পর্বতের প্রতি মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা সেই আদিকাল থেকেই। আর পর্বতের চূড়া জয় করার মতো গৌরবের ভাগীদারর হতে মানুষ চেষ্টাও করে আসছে বহুকাল ধরেই। পর্বত আরোহণ চাট্টিখানি কথা নয়, এজন্য প্রয়োজন হয় কঠোর অনুশীলন, প্রশিক্ষণ, মানসিক আর শারীরিক শক্তি। বেকায়দা হলে পর্বত জান কবচ করে নিতে দ্বিধা করে না। এই যেমন যাত্রাপথে হাজারে হাজারে হিন্দুস্তানী বন্দী মারা পড়তো বলে আফগানিস্তানের একটি পর্বতের নামই হয়ে গিয়েছে হিন্দুকুশ বা হিন্দুদের ঘাতক।
যা-ই হোক, চলুন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের সবথেকে দুরূহ কয়েকটি পর্বতচূড়া প্রসঙ্গে। উল্লেখ্য, এই পর্বতগুলোর অধিকাংশই মহামহিম হিমালয় পর্বতমালার অংশ।
অন্নপূর্ণা (নেপাল)
পৃথিবীর প্রথম ৮,০০০ মিটার উঁচু পর্বতশৃঙ্গ হিসেবে ১৯৫০ সালে অন্নপূর্ণা সামিট জয় করে মরিস হেজহর্গের নেতৃত্বে একটি অভিযাত্রী দল। সেই থেকে এ পর্যন্ত ১৯১ জন মানুষ এই পর্বতচূড়া জয় করেছেন। অন্নপূর্ণার উচ্চতা ৮,০৯১ মিটার। বিশ্বের দশম সর্বোচ্চ উঁচু এই পর্বতচূড়া আসলে অন্নপূর্ণা-১ নামে পরিচিত। অন্নপূর্ণা ম্যাসিফের অন্যান্য চূড়াগুলোও ৭,০০০ মিটারের বেশি উঁচু।
অন্নপূর্ণার নামকরণ করা হয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার নামে। তিনি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির যোগানদাতা। দেবী রুষ্ট হলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সব মিলিয়ে যতই মনোহর শোনাক না কেন, অন্নপূর্ণা হচ্ছে বিশ্বের বিপজ্জনকতম পর্বতগুলোর একটি। এ পর্যন্ত ৬১ জন মানুষ এখানে প্রাণ হারিয়েছেন।
২০১৪ সালে এক ভয়ংকর তুষারঝড় ও বরফ ধ্বস নামবার পরে নেপালের ৪৩ জন মানুষ মারা যায়, যা ছিল পর্বতারোহনের ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ঘটনাগুলোর একটি। অন্নপূর্ণা জয় করতে গিয়ে প্রতি তিনজনে একজন মারা গেলেও এটি বিশ্বের জনপ্রিয়তম সামিটগুলোর একটি।
কে২ (চীন/পাকিস্তান)
কারাকোরাম রেঞ্জের সর্বোচ্চ চূড়া কে২ এর উচ্চতা ৮,৬১১ মিটার, অর্থাৎ এভারেস্টের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কে২ কে বিশ্বের কঠিনতম সামিটগুলোর একটি বলে বিবেচনা করা হয়। এ পর্যন্ত যত মানুষ কে২ জয় করতে গিয়েছে তাদের প্রতি চারজনের একজনকে জীবন রেখে আসতে হয়েছে। বিপদজনক এই শৃঙ্গে পা রাখতে গিয়ে এ পর্যন্ত ৭৭ জন মানুষ জীবন খুইয়েছেন। তবে এই চ্যালেঞ্জই কে২ এর প্রতি আগ্রহ সম্ভবত বাড়িয়ে তুলেছে পর্বতারোহীদের মধ্যে। নাহলে প্রায় তিনশত অভিযান কিভাবে পরিচালনা করা সম্ভব! ১৯৫৪ সালে প্রথম কে২ সামিট জয় করেন ইতালীয় নাগরিক আরদিত্তো দেসিও।
মেয়েদের প্রতি বিশেষ বিদ্বেষের জন্য কে২ এর দুর্নাম আছে। পাচঁ জন নারী পর্বতারোহীর একটি দল ১৯৮৬ সালে কে২ সামিট করেন। এর মধ্যে তিনজনই নামবার পথে মারা যান। বাকি ২ জনও কয়েক বছরের মধ্যে অন্য পর্বত অভিযানে মৃত্যুবরণ করেন। শেষমেষ স্পেনের এক পর্বতারোহী ২০০৪ সালে কে২ এর অভিশাপ কাটাতে সমর্থ হন। এখন পর্যন্ত তিনি বহাল তবিয়তে জীবিত আছেন।
