। কিন্তু এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ছোটখোট গড়নের ক্যাম্পবেল ও কুইন্ট ছাড়া আর কারো পক্ষেই প্রবেশ করা সহজ ছিলো না। ক্যাম্পবেল ও কুইন্ট দড়ির সাহায্যে সুড়ঙ্গ ধরে কিছু দূর নামতেই এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী হলেন। গুহার অপার রহস্য দেখে দুজনই কিছু মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে পড়েন।
যেভাবে গড়ে উঠেছে প্রকৃতির এই সৃষ্টিকর্ম
প্রকৃতির এক অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম লুরে ক্যাভার্ন। গুহার মধ্যে প্রকৃতি যেন তার নিপুণ হাতে মনের মাধুরী মিশিয়ে তার এই নির্মাণকাজ চালিয়ে গেছে। মাটির নিচের পাহাড়ের চুনাপাথর চোয়ানো জল গলে গিয়ে লুরের গুহাগুলোতে এই আশ্চর্য জগত তৈরি হয়েছে। অসংখ্য স্টেলেকটাইট ও স্টেলেগমাইটের সাহায্যে এই অসামান্য গুহাগুলো তৈরি।
স্টেলেকটাইট দানাবাঁধা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। হাজার হাজার বছরের বিন্দু বিন্দু জল ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ এর সাথে যুক্ত হয়ে তৈরি করেছে জমাটবদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বনেট। এই জমাটবদ্ধ ক্যালসিয়াম কার্বনেট গুহার ছাদ থেকে নানা আকারে নিচের দিকে নেমে এসেছে। তার শেষ প্রান্ত দণ্ড বা শলাকার মতো। স্টেলেগমাইট আর একধরনের দানাবাঁধা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যা গুহার মেঝে থেকে উপরের দিকে বেড়ে ওঠে। স্টেলেগমাইট স্টেলেকটাইটের মতোই সৃষ্টি হয়েছে গুহার ছাদ থেকে চোয়ানো খনিজ বস্তু সমৃদ্ধ বিন্দু বিন্দু জল থেকে।
অনেক গবেষকের মতে, এর প্রতি কিউবিক ইঞ্চি তৈরি হতে পানির ধারার ওপর নির্ভর করে ১২০-৩০০ বছর পর্যন্ত সময় লেগেছে। প্রথমটি নিচের দিকে নামে এবং দ্বিতীয় উপরের দিকে বেড়ে ওঠে। এ দুটি পরস্পর মিলিত হয়ে অদ্ভুত আকৃতির স্তম্ভগুলো গঠিত হয়েছে। মনে হতে পারে, কারা যেন অপূর্ব কারুকাজ করা অনেকগুলো থাম প্রাচীন কোনো স্থাপনার থামের মতো গুহার গহ্বরে সাজিয়ে রেখেছে।
প্রকৃতির এক আশ্চর্য বিস্ময়
প্রকৃতির এই বিস্ময়কর জগত স্বচক্ষে না দেখলে এর সৌন্দর্য অনুধাবন করা সত্যিই কঠিন। গুহায় যে কত ধরনের স্ট্যালেগমাইট আর স্ট্যালেকটাইট মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। গুহার কোথাও ছাদের কার্নিশ থেকে তোয়ালের আকারে পাতলা পাথর থরে থরে ঝুলে আছে, কোথাও বা তা ঝালরের মতো উপর থেকে ঝোলানো। এগুলো বিভিন্ন বিচিত্র রঙে রঞ্জিত। এছাড়া গুহার বিভিন্ন জায়গায় স্ট্যালেকটাইট ও স্ট্যালেগমাইটের বিশাল বিশাল পাথরও রয়েছে।
গুহার এক জায়গায় চুঁইয়ে পড়া পানি জমা হয়ে একটি প্রাকৃতিক সরোবরের প্রতিকৃতি তৈরি করেছে। এর কাছাকাছি গেলে স্ট্যালেকটাইট এবং স্ট্যালেগমাইটের এক স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি তৈরি করে, যা কাচের প্রতিফলনের চেয়েও অনেকটা বাস্তব বলে মনে হয়। গুহার কোনো কোনো মেঝেতে চোয়ানো জল জমে রয়েছে এবং তাতে ছায়া পড়ে গুহার নকশাকাটা পাথরের রঙিন আঁকিবুকি দ্বিগুণ সুন্দর হয়ে দেখা দেয়। গুহার চারদিকে রয়েছে রঙিন থাম ও বিচিত্র কারুকার্য করা পাথরের ঝালর।
চুনাপাথরের চোয়ানো জল গলে গিয়ে তৈরি হওয়া আশ্চর্য গুহাগুলো দেখতে সত্যিই বিস্ময় জাগে। যেসব চুনাপাথর গলেনি, সেখানেও এসব পাথরগুলো বিচিত্র আকার ধারণ করে গুহার সৌন্দর্য যেন আরও বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।
এক আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান
লুরের সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকদের ভিড় সবসময় লেগেই থাকে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক প্রকৃতির সাজঘর লুরে ক্যাভার্ন দেখতে ভিড় করেন। দর্শনীর বিনিময়ে দেখতে পাওয়া যায় প্রকৃতির এই অসাধারণ সৃষ্টি। দর্শনীর অধিকাংশ অর্থ ব্যয় করা করা হয় স্থানীয় এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। লোহা মিশ্রিত পাথর থেকে এসেছে লাল রঙ, তামা মেশানো পাথর দিয়েছে সবুজ রঙ। এমনি করে বিচিত্র রঙের পাথরের স্তম্ভ, জোড়া স্তম্ভ, জলপ্রপাতের মতো ঝালরগুচ্ছ, ভৌতিক স্তম্ভ, ভাঁজ করা সাজানো কাপড়চোপড়ের মতো বৈচিত্র্যময় সব সৃষ্টি দর্শকদের নজর কেড়ে নেয়। লুরে ক্যাভার্নের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান উইশিং লেক। সকলে তার মনের ইচ্ছে এখানে এসে জানান দিয়ে যায়।
লুরের গুহাগুলোকে পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদ বললে এতটুকুও ভুল হবে না। ৮০ একর জায়গায়, জমি থেকে ১৬৫ ফুট নিচে নেমে প্রকৃতির এই শোভা উপভোগ করা যায়। সব গুহা যে অত নিচুতে, তা কিন্তু নয়। এই পাতালপুরীতে বৈদ্যুতিক আলোর সুব্যবস্থা রয়েছে। বিদ্যুতের আলোয় গুহাগুলো যেন ঝলমল করছে। সে কারণে গুহার নানা কারুকার্য ও রঙের অফুরন্ত খেলা দেখে ভ্রমণার্থীরা মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
পর্যটকদের গুহার এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে কোনো অসুবিধাই হয় না। গুহার তাপমাত্রাও সৌন্দর্যপিয়াসী দর্শকদের জন্য বেশ অনুকূল। তাই লুরে ক্যাভার্নে প্রকৃতির এই অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম প্রতিনিয়ত দর্শকদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।
ফিচার ইমেজ- downtownluray.com