কে২ নিয়ে বেশ কয়েকটি সিনেমা বানানো হয়েছে। আজতক শীতকালে কেউ কে২ জয় করতে সমর্থ হয়নি।
নাঙ্গা পর্বত (পাকিস্তান)
৮,১২৬ মিটার উঁচু নাঙ্গা পর্বত উচ্চতার দিক দিয়ে বিশ্বে নবম। হিমালয়ের পশ্চিম প্রান্ত গঠন করেছে এই পর্বত। এর নামের আক্ষরিক অর্থ ‘নগ্ন পর্বত’। তিব্বতীরা একে বিশাল পাহাড় বলে চেনে। নাঙ্গা পর্বত অসংখ্য দুর্ঘটনার সাক্ষী হিসেবে কুখ্যাত।
আশেপাশের পার্বত্য ভূমি থেকে আচমকা খাড়া হয়ে ওঠা নাঙ্গা শৃঙ্গ জয় করা পর্বত অভিযানের দুরূহতম কীর্তিগুলোর একটি। এতে প্রথম সফল হন অস্ট্রিয়ান পর্বতারোহী হেরমান বুহল, ১৯৫৩ সালে। তার আগে ৩১ জনের প্রাণ সংহার করে এই পর্বত। নাঙ্গা জয় করতে গিয়ে গড়ে ২২ শতাংশ অভিযাত্রী মারা গিয়েছেন।
ত্রিশের দশকে জার্মানরা নাঙ্গা জয় করবার বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা চালায়। সবগুলোই ব্যর্থ হয়। ১৯৩৭ সালে এক অভিযানে গোটা অভিযাত্রী দলটাই সাবাড় হয়ে যায়। শেষমেষ জার্মানরা ষাটের দশকে এই শৃঙ্গ জয় করতে সমর্থ হয়। ২০১৩ সালে মৌলবাদীরা বেশ কয়েকজন অভিযাত্রীকে সেখানে হত্যা করে।
হেইনরিখ হারের নামের এক জার্মান অভিযাত্রী এই পর্বত অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণকালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বেঁধে যায়। ব্রিটিশরা গুপ্তচর সন্দেহে হারেরকে বন্দী করে। হারের পালিয়ে তিব্বতে যান, সেখানে বর্তমান দালাই লামার সাথে তার বেশ ভাল পরিচয়ও হয়েছিল। এই কাহিনী নিয়ে সেভেন ইয়ার্স ইন তিব্বত নামের একটি চলচ্চিত্রও বানানো হয়েছে।
বাইন্থা ব্রাক (পাকিস্তান)
কারাকোরাম পর্বত রেঞ্জের অংশ বাইন্থা ব্রাকের উচ্চতা ৭,২৮৫ মিটার। ১৯৭৭ সালে ডগ স্কট ও ক্রিস বেনিংটন এই সামিট জয় করেন। নামবার পথে ডগ স্কটের পা ভাঙে, তুষাড়ঝড়ে গোটা দলটি ভীষণ নাকাল হয়। গ্রানাইট পাথরের অত্যন্ত খাড়া এই পর্বত দ্বিতীয়বার জয় করতে সময় লেগে যায় ২৪ বছর, ব্যর্থ হয় অন্তত ২০টি প্রচেষ্টা। ২০০১ সালের সেই জয়ের পর কেবল আর একবার, ২০১২ সালে বাইন্থা ব্রাকের মাথায় মানুষের পা পড়েছে।
বাইন্থা ব্রাকের নীচের বেস ক্যাম্প আবার ভাল্লুকের উৎপাতের জন্য কুখ্যাত। দুষ্ট কালো ভাল্লুকেরা সেখানে হরদম ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুরঘুর করে খাবার দাবারের আশায়।
কাঞ্চনজঙ্ঘা (ভারত/নেপাল)
কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার। নান্দনিক নাম হলে কী হবে, কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করা অত্যন্ত দুরুহ কাজ। ১৯০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত পঞ্চাশের বেশি মানুষ কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে জান খুইয়েছেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা কিন্তু আসলে কেউ আক্ষরিক অর্থে জয় করেনি।
নেপাল আর সিকিমের অনেক মানুষ এই পর্বতকে পূজা করে। প্রথম এর চূড়ায় পৌঁছায় যে দলটি, তারা সিকিমের রাজাকে কথা দিয়ে এসেছিল যে, কাঞ্চনজঙ্ঘার সর্বোচ্চ চূড়ায় কেউ পা রাখবে না। সেই থেকে এ পর্যন্ত সকল অভিযাত্রী দল এই নিয়মটি মেনে এসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার নীচে বাস করা লেপচারা বিশ্বাস করে, এই পর্বতে ইয়েতি থাকে। অমরত্বের রহস্যও নাকি এর শ্বেতশুভ্র শৃঙ্গের নীচে লুকানো আছে। ১৮৫২ সালের আগপর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাই পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ বলে পরিচিত ছিল।
মানাসলু (নেপাল)
১৯৫৬ সালে জাপানীরা এই পর্বতশৃঙ্গ জয় করে। পৃথিবীত অষ্টম উচ্চতম এই পর্বতের উচ্চতা ৮,১৬৩ মিটার। ব্রিটিশদের কাছে যেমন মাউন্ট এভারেস্ট বিশেষ গৌরবের বস্তু, জাপানীদের কাছে মানাসলু তেমনই। তা যা-ই হোক, মানাসলু জয় করে মোটেও সোজা কথা না। অন্তত আশিজন মানুষ মানাসলুর কোলে জীবন রেখে এসেছেন।
অনেকগুলি হিমবাহ বেষ্টিত মানাসলুর আশেপাশের অঞ্চল ট্রেকিং এর জন্য খুবই জনপ্রিয়। মানাসলুর উপত্যকাতে লাল পান্ডা, তুষার চিতাসহ নানা বিরল প্রাণীর দেখা মেলে, তুষারাবৃত পর্বতে চড়ে বেড়ায় বিশালকায় ইয়াক।
এভারেস্ট (চীন/নেপাল)
সাগরমাথা (স্বর্গের চূঁড়া), চো মো লুং মা (বিশ্ব মাতা), পবিত্র মাতা ওরফে মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার। উচ্চতা নিয়ে অবশ্য চীন ও নেপাল সরকারের মধ্যে কিঞ্চিত মন কষাকষি আছে। বরফ নাকি পাথর, কোনটির উচ্চতাকে সর্বোচ্চ বলে ধরে নিতে হবে সেটা নিয়েও মতভেদ আছে। বরফের হিসেব বাদ দিলে এভারেস্টের উচ্চতা দাঁড়ায় ৮,৮৪৪ মিটার। যা-ই হোক, এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। রাধানাথ শিকদারের কল্যাণে এই মুকুট কপালে জোটে উনিশ শতকে। তবে রাধানাথ শিকদারের বড়কর্তা কর্নেল ওয়াহ নামকরণের সময় স্থানীয় নাম বাদ দিয়ে ব্যবহার করলেন নিজের পূর্বসুরী স্যার জর্জ এভারেস্টের নাম। ব্রিটিশরা যুক্তি দেয়, এভারেস্টের অনেকগুলো স্থানীয় নাম প্রচলিত থাকায় তারা বাধ্য হয়ে নতুন নাম দেয়।
মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার সম্মান পর্বতারোহীদের কাছে পরম প্রার্থিত বস্তু। ৩৭৫ জন এ যাবতকালে মারা পড়েছেন, যার মধ্যে বহু দুর্ভাগার দেহাবশেষ আর উদ্ধারই করা সম্ভব হয়নি। তবে জয়ীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ১৯৫৩ সালে এডমুণ্ড হিলারি আর তেনজিং নোরগের প্রথম আরোহণের পর এ পর্যন্ত চার হাজারের বেশি মানুষ এই বিরল সম্মান কুড়িয়েছেন, যাদের মধ্যে একাধিক বাংলাদেশী নাগরিকও আছেন।
এভারেস্টের বিকট উচ্চতার কারণে ঝুঁকির পরিমাণ অনেক বেশি। চূড়ার আশেপাশে মাঝেমধ্যে বায়ুর গতিবেগ ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটারও ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া আট হাজার মিটারের বেশি উঁচু আর তেরটি পাহাড়ের মতো এভারেস্টও বরফ ধ্বস, তুষারঝড়, শ্বাসকষ্ট বা শীতের প্রকোপে মৃত্যুর সুযোগ করে দিতে কার্পণ্য করে না। আদিবাসী শেরপারা থাকে এর পাদদেশে। এভারেস্টের বাসিন্দাদের জীবনাচার আর ধর্মে এভারেস্টের স্থান অতি উঁচ্চে। তিব্বতী বৌদ্ধধর্মেও এর উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি দেখা মেলে।